Site icon CPI(M)

Meghnad Saha: A Memoir

Meghnad Saha Cover

সৌরভ চক্রবর্তী

প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানী ডক্টর মেঘনাদ সাহার আজ ১৩০ তম জন্মদিবস। তিনি যা বলে গেছেন, তিনি যা করে গেছেন তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

মেঘনাদ সাহা শুধুমাত্র উজ্জ্বল এক বিজ্ঞানী ছিলেন না, তন্বিষ্ট সমাজমুখী এই বিজ্ঞান সাধক, সমাজের গ্লানি, চিন্তা-চেতনার দীনতা, জাতপাত, পশ্চাদগামী চিন্তার বিরুদ্ধে প্রখর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি প্রয়োগ করে শাণিত আয়ুধে

সংগ্রাম করে গেছেন আজীবন। নিজেকে যুক্ত করেছিলেন দেশের পরাধীনতার শৃংখল মোচনের সংগ্রামে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সকল প্রয়োগে ভারতীয় সমাজকে বিশ্বের দরবারে  উন্নীত এক সমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্রতই  শুধু নেননি, তাকে কার্যকরী করার জন্য জীবন পণ করেছিলেন।

বিজ্ঞানী হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে তার স্থান ছিল অত্যুজ্জ্বল।বিশ্বের প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানীদের স্বীকৃতি তিনি অর্জন করেছিলেন।নিজের বিজ্ঞান প্রযুক্তি সাধনার ফলকে প্রয়োগ  করতে চেয়ে ছিলেন ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক উন্নয়নের স্বার্থে। সে কারণেই যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। বিপুল মানুষের সমর্থন নিয়ে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে

লোকসভার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন ভারতবর্ষের একমাত্র বিজ্ঞানী হিসেবে। বিরল প্রতিভাধর এই মানুষটি তাঁর বিপুল সম্ভার নিয়ে আজও আমাদের পথপ্রদর্শক। আজকের যুগসন্ধিক্ষণের

সংকট বিন্দুতে তার আয়ুধেই আমাদের রণসজ্জা।

জাতপাতের বিরুদ্ধে কষাঘাত

মেঘনাদ সাহা জন্মেছিলেন অসচ্ছল এক পরিবারে কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার থেকেও নির্মম ছিল জাতের মার। বর্ণের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন শূদ্র। প্রেসিডেন্সী কলেজে  ছাত্রাবস্থায়, ইডেন হিন্দু হোস্টেলে এক পঙ্কক্তিতে খেতে অস্বীকার করেছিল তারই সতীর্থরা। অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে দেখতে শিখেছিলেন ভারতীয় সমাজের এই কুৎসিত ব্যাধিকে।

পরিণত বয়সে তিনি সখেদে  মন্তব্য করেছিলেন,” আমার মতে এই জাতিভেদ প্রথা হস্ত ও মস্তিষ্কের মধ্যে যোগসূত্র সম্পন্ন ছিন্ন করিয়া দিয়েছে এবং এই জন্য ভারতে বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতা ইউরোপ, আমেরিকার বহু পশ্চাতে পড়িয়া রহিয়াছে।

বস্ত্রবয়ন, ভূমিকর্ষণ, স্থাপত্যবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা ইত্যাদিতে বহুকাল হইতে ভারতে নতুন কোন প্রক্রিয়া উদ্ভাবিত হয় নাই। ইহার কারণ জাতিভেদ প্রথা অনুসারে মস্তিষ্কের কাজকে  খুব বড় করিয়া এবং সমস্ত হাতের কাজকে ছোট  করিয়া দেখা – সেজন্য মস্তিষ্ক ও হস্তের যোগসূত্র সম্পূর্ণ ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। “

এ বিষয়ে তিনি আরও বলেছিলেন, ” কসাইয়ের ছেলের যদি প্রতিভা থাকে তাহলে ইউরোপে সে সেক্সপীয়ার হইতে পারিত, এদেশে প্রাচীন প্রথা অনুসারে সে “রবীন্দ্রনাথ” বা “কালিদাস” হইতে পারিত না। হইবার চেষ্টা করিলে ভগবানের অবতার রামচন্দ্র স্বয়ং আসিয়া তাহার মাথা কাটিয়া বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষা করিতেন।”

“বৈদিক চরকার পর বয়ন শিল্পে প্রায় ৮০০ টি নতুন আবিষ্কার হয়েছে, তারই ফলে বিরাট বয়ন শিল্পের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। এই সমস্ত উদ্ভাবকদের মধ্যে হারগ্রীভস ছিলেন নিরক্ষর, আর্করাইট ছিলেন পরামানিক, কার্টরাইট ছিলেন গ্রাম্য পাদ্রী, বাষ্পীয় যন্ত্রের উদ্ভাবন কর্তা জেমস ওয়াট ছিলেন কর্মকার ও যন্ত্র সংস্কারক। তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্ল্যাংক এর সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন বলিয়াই বাষ্পীয় যন্ত্র উদ্ভাবনে সক্ষম হইয়াছিলেন।” এ তাঁর জীবন যন্ত্রনাজাত গবেষণার ফল। বৈদিক সমাজজাত এই নিষ্ঠুর এবং প্রণোদনাহীন অনুৎপাদক এক আর্থিক ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল বর্ণাশ্রম প্রথা। এরই বিরুদ্ধে তীব্র কষাঘাত তাঁর।

বৈদিক সভ্যতা, জ্যোতিষের অতিকথন

স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে এই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় জ্যোতিষ শাস্ত্র শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষান্তে ডিগ্রী দেওয়ার কথা ঘোষণা করলো গত বছর ২৪ শে জুন । কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত IGNOU দু বছরের দূর শিক্ষায় ( এম. এ, জ্যোতিষ) কোর্সে ভর্তির জন্য এ বছর আবেদন জানিয়ে ঘোষণা করেছে।

এর সাথে মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট, গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি, ইন্টার কন্টিনেন্টাল বিমান চলাচল ইত্যাদিতো আছেই।

এ বিষয়ে মেঘনাদ সাহার গবেষণালব্ধ ফল হলো বৈদিক ও  অব্যবহিত পরবর্তী ভারতে বলার  মতো কোনও জ্যোতিষ বিজ্ঞান, বিজ্ঞান – প্রযুক্তির অস্তিত্বই ছিল না।

তিনি বলছেন,  ” খৃঃ অব্দের ৮০ সন পর্যন্ত ভারতীয় নিজস্ব জ্যোতিষ বা কাল গণনা প্রণালী অতিশয় অশুদ্ধ ছিল এবং তৎ পূর্ববর্তী মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থে কুত্রাপি পৃথিবীর আবর্তন বেগ ও সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ স্বীকৃত হয় নাই। আনুমানিক ১০০  খ্রীস্টাব্দের পরে বোধহয় উজ্জয়িনীর শক রাজাদের সময় হইতে (যাহারা পারসিক প্রভাবান্বিত ছিলেন) পাশ্চাত্য কলডিয়ান ও গ্রিক জ্যোতিষ ভারতে আসতে আরম্ভ করে। তখন ভারতীয় জ্যোতিষিকগন পৃথিবীর আবর্তন বেগ ইত্যাদি স্থূলভাবে স্বীকার করিতে আরম্ভ করেন।”

একটা উদাহরণ দিয়েছেন তিন।”  ভারতীয় নিজস্ব জ্যোতিষ যাহা খৃঃ পূঃ ১৪০০ শককাল (৮০ খৃঃঅব্দ) পর্যন্ত প্রচলিত ছিল তাহা এত অশুদ্ধ যে সামান্য দৃষ্টান্ততেই বোঝা যাইবে।এই সিদ্ধান্ত মতে ৩৬৬  দিনে বৎসর হয় অর্থাৎ বৎসর গণনায় পিতামহ ব্রহ্মা প্রায় ১৮ ঘণ্টা ভুল করিয়া ছিলেন কিন্তু ইহার বহু পূর্বেই খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ইজিপশিয়ান, বেবিলোনিয়ান এবং কিছু পরে গ্রিক ও রোমানগন  প্রায় ৩৬৫  এবং এক-চতুর্থাংশ দিনে যে বৎসর হয় তাহা জানিতেন।

এর পরে তিনি কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন। তিনি বলছেন,”  বাস্তবিক পক্ষে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের পর হইতে হিন্দু জ্যোতিষিক পণ্ডিতগণ বেহুলার মত মৃত সভ্যতার সব আলিঙ্গন করিয়া বসিয়া আছেন এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত অতি ভুল পদ্ধতিতে বর্ষ গণনা করিতেছেন।

তিনি আরো বললেন,” হিন্দু তিথি ইত্যাদি গণনা শুভ-অশুভ দিনের মতবাদ কতকগুলি মধ্যযুগীয়  ভ্রান্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত হিন্দু পঞ্জিকা একটা কুসংস্কারের বিশ্বকোষ মাত্র।

এক কথায় তিনি এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করছেন, “কাজেই হিন্দুর সমস্তই “ব্যাদে” আছে একথা প্রস্তরীভূত পন্ডিত অভিমানী ব্যতীত এই যুগে কেহ বলিতে সাহসী হইবেন না। পশ্চাৎগামী মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে  তাঁকে বড়ো প্রয়োজন আজ। 

বিশ্বের দরবারে উজ্জল জ্যোতিষ্ক

মূলত তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞান। তিনি তাপ আয়নন তত্ত্ব  ও নক্ষত্রের শ্রেণীবিন্যাসে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার করেন, সেইসাথে বিকিরণের চাপ, পরমাণু বিজ্ঞান, তাপ গতিতত্ত্ব, বর্ণালী বিজ্ঞান, আয়নস্ফিয়ার সম্পর্কে প্রভূত গবেষণা তিনি করেন।পরমাণু বিজ্ঞানের গবেষণা তার পরিণত বয়সে একটি বিজ্ঞান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার  ভূমিকা বলে মনে করা হয়। অনেকে মনে করেন, তাঁর তাপ আয়নন তত্ত্বের সাহা সমীকরণের থেকে জাতীয়তাবাদের ফসল ” “ইন্স্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিকস ” মেঘনাদ সাহার সেরা কীর্তি। তাঁরই প্রয়াসে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম পরমানু পদার্থবিদ্যা পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়।

মেঘনাদ সাহার আয়নন তত্ত্ব নক্ষত্রের বর্ণালীর বৈচিত্র নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করে। হাইড্রোজেন, ক্যালসিয়াম, আয়রন প্রভৃতি বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের উত্তেজিত আয়নিত অবস্থার সঙ্গে নক্ষত্রের উষ্ণতা ও চাপের নিবিড় সম্পর্ক থেকে নক্ষত্রের শ্রেণীবিন্যাস শুধু ব্যাখ্যা করা যায় তাই নয়,  নক্ষত্রের আভ্যন্তরীণ অবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়।

বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী এডিংটনের মতে “সাহা  তাপ আয়নন তত্ত্ব, গ্যালিলিওর  দূরবীন প্রয়োগের পর, জ্যোতির্বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ দশটি আবিষ্কারের অন্যতম বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।” মেঘনাদ সাহার তত্ত্ব  প্রয়োগ করে  নক্ষত্রের আবহ মন্ডলের রাসায়নিক উপাদান, উষ্ণতা, তাপগতীয় সাম্য থেকে বিচ্যুতি, সেখানে মৌলিক পদার্থের আপেক্ষিক প্রাচুর্য, মহাকর্ষ বলের মান এমনকি আবহমন্ডলের গতিবিধির ধারণা পাওয়া যায়।

১৯২১ সালে তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা তিনি করেছিলেন।

১) সূর্যের বায়ুমণ্ডলে বিকিরণ ঘটিত সাম্যবস্থা ও নির্বাচনমূলক চাপ

২) হাইড্রোজেনের  গৌন বর্ণালী

৩)সৌর ক্রমোস্ফিযারের আয়নন

সৌরমন্ডলে এবং নক্ষত্রের আয়ননে  তাপমাত্রা ও চাপের প্রভাব বিশ্লেষণ ছিল এসব গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য। এরই ওপর ভিত্তি করে এলো সাহা আয়নন তত্ত্ব।সেই সঙ্গে জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা, নিউক্লিয় পদার্থ বিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে ভারতবর্ষে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যা  গবেষণার পথিকৃৎ হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।

বিজ্ঞান সাধক মেঘনাথ সাহা শুধু যুগান্তকারী বিজ্ঞান ও গবেষনা এবং আবিস্কারক  ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান সংগঠক। তিনি এদেশের বিজ্ঞান চর্চার পথকে সুগম করার জন্য যেমন নানা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা করেছেন তেমনি সরকারি নীতি প্রণয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। শুধু বিজ্ঞান গবেষণাগারে নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি বরং গবেষণার ফল যাতে বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তার জন্য তিনি ভগীরথ এর মত পথ তৈরি করেছেন। এখানেই মেঘনাথ সাহা অনন্য।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনার শুরুতেই মেঘনাথ সাহা এবং সত্যেন বোস যুগ্মভাবে সর্বপ্রথম আইনস্টাইন ও মিনকোয়াস্কির জার্মান ভাষায় লিখিত আপেক্ষিকতাবাদের উপরের প্রকাশিত গবেষণা পত্রগুলো ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন।

১৯২০ র দশকেই তিনি গোটা বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।

স্বয়ং আইনস্টাইন বলেছিলেন, ” ডক্টর মেঘনাদ সাহা সারা বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সমাজের শ্রদ্ধা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন।” নরওয়ের জ্যোতিঃপদার্থবিদ উইন রসল্যান্ড  মেঘনাথ সাহা সম্পর্কে  লিখেছিলেন, ” যদিও বোরকে পরমাণু তত্ত্বের অগ্রদূত বলা হয়ে থাকে, আমার মতে পরমাণু তত্ত্বকে কেন্দ্র করে মহাকাশের তারকারাজির বর্ণালীক্রম নিয়ে একটি সুসজ্জিত তত্ত্ব তৈরি করে ( ১৯২০) সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী, তার নাম মেঘনাথ সাহা। ১৯২৭ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলো মনোনীত হন। ১৯৩১ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় উত্তরপ্রদেশ অ্যাক্যাডেমি অফ সাইন্স প্রতিষ্ঠা করেন, পরের বছর থেকে এই সংগঠনের নামকরণ করা হয় ন্যাশনাল অ্যাক্যাডেমি অফ সাইন্স, ইন্ডিয়া। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

১৯৩৩ সালে সূচনা করেন ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের সংগঠন ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি।

এখান থেকে প্রকাশিত হতে থাকে ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ফিজিকস সাময়িকী।

১৯৩৪  সালে  ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ২১ তম অধিবেশনে  সভাপতি হন তিনি।

তাঁর উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স যা  ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি নামে বর্তমানে পরিচিত।

১৯৩৫ সালে জনপ্রিয় বিজ্ঞান  প্রচারের জন্য সায়েন্স এন্ড কালচার পত্রিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটেনের নেচার আমেরিকার সায়েন্স পত্রিকার মত এই পত্রিকা যাতে বিজ্ঞান ও জনসাধারণের মধ্যে যোগ সাধন করতে পারে এজন্য ওই পত্রিকায় তিনি অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। এই পত্রিকা প্রকাশের জন্য তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন এর প্রতিষ্ঠা করেন। ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও প্রথম যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মেঘনাথ সাহা ও বিধুভূষণ  রায়।

এই পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রথম সংখ্যায় যা প্রকাশিত হয়েছিল তা হল, এই পত্রিকা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার আধুনিক আবিষ্কার সাধারণের বোধগম্য ভাষায় প্রকাশ করবে। তাছাড়া গ্রামোন্নয়ন, যানবাহন ব্যবস্থা, শক্তি উৎপাদন ও বন্টন, শ্রমনীতি তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যেখানে যোগসূত্র আছে তা নিয়ে সরকারি নীতির আলোচনা পত্রিকায় প্রকাশিত হবে।

১৮৭৬ সালে মহেন্দ্রলাল সরকার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৮ সালে সিভি রমন এখান থেকেই তার বিশ্ব বিখ্যাত রমন এফেক্ট ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ফিজিকস এ প্রকাশিত হয়। ১৯৩০ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

এখানে সেইসময় আলোকবিজ্ঞান এবং চুম্বকত্ব নিয়ে কাজ হতো।

১৯১৩  সাল থেকেই মেঘনাথ সাহা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স এর সাথে যুক্ত ছিলেন কিন্তু ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পরিচালনায় তার কোনও ভূমিকা ছিল না। হাজার ১৯৪৬ সালে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স এর সভাপতি হন তখন ৬টি বিভাগ খোলা হয়। কাজকর্মের প্রসার অনেকটাই  প্রসারণ ঘটে। তখন আর ২১০ নম্বর বউবাজারে প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না তাই যাদবপুরে ১০  একর জমি কেনা হয়।

একটা সমস্যা এসে দাঁড়ায় যে তিন বছরের বেশি সভাপতি থাকা যাবেনা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্সে।তখনও  পর্যন্ত আইএসএসের  সবসময়ের ডিরেক্টর পথ ছিলনা। ১৯৫২ সালে  ডক্টর এস এস ভাটনগরের প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকার আই এ সি এস এর জন্য সবসময়ের ডিরেক্টরের  পর সৃষ্টি করেন।

ভাটনগরের পরামর্শে আইএসসিএস এর পরিচালক মন্ডলী মেঘনাদ সাহাকে সর্বসময়ের ডিরেক্টর পদ গ্রহণের অনুরোধ করেন। ১৯৫০ এ মেঘনাথ সাহা পালিত অধ্যাপকের পদ ছেড়ে দেন এবং আইএসিএস এর ডিরেক্টর পদ গ্রহণ করেন এবং ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এর আজীবন অনারারি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন।

১৯৫০সালে প্রতিষ্ঠা করেন ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যা বর্তমানে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নামে পরিচিত।

অনেকে মনে করেন সাহা সমীকরণের চেয়ে জাতীয়তাবাদের ফসল  ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিকস মেঘনাথ সাহার সেরা কীর্তি।

পঞ্জিকা সংস্কার

ভারতে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন মত অনুসরণ করে নানা পঞ্জিকা চলে আসছে। ১৯৫২ সালে  ভারত সরকার মেঘনাথ সাহার সভাপতিত্বে একটি ক্যালেন্ডার রিফর্মস কমিটি গঠন করেন। ৩০ টি বিভিন্ন ভারতীয় পঞ্জিকা পর্যালোচনা করে মেঘনাথ সাহা এই কমিটির রিপোর্টে বলেছেন যে, “ভারতের ইতিহাসের মতোই তার পঞ্জিকা ব্যবস্থারও চূড়ান্ত বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে। ” ১৯৫৫  সালে

কমিটি রিপোর্ট পেশ করে একটি দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা প্রণয়নের কথা বলে।

আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সমিতির সঙ্গে সহযোগিতায় ভারতের পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ প্রকাশ করে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ নদী পরিকল্পনা

বোম্বে সায়েন্স কংগ্রেস অধিবেশনে মূল সভাপতির ভাষণে মেঘনাথ সাহা নদী বিজ্ঞান গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে তার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন।

এম এস সি পড়ার সময় ছাত্রাবস্থায় বন্যা ত্রাণে তারকেশ্বর এবং উলুবেড়িয়ায় অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন।

তিনি প্রায়ই কৌতুক ক’রে তাঁর জন্মস্থানের কথা বলতেন,” সেখানে কথা শেখার আগে বাচ্চারা সাঁতার শিখে যেতো, কারণ গ্রাম  বছরে ৪ মাস জলমগ্ন থাকতো। জীবনের এই অভিজ্ঞতা তাঁকে ভবিষ্যতে দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রন ও নদী পরিকল্পনা রচনায় প্রণোদনা জুগিয়েছিল।

দামোদর উপত্যকার বন্যাতে তার নদী ও বন্যা সম্পর্কে প্রথম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা জাগে ১৯১৩ সালে। ১৯২৩  সালে উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যায় কলকাতা থেকে দার্জিলিং বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সাইন্স কলেজে আচার্য্য  প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বন্যাত্রাণ কমিটি গঠন করেন, মেঘনাথ সাহা এবং অন্যরা সাহায্য  করতে এগিয়ে আসেন। এগিয়ে আসেন সুভাষ চন্দ্র বোস। মেঘনাদ সাহার সাথে সুভাষের পরিচয় দৃঢ়  হয়। মর্ডান রিভিউতে উত্তরবঙ্গের বন্যা নিয়ে এবং তার প্রতিকার নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন মেঘনাথ সাহা। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ৭০ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থে হাইড্রোলিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার আবশ্যিকতার  কথা বলেন। সায়েন্স অ্যান্ড কালচার, ১৯৪৪ এ প্ল্যানিং ফর দ্য দামোদর ভ্যালি নিবন্ধ ভারতের নদী পরিকল্পনার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অবদান।

মেঘনাথ সাহা টেনেসী ভ্যালী অথরিটি ( টিভিএ) র  মত একটি কর্তৃপক্ষের অধীনে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন গঠনের পরামর্শ দেন। তদানীন্তন ভাইসরয়ের ক্যাবিনেট সদস্য আম্বেদকরের সাথে এই নিয়ে বারবার  আলোচনা করেছেন। আম্বেদকরের  আগ্রহে ভারত সরকার অবশেষে ডিভিসি গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

নদীর বহুমুখী বিকাশ পরিকল্পনার ভিত্তিতে দামোদর পরিকল্পনার পরিকল্পনায় জলবিদ্যুৎ জলসেচ প্রভৃতি  গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছিলেন ১৯৪৭  সালে, মাল্টিপারপাস ডেভলপমেন্ট অফ ইন্ডিয়ান রিভার প্রবন্ধে। সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প কে নিয়ে কিন্তু তাকে আমল দেওয়া হয়নি।

জাতীয় পরিকল্পনা

কংগ্রেস দলের চরকা ও খাদি আন্দোলনকে তিনি একেবারেই সমর্থন করতেন না। তার মতে চরকা ও খাদির  মত অকেজো প্রযুক্তি দিয়ে দেশের উন্নতি হবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্রমবিপ্লবের  যে সূচনা হওয়া প্রয়োজন চরকা ও খাদি আন্দোলনের স্লোগান তাকে পশ্চাদমুখী করবে।তিনি চিরকাল এই বিশ্বাসে দৃঢ় সংকল্প  ছিলেন যে আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির সাহায্যে অন্য উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও জীবনের মান বাড়ানো প্রয়োজন। ১৯৩৮ সালে মেঘনাদ সাহা নেতাজীকে ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ অধিবেশনের সভাপতিত্ব করার আহ্বান জানান। নেতাজি সুভাষ বোস তখন কংগ্রেসের সভাপতি।

ওই সময়ে জাতীয় পরিকল্পনা সম্পর্কে সাইন্স এন্ড কালচার এ তিনি তাঁর মতামত প্রকাশ করেছিলেন। নেতাজি মেঘনাথ সাহা কে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির সূচনা করতে আহ্বান জানান। ফলে মেঘনাথ সাহা’কে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতিদের সংস্পর্শে আসতে হয়। শিল্পপতি গোষ্ঠী অর্থনৈতিক উন্নয়নে তখন বোম্বে পরিকল্পনায়  প্রাইভেট ও পাবলিক সেক্টরের মিশ্র অর্থনীতির পরামর্শ দিয়েছিলেন।

নেতাজী সুভাষ বোসকে  ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ অধিবেশনে স্বাগত জানিয়ে মেঘনাথ সাহা তাকে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রশ্ন করেন। “আমি জানতে চাইব যে ভবিষ্যতে আমরা কি গ্রামীণ জীবনের গরুর গাড়ির প্রযুক্তিতে ফিরে যাবো অথবা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে আধুনিক শিল্পের সাহায্যে দেশের দারিদ্র অজ্ঞতার সমস্যার সমাধান করব এবং অন্য দেশের সঙ্গে গৌরবের আসন নিয়ে এক নতুন সভ্যতা গড়ে তুলব? কংগ্রেস  কয়েকটি রাজ্য সরকার গঠন করেছে অথচ ভবিষ্যতের শিল্পায়নে যথেষ্ট বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে।”

নেতাজি বলেন,” আমি কুটিরশিল্পের প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে নই, যেখানে সম্ভব তার পুনরুজ্জীবন করা যেতে পারে তবে আমি মনে করি ভারতের আর্থিক উন্নয়নে শিল্পায়নের ভূমিকা মুখ্য হবে। অবশ্য বাংলার গভর্নর স্যার জন অ্যান্ডারসন যে ছাতার বাঁট তৈরী ও বেল মেটালস প্লেট  কারখানা কে শিল্প বলছেন আমি সেরকম শিল্পের উন্নয়নের মধ্যে শিল্পায়নের অর্থ খুঁজে পাইনা।”

নেতাজির দেশ উন্নয়নের পরিচ্ছন্ন ধারণা মেঘনাথ সাহাকে আকৃষ্ট করেছিল, তিনি তাই অন্য নেতাদের তুলনায় নেতাজিকে স্বাধীনত্তোর ভারতের যোগ্য কর্নধার মনে করতেন।

১৯৩০  সাল থেকেই মেঘনাদ সাহা স্বাধীন ভারতের আর্থিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন সমস্যার কথা ভেবে এসেছেন।বিভিন্ন প্রবন্ধে বক্তৃতায় তিনি স্বাধীন ভারতের যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছেন তা শুধু রাজনীতিতে নয় অর্থনীতি, সমাজনীতি, প্রযুক্তিবিদ্যারও বিপ্লব  প্রয়োজন।

তার মতে কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিপরীত। কংগ্রেসের এই দৃষ্টিভঙ্গীকে চরকা ও গরুর গাড়ি সংস্কৃতি বলে বর্ণনা করে তিনি বলতেন এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের প্রযুক্তিগত বিপ্লবের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে। হাজার ১৯৫০ সালে পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হলো। ১৯৫২ সালে মধ্যবর্তী রিপোর্ট, ১৯৫৩ সালে শিল্পনীতি সংক্রান্ত রিপোর্ট পেশ হল।

মেঘনাথ সাহা এইসব রিপোর্টে আশাপ্রদ ভবিষ্যৎ খুঁজে পাননি তিনি কমিশনের রিপোর্টের কঠোর সমালোচনা করেন। মপঘনাদ সাহার এ  বিষয়ে বক্তব্য ছিল যে স্বাধীনতার পর দেশে মাথাপিছু আয় এত কমে গেছে যে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। চোরাকারবার ও অন্যান্য কারণে ধনীদের হাতে বেশি অর্থ জমা হয়েছে গরিবের দারিদ্র বেড়েছে। কংগ্রেসের পরিকল্পিত শ্রেণীহীন সমাজের পরিবর্তে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে। তিনি পি সি মহলানবীশ এর গাণিতিক সূত্র দিয়ে এক প্রবন্ধে প্রমাণ করেন যে কমিশনের পরিকল্পনা কত অসার। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠার ধারণায় নেহেরু ও মেঘনাদ সাহার মধ্যে মত পার্থক্য ছিল। মেঘনাথ সাহা কৃষি কে উপেক্ষা করে গ্রামোন্নয়নে বাধা দিতে চাননি তবে কৃষি থেকে চাপ কমিয়ে শিল্পের প্রসার তার অভিপ্রেত ছিল।

রাজনীতি

১৯৫২ সালে বামপন্থীদের সমর্থনে উত্তর-পশ্চিম কলকাতা কেন্দ্র থেকে শিল্পপতি প্রভুদয়াল হিম্মৎসিংকার বিরুদ্ধে মেঘনাথ সাহা প্রার্থী হন এবং বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ভারতবর্ষের প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন কিন্তু তিনি কেন রাজনীতিতে এলেন এ সম্পর্কে সায়েন্স অ্যান্ড কালচার, ১৯৫৩ সালে,  রিথিংকিং অফ ফিউচার নিবন্ধে বলেছেন, ১৯৩৮  সালে যুক্ত প্রদেশে ডক্টর কে এন কাটজু দেশলাই কারখানার উদ্বোধন করে বলেন,” এই দেশলাই কারখানা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা বৃহৎ শিল্পায়নের পথে এক বিরাট পদক্ষেপের সূচনা করলাম।” ভাষণের এই অংশটিতে আমি  আঘাত পেয়ে ছিলাম।

প্রথম সারির একজন কংগ্রেস নেতা যিনি রাজ্যের শিল্পের প্রসার উন্নয়ন ও পুনর্গঠন এর দায়িত্বে আছেন তার বক্তৃতায় বৃহৎ শিল্প সম্পর্কে তার যে ধারনাই নেই তা জানিয়ে দিলেন। সবার একই অবস্থা। এরা যখন ক্ষমতায় আসবেন দেখা যাবে এরা যেন ডাঙ্গার প্রাণী জল পর্যন্ত দেখেন নি অথচ তাদের মহাসমুদ্রে জাহাজ চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই ভাবনা থেকেই আমি রাজনীতির দিকে  সরে আসার প্রেরণা অনুভব করি।

আমি মনে করি আইন-শৃংখলার মত বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও প্রশাসনের একটি প্রয়োজনীয় অংশ। আমি আমার নিজের পথে দেশের কাজ করতে চাই। “

লোকসভায় মেঘনা

১৯৩৬  সালে  বিদেশি অয়েল রিফাইনারির মাধ্যমে ডক্টর ভাটনগর ১৯৫১  সালে বার্মা শেল  আসাম অয়েলের বিপুল অনুদান পান। সিএসআইআর এর কর্ণধার হিসেবেই সাহার  সমালোচনার হাত থেকে তিনি রেহাই পাননি।

১৯৫২ সালে  ভারত সরকার দেশে তৈল অনুসন্ধানে  আমেরিকান কোম্পানির সহায়তার চুক্তি করে।

মেঘনাথ সাহা লোকসভায় এর তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, “আমেরিকার সব প্রাকৃতিক উৎস দ্রুত দ্রুত গতিতে খরচ করে অন্য দেশের দিকে হাত বাড়াচ্ছে তাদের তৈল অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া যায় না। তারা অক্টোপাসের মতো ভারতকে জড়িয়ে ধরতে চায়।

একথায় কংগ্রেস এবং ভাটনগর কেউই খুশি হননি।

লোকসভায় নদী পরিকল্পনা নিয়ে অপব্যয় ও অবাঞ্ছিত নিয়োগের  তীব্র সমালোচনা করেন তিনি।

সিন্ধ্রি সার কারখানা তদানীন্তন শিল্পগোষ্ঠী ও শ্রীরামের হাতে তুলে দেবার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র সওয়াল করেন। তিনি বলেন, ” বেসরকারি শিল্পপতিদের হাতে সার কারখানা তুলে  দেওয়ার অর্থ হলো, যাদের এই কারখানার পেছনে কোন শ্রম বা দায়-দায়িত্ব নেই তারা শুধু মুনাফাই লুঠবে।

১৯৪৭  সাল থেকে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন এর কাজের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। সরকারি পরিকল্পনার আগেই অনেক কাজ তিনি এ বিষয়ে করেছেন।

বিদেশি পুঁজির কোম্পানি ভারতীয় বাজারে আধিপত্য করুক এটা তাঁর কাম্য নয়। লোকসভায় একাধিকবার বিতর্কে তার এই মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে।

মেঘনাদ সাহা বাজেট ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ  পরীক্ষা তিনি করতেন।

যেসব দেশি কোম্পানি বিদেশি সহযোগিতা চেয়েছে বাধা দিয়েছেন। তার মতে এই সহযোগিতা অপমানজনক এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার দালালের  ভূমিকা নিতে পারেনা।

নেহেরু সাহার শানিত বক্তব্যে উত্তেজিত হয়ে পড়তেন।

বিশিষ্ট লেখক জগজিৎ সিং এমিনেন্ট ইন্ডিয়ান সাইন্টিস্ট এ  লিখছেন পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র নিয়ে সাহার নানা মন্তব্যে তাকে অনেকের কাছে অপ্রিয় করে তুলেছিল।

এই প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানী আদতে প্রকৃত বিপ্লবী ছিলেন। এই বিপ্লবী সত্তার প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর বিদ্যালয় ছাত্রাবস্থায়। ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবার পরিনামে তাকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়। কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের ছাত্রাবস্থায় মেসে নিয়মিত যাতায়াত করতেন বাঘাযতীন। অনুশীলন সমিতির সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে মেঘনাদ সাহাকে সরকারী চাকুরীর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়নি। বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশ এবং তার সহায়তায় দেশের শিল্পায়ন, নদী পরিকল্পনা, বিজ্ঞান শিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞান মনস্কতার বিকাশ ঘটিয়ে দারিদ্র,কূপমন্ডুকতা, পশ্চাদপদ চিন্তা, জাতপাতের অভিশাপমুক্ত, বিদেশী পুঁজির নাগপাশ মুক্ত এক উন্নত দেশ গঠনের স্বপ্ন এঁকে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা। এই আপোষহীন দৃঢ়চেতা কৃতসঙ্কল্প ব্যক্তিত্বের চিন্তা ও কাজ সম্পর্কে অনেক বেশি প্রচার হওয়া প্রয়োজন বর্তমান সঙ্কটকালে। তার চিন্তা ও কাজই আমাদের হাতিয়ার বর্তমান সময়ের মোকাবিলায়। এ কাজ আমাদের করতেই হবে।

ঋণ স্বীকারঃ

১) মেঘনাদ সাহা,জীবন ও সাধনা – সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র

২) উৎমানুষ সংকলন

শেয়ার করুন