ডেথ সার্টিফিকেট মৃত্যুর কারণ বলে দিচ্ছে ফুসফুস এবং হূদযন্ত্রের সমস্যা । মৃতদের পরিবারগুলিকে দরজায় দরজায় ছুটে বেড়াতে হচ্ছে । করোনায় মৃত্যুর ডেথ সার্টিফিকেট দিতে সমনীতি বলে কোন কিছু কি আছে ?"-- সুপ্রিম কোর্ট এ প্রশ্ন করেছে কেন্দ্রীয় সরকারকে । বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষত ছটি রাজ্য থেকে মৃত্যুর সংখ্যা বিষয়টিতে বিরাট হেরফের লক্ষ্য করা যাচ্ছে । মিডিয়াতে এই নিয়ে হইচই চলেছে । বিদেশেও এই খবরটা ফলাও করে প্রচারিত । এসবের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার হলফনামা দিয়ে কোর্টকে বলেছে যে সব করোণা মৃত্যুকে করোনাজনিত মৃত্যু বলে গণ্য করে সার্টিফিকেট দিতে হবে , এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
কর্নাটকে কোভিড -১৯ সংক্রমণে ২০০০ এপ্রিল থেকে ২০২১ মে পর্যন্ত অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে ১,৬৭, ৭৮৮ যা সরকারি হিসেবে ওই সময়ে ২৯০৯০ মৃত্যুর চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বেশি । এই হিসেব পেশ করেছে সিভিক রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম । এছাড়া অন্ধ্র, তামিলনাডু, মধ্যপ্রদেশ থেকেও মৃত্যুর সংখ্যা কম করে দেখানোর বহু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে ।
এখন হাসপাতালে মৃত্যু হলে একমাত্র সার্টিফিকেট দেওয়া হয় । গত ১৫ মাসে মধ্যপ্রদেশ কর্ণাটক তামিলনাড়ু অন্ধ্রপ্রদেশে ও দিল্লিতেই চার লক্ষ আশি হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে । এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই বিহারে ৭৫০০ জনের অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয়েছে । এটা সরকারি তথ্য'র চেয়ে ১০ গুণ বেশি . এ কারণে পাটনা হাইকোর্টের তিরস্কার ভোগ করতে হয়েছে বিহারের বিজেপি নীতিশ কুমার সরকারকে । শীর্ষ আদালত দেখিয়েছে ১৯৭৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে বলেছিল, সাধারণ রুটিন কাজে গোপনীয়তার নামে তথ্য আড়াল করা জনস্বার্থকর নয়, এই ধরনের গোপনীয়তা আইনসংগতও নয় । কেন্দ্রীয় সরকার বারবার দাবি করে এসেছে ভারতে মৃত্যুহার খুবই কম । পশ্চিমবঙ্গসহ রাজ্যগুলিও একই ধারা অনুসরণ করেছে । সরকারি ঘোষণা মত এখনো পর্যন্ত ৩ লক্ষ ৬৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনাভইরাসে । এটা বাড়বে দ্বিতীয় তরঙ্গে, কারণ শ্মশান কবরখানা মৃতদেহে উপচে পড়ছে, গঙ্গাতীরে বালিতে পুঁতে দেওয়া হচ্ছে অসংখ্য মৃতদেহ, নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার মৃতদেহ । গত এপ্রিল মে মাসে সারা দুনিয়ার সংবাদ শিরোনামেও এই দৃশ্য ও তথ্য উঠে এসেছে । এতে সরকারের পক্ষ থেকে মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখানোর অভিযোগ আরো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সরকারি তথ্য সম্পর্কে সন্দেহ বেড়েছে । কোভিড -১৯ এর আগে যা মৃত্যু হতো তার ৮৫% মাত্র রেজিস্ট্রিকৃত হতো । তার মধ্যে এক চতুর্থাংশে মৃত্যুর কারণ সার্টিফিকেটে থাকতো । মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে এবং মোট মৃত্যু সম্পর্কে সার্বিক কোনো তথ্য না থাকার ফলে সরকার নির্ভর করে একটা আনুমানিক হিসেবের উপরে ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে পৃথিবীতে সরকারের ঘোষিত মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত মৃত্যু দুই থেকে তিনগুণ বেশি । জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, রোগ নির্ণয় করার সংস্থা এবং গবেষণা সংস্থাগুলির যারা মৃত্যুর নানা রকম কারণ ও তথ্যাদি নিয়ে গবেষণা করে তাদের হিসেবে ভারতে কোভিড -১৯ মৃত্যু সরকারের ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি হবে । বড় বড় অনেকগুলো শহর এবং অনেকগুলো রাজ্যের প্রকৃত মৃত্যুর খবর বাইরে মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছে । এসব শহরের প্রত্যেকটিতে রাজ্যগুলিকে কোভিড সময়ের চেয়ে আগের দু'বছরের একই সময়ের তথ্য দিয়ে দেখাতে উদগ্রীব হয়ে উঠতে দেখা যায় যে কোভিড সময়ের চেয়ে তখন মৃত্যু সংখ্যা আরো বেশি ছিল ।
গ্রামীণ ভারতে মৃত্যু রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল । ফলে সেখানকার মৃত্যু সরকারি হিসেবের মধ্যে প্রায়ই হিসাব হয়ে আসে না । কোভিড দ্বিতীয় তরঙ্গে গ্রামাঞ্চলে দু'মাসে মৃত্যুহার সরকারি ঘোষণার চেয়ে অনেক বেশি । কেন্দ্র ও রাজ্য একযোগে প্ৰকৃত বেশি মৃত্যুর কথা বললে তারা সেটা অস্বীকার করবে, এতেই তারা বিপদ আড়ালে অভ্যস্ত । শহর থেকে মৃত্যুর খবরটা বেশি আসে কারণ এখানে রেজিস্ট্রেশন করার ব্যবস্থা আছে । গ্রামাঞ্চলে কোভিডজনিত বিধিনিষেধ, যানবাহন ,এম্বুলেন্স এর অভাব, আর্থিক দুরবস্থা ইত্যাদি কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা কেন্দ্রে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় না । শহরে বা গ্রামে কোভডজনিত মৃত্যু কিংবা অন্য সমস্ত মৃত্যুর কারণ ইত্যাদি সব তথ্য সরকারের হাতে পুরোপুরি থাকলে তাহলে সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি, চিকিৎসার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা সুবিধা হয় । যেহেতু স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষত প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে । লকডাউন চলাকালীন সময়ে কি কেন্দ্রীয় সরকার কি রাজ্য সরকার এই প্রশ্নে একদম নীরব ।এক মাস পেরিয়ে প্রায় দেড় মাস হতে চলল পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন চলছে । সাধারণ মানুষের ভয়াবহ অবস্থা । আয় নেই, ভয়ংকর কমে গেছে । কর্মহীনতা মারাত্মক আকার নিয়েছে । কিন্তু সরকার স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বৃদ্ধির জন্য এই সময়ে যে ব্যবস্থা নিতে পারত সেদিকে নজর দেয়নি । এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অথচ হাজার হাজার অসহায় পরিবার এখনো রোগীকে নিয়ে প্রচন্ড অসুবিধার মধ্যে পড়েছে । না আসে সরকারি কোন সাহায্য । মাসে পরিবারপিছু ৩৫ কিলো চাল বা কর্মহীনদের যাদের আয়কর দিতে হয় না এরকম সব পরিবারকে মাসে ৭০০০ টাকা করে দিলে তাহলে জীবনটুকু বাঁচাতে যে স্বস্তি পাওয়া যেত সেটা একেবারেই নেই । এইজন্যে বিভিন্ন ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলোও অর্থনীতিবিদদের কথায় সে দিয়ে এখন বলতে শুরু করেছে যে তাদের ব্যবসায় ভয়ঙ্কর মন্দা কারণ মানুষের হাতে কোন সঙ্গতি নেই, কোনো আয় নেই , তারাও চায় সরকার এই বিপর্যয়ের সময় মানুষকে অন্তত আর্থিক সহায়তা করুক, মন্দার বসায় একটু গতি আসবে ।
সরকার বলছে অর্থ নেই । অর্থ আছে, নেই কেবল সদিচ্ছা ।কারণ বিপর্যয় মোকাবিলার স্থায়ী ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের আছে । রাজ্যেরও আছে । এ জন্য অর্থ বরাদ্দ করা থাকে বরাবর । এই বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যবস্থা থেকে এ সহায়তা অনায়াসে করা যায় । কিন্তু এদিকে সরকার ভ্রুক্ষেপই করছে না, ধনীদের স্বার্থ ঠিক থাকলে সরকার নিশ্চিন্ত ।
"না-জেতা পর্যন্ত এই কোভিড-১৯ সংক্রমনের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই" শীর্ষক বইতে ভাইরাস, সংক্রমন ও অতিমারী ইত্যাদি বিষয়ে শীর্ষ তিনজন ভারতীয় বিশেষজ্ঞ লিখেছেন যে ,এই অতিমারী দেখিয়ে দিয়েছে দেশের গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করার আশু প্রয়োজনীতার কথা; তথ্য ও নির্ভুল প্রমাণভিত্তিক প্রতিকারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে; এই গুরুতর সংকট গোটা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার,স্বাস্থ্যের জন্য বাজেট বরাদ্দ পর্যাপ্ত বাড়ানোর এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্যরক্ষার ওপর জোর দেওয়ার; এজন্য অনেক উদ্ভাবন আছে আরও করা যায় এবং পথনির্দেশ রয়েছে ।
সরকার এসব মূল্যবান পরামর্শের ধারেকাছে যেতেও অনিচ্ছুক । গোটা দুনিয়ায় এই ভাইরাস নির্মূল না হলে বিপদ থেকেই যাবে, কবে এর অবসান ঘটতে পারে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ কেই বলতে পারছে না । কারন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে কেউ কাউকে বাধ্য করতে পারে না । যেমন প্রায় ১৪০ লোকের দেশ ভারত, ক্রেডিট নিতেই কেবল তৎপর, দায়িত্ব পালনে নয় ।
কোভিড সংক্রমণ একটু কমলেও আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে যে দ্বিতীয় তরঙ্গ থেকে তৃতীয় তরঙ্গ আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে দেখা দেবে । এবার শিশুদের বিপদ বেশী । অথচ সেই প্রস্তুতিও নেই । পৃথিবীর মধ্যে টিকা উৎপাদনে ভারতের সেরা স্থান । এই অবস্থা সত্ত্বেও বিনামূল্যে সমস্ত মানুষকে দ্রুত টিকাকরনের কোন কার্যকরী ব্যবস্থা সরকার হাতে নেয়নি । ফলে গোটা ভারতবর্ষের সাধারণ সমস্ত পরিবার প্রচন্ড উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা এবং আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে । এটা অনিবার্য ছিল না । কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার ফলে জীবন জীবিকার অবর্ণনীয় হাল, দুরবস্থা উর্ধগামী এবং যেটুকু অর্থ ও আয় কুড়িয়ে বাড়িয়ে মানুষের সঞ্চিত ছিল তা নিঃশেষ বলা চলে । নিঃস্ব হয়ে ধার করে সব খরচ করে তাদের প্রিয়জনকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে । যারা মৃত হয়েছে কোভিড সংক্রমণে, এই মৃতদের অসহায় পরিবারগুলিকে চার লক্ষ টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে । কেন্দ্রীয় সরকার এ প্রস্তাব মানতে অস্বীকার করেছে অর্থের অভাবের অজুহাতে । অথচ বেহিসেবি খরচ সরকার যথেচ্ছ করে চলেছে এবং এক কোভিড সংক্রমনের সময় আদানি আম্বানি সহ বৃহৎ কর্পোরেটদের মুনাফা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে । এদের স্বার্থ সরকার মানুষের জীবনের বিনিময়ে রক্ষা করতে প্রাণপাত করছে । বিপদগ্রস্ত মানুষকে বাঁচানোর ন্যূনতম চেষ্টা না করে সমস্ত জিনিসের দাম বাড়ানোর ব্যবস্থা সরকার পাকাপোক্ত করছে । পেট্রোল ডিজেল খাদ্যশস্য থেকে ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অস্বাভাবিক বেশি যখন মানুষের পকেটে কোন অর্থ নেই । এবং অল্প কিছু মানুষ মাত্র মাসিক আয় থেকে নিজেদের সামাল দিচ্ছে । বেশিরভাগ মানুষের কোন কাজ নেই । উপায়ও অত্যন্ত সঙ্কুচিত ।
এ অবস্থার প্রতিকারে মানুষকে যেমন সহায়তা করতে হবে, তেমনি তাদের সচেতন করতে হবে,গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জাতীয় দাবিসহ তাদের এই জরুরী জীবন বাঁচার দাবিগুলো নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে -- যাতে তারা অভিন্ন দাবি ও চাহিদার ভিত্তিতে একজোট হতে পারে, দয়া নয় তাদের ন্যায়সঙ্গত হক আদায় করতে পারেন ।