বুঝছেন কি দাঁড়িবাবা ? - শমীক লাহিড়ী...

৩ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার

পৃথিবী আমারে চায়, খুলে দাও বাহুডোর......


সেই যে যশোদার বাহুডোর ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়লেন, তারপর থেকে শুধুই ছুট ছুট আর ছুট। কখনো চা বেচছেন, কখনো ব্রহ্মচর্যে নিমগ্ন, কখনো "Whole political science" নিয়ে MA পরীক্ষা দিচ্ছেন, আবার কখনো ২০০০ বছর আগে প্রথম হওয়া প্লাস্টিক সার্জারি শেখাচ্ছেন মুম্বাইয়ের ডাক্তারদের।

শুধু দেশ? তামাম দুনিয়ার ভার তাঁর ঘাড়ে। এই শি চিনফিনের সাথে দোলনায় দুলছেন নিজের ৬৪তম জন্মদিনে , এই আবার ২২৪টা চীনা অ্যাপ বাতিল করে দেশের ১৩০ কোটি মানুষকে ঘোর বিপদের হাত থেকে মুক্ত করছেন। তার আগে গুগুল, ফেসবুকের সাথে আম্বানির নিকাহ'র কাজটা অবশ্য সেরে ফেলেছেন। অভিভাবকের দায়িত্ব নেই? এখন ঐ সুখী দম্পতির হাতে আমার আপনার সব তথ্য নিরাপদে আছে। কি খাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কি ভাবছেন সব ঐ দম্পতি জানে। আমাদের তথ্য সুরক্ষা পুরো A-Z+++++++!



এই তো সেদিন হাওয়াই থেকে হাওয়া খেয়ে ফেরার পথে বিনা নেমত্তনে চা খেতে সটান লাহারে চলে গেলেন নওয়াজ শরীফের বাড়ি (২৫/১২/১৫)। তারপরই আবার সার্জিকাল স্ট্রাইক। দমাদম বোমা গুলিতে গুঁড়িয়ে গেল সীমান্ত পারের পাথরের টিলা। পাকিস্তানকে এমন টাইট দিলেন বালাকোটে যে, আমাদের পাইলট পাকিস্তানের হাতে বন্দী আর আমাদের খান দুয়েক যুদ্ধ বিমান আর হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে গেল। শত্রুর কি ক্ষতি হ'লো? মহা মুস্কিল, এটাও বোঝেন না! উনি ঐ জুজু দেখিয়ে সরকার করে ফেললেন। এটা কি 'দেশপ্রেম'-র সাফল্য নয়!



চা দোকান থেকে নাগপুর হয়ে দেশ-দুনিয়া ঘুরে বিশাল অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। মাঝে এই 'ডোনেল টাম্পের' নির্বাচনটা একটা ফালতু ব্যাপার হয়ে গেল। একটা ভালো IT cell তৈরি করতে পারলো না লোকটা! না হয় মালব্যকে পাঠিয়ে দিতেন। ওর একটা ফরেন পোস্টিংও হ'ত, আর ট্রাম্পের জয়ধ্বনির সুর ট্রাম্পেটে বাজিয়ে বাইডেনকে গুডবাই দেখিয়ে দিত। টিভি-খবরের কাগজগুলোকেও বাগে আনতে পারলো না লোকটা! আরে বললেই 'রিপাব্লিকের স্বামী'কে পাঠিয়ে দিতেন। তবে ব্যাটার একটু হাতটান আছে, কাজ করিয়ে পয়সা না দেওয়ার অভ্যাস আর কি। সেটা একটু fbi-পুলিশ আর আদালতকে ম্যানেজ করে দিতে হতো। কিন্তু ফাটিয়ে দিত ট্রাম্পের প্রচার। অবশ্য একটা বড় সমস্যা বেচারা ট্রাম্পের - প্রতিবেশী একটা পাকিস্তান নেই। না হলে নির্বাচন জেতা কোনো ব্যাপার! কিউবা-ভেনেজুয়েলা- মেক্সিকো দিয়ে কেসটা ঠিক দাঁড়ায় না। 'হাউডি মোদী' আর 'নমস্তে ট্রাম্প' এর পুরো পয়সাটাই জলে গেল।



এর মধ্যে ভাগ্যিস করোনাটা আসলো। না হ'লে - ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ৭৫ দিনের লকডাউন। নে ব্যাটা জনগণ ঘরে থাক, আর ঘুরে ঘুরে আম্বানি-আদানি পছন্দের জিনিসের তালিকাটা করে ফেলুক। হরেক মাল পাঁচ সিকে, লে লে বাবু চার আনা - হৈহৈ বেচাকেনা চলছে। কে বলে অর্থনীতি থমকে আছে বর্ষার জলভরা মেঘের মতো? দেখছেন না - ব্যাংক কিনছে, খনি কিনছে, আস্ত আস্ত রেলগাড়ী কিনছে। ব্যাংকের লেনদেন দেখছেন না? ১১ লক্ষ কোটি টাকা 'লোনদান' থুড়ি লেনদেন হ'লো। টাকা ফেরৎ আসেনি তো কি! টাকাটা মার্কিটে ঘুমছে তো নাকি! ওদিকে মোটাভাই বিধায়ক কিনছে, সরকার কিনছে। দেখলে হবে, খরচা আছে। কত মানি সার্কুলেশন হচ্ছে বাজারে। বাজার পুরা চাঙ্গিস ছে।



কিছু লোক খামোখা হল্লা করছে। করোনায় চাকরি যাচ্ছে। তো যাবে না! আরে করোনায় প্রাণ চলে যাচ্ছে, আর চাকরি! এত চাকরির কি আছে! বেওসা করো। চপ ভাজো। লটারির টিকিট কাটো। কিছু না হ'লে IT Cell এ নাম লেখাও। কমেন্ট লাগিয়ে ৫/১০টাকা কামিয়ে নাও।

দেশে বেচা কেনা বাড়াতে হবে। তবেই তো আচ্ছে দিন আসবে। তাই রেল, খনি, বীমা, ব্যাংক বেচা কেনা হচ্ছে। কিন্তু দেশের ৪০০০ লক্ষ একর চাষের জমি আছে, ওটা শুধু চাষী চাষ করলেই হবে! ওখানেও বেচা কেনা চাই।

ফসল বেচা কেনা তো হচ্ছে। কিন্তু চাষী কেনা বেচার কি বোঝে? চাষীভাই চাষ করুক, বেচা কেনাটা আম্বানি-আদানি-ফড়ে দালালকে ছেড়ে দিক। এতে কি অন্যায় আছে? এটা শুধু কাজের ডিভিশন, এফিসিয়েন্সি বাড়াবার জন্য। তুমি চাষ করো, মাল বেচে দেবে ওরা। তোমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এতে চাষীর লাভ আছে। সরকার বা চাষীর কাজ নয় কেনাবেচা। এটা আবার কেমন কথা - কেনার দাম সরকার ঠিক করে দেবে? সরকার ন্যূনতম দাম ঠিক করে দিলে, বেচারা আম্বানি-আদানির এজেন্টদের কি হবে! মার্কিটের ওপর ছেড়ে দাও সব। মার্কিট চাঙ্গিস হ্যায় না! সব বছর শুধু চাষী লাভ করবে, তা হয়! এজেন্টদের কথা ভাবতে হবে তো। লাভ-লোকসান নিয়েই তো জীবন। দেশের জন্য এইটুকু সেক্রিফাইস করতে তো চাষীভাইদের করতেই হবে।

বেকার হৈচৈ করছো কেন বাবা অত্যাবশকীয় পণ্য আইন নিয়ে? আলু-পিঁয়াজ-চাল-ডাল এসব জরুরী জিনিস? আমার অর্থমন্ত্রী তো পিঁয়াজ খায়না। মোটাভাই ভি আলু খায় না। ওরা কি বেঁচে নেই? এসব সামান কি অক্সিজেন আছে না কি? না নিলে মরে যাবে? আরে ভাই কম খাও। সতিয়াজিৎ রে ভি বলিয়েছেন - বেশী খেলে বাড়ে মেদ, অনাহারে নাহি খেদ। কি বলেন নি? আরে দুনিয়া জুড়ে খেয়ে খেয়ে কত লোক মরে যাচ্ছে জানেন? এত ভোজনবিলাস কিসের? ভজন করো, পূজন করো। মরলেও শান্তি পাবে। চেহারা হাল্কাপুল্কা হলে খাটিয়াতে তুলতেও সুবিধা হবে।

আচ্ছা ৪০০০লক্ষ একর জমি স্থির হয়ে থাকবে? খুচ খুচ করে ছেলে কি মেয়ের বিয়ের সময় শুধু একটু কেনা বেচায় কি হবে! এই জমি যদি কেনা বেচায় আনা যায় কত মানি সার্কুলেশন হবে, ভাবতে পারছেন? চাষীর থেকে এজেন্ট কিনলো, তার থেকে আম্বানি কি আদানি কিনলো, উফ মানি তো ঘুরতেই থাকবে বাজারে। বাজার পুরো পাগলা ঘোড়ার মতো দৌড়াবে। আরে চাষীর হাত থেকে জমি চলে যাবে তো কি হয়েছে! দেশের লোকের হাতেই তো থাকবে। জমিন যার, ফসল তার, মার্কিট তার। সব এক হাতে চলে আসলে একটা সিস্টেম থাকবে। এক জাতি, এক প্রাণ, এক শোচ, এক সিস্টেমে পুরো কৃষি ব্যবস্থা - এর চাইতে দেশপ্রেমিক ভাবনা আর কি আছে?

চাষীর জমি চলে গেলে কাঁদবার কি আছে? জমিতে তো মুকেশবাবু গৌতমবাবু স্যুট বুট গায়ে দিয়ে চাষ করবে না। চাষীভাইদেরই দিয়ে চাষ করাবে। চাকরি খুঁজছিলেন তো? কত লোকের চাকরি হবে এই জমিতে। সার লাও-বিষ লাও-বীজ লাও, তারজন্য কর্জ করো - এইসব কোনো ঝামেলা নেই। জমির জন্য দুঃখ করে লাভ নেই।

যারা জমি দেবে না, চুক্তি চাষ করো। চুক্তি করলে সব ফসল কিনে নেবে বড় বড় কোম্পানি। সবটা কিনবে না ঠিকই। ত্যাড়া বাঁকা বেগুন হলে কিনবে কেন! ফিল্মের নায়িকাদের গালের মতো চিকনাই থাকতে হবে। তবে তো ৪টাকার আলু ৪০, ১০টাকার পিঁয়াজ ৮০ টাকা দাম পাবে। আম্বানি-আদানির এজেন্টরা কি লোকসান করবে? যা কিনবে না ওরা, সেটা জমিতে রেখে দাও। সার হবে ভালো। চাষীর কিছু লোকসান তো হতেই পারে। চাষে বিজনেস হলে লাভ লোকসান সবই হবে। লোকসান বেশি হলে, কর্জ বেশি হ'লে ফলিডল খেয়ে নাও। আম্বানি-আদানি- দালালদের উপকারের পূণ্যে স্বর্গ/বেহস্তবাস নিশ্চিত। ওখানে অপ্সরা আছে, আঙুর আছে। ফূর্তিই ফূর্তি।



বেকার বেকার ঠান্ডার মধ্যে কেন বসে আছে চাষীরা! বলুন তো, যাকে তাকে রাজধানীতে ঢুকতে দেওয়া যায়? মন্ত্রী-সান্ত্রী-কাজী- হুজুর সবাই থাকে এখানে। রাস্তা কি বসার জায়গা? এর আগে সুপ্রিম কোর্টও বলেছিল - রেললাইন কি হাঁটার জায়গা, রাস্তা কি বসে থাকার জায়গা? আন্দোলন করতে হলে মরুভূমি যাও, জঙ্গলে যাও, ফাঁকা ময়দান। বছরের পর বছর বসে থাকো না, কে আটকেছে? জোরদার আন্দোলন করো সেখানে। দিল্লিতে কেন?

দেশের রাজধানী দিল্লি। দেশের হোমরাচোমরা- কেষ্টবিষ্টু-মন্ত্রী আমাত্যদের বাস। ১৩০ কোটির দেশ চলে ওখান থেকে। সেখানে ঢোকার রাস্তায় বসে চাষীরা। কি আপদ!

রাজধানী যাওয়ার রাস্তা আটকে রাখলে দেশ চলবে কেমন করে! মুখ্যু চাষীগুলো তাও বোঝে না?

বোঝেনা ওদের করোনা হবে? করোনা হ'লে মরে যাবে এটুকুও জানে না, না কি! পৃথিবী জুড়ে ৬ কোটি লোককে করোনায় ধরেছে, ওরা কি জানে না! দেশে ১লাখ ৪০ হাজার লোক মরে গেল, তাও এদের চোখে জল নেই, উলটে আগুন জ্বলছে! এই আগুন নেভানোর জন্যই তো খট্টর তাওজি আর যোগী বাবার পুলিশ কাঁদানে গ্যাস চালিয়েছে ওদের চোখের জলে নাকের জলে এক করে আগুন নেভাতে। চোখের জল নাকের জল এক হওয়ার বদলে ওরাই এক হয়ে গেল! কি বিপদ!!!

দিল্লিতে ঠান্ডা নেমে গেছে। বুড়ো বুড়ো লোকগুলোর নিউমোনিয়া হ'লে কি হবে? এই জন্যই জল কামানে বরফ গলা জল ছুঁড়ে নিউমোনিয়া থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো দাঁড়ি বাবা। কিন্তু মুখ্যুগুলো তাও গেল না!

মোটাভাইয়ের বুদ্ধিতে ওর চাইতেও মোটা মোটা কংক্রিটের চাঁই জড়ো করেছিল দিল্লি পুলিশ। ওরা মানুষ না কিংকং-এর বংশধর? ওগুলো টেনে হিঁচড়ে ফেলে দিল!!!

পুলিশ প্যাঁদাচ্ছে, আর তাকেই রুটি সব্জি খাওয়াচ্ছে! লে হালুয়া! এ আবার কেমন গান্ধীগিরি!!

সব কটা হয় খালিস্থানী নয়তো কমুনিস্ট। নিশ্চয়ই এর পিছনে পাকিস্তান বা চীন আছে। কারণ ওদের হাতে লাল পতাকাও আছে আবার সবুজ পতাকাও আছে।

ডোনেল টাম্প ১৪% এর এক আন্দোলনেই কাত - ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। এখানেও এরা বলছে - কিষাণ লাইভস ম্যাটার। কিষাণ দেশে ৫২%। আরও ১৫% পরোক্ষভাবে চাষের সাথে যুক্ত।



বুঝছেন কি দাঁড়িবাবা?




শেয়ার করুন

উত্তর দিন