Stalin

কমরেড জে ভি স্তালিনঃ ইস্পাতসম অঙ্গীকারের ইতিহাস

৫ মার্চ, ২০২৪

কমরেড জে ভি স্তালিনের ৭১-তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ওয়েবডেস্কের প্রতিবেদন

লেনিন তখনও জীবিত, ককেশাসের সৈকতে একটি শহর - কিসলোভদস্ক। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। তৎকালীন সোভিয়েত পার্টির কয়েকজন অন্যতম নেতৃত্ব এই শহরের একটি গুহায় গোপন সভার আয়োজন করেছিলেন। এরা কারা? জিনোভিয়েভ, বুখারিন, এওদকিমভ এবং লাসেভিচ। এই সভার গোপনীয়তার কারন কি ছিল? পার্টির ভিতরে কমরেড স্তালিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা, সেই জালে আরও অন্যদের টেনে এনে যুক্ত করা। কমরেডদের থেকে স্তালিনের কাছে এই গোপন সভার খবর পৌঁছে যায়! সভা চলাকালীন স্তালিনের বার্তা এসে পৌঁছায় - " Why are you fooling about boys, I'll be with you soon and talk then "...

তিনি কমরেড স্তালিন। জে ভি স্তালিন। সাধারণত কমিউনিস্ট পার্টিতে মৃত্যুদিন পালন করা হয় না, কিন্তু অন্যদের তুলনায় এই ক্ষেত্রেও কমরেড স্তালিন অনন্য। জাতি সমস্যা সম্পর্কে তার জানা-বোঝা-চর্চা এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি প্রসঙ্গে বিভিন্ন কুযুক্তির বিরুদ্ধে তার লেখা প্রবন্ধ পড়ে লেনিন তার সম্পর্কে বলেছিলেন "রিপোর্ট কি করে লিখতে হয় অন্য কমরেডদের কোবা-কে দেখে শেখা উচিত"। কোবা নামেই তাকে সম্বোধন করতেন লেনিন। ১৯১৮ সালে জার্মানির সাথে অনাক্রমন বিষয়ক ব্রেটলিতোভস্ক চুক্তির দায়িত্ব দেওয়া হয় ত্রৎস্কিকে। চুক্তির ব্যাপারে একটি সুক্ষ এবং জরুরী বিষয়ে লেনিনের পরামর্শ চেয়ে ১২ই ফেব্রুয়ারি টেলিগ্রাম পাঠান ত্রৎস্কি, লেনিন তার উত্তরে টেলিগ্রামে বার্তা দেন " এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাকে স্তালিনের সাথে পরামর্শ করতে হবে"।

রাশিয়ায় বিপ্লব সফল হবার পরের কয়েকবছর একের পর এক প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত হয়, দেশের ভিতর এবং বাইরে দুদিক থেকেই। সেই সময় সোভিয়েত ফৌজের দায়িত্বে ছিলেন ত্রৎস্কি। পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল এবং সংকটজনক হয়ে উঠছিল। এই সময়েই বাড়তি দায়িত্ব দিয়ে স্তালিনকে যুদ্ধরত ফ্রন্টে পাঠান লেনিন। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ডন এবং জরিস্তিন এলাকায় খাদ্য সরবরাহ লাইনসহ বিপ্লবী নিয়ন্ত্রণকে রক্ষা করার। কিছুদিন পরেই লেনিনের কাছে টেলিগ্রাম আসে - "কমরেড লেনিন, আপনি সুনিশ্চিত থাকুন যাদের চোখ রাঙানোর প্রয়োজনতাদের আমি তাই-ই করছি। কাউকেই রেহাই দেওয়া হচ্ছেনা। আমাকেও নয়। আমাদের সামরিক বিশেষজ্ঞগণ (যাদের মাথামোটা) যদি অলস না হতেন বা ঘুমিয়ে না থাকতেন, তবে আমাদের লাইন ভেঙ্গে ফেলা যেত না। আমরা যদি তা পুনরুদ্ধার করতে পারি তাহলে তা তাঁদের জন্য (সামরিক অফিসারদের জন্য) হবে না, বরঞ্চ তারা থাকা সত্বেও তা হবে"।

স্তালিন এমনই ছিলেন। সমস্যার একেবারের গোড়ায় পৌঁছে তাকে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা এবং সমাধান না হওয়া অবধি সেই কাজে একনিষ্ঠ থাকা। তার এহেন গুণাবলী কাউকে বিরক্ত করেছে, কাউকে ভয় পাইয়েছে আবার কেউ স্তালিনের কাজে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সুষমার অভাব অনুভব করে পাতার পরে পাতা লিখেছেন - এবং পুরস্কৃত হয়েছেন। আর এরা যখন এই সব কাজে নিজেদের ব্যাস্ত রেখেছিলেন সেই গোটা যুগ ধরে কমরেড স্তালিন ব্যাস্ত ছিলেন সোভিয়েত রাষ্ট্র, শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রকে রক্ষায়। লেখিকা আনা ল্যুইস স্ট্রং এই কারনেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত রাশিয়ার ইতিহাসকে স্তালিন যুগ নাম দিয়েছেন। আক্রমন ধেয়ে এসেছে কখনো শত্রুর চেহারায় সামনে থেকে, আবার কখনো পার্টির ভিতর থেকে একবার বিপ্লবী বুলি আরেকবার মহান গণতান্ত্রিক সুযোগসুবিধার মুখোশ পরে। দুই ক্ষেত্রেই তিনি সমস্যার সমাধানে সফল হয়েছিলেন। ১৯১৮ সালে লাল ফৌজ গড়ে তুলে কসাকদের, সামরিক অফিসারদের এবং শ্বেতরক্ষীদের যৌথ সন্ত্রাস যাকে ইতিহাসে শ্বেত সন্ত্রাস বলে তার মোকাবিলায় লাল ফৌজকে নির্দেশ দিয়েছিলেন জনগণের শত্রুদের সন্ত্রস্থ করতে শ্বেত সন্ত্রাসের জবাবে লাল সন্ত্রাস গড়ে তুলতে হবে, বিপ্লবকে রক্ষা করতে হবে। একই মনোভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটালারের বাহিনী যখন সোভিয়েতকে আক্রমন করে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মোকাবিলায় তার আহ্বান ছিল জনযুদ্ধের - নির্দেশ দেন "There is no land beyond Volga"। জনগণের নেতা ছিলেন বলেই সেদিন তার আহ্বানে গোটা দেশের সাধারণ মানুষ হাতের কাছে থাকা শেষ সম্বলটুকু নিয়েই নাৎসি সেনাবাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল - ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়েছিল, জনযুদ্ধ এবং সেইসাথে গোটা পৃথিবীতে মানবতা জিতেছিল।

কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যাক্তিমাহাত্মের প্রচার চলে না, এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য একইসাথে সেই ধরণের ঝোঁকেরও বিরোধিতা করা। একটা সময় সোভিয়েত পার্টিতে কমরেড স্তালিনের নামে "স্লাভা" উচ্চারণ করে অনেক কিছু করা হয়েছে - তার দায় পড়েছে স্তালিনের উপরে। তিনি নিজে এব্যাপারে অজ্ঞ ছিলেন না; " এমন নির্বোধ সুবিধাবাদীরা শত্রুদের থেকেও বেশি ক্ষতি করে পার্টির" - এই ছিল তার প্রতিক্রিয়া।

আজ স্তালিনের মৃত্যুদিন। গোটা একটা যুগ তিনি পৃথিবীতে শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রের দায়িত্ব সামলেছেন, তাকে রক্ষা করেছেন। সমাজতান্ত্রিক নির্মান বলে আজকের পৃথিবীতে যা কিছু আমাদের গর্বের বিষয়, সেইসবকিছুর শুরু তার হাতেই। সেই দুটি হাত ইস্পাত ছিল - তাতে কারোর কাঠিন্যের অভিযোগ থাকতেই পারে, কিন্তু মরচে এতটুকুও ছিল না। বিপ্লবী বুলির আড়ালে যারা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার রাস্তা খুঁজে নিতে চান তাদের জন্য স্তালিনের নামের ভয় দীর্ঘজীবী হোক। তিনি নিজেই কুচক্রিদের জবাব দিয়ে গেছেন - "একথা ভুললে চলবে না যে দক্ষিণপন্থী ও অতি বামপন্থীরা হচ্ছেন প্রকৃতপক্ষে যমজ। এবং উভয়েই সুবিধাবাদী পথ গ্রহন করেন। কিন্তু উভয়ের মধ্যে তফাত হচ্ছে এই যে, দক্ষিণপন্থীরা সর্বদা তাঁদের সুবিধাবাদকে লুকিয়ে রাখেন না। কিন্তু, অতি বামপন্থীরা অপরিহার্যভাবেই তাঁদের সুবিধাবাদকে লুকিয়ে রাখেন বিপ্লবী কথার আড়ালে"।

কমরেড স্তালিনের নামে অপবাদ, মিথ্যা অভিযোগ, কুৎসা ইতিহাসের একটা বিশেষ পর্বে শুরু হয়, আজও সেই ধারা বিভিন্ন কায়দায় বয়ে চলেছে। এসবের উদ্দেশ্য একটাই যাতে জনগণের ঐক্যকে ভেঙ্গে দেওয়া যায়, মুল সমস্যা থেকে চোখ ঘুরিয়ে দিয়ে চলতি শোষণের ব্যাবস্থাকেই কায়েম রাখা যায়। নিকিতা ক্রশ্চেভের ষড়যন্ত্রে যে অসভ্যতার শুরু তাকে মাও সে তুং-এর কথা দিয়েই শেষ করা যায় - "The opportunists in the history of the international communist movement were unable to negate Marx, Engels or Lenin by vilification, nor is Khrushchov able to negate Stalin by vilification."

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন