ক্রমবর্ধমান প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র ও সংখ্যাগুরুবাদের বিরুদ্ধে লড়াই

ভারতের বিচারব্যবস্থার বর্তমান হাল হকিকত

Nilotpal Basu

নীলোৎপল বসু

প্রায় এক মাস আগে “পিপলস ডেমোক্রেসি” পত্রিকার জন্য একটি প্রবন্ধ লিখি দেশের বিচার ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি সমন্ধে। কৃষি আইন সংক্রান্ত বর্তমান বিতর্কের প্রেক্ষিতে লেখাটি প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি।

২৬শে নভেম্বর ১৯৪৯ এ বাবাসাহেব আম্বেদকর ভারতের সাংবিধানিক গণ পরিষদের সামনে সংবিধানের রচয়িতা সমিতির প্রধান হিসাবে এ দেশের সংবিধানের খসড়া দলিল পেশ করেন। সংবিধানের খসড়া দলিল পেশ করার সময়েই তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত মন্তব্য করেনঃ “আমরা আমাদের এমন এক সংবিধান দিতে চলেছি যার বলে প্রতিটি ব্যাক্তির একটি করে ভোট দেওয়ার সমানাধিকার থাকবে বটে, কিন্তু মানুষ হিসাবে প্রতিটি ব্যাক্তির সমানাধিকার সুনিশ্চিত করার থেকে এখনো আমরা বহু দূরে”। এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে বাবাসাহেব সেই সময়ে দেশের চূড়ান্ত আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের বিষয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছিলেন এবং বারে বারে সংবিধান প্রদত্ত আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিধানের নীতিসমূহের বাস্তবায়নের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সেই প্রজন্মের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন “we the people” এর অতিবৃহৎ ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র কে সম্মিলিত করার গুরুত্ব। সংবিধানের এই সকল মৌলিক বোঝাপড়ার উপর দাঁড়িয়ে একদম সঠিকভাবেই সমান নাগরিকত্ব ও সমান নাগরিক অধিকার প্রদান কে এই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যসাধনের অন্যতম গ্রন্থিরূপে চিহ্নিত করা হয়। সংবিধানের এই মৌলিক ভাবনাগুলিকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রযন্ত্রের তিনটি বিভাগের বিভাজন ও একে অপরের থেকে স্বাতন্ত্র্য’র বিধান দেওয়া হয় এবং এই বিভাজনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রক্ষমতার প্রয়োগের উপর পারষ্পরিক নিয়ন্ত্রণের এবং বিধিনিষেধের এক বন্দোবস্ত করা হয়।  কিন্তু ২০২০ সালের সেই ২৬শে নভেম্বরেই রাষ্ট্রযন্ত্র তার পেশিশক্তি প্রয়োগ করে শ্রমিক কৃষক জনতার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের মৌলিক অধিকারের উপর, যখন সেই জনতা সংসদে স্রেফ সংখ্যাধিক্যের জোরে, কোনো বিতর্ক ছাড়াই পাশ করা কিছু আইনের বিরোধীতা করছিল’। কেন্দ্রীয় সরকারের এই ঘৃণ্য গা-জোয়ারি অবশ্যই মদত পেয়েছে বিচার ব্যবস্থার সংবিধান-রক্ষকের ভূমিকায় ক্রমবর্ধমান গাফিলতির কারণে।

সংবিধানবেত্তা হিসাবে আদালতঃ বিচারব্যবস্থার সংবিধাননির্দিষ্ট ভূমিকা

দেশের সংবিধান সুনির্দিষ্টভাবে বিচারব্যবস্থা কে এমন ক্ষমতা প্রদান করেছে যা তার নির্দিষ্ট স্বাধীন ভূমিকার সাথে সম্পৃক্ত, বিশেষ করে সুপ্রীম কোর্টের ক্ষেত্রে। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা দেখছি যে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থের সাথে সঙ্গত রেখেই দেওয়া হচ্ছে।

অযোধ্যা মামলার রায়ে এই কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবনার সাথে সঙ্গত রেখে চলার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ মিলবে। এই রায়েই এক দিকে বলা হচ্ছে যে ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২ এ একটি “ক্রিমিনাল এক্ট” বা অপরাধ্মূলক কার্য ঘটে বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করার মাধ্যমে এবং সেই মসজিদের স্থানে অতীতে কখনো কোনো মন্দির থাকার  নির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও রায় প্রদান করা হল’ ওই স্থানেই মন্দির নির্মাণের জন্য। ন্যায়বিচার-বিহীন একটি রায় প্রদানের অসামান্য একটি উদাহরণ এটি।

এই রকম বহু রায়ের কথা এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যা এই লেখাটিকে দীর্ঘায়িত করবে, কিন্তু এটুকু বলা যেতেই পারে যে আমাদের সংবিধান খুব সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিকভাবে সংখ্যাগুরুর শাসনক্ষমতা ও সংখ্যাগুরুবাদের মধ্যে বিভাজনরেখা টেনেছে, যার ভিত্তি হল’ সমান নাগরিকত্বের অলঙ্ঘনীয় মতবাদ।

সংবিধানের অন্তরাত্মাঃ ৩২ নং ধারা

 ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সাংবিধানিক গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনা/ বিতর্কের সময় সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা বাবাসাহেব আম্বেদকর বলেনঃ “আমকে যদি এই সংবিধানের কোনো একটি ধারা কে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বলতে বলা হয়, যেই ধারা ব্যাতিরেকে সংবিধানের গুরুত্বই থাকে না, তা হল’ এই ৩২ নং ধারা। এই ধারা সংবিধানের অন্তরাত্মা”। সংবিধানের ৩২ নং ধারা এ দেশে যে কোনো ব্যাক্তিকে এই অধিকার প্রদান করেছে যার বলে তৃতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত কোনো প্রকার মৌলিক অধিকার খর্ব করার চেষ্টা ঘটলে সেই ব্যাক্তি সুপ্রীম কোর্টের বিচার চাইতে পারেন এবং এই ৩২ নং ধারায় প্রদত্ত অধিকার একমাত্র জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময়কাল বাদে আর কখনো লঙ্ঘণ করা সম্ভব নয়। এই ধারার প্রয়োগ ব্যাতীত মৌলিক অধিকারসমূহের রক্ষা অসম্ভব এবং সর্বোচ্চ আদালত যদি এই ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ না করে, সে ক্ষেত্রে, জনস্বার্থ মামলার তাবৎ পরিধিটাই সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই ধারাই সুপ্রীম কোর্টকে সংবিধানের সর্বোচ্চ রক্ষকর্তার ভূমিকায় বসায়। সর্বোচ্চ আদালতের আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, যেমন ৩০ নং ধারার আওতায় প্রশাসন বা আইনসভার কোনো কাজের “জুডিশিয়াল রিভিউ” অর্থাৎ সাংবিধানিক যথার্থতা নিরূপণ করার ক্ষেত্রেও ৩২ নং ধারার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং সেই কারণেই এই ধারাটি কে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা বিরাট।

বর্তমান সময়ে এই ৩২ নং ধারা নিয়ে বিতর্কের অন্যতম সূত্রপাত ঘটেছে সর্বোচ্চ বিচারপতির ২০শে নভেম্বরে কেরলের ধৃত সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের “হেবিয়াস কর্পাস” (কোনো ব্যাক্তি বা ব্যাক্তিসমূহকে অন্যায্য বা বেআইনি গ্রেপ্তারি/ আটক করে রাখার বিরুদ্ধে সংবিধানের ৩২ নং ধারার আওতায় দায়ের করা মামলা) মামলায় করা মন্তব্যঃ “আমরা এই ৩২ নং ধারার আওতায় মামলা করা কে নিরুৎসাহিত করতে চাইছি”। এদিকে সেই একই প্রধান বিচারপতি সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীর দায়ের করা একই হেবিয়াস কর্পাস মামলায় মহারাষ্ট্র বিধানসভার সচিবের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করার সময় মন্তব্য করেন “৩২ নং ধারা থাকতে উনি এমন কথা বলার সাহস পান কোত্থেকে?” অর্ণব গোস্বামী কে জামিন দেওয়া নিয়ে সমস্যা না থাকলেও এই প্রশ্ন অবশ্যই করা যায় যে একই ধরনের অন্যান্য মামলায় এমন চোখে পড়ার মত বৈপিরিত্য ঘটছে কেন? বারে বারে সুপ্রীম কোর্ট একই ধরনের অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে প্রমাণাভাব অথবা পুলিশ বা অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থার তরফে মারাত্মক আইন লঙ্ঘণের ঘটনা থাকা সত্ত্বেও আবেদনকারীদের প্রতি যে ঔদাসিন্য দেখিয়েছে , তার থেকে এই ধারণা দৃঢ়তর হচ্ছে যে সর্বোচ্চ আদালত কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবনা এবং ক্রিয়ারই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে, তার স্বতন্ত্র ভূমিকা বিসর্জন দিয়ে।

প্রতিবাদের সাম্প্রদায়ীকরণঃ ভিমা কোরেগাঁও এবং দিল্লীর সাম্প্রদায়িক হিংসা

বর্তমান মোদি সরকারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল’ ভিন্নমত এবং প্রতিবাদকে “অপরাধের” তকমা দেওয়া। সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত বা আইন পাশ করার বিরুদ্ধে যে কোনো বৈধ প্রতিবাদকেও বেআইনি বা অসাংবিধানিক বলে দাগিয়ে দেওয়ার ঘটনা লাগাতার ঘটে চলেছে। এই ধরণের দাগিয়ে দেওয়াই আদতে সংবিধানবিরোধী কাজ। ৩২নং ধারার উপজীব্যই হল’ সরকারের সিদ্ধান্ত এবং কাজের সাংবিধানিক পদ্ধতিতে ন্যায্য বিরোধীতা।

এই সকল প্রতিবাদ কে “অপরাধের” তকমা দেওয়া হচ্ছে “রাষ্ট্রদ্রোহিতার” জিগিড় তুলে, যেই শব্দেরই কোনো উল্লেখ নেই গোটা সংবিধানে। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় NIAর ভূমিকা বা উত্তর প্রদেশ সরকারের তরফে নাগরিকত্ব আইন বিরোধীদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারী প্রসাশনিক ব্যবস্থাগ্রহণ, তাদের সম্পত্তি বেআইনি ভাবে বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে কিংবা সেই সকল প্রতিবাদীদের ছবি হোর্ডিঙে টাঙিয়ে দিয়ে তাদের অপমানিত করার চেষ্টা অথবা উত্তর পশ্চিম দিল্লীতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে পুলিশের ভুমিকা সবই কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রবৃত্তির পরিচায়ক। পুলিশ প্রশাসনের এই ভূমিকা আদতে কেন্দ্রীয় শাসকদলের রাজনৈতিক ভাষ্যেরই স্বপক্ষে মদত যোগানোর জন্যই।

পুলিশ ও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির উপরোক্ত ভূমিকা দুইভাবে আজকাল দেখা যাচ্ছে। প্রথমে কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোড অফ ক্রিমিনাল প্রোসিজিওরের আওতায় মামলা রুজু করা হচ্ছে, কিন্তু সেই সকল মামলায় আদালতে জামিন আটকানো সম্ভব হচ্ছে না পুলিশের পক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে। দ্বিতীয় প্রবণতা হল’ প্রমাণাভাবে যাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মুক্তি না পায়, সেই জন্য “রাষ্ট্রদ্রোহীতার” নাম করে UAPA জাতীয় অত্যুগ্র আইনের আওতায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে, যার বলে বিনা বিচারে, সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব থাকা সত্ত্বেও প্রতিবাদীদের দিনের পর দিন জেলবন্দি করে রাখা সম্ভব। এই দ্বিতীয় পন্থাটি আজকাল পুলিশ বা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী বা গোয়েন্দা সংস্থা অবলম্বন করছে কোনোরকমের কারণ না দর্শিয়েই, রাজনৈতিক বিরোধীতাকে দমন করার জন্য। এই পদ্ধতিতেই বিনা কারণে তাবৎ রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে “দেশদ্রোহী” বা “আর্বান নকশাল” জাতীয় তকমা লাগানোর ব্যাপক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় লব্ধ তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছেই এই সব “আর্বান নকশাল” জাতীয় শব্দবন্ধের সংজ্ঞা বা সেই শব্দ প্রয়োগের কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতিই নেই।   

এতদসত্ত্বেও উপরোক্ত এই পুলিশি পদ্ধতি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বিচার ব্যবস্থার ভূমিকা কেমন, তা পর্যবেক্ষণ করাটা জরুরি হয়ে ওঠে।  নাগরিকদের সংবিধানপ্রদত্ত স্বাধীনতা ও অধিকারসমূহের রক্ষায় বিচারব্যস্থার সম্পূর্ণ পিছু হঠে যাওয়া এই সময়ের এক যন্ত্রণাদায়ক বাস্তবতা। এই “নতুন ভারতের” বিচারব্যবস্থার উপরোক্ত অবস্থান একের পর এক ঘটনার মধ্যে দিয়ে আজ আমাদের সামনে সুস্পষ্ট। সে দিল্লী দাঙ্গার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তারি হোক, অসাংবিধানিক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের উপর দমন পীড়ন হোক, ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় বয়স্ক বুদ্ধিজীবি আন্দোলনকারীরাই হ’ন কিংবা রাজনৈতিক কারণে বন্দি করে রাখা কাশ্মীরি মানুষ হ’ন, আদালতের উদাসীনতা আজ পরিষ্কার। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮৩ বছর বয়সী এক পাদ্রী এবং মানবাধিকার কর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামী কে, যিনি দুরারোগ্য পার্কিনসন্স রোগের শিকার। জেল থেকে তিনি আবেদন করেছিলেন যে জল খাওয়ার জন্য যেন’ তাঁকে একটি “সীপার” মঞ্জুর করা হয়। এই সামান্য দাবীটুকু তৎক্ষণাৎ মেনে নেওয়ার পরিবর্তে অদ্ভুতভাবে NIA কোর্ট সরকার কে দু সপ্তাহ সময় দেয় এই আবেদনের “জবাব” দেওয়ার জন্য!

দুর্বোধ্য অগ্রাধিকার

 বর্তমানে সুপ্রীম কোর্ট বহু অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দায়ের করা মামলা, যেমন কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলোপ, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কিংবা নির্বাচনী বন্ডের আইন, শুনানি করার তারিখ ঘোষণা করে উঠতে পারছে না যেখানে তুলনামূলকভাবে বহু কম গুরুত্বের মামলা দায়ের করার অল্প সময়ের মধ্যেই শুনানির দিন ধার্য করে দেওয়া হচ্ছে।

উপরোক্ত বিষয়ে মামলাগুলি সাংবিধানিক কাঠামো, শাসনব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক পরিসরের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সকল মামলা কে সরিয়ে রেখে অন্যদিকে সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীকে অতি দ্রুত জামিন প্রদান করা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একইরকমভাবে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনর্থক কিছু অত্যুগ্র আইনের আওতায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রুজু করা মামলার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ আদালতের নীরবতা লক্ষ্যণীয় যেখানে সাধারণ ফৌজদারি আইনের আওতাতেই এই মামলা দায়ের করা সম্ভব হত’। একটি ক্ষেত্রে এলাহাবাদ হাই কোর্টের একটি রায় কে বলবত করার সুযোগই দিল না সুপ্রীম কোর্ট সেই রায় কে বৃহত্তর সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়ে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের এই রায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের দ্বারা রাজনৈতিক প্রতিবাদীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত  করে তাদের নাম জনসমক্ষে ঘোষণা করার বিরুদ্ধে ছিল’। সর্বোচ্চ আদালতের এই অসমান দৃষ্টিভঙ্গি আরো মদত যুগিয়েছে রাজনৈতিক প্রশাসকদের এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় থাকা সত্ত্বেও “লাভ জিহাদ” জাতীয় বিষয়ে নির্লজ্জভাবে আইন পাশ করার যেখানে হাইকোর্টের রায় বারংবার সঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাক্তির স্বাধীনতাকে সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য করেছে।

স্বনামধন্য আইনজীবি প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে দায়ের করা আদালত অবমাননার মামলা আরেকবার সর্বোচ্চ আদালতের এই অদ্ভুত অগ্রাধিকারের মানসিকতাকে প্রমাণ করে। প্রশান্ত ভূষণের যে ট্যুইটকে কেন্দ্র করে এই আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা হল’ সেই ট্যুইটের মর্মবস্তুই ছিল’ আদালতের এই দুর্বোধ্য অগ্রাধিকার প্রদানের বর্তমান প্রবণতা। এই সকল ঘটনার থেকে যে প্রশ্ন যথাযথভাবেই জাগে, তা হল’ সংবিধানপ্রদত্ত স্বাধীনতা ও অধিকারসমূহের রক্ষা করার পরিবর্তে সর্বোচ্চ আদালত যদি তার ন্যায্য সমালোচনা বন্ধ করতেই তৎপর হয়ে ওঠে তবে আর কীসেরই বা সাংবিধানিক আদালত আর কীসেরই বা গণতন্ত্র!  

কিছু আশাপ্রদ বিষয়

 সর্বোচ্চ আদালতের তরফে উপরোক্ত নৈরাশ্যব্যাঞ্জক ভূমিকা সত্ত্বেও বহু রাজ্যের হাইকোর্ট এবং সেশন্স কোর্টের তরফে এই সময়ে সংবেদনশীলতা, বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ চিন্তাভাবনা এবং সাংবিধানিক মর্মবস্তুকে রক্ষা করার সৎ প্রয়াস লক্ষ্যনীয়। বোম্বে হাইকোর্টের পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত মামলায়, বোম্বে ও গুজরাট হাইকোর্টের কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে রায়ে, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ডাক্তার কাফিল খানের গ্রেপ্তারির মামলায় UAPA আইনের অপসারণ, বোম্বে হাইকোর্টের ঔরঙ্গাবাদ বেঞ্চ এবং মাদ্রাজ হাইকোর্টের তরফে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলনের অধিকারের স্বপক্ষে রায় প্রদান নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ঘটনা। ঝারখন্ড, তেলেঙ্গানা এবং ত্রিপুরা হাইকোর্টের তরফেও এই ধরনের রায় প্রদান করা হয়েছে।

বিভিন্ন আদালতের তরফে দিল্লী দাঙ্গায় অভিযুক্তদের জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে দিল্লী পুলিশের তরফে অন্যায্যভাবে UAPA আইনের প্রয়োগ চিহ্নিত করা হয়েছে।

আরেকটি ইতিবাচক বিষয় হল’ বহু নামী আইনবেত্তা ও সুপ্রীম কোর্ট ও বিভিন্ন হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতিদের তরফ থেকে সোচ্চার প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে সর্বোচ্চ আদালতের ন্যায়প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার বিরুদ্ধে। এই সকল প্রতিবাদ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করছে সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার উপর নেমে আসা প্রবল বিপদ সম্বন্ধে।

লড়াই জারি রয়েছে

সরকারের ফ্যাসিস্ত প্রবণতা যে রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল অঙ্গকেই প্রভাবিত করে, তা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এই কঠিন পরিস্থিতিতে বিচারব্যবস্থার উপর বাড়তি দায়িত্ব এসে পড়ে সংবিধানকে রক্ষা করার। সংখ্যাগুরুবাদ যখন নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে আইনসভা ও প্রশাসন কে করায়ত্ত করে তখন সেই সংখ্যাগুরুবাদ বিভিন্ন সাংবিধানিক পদেও তাদের পক্ষে সহানুভূতিশীল আধিকারিকদের খুঁজে নিতে সক্ষম হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বর্তমানে লক্ষ্যনীয় যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, নির্বাচন কমিশন, CAG জাতীয় স্বাধীন সংস্থার স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে যা কীনা সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার পরিপন্থী। এই পরিস্থিতিতে বিচারব্যবস্থার গুরুদায়িত্ব থাকে এই সকল প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতাহরণের প্রচেষ্টা কে প্রতিহত করার। বলাই বাহুল্য যে সরকার যেই কার্য কারণই দেখাক না কেন’ তার নিজের স্বার্থে, নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারসমূহকে নস্যাৎ করা যায়না। এই দায়িত্বপালনে গাফিলতি দেশের মানুষের কছে তথা গোটা বিশ্বের কাছে এই বার্তা বহন করে যে দেশে গণতন্ত্র ভেঙে পড়ছে। বিশ্বের একটা বিরাট সংখ্যক গণমাধ্যমে

আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে যে সকল মতামত বা পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করা হচ্ছে তাতে ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রমাবনতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

সব শেষে সাধারণ মানুষকেই উদ্যোগী হতে হবে এই পচন কে রোধ করার জন্য। বিচারব্যবস্থার এই ক্রমবর্ধমান বিচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াই আদতে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের নেতৃত্বে ক্রমবর্ধমান প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র ও সংখ্যাগুরুবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই অংশ।   


শেয়ার করুন

উত্তর দিন