হুল দিবসঃ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

আজ হুল দিবস।

১৮৫৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে থাকা ভারতবর্ষে সাঁওতালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। প্রথম দিকে বিদেশি শাসকদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রাজি থাকলেও পরে জল, জঙ্গল এবং জমি থেকে তাদের সরিয়ে ফেলার সাম্রাজ্যবাদী লুঠের রাজনীতি ধরে ফেলে তারা - শুরু হয় সর্বাত্মক বিদ্রোহ। ভূমিজ কুড়মী, কোড়া, মুন্ডা, মাহালি, খেড়িয়া, কামার, কুমোর, তাঁতী সবাইকে নিজেদের লড়াইতে সামিল করেছিল এই সংগ্রাম।

বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল একদিকে হারানো জমির পুনর্দখল আর অন্যদিকে অত্যাচারি বিদেশি লুঠেরা এবং এদেশে তাদের দালালদের খতম করা। সুদখোর-মহাজন, জমিদার, খাজনা আদায়কারীরা, রেল ব্যবস্থা এবং নীলকুঠিগুলীর উপরে হামলা চালানো হয়েছিল।

তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত সাঁওতাল পরগণা, বরাভূম, মানভূম, বীরভূম সহ এক বিস্তীর্ণ এলাকায় এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের বিস্তৃতি হয়েছিল। আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল বর্তমানে ঝাড়খন্ড জেলার ভগ্নাডিহি গ্রামে জন্ম হওয়া চারজনের হাতে, সিধু, কানহু দুই ভাই এবং চাঁদ ও ভৈরব।

Hul Divas 3

জীবনযাপনের সহজ-সরল ছন্দ ভেঙ্গে কেন আদিবাসিরা এভাবে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হল তার উত্তর পেতে হলে সেই সময়ে ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোকে বুঝতে হবে। এদেশে উপনিবেশ স্থাপন করার পরে ব্রিটিশ শাসক এক অভিন্ন কর ব্যাবস্থার প্রনয়ন করেন এবং নতুন ভূমি রাজস্ব প্রথার সুত্রপাত্র হয়। ব্রিটিশ শাসন এবং এদেশে তাদের তৈরি করা সাম্রাজ্যবাদের দালাল জমিদার ও মহাজনেরা মিলে এক দ্বিস্তরীয় শোষণমূলক ব্যবস্থার পত্তন করেছিল যার কবলে পড়েন সারা দেশের কৃষক, কুটিরশিল্পী। এক কথায় বলা যায় পরম্পরাগত ভারতীয় অর্থনৈতিক কাঠামোকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। শোষণ-নিপীড়নের ফলে এদেশের আদিবাসিরাও তাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা জমি-জঙ্গলের থেকে বিতাড়িত হয়। এদের পরিণত করা হয় মূলত দাস শ্রমিকে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইন এনে আদিবাসি সহ ভারতের কৃষিব্যবস্থাকেই আমুল পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। এদেশের মানুষেরা পরিণত হলেন একদিকে ব্রিটিশ উপনিবেশের দাস আবার অন্যদিকে নব্য প্রতিষ্ঠিত জমিদার, মহাজনদের জন্য বেগার খাটার যন্ত্র বিশেষ। তাদের উপরে অর্থনৈতিক শোষণ চাপিয়ে দেবার পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যকেও চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসি মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমছিল বহুদিন ধরেই, সেই পুঞ্জিভূত ক্ষোভেরই সংগঠিত বহিঃপ্রকাশ এই সাঁওতাল-হুল মহাবিদ্রোহ। ১৮৫৫ সালের ১৫ই অগাস্ট ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তরফে বিদ্রোহীদের ১০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশ অমান্য করেই লড়াইয়ের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী প্রায় ছয় হাজার বিদ্রোহীকে গুলি করে হত্যা করেছিল, সেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লয়েড। সংঘর্ষ চলাকালীন হত্যা করা হয়েছিল সিধু, চাঁদ ও ভৈরবকে। কানহুকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়।

আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র কামান-বন্দুকের সামনে হাতে তীর-ধনুক নিয়ে আদিবাসীদের এই সংগ্রাম, এই মরনপণ যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইতে অবিস্মরণীয়।

হুল দিবস উদযাপন মানে সামিয়ানা খাটিয়ে, ঢোল-তাসা বাজিয়ে, গান গেয়ে উৎসব পালন কখনো নয়। হুল দিবসের তাৎপর্য নিহিত রয়েছে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার ফেরানোর লড়াইতে। প্রান্তিক মানুষের জীবন বাজি রেখে লড়াই-সংগ্রামের যে ঐতিহ্য সাঁওতাল-হুল মহাবিদ্রোহ রেখে গেছে তাকে উত্তরাধিকার হিসাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

আজকের ভারতে লুঠেরা পুঁজির স্বার্থে যেভাবে আবার একবার জল-জমি-পরিবেশকে বেনিয়াদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। হুল দিবসকে এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই আমাদের মনে রাখতে হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন