‘‘চিতা যখন জ্বলছে
তোমরা চাও আমি আলোর কথা বলি
বলব আলোর কথা।’’
চাঁদপুরের চিত্তপ্রিয় ঘোষ প্রয়াত হয়েছেন। যে মহামারী পুঁজিবাদের জামা কাপড় খুলে নিয়েছে, সেই করোনা কেড়ে নিয়েছে ‘হৃৎকমলের’ শঙ্খ ঘোষকে।
অনুব্রত মন্ডল বলেছিলেন,‘‘...এ কোন নতুন কবি উঠে এলো..শঙ্খ নাম দেওয়াটা ঠিক হয়নি।’’ আমাদের কাছে ‘শঙ্খ ঘোষ’ নামটি পুরোন। চিরন্তন। কারন উজ্বল সাংস্কৃতিক ধারাকে অস্বীকার করা প্রতিক্রিয়ার ধর্ম। যা কিছু ভালো, সুন্দর, অনুপ্রেরণার আধার তাকে চ্যালেঞ্জ করা, ধ্বংস করা পুঁজির দর্শনের মন্ত্র — শ্রমিক শ্রেণীর মতাদর্শের ধর্ম তা নয়।
![Lockdown 2](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/04/5.jpg)
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/11/IMG_20201117_215910.jpg)
বিশ্বায়নের ধারণা মুখ থুবড়ে পড়েছে নর্দমায়। বিশ্বায়নের প্রবক্তারাই নিজের নিজের দেশের সীমানায় নতুন করে পাঁচিল তুলে বলছে কাউকে ঢুকতে দেব না। আমাদের দেশেও সমস্যার মূল হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টায় ‘বহিরাগত’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ ইত্যাদি উচ্চারণের মাধ্যমে শাসকরা টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তবে শ্রমের জন্য সীমানা তোলেনি। তার মধ্যেও শ্রমজীবী মানুষ ‘পরিযায়ী’ হচ্ছেন। সমস্যার দায় তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। করোনা, লকডাউন দেখালো — মূল কাঠামোগত সমস্যাকে আড়াল করে সংক্রমণের জন্যও পরিযায়ীদের আক্রমণ করা হচ্ছে।
যারা কাজের বন্দোবস্ত করতে পারে না, তারাই শস্তা শ্রমের আধারদের বাড়ি ফেরার মরীয়া চেষ্টাকে ‘করোনা এক্সপ্রেস’ বলে চিহ্নিত করেছেন। ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। সেই পরিযায়ী শ্রমিকরাই আবার রাজ্যে কাজ না পেয়ে ভিন রাজ্যে ছুটেছেন। এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় তারা আরও দিশাহারা। লকডাউনে বিধ্বস্ত শ্রমিকরা। পরিযায়ীরা ঘরে ফেরার জন্য অমানবিক যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। কেউ কেউ নিজেদের স্ত্রী, মায়ের গয়না বন্দক দেওয়া টাকায় বাড়ি ফেরার বন্দোবস্ত করেছেন। কারও পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রী করতে হয়েছে। কেউ কেউ হাজারও কিমি হেঁটেছেন। কোনও সুরক্ষা তাঁদের জন্য বন্দোবস্ত করতে পারেনি কোনও সরকার। পথে মৃত্যু হয় অনেকের। এই বিষয়ে সংসদে ২০২০’র ১৫ই সেপ্টেম্বর প্রশ্ন করা হয়েছিল। মোদী সরকারের শ্রমমন্ত্রী সন্তোষকুমার গাঙ্গোয়ার সংসদে জানিয়েছিলেন লকডাউনে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক মারা গিয়েছেন তার বিন্দুবিসর্গ জানে না কেন্দ্র। চারঘণ্টার নোটিসে লকডাউনের জেরে বাড়ি ফিরতে গিয়ে বা অন্যান্য কারণে কতজন মারা গিয়েছেন? এর জবাবে তিনি জানান, ‘এমন কোনও তথ্যই নেই’ সরকারের কাছে। তুমুল সমালোচনার মুখে শ্রমমন্ত্রী মুখ না খুললেও ১৯শে সেপ্টেম্বর রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল শুধু শ্রমিক স্পেশালে ৯৭ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। এ’তো হিমশৈলের চূড়া মাত্র। রাষ্ট্রীয় নৃশংসতার চেহারা আরও মারাত্মক। সিএমআইই’র সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে গত এপ্রিলে দেশে বেকারীর হার ফেব্রুয়ারি, মার্চের থেকেও বেড়েছে। মার্চে দেশে বেকারীর হার ছিল ৬.৫%। এপ্রিলে তা ৮%-এ পৌঁছোবে বলেই সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি(সিএমআইই)-র রিপোর্ট জানাচ্ছে। একশো দিনের কাজের গড় গত আর্থিক বছরে কমেছে — দেশে এবং রাজ্যেও। গ্রামের অথবা শহরের — শ্রমজীবীদের আয় কমেছে। বেকারী বেড়েছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। সংগঠিত এবং অসংগঠিত উভয় অংশের শ্রমিকের অবস্থাই খারাপ হয়েছে। হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদী সরকারের মনে হয়েছে নতুন শ্রম আইন কোড চালু করা উচিত।
তার আগে রাজ্যে রাজ্যে এই কাজগুলি শুরু হয়ে গেছিল। ২০২০’র ৭ই মে সিপিআই(এম)-র সাধারন সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘মুনাফার রাস্তা সহজ করার জন্য শ্রমিকদের জীবন এবং আরও লক্ষ মানুষের জীবনকে এইভাবে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন রাজ্যে আপনার দলের পরিচালিত সরকারগুলি এবং দেশের সরকার যাতে শ্রম আইন ও ফ্যাক্টরি আইনের পরিবর্তন না করে সেটা আগে নিশ্চিত করুন।’’
কেন? কারন ওই সময়েই উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানার মত রাজ্যগুলিতে শ্রম আইন শিথীল করার কাজ শুরু হয়ে গেছিল।
তারপর ১৯শে সেপ্টেম্বর। করোনায় বিধ্বস্ত দেশ এবং লকডাউনে বিপর্যস্ত শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগে শিলমোহর লাগানো হলো বিজেপি’র পক্ষ থেকে সংসদে। আনলক পর্বে সংসদ খুলতেই এবারে কেন্দ্রে। সামাজিক নিরাপত্তা, শিল্প সম্পর্ক এবং পেশাগত নিরাপত্তা সংক্রান্ত তিনটি শ্রম কোড লোকসভায় পেশ করল সরকার। যেখানে মালিকদের দেওয়া হলো ছাঁটাই ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ারের’ একতরফা সুযোগ। ধর্মঘট করার ক্ষেত্রে চড়া জরিমানা, জেল থেকে এমন সব কঠোর শর্ত চাপানো হয়েছে, যে ধর্মঘটের অধিকারই আক্রান্ত হবে। এমনকি ‘মাস ক্যাজুয়াল লিভ’কেও ধরা হবে ধর্মঘট হিসেবে, হবে গণহারে শাস্তি। ধর্মঘটের নোটিশ দেওয়ার দিনকেই বোঝাপড়া শুরু দিন হিসেবে ধরে নেওয়া হবে, সে বোঝাপড়া হোক আর না হোক, আর তা না হওয়া পর্যন্ত ডাকা যাবে না ধর্মঘট।
মোদী সরকারের আনা শ্রম আইন কোড তিনটি হলো — অ্যকুপেশানাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশনস কোড ২০২০, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড ২০২০ এবং কোড অন সোশাল সিকিউরিটি ২০২০।
প্রসঙ্গত, ২৯টি শ্রম আইনকে মিশিয়ে যে চারটি কোডে আনা হয়, তার একটি বিল আগেই পাশ করানো হয়েছিল ২০১৯-এ — কোড অব ওয়েজ বিল ২০১৯। ন্যূনতম মজুরির কী হলো? সেই আইনে দেশের গড় ন্যূনতম মজুরি ঠিক হয়েছে ১৭৮ টাকা। আগে ছিল ১৭৬ টাকা। কিভাবে এই মজুরি ঠিক হলো, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। ওয়েজ কোড জানিয়েছে, এবার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার একটি সাধারন গড় মজুরি ঠিক করবে। বিভিন্ন রাজ্য সেখানকার অবস্থা বিচার করে সেই মজুরির পরিমাণের কিছু হেরফের করতে পারে। তবে এই আইন সেখানেই প্রযোজ্য হবে, যেখানে শ্রমিক ২০-র বেশি। অর্থাৎ আইনের ফাঁককে ব্যবহার করে বিরাট অংশের শ্রমিক ওই ন্যূনতম মজুরি পাওয়ার থেকেও সহজেই বঞ্চিত হবেন।
২০২০’র সেপ্টেম্বরে আইন হওয়া কোড কেমন? আগে ছিল, ১০০ জনের নিচে কোনও সংস্থায় ছাঁটাই বা ক্লোজার করতে হলে সংশ্লিষ্ট সরকারের কোনও অনুমতি নিতে হবে না। এখন তা বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। ৩০০ জনের নিচে কর্মী থাকলে নিয়োগের মুখ্য শর্তে আর বিধিবদ্ধ চুক্তি করতে হবে না। অর্থাৎ, আরও ব্যাপক ছাঁটাই, ক্লোজারের অধিকার। আরও কী? নতুন শ্রম কোড এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভাকে এড়িয়ে যে কোন সময় সরকার তার খুশিমত কোড বদলাতে পারে। অর্থাৎ, শ্রমিকদের ভোটে জেতা প্রতিনিধিদের কোনও ভূমিকাই থাকছে না। রাষ্ট্র নিজেই নিজেকে দুর্বল করছে এবং লগ্নিপুঁজির দাপটের অস্ত্র হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকেও যথেচ্ছ সঙ্কুচিত করা হয়েছে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/10/swp-general-strike.jpg)
সংসদে শ্রমমন্ত্রী নতুন শ্রম আইন কোডের প্রশংসা করতে গিয়ে দাবি করেন, শ্রম আইনগুলিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধা আরও ব্যাপক হবে। যদিও ইন্টারস্টেট মাইগ্রেশান ওয়ার্কমেন্স অ্যাক্ট, ১৯৭৯ তুলে দেওয়া হয়েছে, যে আইনে এতদিন পরিযায়ী শ্রমিকদের নথিভূক্ত করার কাজে উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল। আইনের অতীতের খসড়ায় পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘তাঁদের কাজের মেয়াদে’ কর্তৃপক্ষের তরফে ‘আবাসিক বন্দোবস্ত ও রক্ষণারেক্ষণ’ বাধ্যতামূলক রাখার বিষয়টি বেমালুম তুলে নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, পরিযায়ী শ্রমিকরা ঠিকাদার সংস্থার কাছ থেকে যে ‘উৎখাত হওয়ার ভাতা’ পেতেন, তা-ও তুলে নেওয়া হয়েছে। পরিবর্তে বছরে একটা ‘থোক টাকা’ দেওয়া হবে তাঁদের বাড়িতে ফেরার জন্য। বহু লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের যে দু’টি আইন ছিল, তা বেমালুম তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এই বিলে।
তাহলে এখন ‘আলোর কথা’ কী? চিতার কথা? শুধুই চিতার কথা?
২০০৮-এ শুরু হওয়া মন্দার প্রতিষেধক এখনও খুঁজে পায়নি পুঁজিবাদ। ওই সময়েই বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক চক্রান্ত প্রবল হতে পেরেছিল। দেশে বামপন্থীদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটিতে কমিউনিস্টদের রক্তাক্ত করতে পেরে মমতা ব্যানার্জির পাশে উল্লাস প্রকাশ করেছিল কিষাণজী আর আরএসএস — একসাথে। ফল কী হয়েছে? প্রতিরোধের শক্তি দুর্বল হয়েছে। লগ্নি পুঁজির আক্রমন প্রবল হয়েছে। কতটা তা জানিয়ে দিচ্ছে মোদীর শ্রম আইন কোড, ২০২০।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/05/IMG_20200501_035501-1.jpg)
কিন্তু লগ্নিপুঁজির সেই দাপটকে চ্যালেঞ্জ করছে একের পর এক ধর্মঘট, শ্রমিক শ্রেণীর নানা ধরনের আন্দোলন। পাশাপাশি মোদী সরকারের মারাত্মক কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষক সমাজের আন্দোলন ঐতিহাসিক হয়ে উঠেছে। এই মে দিবসে ‘আলোর কথা’ এই গুলিই। প্রবল আক্রমনের মুখেও গড়ে ওঠা আজকের প্রতিরোধে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ক্রমশঃ মুখর হচ্ছে। লেনিন তো তাই বলেছিলেন। ১৯০৪’র মে দিবসের প্রাক্কালে লেনিনের আহ্বান ছিল —
‘‘মে দিবসের উদ্যাপন হোক আমাদের সমস্ত শক্তি সহস্র নতুন সংগ্রামে বিজয়ের লক্ষ্য সংহত করে, যাতে সব মানুষের স্বাধীনতা অর্জন করা যায়, পুঁজির বাঁধনে শোষিত সব মানুষের মুক্তি নিয়ে আসা যায়।’’
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/WhatsApp-Image-2021-04-21-at-4.01.43-PM-5.jpeg)
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/05/FB_IMG_1619816170967-1.jpg)