কৃষি আইন ও কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে সিপিআই(এম)- এর নোট
সম্পূর্ণ নোটটি তিনটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে।
পর্ব - ২
কৃষি আইনের প্রস্তাবনা এবং সেই প্রসঙ্গে সরকারের বক্তব্য
নয়া তিন কৃষি আইন প্রধানত তিনটি বিষয় সম্পর্কিত - ১) কৃষিজাত পণ্য বিপণন বিষয়ক ( Promotion and Facilitation Act), ২) চুক্তি ভিত্তিক কৃষিকাজ বিষয়ক ( Agreement on Price Assurance and Farm Services Act) এবং ৩) খাদ্যপণ্যের মজুত বিষয়ক ( Essential Commodities Act)
তিনটি আইন সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করা হল:
১) কৃষিজাত পণ্য বিপণন বিষয়ক আইন ( Promotion and Facilitation Act) : এই আইনে কর্পোরেটদের জন্য দেশে কৃষিজাত পণ্যের বাজার সম্পূর্ণ খুলে দেবার আড়ালে আসলে জনস্বার্থে খাদ্য শস্য এবং সংশ্লিষ্ট সুরক্ষার ক্ষেত্রে সরকার নিজেকে দায়মুক্ত করতে চায়। কৃষি বিপণন (agricultural marketing) সংক্রান্ত আইনের সাহায্যে সরকার বেসরকারি মালিকানার হাতে তুলে দিয়ে বাজারকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে চাইছে। এর ফলে যে কেউ কৃষকদের থেকে খোলা বাজারে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য ব্যতীত শস্য কিনে নেবার অধিকার পাবে। এধরনের বেসরকারি খোলা বাজারের উপরে রাজ্য সরকার কোনো কর কিংবা লেভি ধার্য করতে পারবে না। অথচ সরকারি নিয়ন্ত্রণের কৃষি মান্ডি গুলিতে আগের ব্যবস্থা চালু রাখা হবে - ফলে বোঝাই যাচ্ছে এই অবস্থার ফলে সরকারি বন্দোবস্ত ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকবে এবং একসময় একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে।
বিহারে ২০০৬ সালে এপিএমসি (APMC s) গুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার ফলাফল কেমন ছিল? বিহারের কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফসল বেসরকারি মালিকের হাতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ধানের বিক্রয়মূল্য হয়ে দাঁড়ায় ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের তিন ভাগের এক ভাগ থেকেও কম। ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রদেশে নয়া কৃষি আইনের সুবাদে বহু কৃষক বেসরকারি মালিকানায় ফসল বিক্রি করে প্রতারিত, সর্বসান্ত হয়েছেন (চেক বাউন্স, টাকা আদায়ে ব্যর্থতা, চুক্তি সত্বেও সম্পূর্ণ টাকা উদ্ধার না করতে পারা) - কোনো ক্ষেত্রেই সুরাহা করা যায় নি।
এখন কেন্দ্রীয় সরকার পরামর্শ দেবার কায়দায় বলছে রাজ্য সরকার চাইলে নিজেদের রাজ্যে বেসরকারি কৃষি বানিজ্য সংস্থাগুলিকে রেজিস্টার করে রাখতে পারে এবং মনে করলে তাদের থেকে বানিজ্যে ফি আদায় করতে পারে। এই প্রস্তাব ২০১৭ সালের মডেল এক্ট - এ উল্লেখ করাই ছিল। তাহলে পুনরায় কেন্দ্রীয় স্তরে নয়া কৃষি আইনের প্রয়োজন হল কেন?
কৃষকদের দুশ্চিন্তার প্রধান বিষয় হল নয়া আইনের বলে বেসরকারি মালিকেরা ফসলের বাজার কব্জা করে নেবে। এছাড়াও ন্যুনতম সহায়োক মূল্যের সুবিধা না থাকায় কৃষকেরা বেসরকারি মালিকদের বদান্যতায় বেঁচে থাকতে বাধ্য হবে।
আমাদের দেশের বুকে এখনও অবধি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন ফসলের বাজার (APMC) রয়েছে প্রায় ২৪৭৭ টি। এগুলি ছাড়াও সারা দেশে নির্দিষ্ট জায়গায় আধা সরকারি নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৪৮৪৩ টি ছোট বাজার রয়েছে। স্বামিনাথন কমিশনের সুপারিশ ছিল সরকারি ব্যবস্থাপনায় সারা দেশে প্রতি ৮০ বর্গ কিলোমিটার ব্যবধানে আরো অনেক বাজারের বন্দোবস্ত করতে হবে, বর্তমানে প্রতি ৫০০ বর্গ কিলোমিটার ব্যবধানে (গড় হিসাবে) এই সুবিধার সুযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই সুপারিশ অনুযায়ী জরুরী সংস্কার মেনে নেওয়া হলে তাতে সত্যিই কৃষকদের লাভ হত। কিন্তু সরকার নতুন কোনো বাজারের বন্দোবস্ত করতে অস্বীকার করেছে, উল্টে পুরানো অবস্থায় প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার আরো কাটছাঁট করছে।
২) চুক্তি ভিত্তিক কৃষিকাজ বিষয়ক আইন ( Agreement on Price Assurance and Farm Services Act) : এই আইনের ফলে চুক্তির জোরে কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট দখলদারির রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে কৃষি বাজারের গোটা ব্যাবস্থাই সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। বড়ো বড়ো কৃষি বিপণন সংস্থাগুলি কৃষকদের ঘাড়ে চেপে বসবে এবং কৃষকদের স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন অস্পষ্টতা ও জটিলতায় ভরা চুক্তির ভিত্তিতে উৎপাদিত ফসল হস্তান্তর করতে বাধ্য করবে। এই আইনে এমন কোনো স্পষ্ট বার্তা নেই যাতে বলা যায় কৃষকেরা উৎপাদিত ফসল বেচে ন্যায্য দাম এবং চুক্তির ভিত্তিতে কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক পাবেন। চুক্তির ভাষ্যে যা ব্যাখ্যা করা হয়েছে তার চরিত্র অস্পষ্ট এবং দ্বৈত অর্থবহ। এইসব চুক্তির বলে কৃষকদের শোষণ করা যাবেনা বলেও কোনো নিশ্চয়তার উল্লেখ করা হয় নি।
কৃষিজাত পণ্য বিপণন এবং চুক্তি ভিত্তিক কৃষিকাজ বিষয়ক আইন দুটিতেই এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় আইনে কৃষক এবং উৎপাদিত ফসলের ক্রেতা হিসাবে বেসরকারি সংস্থার মধ্যেকার সম্ভাব্য জটিলতা দূরীকরণে কোনো সমাধানসূত্র নেই। এর ফলে চুক্তি ভিত্তিক চাষের ক্ষেত্রে কৃষকরা দুর্বল অবস্থানে রয়েছেন এবং উল্টোদিকে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার হাতে প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রয়োজন হলে নির্বাচিত স্থানীয় সংসদ, গ্রামসভা কিংবা কৃষক সংগঠন গুলি কোনরকম জটিল অবস্থাতেই কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে পারবে না। এমনকি চুক্তির জটিলতা দূর করতে কৃষকদের কোর্টের দ্বারস্থ হবার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত রাখার প্রস্তাবনা রয়েছে এই আইনে।
এই প্রসঙ্গে বলা যায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো জটিল অবস্থার সমাধানে কৃষকদের কোর্টের দ্বারস্থ হবার সুযোগটুকু আইনে অন্তর্ভুক্ত করাই যেত। সেই সুযোগ তো দূর, বেসরকারি বিপণন সংস্থার সাথে কৃষকদের চুক্তির মধ্যে সরকার নিজেকে কৃষকদের পক্ষে নিশ্চয়তা জ্ঞাপক (Guarantor) হিসাবেও রাখতে চায় না। পাঞ্জাবে বহুজাতিক সংস্থার সাথে চুক্তির ভিত্তিতে আলু চাষের অভিজ্ঞতা ভয়ানক, কৃষকেরা সরাসরি শোষণের শিকার হয়েছিলেন। চুক্তির খেলাপ করা হলে হিমাচল প্রদেশের একজন আপেল চাষীর পক্ষে আদানি ফ্রেশ কোম্পানির বিরুদ্ধে কোর্টে এক দীর্ঘ আইনি লড়াই করা আদৌ সম্ভব হবে? কৃষি আইনে সংস্কারের নামে আসলে সরকার কৃষকদের সুরক্ষায় নিজের দায় ঝেড়ে ফেলতে চায়। কৃষকরা তখনই সুরক্ষিত থাকবেন যদি সরকার নিজেকে কৃষকদের পক্ষে নিশ্চয়তা জ্ঞাপক (Guarentor) হিসাবে ঘোষনা করে।
৩) খাদ্যপণ্যের মজুত বিষয়ক আইন ( Essential Commodities Act): এই আইনের বলে কার্যত অবৈধ হোর্ডিং / মজুত কে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যেই খাদ্য মজুত করার উর্ধ্ব সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হল। এই সুযোগে খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াকরণের ব্যবসাদার সংস্থাগুলি নিজেদের মজুত বাড়িয়ে বাজারে মেকি অভাব তৈরি করবে এবং দাম বাড়িয়ে নেবে। খাদ্যপণ্যের দামে এমন অস্থিরতার ফলে জনগণের খাদ্য সুরক্ষা সংকটে পড়বে। সম্প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় জমি এবং খুবই সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের সাহায্যে আদানি গোষ্ঠী অতি দ্রুতগতিতে নিজেদের কোল্ড স্টোরেজ এবং সাইলো মেশিন ইত্যাদির সংখ্যা অনেকটাই বাড়িয়েছে, এই ঘটনা আকস্মিক নয়। বরং বোঝাই যাচ্ছে এসবই হচ্ছে সরকারি নীতির ব্যাপারে এক গভীর আলোচনার ভিত্তিতে। কিছুদিন আগেই হরিয়ানায় কৃষি জমি ব্যবহার সংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন করা হয়েছে যাতে পানিপত জেলায় আদানি গোষ্ঠী ১৫০ একর কৃষি জমি অতি স্বল্প মূল্যে কৃষকদের থেকে কিনে নিয়ে সেখানে সাইলো স্থাপন করতে পারে। এই আইনের ব্যাপারে কৃষকদের বিরোধিতায় সেজন্যেই সরকারের কোনো পরামর্শ নেই, কোনো বক্তব্য নেই।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে নোটের অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ