সমাজতন্ত্রের সঙ্গে অভিসার - শান্তনু দে ...

৭ নভেম্বর ২০২১ (রবিবার)

কোথায় ভলগা, আর কোথায় আত্রেই!

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কয়েকবছর পরের ঘটনা। আত্রেই নদীপথে শিলাইদহ পতিসর যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ-পুত্র রথীন্দ্রনাথের একটি অভিজ্ঞতা।

পাকা দাড়িওয়ালা এক গ্রামবৃদ্ধ হটাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ‘বাবুমশাই, স্বদেশী ছোঁড়ারা দেশের উন্নতি নিয়ে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দেয় শুধু। আসল কাজের বেলা কারো টিকিটুকু দেখবার জো নেই। হ্যাঁ, লেনিনের মতো একজন লোক দেশে জন্মাত, দেখতেন সব ঠিক হয়ে যেত।’

রথীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘পিতৃস্মৃতি’তে।

‘লেনিন আর নেই!’ এই সংবাদ জনগণের কাছে নেমে এসেছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকার উর্বর সমভূমির প্রতিটি কোণে এবং এশিয়ার সবুজ খেতগুলিতে। একথা সত্যি, কৃষ্ণাঙ্গ ও হলুদ মানুষরা এখনও স্পষ্টভাবে জানেন না লেনিন কে, রাশিয়াই বা কোথায়। সাম্রাজ্যবাদীরা এবিষয়ে তাদের ইচ্ছাকৃতভাবেই অজ্ঞ করে রেখেছে। মানুষকে অজ্ঞ রাখা— পুঁজিবাদের অন্যতম প্রধান অবলম্বন। তারপরেও, ভিয়েতনামের কৃষক থেকে ডহেমি বনভূমির শিকারি পর্যন্ত সকলেই গোপনে জেনে গিয়েছেন যে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে এমন এক জাতি রয়েছে, যারা তাদের শোষকদের উৎখাত করতে সফল হয়েছে। এবং তারা কোনও প্রভু বা গভর্নর জেনারেল ছাড়াই দেশ পরিচালনায় সক্ষম হয়েছে। তাঁরা এও জেনে গিয়েছেন সেই দেশটির নাম রাশিয়া। সেখানে রয়েছেন সব সাহসী মানুষ। আর তাঁদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে সাহসী, তিনিই লেনিন।

রথীন্দ্রনাথ নয়। লিখছেন হো চি মিন।

‘পিতৃস্মৃতি’ প্রকাশের বহুদিন আগে। ভ্লাদিমির লেনিনের প্রয়ানের সাতদিন পরে। সালটা ১৯২৪। প্রাভদা পত্রিকায়। ‘লেনিন এবং উপনিবেশগুলির জনগণ’ শিরোনামে।

তারও বছরচারেক আগের ঘটনা। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ইউরোপের সমাজবাদী গণতন্ত্রী দলগুলির মধ্যে তখন জোর বিতর্ক। সব দলের সামনেই গুরুতর প্রশ্ন: দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে থাকা উচিত, না কি যোগ দেওয়া উচিত লেনিনের তৃতীয় আন্তর্জাতিকে, না কি দরকার অন্য একটি আড়াই আন্তর্জাতিক? ফরাসী সমাজতান্ত্রিক দলেও এই নিয়ে তুমুল বিতর্ক। সেই দলের প্রতিটি সভায় হাজির থাকতেন এক তরুণ ভিয়েতনামি। তখন তাঁকে সবাই চিনতেন নগুয়েন আই কুওক (দেশপ্রেমিক নগুয়েন) বলে। দল, শ্রমিক সংগঠন, সমাজ ও কমিউনিজম সম্পর্কে তাঁর ধারনা ছিল নিতান্তই ভাসাভাসা। তবু খুব মন দিয়ে গরম গরম তর্কবিতর্ক শুনতেন। ভাবতেন ‘কেন এই আলোচনাগুলো এত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে? দ্বিতীয় হোক, আড়াই হোক, বা তৃতীয়— বিপ্লব তো হবেই। তাহলে এত কথা কাটাকাটি কেন? প্রথম আন্তর্জাতিক থেকে কী পাওয়া গেল?’ কিন্তু সেই তরুণ তখন কোনও বিতর্ক চাইতেন না। শুধু জানতে চাইতেন— কোন্ আন্তর্জাতিক উপনিবেশিক দেশগুলির মানুষের পাশে আছে? একদিন সভায় সেই প্রশ্নও করে বসেন। কয়েকজন কমরেড বলেন: ‘দ্বিতীয় নয়, তৃতীয় আন্তর্জাতিক’। আরেকজন কমরেড তাঁকে দেন লা হিউমানিতে প্রকাশিত লেনিনের লেখা ‘থিসিস অন ন্যাশনাল অ্যান্ড কলোনিয়াল কোয়েশ্চনস’। এতকাল চুপ করে বসে থাকা তরুণটিই এবারে মুখ খুললেন। তৃতীয় (কমিউনিস্ট) আন্তর্জাতিকের বিরোধীদের আক্রমণ করলেন সপাটে। পার্টি কংগ্রেসে ভোট দিলেন তৃতীয় আন্তর্জাতিকের পক্ষে।


এই তরুণ আর কেউ নন। হো চি মিন। চাচা হো। ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বহুদিন বাদে তিনি নিজেই অকপটে জানিয়েছেন সেকথা। ১৯৬০, লেনিনের নব্বইতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সোভিয়েত রিভিউ ‘প্রবলেমস অব দি ইস্ট’-এ প্রকাশিত ‘যে পথ আমায় লেনিনবাদের দিকে নিয়ে গিয়েছে’ শিরোনামে লেখা নিবন্ধে।

এমনই ছিল অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব।

স্বাভাবিক। এই গ্রহের প্রথম সর্বহারা রাষ্ট্র। এই প্রথম, পুঁজিবাদের একটি সুনির্দিষ্ট বিকল্প হিসাবে বিশ্ব ইতিহাসের অ্যাজেন্ডায় সমাজতন্ত্র। তারপর থেকে এই বসুন্ধরার মানচিত্রের গায়ে কৃষ্ণচূড়ার মতো নিয়ত ফুটে উঠছে লেনিনের স্বপ্ন। এই বিশ্ব নিয়ত হয়ে চলেছে লেনিন।

অক্টোবর বিপ্লব। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তর। শোষণ-ভিত্তিক সমাজের অবসান। পুঁজি ও মুনাফার স্বার্থে নয়, শোষিত জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্র— সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তার প্রথম বাস্তব প্রতিফলন।

অক্টোবর বিপ্লব। এক নতুন বিশ্বের অগ্রদূত। একটি নতুন যুগের সূচনা।

কেন? এর আগে আঠারো বা উনিশ শতকে অনেক বিপ্লব হয়েছে। কিন্তু তা হয়েছে সামন্ত রাজাদের উৎখাতের লক্ষ্যে। বুর্জোয়া বিপ্লব। যেমন ছিল ফরাসী বিপ্লব। একটি ধ্রুপদী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। তারপরে বিশ শতকে অক্টোবর বিপ্লব। তার আগে প্যারি কমিউন। সর্বহারাদের প্রথম ক্ষমতা দখল ও একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রচেষ্টা। যদিও তা ছিল স্বল্পায়ু। কিন্তু ছিল অক্টোবর বিপ্লবের ছিল পূর্বসূরী। কেন অক্টোবর বিপ্লব নতুন বিশ্বের অগ্রদূত? কারণ, অক্টোবর বিপ্লব পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণে প্রথম মাইলফলক। এই প্রথম একটি বিপ্লব করল শ্রমিক শ্রেণি। এই প্রথম একটি বিপ্লব হলো, যার নেতৃত্ব শ্রমিক শ্রেণি।

কেবল জারের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিল না এই বিপ্লব। এই বিপ্লব ছিল একটি নতুন ধরনের বিপ্লবের আগমন বার্তা: সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, পুঁজিবাদ-বিরোধী এবং চরিত্রের দিক থেকে সমাজতান্ত্রিক। যার ছিল বিশ্বজোড়া তাৎপর্য। লেনিন এবং বলশেভিকরা রাশিয়ার বিপ্লবকে বিশুদ্ধ ‘জাতীয়’ পরিসরে দেখেননি। দেখেছিলেন বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বসূরী হিসাবে।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপার সম্ভাবনাকে দেখায় এই বিপ্লব। এই বিপ্লব দেখায় তার অভাবনীয় সাফল্যকে।

অক্টোবর বিপ্লবের বজ্রনির্ঘোষ। প্রথম ঢেউ ওঠে ইউরোপে। বিপ্লবের পরের বছরই গ্রিসে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা। তিনবছর বাদে ব্রিটেনে। ফ্রান্সে। তার পরের বছর পর্তুগালে। জমি, রুটি আর শান্তি। ইউরোপের অধিকাংশ দেশের শ্রমিকশ্রেণির কাছে ছিল এক তূর্যনিনাদ।

১৯১৯, লেনিনের নেতৃত্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিক। দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা। ওই বছরই মেক্সিকোতে, অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এম এন রায়। পরের বছর, তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। তার পরের বছর চীনে।

পুলিশের সতর্ক চোখ এড়িয়ে চীনের নানা প্রান্ত থেকে বারোজন গোপনে জড়ো হন সাঙহাই শহরে। ১০৮ ওয়াঙঝি রোড়ের বাড়িতে। এখন অবশ্য ৭৬ সিঙজি রোড। তাঁদের মধ্যে একজন হুনান প্রদেশ থেকে আসা বছরআঠাশের এক যুবকও। ভবিষ্যত যাঁকে একডাকে চিনবে মাও নামে। তাঁরা সকলে মিলিত হন পঞ্চাশজনের বেশি সদস্য ও কিছু কমিউনিস্ট গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে। সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দু’জন প্রতিনিধিও। বিপ্লবের প্রস্তুতির জন্য সেসময় সাঙহাই ছিল আদর্শ জায়গা। ‘নব্য শ্রমিকশ্রেণির’ আঁতুড় ঘর। বিদেশী চিন্তা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র। বিদেশীদের জন্য ছাড় থাকায় ছিল তুলনামূলক সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। ওয়ারলর্ড সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল আলগা। দেশের সবচেয়ে জনবহুল শহর। ২০ লক্ষ মানুষের চারভাগের একভাগই শ্রমিক। ৪ মে, ১৯১৯— পিকিংয়ে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনে দেশপ্রেমিক ছাত্রদের গ্রেপ্তারের খবর যখন সাঙহাইয়ে পৌছয়, তখন বস্ত্রশিল্প, ইস্পাতশিল্প থেকে পরিবহন শিল্প— ১,৮০,০০০ শ্রমিক ছাত্রদের সমর্থনে ধর্মঘট করেন। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, দাস ক্যাপিটাল-সহ সমস্ত মার্কসবাদী কাজের প্রথম অনুবাদ এই শহরেই। তেইশে জুলাই, ১৯২১ সাঙহাইয়ের ওই বাড়িতেই শুরু হয় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তিরিশ জুলাই, শেষদিনের ঠিক আগেই বুঝতে পারেন তাঁরা নজরে পড়ে গিয়েছেন। চরবৃত্তি হচ্ছে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সরে পড়েন সকলে। আর তারপরেই ওয়াঙঝি রোড়ের বাড়িতে ঢোকে সিক্রেট এজেন্ট। কয়েকমুহূর্ত পরে পুলিশ। যদিও তল্লাশি শেষে পায়নি রাজনৈতিক সভার শক্তপোক্ত কোনও তথ্য-প্রমান। প্রতিনিধিরা ততক্ষনে গা ঢাকা দিয়েছেন প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে। জিজঙ প্রদেশের জাসিঙ শহরে। সেখানেই নানহু লেকে আটটি রৌপ্য মুদ্রায় ভাড়া করা হয়েছে একটি বোট। অনেকটা কাশ্মীরের ডাল লেকের শিকারার মতো। কংগ্রেসের শেষ অধিবেশেন হয় এই লেকের মাঝেই। এই বোটে। এখনও রয়েছে যার রেপ্লিকা। ‘রেড বোট’ হিসেবে। এখান থেকেই ঘোষণা করা হয় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) গঠনের কথা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে গ্রহন করা হয় পার্টির প্রথম কর্মসূচী।

১৯২১, ওই বছরই ইতালিতে, পার্তিদো কমিউনিস্তা ইতালিয়ানো। সঙ্গত কারণেই পরবর্তীতে এই পার্টির মতাদর্শগত অবস্থান সম্পর্কে কারো ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু, কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না বিশ শতকের ইতিহাসে এর গুরুত্বকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দশকগুলিতে পশ্চিম ইউরোপে বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি ছিল ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি। আন্তোনিও গ্রামসি’র কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৪৭, পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল ২৩ লক্ষ। সাতের দশকেও পার্টির পক্ষে সমর্থনের হার ছিল প্রায় তিনভাগের একভাগ। ১৯৭৬, সমর্থনের হার ছিল ৩৪.৪ শতাংশ। মুসোলিনির জমানার বিরুদ্ধে লড়াই, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পার্টিজান প্রতিরোধ গড়ে তোলায় তার উজ্জ্বল ঐতিহ্য, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জঙ্গীপনা পার্টিকে করেছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির কাছে এক আলোকবর্তিকা।

পাশাপাশি ওই বছরই কেপটাউনে, দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা। আর ভারতে, জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশন। কমিউনিস্টরাই প্রথম তোলেন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি। ১৯২২, ব্রাজিলে। সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ ঘোষণা। পার্টি আন্ডারগ্রাউন্ডে। তিন বছর বাদে কিউবায়। ফিদেলের তখন জন্মই হয়নি। আগস্ট, ১৯২৫। আমেরিকা থেকে মাত্র নব্বই মাইল দূরে একরত্তি দ্বীপরাষ্ট্রে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠা। ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মার্কস-এঙ্গেলসের বন্ধু এবং মার্কসের কন্যা লারার স্বামী পল লাফার্গ আদতে ছিলেন কিউবার সন্তান। সে এক অন্য কথা। যাইহোক, হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র জুলিও আন্তোনিও মেল্লার নেতৃত্বে সেদিন কিউবায় কমিউনিস্ট পার্টির আত্মপ্রকাশ। ১৯৩০, ভিয়েতনামে। ওই বছরই কলম্বিয়াতে, পার্তিদো কমুনিস্তা কলম্বিয়ানোর প্রতিষ্ঠা।

ভোলগার ঢেউ রবিতে। অক্টোবর বিপ্লবের আলোড়ন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে। ফাঁসির আগের দিনগুলিতে লেনিনে ডুবে ছিলেন শহীদ ভগৎ সিং। ২১ জানুয়ারি, ১৯৩০। লেনিনের মৃত্যু বার্ষিকীতে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডরা আদালতে ঢোকেন রক্তলাল স্কার্ফ পরে। বন্দে মাতরম থেকে সরে এসে স্লোগান ইনকিলাব জিন্দাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক। তারপর খোলা আদালতে ভগৎ সিং সোচ্চারে শোনান তৃতীয় আন্তর্জাতিকের কাছে পাঠানো টেলিগ্রাম।

তরুণ ভগৎকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন স্তালিন। সেই আমন্ত্রণ অবশ্য আর তাঁর কাছে পৌছয়নি। সেকারণে ইতিহাসবিদরা বড়জোর অনুমান করতে পারেন যদি তিনি তা পেতেন এবং গ্রহণ করতেন, তাহলে কী ঘটত!

এই সময়ই বিশ্বজুড়ে মহামন্দা। ছুঁতে পারেনি রাশিয়াকে। কোনও কাকতালীয় ঘটনা না। একটি পরিকল্পিত অর্থনীতির ফসল। দু’টি ব্যবস্থার ভিন্নতার অনিবার্য প্রকাশ।

গোটা দুনিয়াতে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগোচ্ছে হিটলার। প্রবল পরাক্রান্ত শক্তি। আটকে দেওয়ার ক্ষমতা কার আছে? কে কোথায় ছিল সেদিন? মস্কোয় স্তালিন। একা সোভিয়েত। আড়াই কোটি রুশ জনগণ, তার লাল ফৌজের জীবনদান।

স্তালিনগ্রাদের লড়াই। ইতিহাসের মহাকাব্য।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ছিল শুধু একটিই সমাজতান্ত্রিক দেশ। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বদলে গেল চেহারা। পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ নিল সমাজতন্ত্রের পথ। তার রেশ ধরে উত্তর ভিয়েতনাম, গণতান্ত্রিক কোরিয়া, শেষে চীনের আকাশে লাল তারা। সবশেষে ১৯৫৯, কিউবার বিপ্লব। গোটাটা মিলিয়ে সমাজতান্ত্রিক শিবির।

একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া।

পৃথিবীর জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ সমাজতন্ত্রের পথ গ্রহণ করে গড়ে তুলছেন নতুন জীবন।

এই গ্রহের যেখানে সূর্যের আলো, সেখানেই লাল পতাকা। আর সেখানেই লেনিন। খেতে কারখানায় হাটে বন্দরে বস্তিতে— যেখানে মানুষ, সেখানেই লাল পতাকা। সেখানেই লেনিন। যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন। এমনকি হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পর্যন্ত উড়েছে লাল পতাকা। ইতিহাস জানে। আর জানেন জুলিয়াস ফুচিক। যিনি ফ্যাসিস্ত কারাগারে মে’দিন পালনের সেই বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।

একথা ঠিক, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র নির্মাণের শেষদিকে ফুটে উঠেছে বেশকিছু ত্রুটিবিচ্যুতি, দুর্বলতা। আবার এও ঠিক, একদিনে ভেঙে পড়েনি মস্কো।

গত দশকের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে রয়েছে দু’টি ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’: একটি অক্টোবরের দিনগুলি, যার বর্ণনা রয়েছে ওই শিরোনামে লেখা জন রীডের বইয়ে, আরেকটি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেস (১৪-২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬)। দু’টি ঘটনাই আচমকা এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছিল ‘আগে’ এবং ‘পরের’ মধ্যে... সহজ করে বললে, অক্টোবর বিপ্লব তৈরি করেছিল একটি বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন, যাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল বিংশতিতম কংগ্রেস। বলেছেন এরিক হবসবম। কী আশ্চর্য, অক্টোবর বিপ্লবের বছরেই এই মার্কসবাদী ইতিহাসবিদের জন্ম।

সেদিন ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ঘোষণা করেছিলেন: ‘ইতিহাসের অবসান।’

জিতেছে পশ্চিমের পুঁজিবাদ। ধনতন্ত্রই ‘সার-সত্য’, শাশ্বত। এর কোনও বিকল্প নেই। সমাজতন্ত্রের অবসান মানে দ্বন্দ্বের অবসান। সংকটের স্থায়ী অবসান। ধনতন্ত্রই হলো সামাজিক বিকাশের শেষ স্তর।

দু’দশক যেতে না যেতেই খসে পড়েছে ‘অ-বিকল্প’ বিশ্ব পুঁজিবাদের বাহারি পলেস্তারা। শতাব্দী প্রাচীন সংস্থা লেম্যান বোল্ড। ওয়ালস্ট্রিটে বেআব্রু পুঁজিবাদ। সংকটের শুরু। লেম্যান পতনের এক দশক। এখনও চলছে।

অন্যদিকে, মার্কস ২০০ অতিক্রম করে এখনও ক্রিজে। এখনও নটআউট। এবং ফুল ফর্মে। ফুকুয়ামা এখন বলছেন বরং সমাজতন্ত্রেরই ফিরে আসা ভালো।

স্বাভাবিক। বিশ্ব পুঁজিবাদের মুখপত্র ইকনমিস্টে শিরোনাম, ‘বিশ্বের শাসকরা: কার্ল মার্কস পড়ুন!’ ২০১৫, মেরিয়াম ওয়েবস্টার অনলাইন অভিধানে সবচেয়ে সন্ধানী শব্দ ‘সমাজতন্ত্র’

রুশ জনগণ এখন ফিরতে চান সোভিয়েত ইউনিয়নে, সমাজতন্ত্রে। গতবছর লেভাদা সেন্টারের জনমত সমীক্ষায় প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই (৭৫ শতাংশ) বলেছেন, দেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে ভালো সময় ছিল সোভিয়েত যুগ’!

জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্তালিন। এবছর লেভাদা সেন্টারের জনমত সমীক্ষায় ৫৬ শতাংশই তাঁদের ‘মহান নেতা’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন স্তালিনকে। পরে লেনিন, পুশকিন। দুমায় কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয় বৃহওম দল।

গত সেপ্টেম্বরে রুশ সংসদের নিম্নকক্ষ দুমার নির্বাচনে তাক লাগিয়ে দেওয়া সাফল্য পেয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। রিগিং, অনলাইন ভোটে ব্যাপক কারচুপি সত্ত্বেও সমর্থনের হার সাড়ে পাঁচ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৮.৯৩ শতাংশ। আসন সংখ্যা পনের থেকে বেড়ে এখন ৫৭। সাইবেরিয়া ও দূর প্রাচ্যের একাধিক প্রদেশে জিতেছেন কমিউনিস্টরা। লেনিনের জন্মস্থান উলিয়ানোভস্কেও জিতেছেন কমিউনিস্টরা।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পরে অনেকেই মনে করেছিলেন এবারে কমিউনিস্ট পার্টি চলে যাবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু, তা হয়নি। বাড়ছে কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয়তা আর প্রভাব। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা এখন ১ লক্ষ ৬২ হাজারের বেশি। রয়েছে ৮১-টি প্রাদেশিক কমিটি। পার্টি শাখার সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি।

এখনও বিপ্লবের দিনে আমাজন থেকে আন্দামান সাজে লাল ঝান্ডায়। আজও দুনিয়ার ‘গ্রামে ও নগরে হাজার লেনিন যুদ্ধ করে। বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন।’ এই শপথে: একদিন ‘প্রতি মাস হবে অক্টোবর, প্রতিদিন প্রত্যেকে লেনিন।’




শেয়ার করুন

উত্তর দিন