সৌভিক ঘোষ
লেনিনের ‘রাষ্ট্র’ এবং স্তালিনের ‘জাতিরাষ্ট্র’
সকলে মিলে একসাথে শান্তিতে জীবন কাটানো যায় না ? পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মানুষের উদ্দেশ্যে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করলে নিছক উন্মাদ ব্যাতিরেকে প্রায় একই ধরনের উত্তর পাওয়া যাবে। সেই উত্তরে কোথাও সন্দেহ থাকতে পারে, কোথাও ইতিহাসের কম বেশি উপলব্ধির কারনে সংশয় থাকতে পারে আবার কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে হতাশা – কিন্তু কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না এমনটাই সকলে কামনা করেন।
এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই একের পরে এক মত এবং পথ ইতিহাসের নানা পর্যায়ে সক্রিয়তা দেখিয়েছে। মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষা পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাসের রহস্য সমাধানে শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গীকে ভিত্তি করে নির্মিত – এই কারনেই ইতিহাসের গতির সাথে মার্কসবাদীদের উপলব্ধি নতুন মতে, নতুন পথে উৎসারিত হয়। একটা গোটা সমাজব্যবস্থাকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে আগাছা পরিস্কার করে নতুন যুগ, নতুন মানুষ গড়ার কর্তব্যে লক্ষ্যস্থির করলে উপরোক্ত সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতেই হবে– লেনিন এই সত্য জানতেন। বিপ্লব সফল হলেও বিদ্যমান জাতিগুলির মধ্যে প্রকৃত সংহতি গড়ে না উঠলে যে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করা যাবে না এই প্রসঙ্গে লেনিন থেকে ম্যাক্সিম গোর্কি অবধি চিন্তিত ছিলেন। রাষ্ট্র কিভাবে সক্রিয় হয় তার বিজ্ঞান প্রকাশ করেছিলেন লেনিন (রাষ্ট্র ও বিপ্লব), স্তালিন ব্যাখ্যা করলেন জাতিরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ভিত্তি ও চিহ্নিত করলেন তার আভ্যন্তরীণ সমস্যাবলী।
যদি নেকড়েকে ভয় পান তাহলে জঙ্গলের বাইরে থাকুন
একটা বিরাট দেশ, যার মধ্যে জীবন ধারনের বৃত্তি, মনোভাব আদান প্রদানের ভাষা, বহুযুগ ধরে চেতনায় সম্পৃক্ত গোষ্ঠী সংস্কৃতি সবটা মিলে নানা জাতির সমাহার ছিল রাশিয়ায়। আকারে বড় জনগোষ্ঠী অন্যদের উপরে নানা মাত্রায় আধিপত্য চাপিয়ে দেয় – তার বিরুদ্ধে সামাজিক অসন্তোষ বজায় থাকে, কখনো সেই ক্ষোভ সামনে এগিয়ে আসে, কখনো ছাইয়ের তলায় চাপা আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। এই অবস্থা সমাজ বিপ্লবীদের মোকাবিলা করতেই হয়, লেনিনকেও করতে হয়েছিল। এই সমস্যার সমাধানে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন একজন জর্জিয়ান কমরেডকে – তিনিই যোসেফ স্তালিন।
১৯১৩ সালে প্রোসবেশচেনিয়ে পত্রিকায় স্তালিনের লেখা 'জাতিগত প্রশ্ন ও মার্কসবাদ' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই প্রবন্ধ সম্পর্কে লেনিন ম্যাক্সিম গোর্কিকে চিঠি লিখলেন - 'আমরা একজন চমৎকার জর্জিয়ানকে পেয়েছি যিনি সমস্ত অস্ট্রীয় ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করেছেন, জাতিগত সমস্যায় একটি প্রবন্ধ লিখছেন'।
আসলে স্তালিন কি করেছিলেন? কোন ম্যাজিক কিংবা জনপ্রিয় কর্মসূচি যাতে জনগন আত্মহারা হয়ে সমস্যা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে থাকেন? একেবারেই নয়। বিভিন্ন জাতিগুলির মধ্যে সংহতির পথে যে বাধা তাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করলেন তিনি, জাতীয় স্বার্থে লড়াইয়ের স্লোগান তুলে বুর্জোয়ারা একদিন মানুষকে একজোট করলেও আজ নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থেই তারা জনগনের মধ্যে অনৈক্য চায়। সেই অনৈক্য আসলে অর্থনৈতিক দুর্দশার সাথেই সংযুক্ত – তাই সবার আগে প্রয়োজন অর্থনৈতিক শোষণের সমাধান। সেই কাজ করা হবে প্রথমে বুর্জোয়াদের সামাজিক, অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব উচ্ছেদ করে, পরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে মর্যাদা দিয়ে। বিপ্লব সফল হওয়ার অনেকটা পরে, ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধান রচনার সময় স্তালিন জাতিগত সমস্যায় মার্কসবাদীদের কর্তব্যকে প্রয়োগ করে দেখালেন। সংবিধানের ১৭নং ধারায় উল্লিখিত হল ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত সকল গনপ্রজাতন্ত্রগুলি সোভিয়েত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারবে – তাদের সেই অধিকার রয়েছে। অনেকেই তখন এই ধারার বিরোধিতা করেছিলেন, স্তালিন তাদের ভুল ধরিয়ে দিলেন এই বলে “বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার অর্থ হবে সংযুক্ত হওয়ার স্বাধীনতা হরণ করা”।
সেই সংবিধানের উপরে আরেকটি সংশোধনীর প্রস্তাব এসেছিল– কুলাক (বড় জমিদার), প্রাক্তন হোয়াইট গার্ড (শ্বেত রক্ষীবাহিনি) এবং ধর্মযাজকদের যাবতীয় অধিকার কেড়ে নেওয়া হোক কেননা তারা পুনরায় দেশ পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। স্তালিন সেই প্রস্তাব খারিজ করলেন। সর্বহারা একনায়কত্ব সম্পর্কে অনেকের মনেই নানা কাহিনী বাসা বেঁধে থাকে, তাদের জন্য স্তালিনের সমাধান আজও প্রাসঙ্গিক “এদের ভয় পাওয়ার কি আছে? যদি নেকড়েকে ভয় পান তাহলে জঙ্গলের বাইরে থাকুন”। জাতিগত সমস্যা জটিল নিশ্চিত, কিন্তু স্তালিন শেখালেন জটিলতার অজুহাতে সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া চলে না, বাস্তবিক সমাধান খুঁজেই পথ চলতে হয়।
বুর্জোয়া জাতিয়তাবোধ এবং কমিউনিস্টদের কর্তব্য
বুর্জোয়ারা জাতিসমস্যার আংশিক সমাধান করে। নিজেদের সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় পুরানো সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ককে উচ্ছেদ করতেই এই কাজ করতে তারা বাধ্য হয়। সেই লক্ষ্যেই নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে যাবতীয় বাধাকে তারা গোটা সমাজের কাছে বাধা হিসাবে প্রচার চালায়। এভাবেই জাতীয় আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটে, সেই আন্দোলনে শ্রমিক এবং কৃষক জনতার যোগদান নির্ভর করে ঐ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণীবৈরিতার মাত্রার উপরে। শ্রেনীগত চেতনায় শ্রমিকজনতা কতদূর সংঘবদ্ধ হতে পেরেছে তারই প্রভাবে তারা বুর্জোয়া জাতিয়তাবাদের স্লোগানকে নিজেদের বক্তব্য হিসাবে মেনে নেয়। একইভাবে জমি সম্পর্কিত শোষণের তীব্রতার উপরেই নির্ভর করে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে কৃষকজনতার ভূমিকা। বুর্জোয়ারা নিজেদের লড়াইয়ের প্রথমার্ধে এই সুযোগকে কাজে লাগায়, পরে (জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী স্তরে) শ্রেণীশাসনের ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে অব্যাহত রাখতে এক জাতিকে অন্য জাতির বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়, প্ররোচিত করে। শোষণের গোড়ায় সামাজিক শ্রমে উৎপাদিত পন্যের উপরে ব্যাক্তি মালিকানার প্রসঙ্গকে আড়াল করতে সামনে নিয়ে আসে জাতিগত (ধর্ম, পেশা, ভাষা ও সংস্কৃতিগত বিভিন্নতাকে অজুহাত করে) সংকীর্ণ পরিচয়কে। এভাবেই ব্যাপক জনসাধারনকে তারা লড়াইয়ের ময়দানে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে রাখে। নিরবিচ্ছিন্ন সামাজিক নিপীড়নে বিচ্ছিন্ন, ব্যতিব্যস্ত জনসাধারণ আসল রোগের চিকিৎসা না করে ব্যাথা নিরাময়ে সাময়িক আরামদায়ক মলমেই সুরাহার খোঁজ করে চলে – জনগণের মধ্যেকার সেই অসংহতিই জাতি সমস্যার আসল কারন।
স্তালিন ব্যখ্যা দিলেন “জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য সংগ্রামে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির লক্ষ্য হল জাতীয় নিপীড়নের নীতি খতম করা, তাকে অসম্ভব করে তোলা এবং এভাবেই জাতিগুলির মধ্যে সংঘর্ষের কারনকে দূর করে দেওয়া, সংঘর্ষের ধারকে ভোঁতা করে একেবারে নিম্নতম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া”। লেনিন “জাতিসমুহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার” রচনা করেছিলেন, স্তালিন সেই তত্ত্বকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে তুলতে রাশিয়ার নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োগ করলেন। জাতীয় নিপীড়নের নীতি উচ্ছেদ করার অর্থ দ্বিবিধ, এক বুর্জোয়া শাসনের অবসান আরেকদিকে ছোট ছোট অংশগুলির উপরে বড় জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে রুখে দেওয়া। একদিকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আরেকদিকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অবসান। এই দুয়ের প্রভাবে জনগণের প্রতিটি অংশের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় মূল সমস্যা কি, তার থেকে মুক্তির পথই বা কোথায়। স্তালিনের সমাধান ঐতিহাসিক কর্তব্য সমাধা করতে সফল হয়েছিল। আজকের দিনে এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য সেই কর্তব্যেরই সময়োপযোগী পুনঃপরিকল্পনা।
সারা পৃথিবীতে আমাদের দেশ বহু ধর্ম, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির এক ঐতিহাসিক মিলনক্ষেত্র। আমাদের দেশেও জনগণের শক্তি নিহিত রয়েছে নিজেদের মধ্যেকার সংহতিতেই, তাকে নস্ট করতে শাসক চিরায়ত ভেদনীতিই নতুন কায়দায় প্রয়োগ করছে। অর্থনৈতিক,সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বকে উচ্ছেদ করতে আন্তোনিও গ্রামশী’র হেজিমনি’র আলোচনা যতটা প্রয়োজন তটটাই জরুরী ‘জাতিগত সমস্যায় মার্কসবাদ’-এর ঐতিহাসিক শিক্ষা থেকে অভিজ্ঞতার সার গ্রহন করা।
সারা পৃথিবীর সামনে কমিউনিস্ট ইশতেহার আহ্বান রেখেছিল দুনিয়ার মজদুর এক হও, আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য ভারতে সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া, এই কাজে বাধা অনেক – রাশিয়ার বাস্তবতায় সেইসব বাধা পেরোতে যোসেফ স্তালিন সফল হয়েছিলেন। নিপীড়নের কৌশলসমূহের মতোই নিপীড়িত মানুষও শুরু থেকে শেষ অবধি আন্তর্জাতিক (তথাকথিত বিশ্বায়নের অনেক আগে থেকেই), এই কারনেই তার থেকে আমাদের শিখতে হয়।