নয়া উদার মহামারি

২৬ মার্চ, ২০২০

সংক্রমণ সীমান্ত মানে না। শ্রেণি মানে না।
উনিশ শতকে কলেরার মহামারি এতটাই নাটকীয় মাত্রায় প্রাচীর ভেঙেছিল যে, জন্ম নিয়েছিল সরকারি নিকাশী ও স্বাস্থ্য আন্দোলনের। যে আন্দোলন এই একুশ শতকেও দস্তুরমতো জারি রয়েছে। এমনকি খোদ মার্কিনমুলুকে (মেডিকেয়ার ফর অল) পর্যন্ত। এই আন্দোলন সবার সুরক্ষার জন্য, না কি কেবলই অভিজাতদের জন্য— তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে আজও বিভিন্ন শ্রেণি ও সমাজ এতে আক্রান্ত হচ্ছেন। গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষের সঙ্গেই আক্রান্ত হচ্ছে বিমানবন্দর ও লজিস্টিক্যাল ক্ষেত্র।
একুশ শতক দেখছে ‘এক নব্য শ্রমিকশ্রেণি’কে। প্রশ্ন হলো, কে বাড়ি থেকে কাজ করতে পারবেন, কে পারবেন না! এই সামাজিক বিভাজন থেকেই প্রশ্ন, কে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে, অথবা কোয়ারেন্টাইনে রাখতে পারবেন, কে বা কারা (ইচ্ছে থাকলেও পেটের টানে) পারবেন না।
যেমন নিকারাগুয়া (১৯৭৩), মেক্সিকো (১৯৯৫)-র ভূকম্পনকে বলা হয় ‘শ্রেণি-কম্পন’, তেমনই করোনার বিস্তার বেআব্রু করে চলেছে তার শ্রেণি চরিত্রকে।

২.
করোনায় বাঁচলেও অনাহারে বাঁচবে তো!
করোনায় বাঁচলেও মন্দায় বাঁচবে তো!
বিশ্বের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ, বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ আমেরিকা করোনা ঠেকাতে রীতিমতো জেরবার। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ১,০৫০। আক্রান্তের সংখ্যা ৬৯,০০০। রহু প্রদেশে লকডাউন। জরুরি অবস্থা। শেষে ২.২ লক্ষ কোটি ডলারের ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা।
ক্যাপিটালিজম বনাম করোনা ভাইরাস বিতর্কের নির্যাস: এই সঙ্কট মোকাবিলার জন্য দেশকে যোগ্য করে তুলতে পারেনি পুঁজিবাদের মার্কিন নয়া উদার মডেল। নয়া উদার স্বাস্থ্য পরিষেবার অসুস্থ ব্যবস্থা বরং পুরোপুরি ব্যর্থ।

৩.
যেমন বলেছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাপোর্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অধকর্তা জেফরি স্যাচস: ‘আমাদের নেই সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা। আমাদের আছে মুনাফাখোর বেসরকারি ব্যবস্থা। আমাদের আছেন এমন লক্ষ কোটি মানুষ, যাঁদের নেই কোনও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বীমা। আমরা তাই মুখ থুবডে পড়ছি।’
ভবিষ্যতের ইতিহাস তুলে ধরবে নয়া উদারবাদে বিশ্বজোডা মন্দায় বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বীভৎস চেহারাকে। আমাদের অদূরদর্শী, শোষণমূলক, মারাত্মক রকমের আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবকে।
৩ কোটি মানুষের নেই কোনও স্বাস্থ্য বীমা। দাবি উঠেছে ‘মেডিকেয়ার ফর অল’। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশে স্বাস্থ্য হলো পণ্য। যার টাকা আছে সে পাবে। যার নেই পাবে না।

৪.
অন্যদিকে ভারত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে বলেছে প্রতিটি দেশকে জিডিপি’র ৪-৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে, সেখানে মোদীর নয়া উদার ভারতে বরাদ্দের হার মাত্র ১.৬ শতাংশ!
সর্দার প্যাটেলের মূর্তির জন্য ২,৯৮৯ কোটি টাকা খরচ করতে পারে, আসামে বেফালতু এনআরসির জন্য ১,১০০ কোটি টাকা জলে ঢালতে পারে, নয়াদিল্লির সেন্ট্রাল ভিস্তার জন্য ২০,০০০ কোটি টাকার পরিকল্পনা নিতে পারে, ২০১৪ থেকে ৬,৬০,০০০ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ বেবাক মকুব করে দিতে পারে— সবার জন্য স্বাস্থ্যের সময়ই খালি অর্থ নেই!
গোটা দেশে ভাইরাস রিসার্চ অ্যান্ড ডায়াগোনেস্টিক ল্যাবের সংখ্যা কত? সাকুল্য্ ৭৫। একটি ল্যাব দিনে ক’টি নমুনা পরীক্ষা করতে পারে? সর্বোচ্চ ৯০। তাহলে একদিনে ৭৫টি সেন্টারে কত নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব? মেরেকেটে ৬,৭৫০। বুঝুন ১৩০ কোটির দেশে দিনে মাত্র ৬,৭৫০ জনের নমুনা পরীক্ষা সম্ভব!
এপর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার জনের পরীক্ষা হয়েছে। প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের করোনা পরীক্ষায় ভারত সবার নিচে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ২০১৯ ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইল অনুযায়ী দেশে ডাক্তারের সংখ্যা ১১,৫৪,৬৮৬ জন। এর মধ্যে সরকারি ক্ষেত্রে— যেখানে এখনও পর্যন্ত করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসা সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, সেখানে ডাক্তারের সংখ্যা টেনেটুনে ১,১৬,৭৫৬ জন। মানে প্রতি ১০,৯২৬ জন পিছু একজন ডাক্তার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য প্রতি ১ হাজার জনের জন্য একজন ডাক্তার থাকা উচিত। রয়টার্সে (২০১৬) প্রতিবেদনে ভারতে অন্তত ৫০,০০০ ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্ট প্রয়োজন। আছে কত? মাত্র ৮,৩৫০ জন।
গত দু’বছরের সরকারি বাজেটে জাতীয় স্বাস্থ্য অভিযানে (প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি লেভেলের জন্য) বরাদ্দের অংশ ৫৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৪৯ শতাংশ!
গো-মূত্র থেকে কাঁসর ঘণ্টা বাজানো ছাড়া উপায় কী!!!

ঋণ: ডেভিড হার্ভে


শেয়ার করুন

উত্তর দিন