পূর্বাভাস ছিলই। আরম্ভের থেকেই ।সেই সাতের দশক প্রায় শুরুতেই। আর তীব্রগতি পেল শীতযুদ্ধেরশেষে। তিন দশক পর , এখন এতোটাই স্পষ্ট যে গত বছর আগস্ট মাসে আইএমএফও প্রথম বার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। নয়া উদারবাদের অস্তিত্ব । শুধু তাই নয়। তাত্বিক ভাবেই নয়াউদারবাদ প্রাত্যহিক ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রের ভুমিকাই বদলে গেছে বাজারের নিরঙ্কুশ আধিপত্য নিশ্চিত করায়।
আসলে শুধু তো তত্ব নয়; পাহাড় প্রমান তথ্য আর পরিসংখ্যানও স্পষ্ট করে দিচ্ছে সমাজ আর অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে । রাষ্ট্রের ভূমিকার এই রূপান্তরে । অর্থনৈতিক বৈষম্য আর তীব্র বেকারির বৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে সমাজের স্থিতিশীলতাকেই ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। ইতিহাসের গতিপ্রকৃতির মধ্যেও এই প্রবনতা স্পষ্ট।শীত যুদ্ধ শেষে যে তীব্র গতিবেগ এসেছিল, গত তিন দশকে এই গতিপথ যে সঙ্কট তৈরী করেছিল , আজ তা চূড়ান্ত বিপর্যয়ের চেহারায় উপস্থিত। শীত যুদ্ধের শেষে যে ঔদ্ধত্যের সোচ্চার উল্লাস শোনা গেছিল ‘পুঁজিবাদই ইতিহাসের শেষ অধ্যায়’ , তা আজ অনেকটাই অন্তর্হিত। ২০০৮ সালের লগ্নি পুঁজির সঙ্কট ব্যাপক আর্থিক বিপর্যয় এবং মন্দার চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছিল , তা সামাল দিতে নয়া উদারবাদের মৌলিক গতিপথের কোনো পরিবর্তনের ধারকাছ দিয়েও গেল না সর্বশক্তিমান কর্পোরেট লগ্নি পুঁজি । ফল যা হবার তাই হোল। আরো তীক্ষ্ণ অর্থনৈতিক বৈষম্য। সঙ্গে বাড়ল কর্মহীনতার প্রবনতাও। ২/৩ বছরেই চূড়ান্ত ধনী বিলিওনিয়ার কর্পোরেটগুল, তাদের ২০০৮ আর্থিক অবস্থা ফিরে পেলেও, তলার দিকের মানুষ –খেটে খাওয়া মানুষ , তাদের রুটি রুজি শুধু যে আগের অবস্থায় ফিরতে পারল না তাই নয়, চূড়ান্ত সঙ্কটের মধ্যেই চলে গেল। আইএমএফ এখন এই নয়াউদারবাদের বিষবৃক্ষের এই ফলগুলোর অস্তত্ব স্বীকার করে নিচ্ছে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/11/IMG_20201117_215955.jpg)
অর্থনীতির বড় ছবিটাই তো শুধু নয়, লগ্নি কর্পোরেট তাড়িত বাজারের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের প্রভাব নাগরিক জীবনে , সামাজিক জীবনে কি হয়েছে তাও কিন্তু এখন স্পষ্ট। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা কর্পোরেটের হাতে তুলে দিয়েছে মহার্ঘ সম্পদ পরিষেবা। এমনকি পরিবেশও। ফলত, স্বাস্থ্যের অধিকার,সরকার পোষিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও জাহান্নামে গেছে। সবই বেসরকারি বীমা কোম্পানি আর বহুজাতিক ওষুধ কম্পানির হাতে। পাশাপাশি , জল-জঙ্গল-জমি নদী পাহাড় সবই মুনাফার গ্রাসে। এখন তাই এই গ্রহের অস্তিত্বই চ্যালেঞ্জের মুখে। অবশ্যই , এই পরিস্থিতি ভাইরাসের বিবর্তনেও প্রভাব ফেলছে। বিজ্ঞান গবেষণা আর প্রযুক্তি নিয়ে উদ্যোগও যেহেতু মুনাফা অনুসারি, ফলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাই ভেঙ্গে পড়বার মুখে। করোনা সংক্রমণের মহামারি সমকালীন পুঁজিবাদের , নয়া উদারবাদের অভিমুখের এই বিপর্যয় পৃথিবীর এই কঙ্কালসার ক্লেদাক্ত ভঙ্গুর চেহারাটাকেই সামনে এনে দিয়েছে। এটাই দুনিয়ায় করোনা সংক্রমণের আবহ এই আবহে মহামারি যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য। হয়েছেও তাই । বিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রগতি সত্বেও , সংকরমণের ব্যাপকতা এবং ব্যাপ্তি , বিংশ শতাব্দীর স্প্যানিশ ফ্লুর পর দেখা যায়নি। আর এর প্রভাবও অসম । অর্থনৈতিক –সামাজিক বৈষম্যের শিকার মানুষ সংক্রমণের প্রধান ভুক্তভোগি।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/11/IMG_20201107_020900.jpg)
নভেম্বর বিপ্লব আর লেনিনের প্রধান শিক্ষা , নির্দিষ্ট পরিস্থির নির্দিষ্ট বিশ্লেষন ছাড়া সদর্থক পরিবর্তন আসে না ,জনমুখি বিকল্পের নির্মানও করা যায় না। আজও তাই এই ভাঙ্গনের কালে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে , রুটি-রুজির উপর উগ্র দক্ষিণপন্থী নয়াউদারবাদী আক্রমন প্রতিহত করে একটি বিকল্প রাস্তা তৈরী করলেই সংবিধান বহির্ভুত স্বৈরাচারি এবং পরিচিতি সত্বার বিভাজনকে প্রতিরোধ করা যাবে। সাম্প্রতিক মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হয়েছে, রুটি-রুজি আক্রান্ত , জাতিবিদ্বেষের শিকার মানুষ ভোট দিয়ে ট্রাম্পকে পরাজিত করেছেন; কিন্তু ট্রাম্পবাদ এখনও সজীব। তাই ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে , স্থিতাবস্থাপন্থি আর প্রগতিশীলদের লড়াই অব্যাহত , নয়াউদারবাদী অভিমুখের পরিবর্তনের জন্য, অর্থনীতি ,সমাজ আর গণতন্ত্রকে পুনপ্রতিষ্ঠিত করবার দাবিতে। বেশীর ভাগ উন্নত পুঁজিবাদ মহামারির সবচেয়ে ব্যাপক শিকার ; জনস্বাস্থ্যে ,রুটি-রুজিতে । মার্কিণ মুলুক ছাড়াও বৃটেন, ফ্রান্স , ইতালি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। উল্টোদিকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা চীন,ভিয়েতনাম, কিউবাতে। টানাপোড়েন চলছে। জি-২০ দেশগুলোর সর্বত্র অর্থনীতি অধোগতি। একমাত্র চীনে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের লক্ষণ স্পষ্ট। এটাও স্পষ্ট অর্থনীতির সঙ্কট ,মন্দা এসবই চাহিদা বিধ্বস্ত হয়ে যাবার ফলশ্রুতি। প্রাথমিকভাবে , এর স্বীকৃতি থাকলেও , নয়াউদারবাদের মূল অভিমুখ বদলায়নি। অতিধনীদের মুনাফা আর সম্পদবৃদ্ধি অব্যাহত;আর অধিকাংশ শ্রমজীবিদের বিপর্যয়ও । তাই লগ্নি পুঁজির তাত্বিকরা উপলব্ধি করছে, লন্ডনের ফাইনান্সিয়াল টাইমস সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলছে ,বাজারের এই নিরঙ্কুশ আধিপত্য চলতে পারে না, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার আর পরিষেবা সুনিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে সক্রিয় ভূমিকায় ফিরিয়ে আনাটা জরুরি। কিন্তু কেউ কি স্বেচ্ছায় বিশেষাধিকার ছেড়ে দেয়? পরিবর্তন বা বিকল্প মানুষের সম্মিলিত সক্রিয় অংশগ্রহনেই তৈরী হয়।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/11/IMG_20201117_215910.jpg)
এ দেশে আক্রমণ আরো তীব্র স্বভাবতই। কারণ , এখানে উগ্রদক্ষিণপন্থা শুধুই লগ্নি পুঁজির চালিকা শক্তি নয় , শক্তিশালী সহযোগী ফ্যাসিস্ট ভাবাদর্শ আর ইস্পাত দৃঢ় সাংগঠনিক নিয়ে আরএসএস। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রনির্মানে নিয়োজিত সামরিক জাতীয়তাবাদ বৈচিত্রের ভারতে , পরিচিতি সত্বার ভিন্নতা বিশেষ করে, হিন্দু-মুসলমান ধর্মিয় পার্থক্যকে বিষিয়ে দিয়ে ঘৃণা আর বিদ্বেষের চাষ করে মেরুকণের আবহাওয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সংহত করা। ডিমনিটাইসেশন আর জিএসটি’র জোড়া ধাক্কা , সামগ্রিক নয়াউদারবাদী হামলাকে আরো তীব্র চেহারায় উপস্থিত করেছে। ২০১৬ সাল ভারতীয় অর্থনীতির অধোগতি অব্যাহত। সবচেয়ে বড় প্রতিফলন কর্মসংস্থানে । কৃষিতে সঙ্কট আরো গভীর হবার পাশাপাশি ছোট অসংগঠিত শিল্পেরও নাভিশ্বাস। করোনার থাবাকে আরো ভয়ঙ্কর করে তোলবার সমস্ত রসদই মজুত ছিল।
আর আরএসএস-বিজেপির নেতৃত্বে চলা কেন্দ্রীয় সরকারের অপরিকল্পিত লকডাউন অধিকাংশ মানুষের জীবনকে করেছে দুর্বিসহ। প্রায় ১৫ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। শুধু তো সংখ্যাই নয়; লক্ষ লক্ষ পরিযায়ি কৃষকের পায়ে হাজার হাজার কিলোমিটার মরিয়া হেঁটে চলা , অভুক্ত , দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুর শিকার হওয়া, সবকিছুই দুঃস্বপ্নের মতো আজও হানা দেয়। এটাও স্পষ্ট, সরকার পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক প্রয়াসের বদলে দানবীয় লকডাউনকে ব্যবহার করেছে একতরফাভাবে উগ্রদক্ষিণপন্থী নীতিগুলিকে রূপায়িত করতে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি , সবচেয়ে ধনী সরকার ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটগুলোর মুনাফা আর সম্পত্তি বেড়েছে রেকর্ড হারে। মূলত, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার জেরে। আর আইনের পরিবর্তন। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার কেড়ে নেওয়া, বেসরকারিকরণ,কৃষিকে সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেট হাতে ন্যস্ত করা। এইসব করতে গিয়ে সংসদীয় রীতিনীতির বিসর্জন আর সংবিধানিক অধিকারগুলোর রক্ষাকবচগুলো সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দেওয়া। তার মধ্যেও চূড়ান্ত দৃষ্টিকটু বিচার ব্যবস্থা , বিশেষ করে সুপ্রীম কোর্টের তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পরা। একইভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং রাজ্যের অধিকারগুলো। নভেম্বর বিপ্লব এবং লেনিন শিখিয়েছে, প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে পর্যুদস্ত করতে খুঁজে নিতে হয় সবচেয়ে দুর্বল গ্রন্থিকে। এই ভাঙ্গনের সময় সবচেয়ে দুর্বল গ্রন্থি ব্যাপকতম শ্রমজীবি মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্কট। এখন সেটা অস্তিত্বের সঙ্কটের চেহারা নিয়েছে। এই মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই তাই বিকল্পের মূল উৎস। অবিজেপি দলগুলো, বিশেষ করে তারা যদি রাজ্য সরকারের পরিচালনায় , তারা যদি এই সঙ্কটকে স্বীকৃতি না দিতে পারে , তাহলে তাদের বিরোধিতা –প্রতিরোধ হবে বালির বাঁধ। পশ্চিমবঙ্গ এখন যেমন পশ্চিবঙ্গেও অবস্থাটা অনেকটা এরকমই। মানুষের অধিকার , জীবন জীবিকার অধিকার , আইনের শাসন , খেয়াল খুশী মতো সংগঠন করবার অধিকার , গণতন্ত্র , স্বাধীনভাবে ভোট প্রয়োগের অধিকার , সবকিছুই ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় আসবার পর থেকে আক্রমনের মুখে। স্বভাবতই আজকে উগ্র দক্ষিণপন্থার এই তীব্র অভিযানের মুখে দাঁড়িয়ে অসহায় তৃণমূল ।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/11/IMG_20201117_220034.jpg)
আসলে যে সমস্ত পদক্ষেপ আরএসএস-বিজেপির তার অনেককিছুই পশ্চিমবঙ্গ, রাজ্য সরকারের হাত ধরে ঘটতে দেখেছে। ২০১১ সালের পরবর্তীতে যে কটা যৌথ সর্বভারতীয় ধর্মঘট হয়েছে , যে হিংস্রতা নিয়ে তার মোকাবিলা করেছে রাজ্য সরকার, তা অনেক ক্ষেত্রেই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোকে ছাপিয়ে গেছে। একই কথা সম্প্রতিতে , যে কৃষি সংক্রান্ত আইনগুলি নিয়ে কৃষক আন্দোলনের সর্বাত্মক বিরুদ্ধতা , সেই বিষয়বস্তু নিয়ে রাজ্যের আইন পাশ হয়েছে ২০১৬ তে। মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি না দিয়ে, সেগুলিকে পদদলিত করলে যা হবার তাই হয়েছে । সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ গতি পেয়েছে , সক্রিয়ভাবে ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিইয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে। এটা বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে, আরএসএসের সাংগঠনিক কাঠামোর বিস্তারে শক্তি যুগিয়েছে। এই আবহে বিকল্পের খোঁজ বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি । সাম্প্রতিক বিহার নির্বাচনে প্রবলতম প্রতিরোধের সম্মুখিন হয়েছে তার প্রধান কারণ , রুটী-রুজির প্রশ্ন , কর্মসংস্থানের নির্বাচনি এজেন্ডা কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হিসাবে উপস্থিত করা গেছে।
পশ্চিমবঙ্গের আজকের আবহে তাই দলবদল আর হিন্দু মুসলমানের পরিচিতি সত্বার সঙ্ঘাতের সোচ্চার উচ্চারন। যেমন শিখিয়েছে নভেম্বর , রুটি-রুজির –অস্তিত্বের ভারকেন্দ্রেই চলবে বিকল্পের খোঁজ ।
শেয়ার করুন