অরিন্দম কোঙার
আমাদের দেশে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশকে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে যাঁরা আজীবন ব্রতী ছিলেন, তাঁদের অন্যতম মুহম্মদ আবদুল্লাহ্ রসুল। ১৯২১ সালে ১৮ বছর বয়সে পরাধীন ভারতে মানববমুক্তির সংগ্রামী জীবনে প্রবেশ, প্রস্থান ১৯৯১ সালে স্বাধীন ভারতে। রেখে যান এক স্বাধীনতা সংগ্রামী, এক অনুসরণযোগ্য কমিউনিস্টের জীবন।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র নেতা মুহম্মদ আবদুল্লাহ রসুলের জন্ম ১৯০৩ সালের ১০ জুন বর্ধমান জেলার মেমারী থানার শলদা গ্রামে (শলদা-মামার বাড়ি, নিজেদের বাড়ি-মেমারী থানার কেজা গ্রামে) এবং মৃত্যু ১৯৯১ সালের ২১ নভেম্বর কলকাতায়। সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী আদর্শ কমিউনিস্ট অকৃতদার আবদুল্লাহ্ রসুল ভারতের কৃষক আন্দোলনের সামনের সারির একজন নেতা। অশক্ত শারীরিক অবস্থার জন্য তিনি নিজেই স্বেচ্ছায় নেতৃত্বের পদ থেকে অব্যহতি চেয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক শৈলেন দাশগুপ্তকে শেষ চিঠিতে লেখেন, ‘‘এই সঙ্গে বলে রাখি যখন নতুন সম্পাদকমন্ডলী হবে তার প্যানেলে আমার নাম যেন না থাকে। তবে কমরেডদের আপত্তি না থাকলে আমি পিসি-তে থাকতে চাই। তা না থাকলে আমাকে পার্টি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। দু’তিন মাস অন্তর একবার পিসি মিটিং হলেও তখন অন্তত কমরেডদের সঙ্গে দেখাটা হবে।’’(০২.১১.৯১)অবশ্য রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় রসুলের মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালের ১১-১৫ ডিসেম্বর। উল্লেখ, সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী)-র আত্মপ্রকাশ ঘটলে তিনি প্রথম থেকে আমৃত্যু পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ও সেই সঙ্গে রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন ১৯৮২-৮৮সালে। বয়স ও অসুস্থতার কারণে নিজেই এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।
‘বিশ্ববিপ্লবের পথিকৃৎ’,‘মহান বিপ্লবী কার্ল মার্কস’, ‘ভূমি ও কৃষি সমস্যা : লেনিনবাদের আলোকে’‘প্রলেতারীয় সংস্কৃতি : লেনিনবাদের আলোকে’, ‘দুটি জটিল সামাজিক সমস্যা’ ইত্যাদি প্রবন্ধে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবদুল্লাহ্ রসুল দেখিয়েছেন মার্কসবাদের উদ্ভব ও তার বিকাশ কেমনভাবে হয়েছে, মার্কসবাদের প্রয়োগ ঘটিয়ে সমাজের পরিবর্তন ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান কিভাবে হয়েছে। রসুলের ভাষায়,‘‘মার্কসবাদ সমগ্র মানবজাতির সবচেয়ে অগ্রণী ও বৈজ্ঞানিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি, এ যুগের প্রধান বিপ্লবী শ্রেণী প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী দার্শনিক মতবাদ। এই মতবাদকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণী পৃথিবীকে পরিবর্তন করছে ও করবে।’’ (বিশ্ববিপ্লবের পথিকৃৎ) প্রচারবিমুখ, আত্মম্ভরিতামুক্ত আবদুল্লাহ্ রসুল সহজ ভাষায় সাম্যবাদ সম্পর্কে আলোচনা করে লিখেছেন, ‘‘পার্টি শিক্ষাই পার্টি কর্মীদের মধ্যে সমালোচনা ও আত্ম-সমালোচনার যোগ্যতা বাড়াইতে সাহায্য করে, ভুলত্রুটি সংশোধন করিয়া পার্টিকে নির্ভুল পথে পরিচালিত করিতেও তাহাদের সাহায্য করে। পার্টি-শিক্ষাই পার্টি-মেম্বারদের ব্যক্তিবাদীমত ও বিচ্যুতি হইতে এবং আত্মপ্রচার ও অহমিকা হইতে মুক্ত করিয়া তাহাদের মিলিত প্রচেষ্টার পথে চলিতে সাহায্য করে।’’ (কমিউনিজম কাহাকে বলে)।
সারা ভারত কৃষক সভার প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক (১৯৪৭-৫৩) মুহম্মদ আবদুল্লাহ্ রসুল অবিভক্ত ভারত, বিশেষ করে বাংলার গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছেন, মানুষকে সংগঠিত করেছেন, কষ্টের মধ্যে থেকেছেন, আনন্দ পেয়েছেন, অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘এমনি একদিন হাঁটতে হাঁটতে খিদেয় প্রাণ যায়। কোথাও কিছু পাওয়া যায় না। এক জায়গায় পথে দেখা গেল একজন কৃষক মাথায় এক ঝুড়ি কাঁঠাল নিয়ে হাটে যাচ্ছে। পাকা কাঁঠালও ছিল। একটা কিনে জলের ধারে বসে তাকে অতি সন্তর্পণে ভেঙে (যাতে হাতে বেশি আঠা না লাগে) তিনজনে খেয়ে শেষ করলাম। এই ধরনের অভিজ্ঞতা সেকালে কৃষক কর্মীদের হতো। মাঠের আল বা কাঁচা রাস্তা ছাড়া পাকা রাস্তা ও যানবাহন ছিল অত্যন্ত বিরল।’’ (গ্রামে গ্রামান্তরে) কিন্তু এই কষ্টের মধ্যেও পেয়েছেন কত আনন্দ। তাঁর ভাষায়,‘‘বালি(বর্তমান বাংলাদেশে) ছেড়ে যাবার দিন মাঠ দিয়ে যাবার সময় হান্নান আর পিছু ছাড়ে না। বেশ কিছুদুর যাবার পর তাকে বললাম, হান্নান ভাই, আর কতদুর যাবে? সে ফোঁস করে কেঁদে ফেললে এবং বসে পড়ে আমার পায়ে হাত দিলে। বললে, আর হয়তো কখনো দেখা হবে না। আমি তাকে হাত ধরে তুলে আশ্বাস দিলাম দেখা হবে। এই কদিনের ঘনিষ্ঠতাই মানুষকে কত আপন করে ফেলে।’’ (গ্রামে গ্রামান্তরে) উল্লেখ্য, ১৯৩৮-৪৪ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৭-৭২সালে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভার সম্পাদক,
(২)
১৯৪২-৫৪, ১৯৫৫-৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক সভার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন মুহম্মদ আবদুল্লাহ্ রসুল। কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর দুটি বিখ্যাত বই – কৃষক সভার ইতিহাস, A History Of The All India Kisan Sabha.
ছোট-বড় দাবি নিয়ে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে, কিন্তু সেই আন্দোলনের মুল লক্ষ্য সম্পর্কে বারে বারে সচেতন করেছেন আবদুল্লাহ্ রসুল। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষক সভা, তার আন্দোলন ও সংগ্রাম জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটা প্রধান অংশ। অন্যান্য অংশগুলির মধ্যে আছে শ্রমিক, ছাত্র, যুব, শিক্ষক, নারী প্রভৃতি সমাজের বিভিন্ন অংশের ও স্তরের জনগণ এবং সাধারণভাবে আছে সমস্ত শ্রমজীবী জনগণ আর তাদের সকলের নেতৃত্বে আছে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণী। কৃষকসভার কর্মীদের এই সত্যটি সব সময়ে মনে রাখা দরকার, যাতে গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষক সভার আন্দোলনকে সার্বিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।’’ (কৃষক সভার ইতিহাস — চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা)। কৃষক আন্দোলনের তাগিদে সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় তিনি দিনের পর দিন প্রচার চালিয়েছেন, তুলে ধরেছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাস এবং শেষ পর্যন্ত লিখে ফেলেছেন ‘সাঁওতাল বিদ্রোহের অমর কাহিনী’ নামে পুস্তিকা যা সাঁওতালী ভাষায় অনুদিত হয়ে হয়েছে ’হড় হপন কোআ বিরাদ কাহিনী’। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের দুর্বলতা লক্ষ্য করে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘‘কৃষক আন্দোলনকে বিপ্লবী ধারায় চালিত করতে হলে যে বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন, বর্তমানে আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে তার অভাব আছে। অধিকাংশ কর্মী ও নেতা শ্রমিক বা খেতমজুর ও গরিব কৃষকশ্রেণী থেকে আসেনি, এসেছে পেটি-বুর্জোয়া অথবা ধনী ও মাঝারি কৃষক পরিবার থেকে। তাদের সামাজিক যোগসূত্র ও দীর্ঘকালের শিক্ষার উপর প্রভাব থেকেছে প্রলেতারীয় চিন্তাধারার নয়, মতবাদ ও রাজনীতির দিক থেকে সংস্কারবাদী চিন্তাধারার। সেই কারণে কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গি ও কাজের ধারা সংশোধন ও পরিবর্তন করা জরুরী হয়ে পড়েছে।’’ (বিপ্লবের নেতা শ্রমিকশ্রেণী)
শুধু তত্ত্বগতভাবে নয়, জীবনের অভিজ্ঞতায় মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মুহম্মদ আবদুল্লাহ্ রসুল দেখিয়েছেন যে, সাম্প্রদায়িক প্রতিরোধে শ্রেণীসংগ্রাম কি রকম কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্ট কলকাতায় বীভৎসতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, দু’দিনে প্রায় ৫০০০ মানুষের প্রাণ যায়। অক্টোবর মাসে দাঙ্গা বাধে নোয়াখালিতে এবং তারপর দাঙ্গা বাংলার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত এই সাম্প্রদায়িক গণহত্যার সরকারী হিসেবে ১২,৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়। এই পটভূমিকায় ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা তেভাগা আন্দোলন (বর্গাদারের জন্য ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ ভাগের দাবি) –এর ডাক দেয়। দিনাজপুর জেলার আটোয়ারি থানা এলাকায় এই আন্দোলন শুরু হয় নভেম্বর মাসে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাংলার অধিকাংশ জেলায়, শহীদ হন ৭৩ জন। এই আন্দোলন চলে ১৯৪৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত।(দ্বিতীয় পর্যায়ে তেভাগা আন্দোলন চলে ১৯৪৮-৪৯ সালে)। অধিকার প্রতিষ্ঠায় গড়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক বিরোধের মোকাবিলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। আবদুল্লাহ্ রসুল তাই লিখেছিলেন, সমাজের ইতিহাসের এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, সাধারণ শ্রমজীবী জনগণকে সম্প্রদায়গত চিন্তা ও মানসিকতার দুর্বলতা থেকে রক্ষা করবার একমাত্র নিশ্চিত উপায় তাদের শ্রেণীস্বার্থ সম্বন্ধে তাদের সচেতন ও সংগঠিত করে শ্রেণী-সংগ্রামের মধ্যে নিয়ে আসা, শ্রেণী শোষণ থেকে স্থায়ী মুক্তির জন্য শ্রেণীগত বিপ্লবের পথে পরিচালিত করা।’’ (সাম্প্রদায়িকতা বনাম শ্রেণী সংগ্রাম)।
(৩)
সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা মুহম্মদ আবদুল্লাহ্ রসুল মনে করতেন, ‘‘ভূমি-বিপ্লব ও কৃষক মুক্তির বিপ্লবকে সফল করে তুলতে হলে একদিকে যেমন কৃষকের রাজনৈতিক সংগ্রামে তার বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমাজবাদী চেতনার স্তরে তোলা দরকার, তেমনি কৃষক স্বার্থে রচিত শিল্পকর্মগুলির মধ্যেও সমাজবাদী চিন্তাধারার সুস্পষ্ট প্রতিফলনও একান্ত প্রয়োজন। এই দুইয়ের সমন্বয়ের ভিতর দিয়েই কৃষকের শিল্প-সংস্কৃতি সার্থকতা লাভ করবে।’’ (কৃষকের শিল্প-সংস্কৃতি)। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তেলার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি দেখিয়েছেন যে, কেমনভাবে বিশ শতকের চারের দশকে বাংলায় কৃষক সভার সঙ্গে গণনাট্য সঙ্ঘের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে ছৌ, গম্ভীরা, জারি, ভাটিয়ালি, আখড়ার কীর্তন, সত্যপীরের পালা, লেটো, মনসার ভাসান, বাউলের গান, কবিয়ালি ইত্যাদি বিভিন্ন রূপের শিল্পের স্রস্টা গ্রামের কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ। সুতরাং উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সাধারণ মানুষের শিল্পবোধ আছে, শিল্প রুচি আছে, শিল্পের চাহিদা আছে আর এই শিল্প হচ্ছে তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভুত। আবদুল্লাহ্ রসুল মনে করতেন, ‘‘প্রলেতারিয় সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির পুষ্টি ও অগ্রগতিতে সাহায্য করবার পক্ষে বাংলার সাহিত্য ও শিল্পকলা এখনো যথেষ্ট উন্নত হতে পারেনি। গণআন্দোলনের প্রবল স্রোতের সঙ্গে তা তাল রাখতে পারছে না। উপন্যাসে শ্রমিক ও কৃষকদের জীবনকে যারা চিত্রিত করে তাদের রচনা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একপেশে, একঘেয়ে এবং তার মধ্যে থাকে
তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও অভাব-অভিযোগের বর্ণনা, অপ্রয়োজনীয় অতিরঞ্জন। সম্ভবত সেসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে এবং রোম্যান্স করবার আগ্রহের ফলে তা ঘটে থাকে।’’ (প্রলেতারীয় সংস্কৃতি: লেনিনবাদের আলোকে)। তিনি নিজে কৃষক জীবন, কৃষক আন্দোলনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখেছেন ‘আবাদ’, ‘শহর থেকে গ্রামে’, ‘ছিটেফোঁটা’ (মৃত্যুর পর প্রকাশিত)-র মতো উপন্যাস। ‘আবাদ’ উপন্যাসটি আবার মালয়ালাম ও জাপানী ভাষায় অনুদিত হয়েছে। যদিও তিনি এগুলিকে উপন্যাস না বলে, কাহিনী বলেছেন আর নিজেকে সাহিত্যিক বলে মনে করতেন না।
মৃদুভাষী আবদুল্লাহ্ রসুল তাই সাহিত্যিকদের পরামর্শ দিয়েছেন মৃদু ভাষায়। তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, ‘‘কৃষক জীবন সম্বন্ধে সাহিত্য রচনা করতে হলে প্রথেমেই দেখতে হবে সে লেখার ভাষা যেন হয় সহজ ও সরল, যা সাধারণ কৃষক পড়ে বা শুনে বুঝতে পারে। যেন হয় সজীব ও সরল এবং রাজনীতিক চিন্তা ও প্রেরণায় সমৃদ্ধ; যেন তার মধ্যে প্রতিফলিত হয় চলতি মামুলি জীবনের তুলনায় আরো উন্নত জীবন ও চরিত্র, বাস্তব ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন গুণের সমাবেশে আদর্শ ধরনের কিন্তু বাস্তবসম্মত, সতেজ, তীক্ষ্ণ, আত্মত্যাগী ও জনপ্রিয় চরিত্র। চরিত্র অবশ্যই এক রকমের হবে না। তার মধ্যে ভালো ও মন্দের পার্থক্য ও বিরোধকে তুলে ফরতে হবে।’’ (জনগণের বিপ্লবী শিল্প-সাহিত্য)। শিল্পী-সাহিত্যিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ্ রসুল ছিলেন একজন উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক। ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের সময়ে গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী কলাকুশলী সম্মেলন প্রতিষ্ঠায় (বর্তমান নাম গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ) ও পরবর্তী কালে এই সংগঠন পরিচালনায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বিশ্বাস করতেন,‘‘পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় একটু খোঁজ করলেই এমন বহু ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে যাদের কোন না কোন সাংস্কৃতিক কর্মের প্রতি আকর্ষণ ও আগ্রহ আছে। তাদের ভিতর থেকে বাছাই করে নিতে পারলে অনেক উৎকৃষ্ট সম্ভাবনাময় শিল্পকর্মী আবিষ্কার করা যেতে পারে। শিল্পকর্মের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে কার কোন দিকে প্রবণতা বেশি তা বিবেচনা করে তাদের শিক্ষা দিতে পারলে সাংস্কৃতিক সংগঠনের একটা বড় প্রয়োজন মিটতে তারে।’’ (সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠন)।
আন্দোলনের জন্য চাই সচেতনতা। আর সেই চেতনার বিকাশে সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পরিবহন মন্ত্রী (১৯৬৯-জানুয়ারি,১৯৭০) আবদুল্লাহ্ রসুল লিখেছেন, ‘‘নিরক্ষরতা দুর করবার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী কাজে সাহায্য করাকে বর্তমান যুক্তফ্রন্ট সরকারের উচিত সামগ্রিক দায়িত্ব বলে গ্রহণ করা, তাকে একটা বিশেষ দপ্তরের বিষয় বলে উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে বিচার না করা জনগণের মৌলিক সাংস্কৃতিক স্বার্থেরই পরিপন্থী। বেসরকারীভাবেও নিরক্ষরতা দুর করার কাজে সাহায্য করা, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কৃষক সভার এবং ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলির নিকট একটা বিশেষ দায়িত্ব বলে গণ্য ও স্বীকৃত হওয়া উচিত।’’ (প্রলেতারীয় সংস্কৃতি: লেনিনবাদের আলোকে)। সাক্ষরতার সঙ্গে সচেতনতা ও সক্ষমতাকে যুক্ত করতে ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মসুচী যুক্ত করা আবশ্যক। আবদুল্লাহ্ রসুলের উপন্যাসে ঠিক এই কথাই বলা হয়েছে। তাঁর শেষ উপন্যাস ‘ছিটেফোঁটা’–র মুল চরিত্র হালিম হাশেমির মৃত্যুর পর উপন্যাসে আছে, ‘‘একজন কিশোর বললে হালিম চাচার সঙ্গে দেখা হলেই তিনি বলতেন, স্কুল যাচ্ছিস তো ? খেলার মাঠে যাস ? শিক্ষা সংস্কৃতি না থাকলে তোরা মানুষ হতে পারবি না। সব সময় সেদিকে নজর রাখবি।’’
ভারতে বর্তমানে নয়া উদারবাদ চলছে, কর্পোরেট সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে, স্বৈরাচারী আক্রমণে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে দেশের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ক্রমশ বিপদাপন্ন হচ্ছে। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে ধর্মকে যুক্ত করে রাষ্ট্রকে তথাকথিত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-এর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই সব বিপদ ২০২৪ সালে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য উল্লেখযোগ্যভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ করা গেছে। নয়া-ফ্যাসিবাদের হোতা নরেন্দ্র মোদীর অপরাজেয়তায় বড় ধরণের আঘাত পড়েছে। কিন্তু এই প্রতিরোধ স্থায়ী রূপ নিতে পারে না অবিরত গণসংগ্রাম ব্যতি রেখে। জনগণের ঐক্য আরো দৃঢ় করতে হবে। ভিত্তি ও উপরি কাঠামোয় সংগ্রাম প্রসারিত করতে হবে। গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে হবে। বিকল্প শক্তি হিসাবে বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে দাঁড় করাতে হবে। আমরা জানি মুহম্মদ আবদুল্লাহ্ রসুল আমাদের প্রেরণা হিসাবে সব সময়েই আলোকবর্তিকার ভূমিকা গ্রহণ করছেন।