Site icon CPI(M)

‘Marx’s Writing More Relevent Today Than Ever’ – Wolfgang Streeck

Capitalism is the crisis

পুঁজিবাদের প্রস্থান অনিবার্য – উলফগ্যাং স্ট্রীক

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

অর্থনৈতিক – সমাজবিদ্যা বিষয়ে দুনিয়াজূড়ে যাদের মতামত প্রামান্য মেনে চলা হয় উলফগ্যাং স্ট্রীক এমনই একজন ব্যাক্তিত্ব। ২০১৪ সালে নিউ লেফট রিভিউ পত্রিকায় স্ট্রীকের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, সেই প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল কিভাবে ধ্বংস হবে পুঁজিবাদ – ‘How will capitalism end’ ? পরবর্তীকালে এই প্রবন্ধ একটি বইয়ের আকারেও প্রকাশিত হয়েছে।

উলফগ্যাং স্ট্রীক

রাজনৈতিক-অর্থনীতিবিদ হিসাবে জার্মানির নাগরিক উলফগ্যাং স্ট্রীক এক দশক আগেও মনে করতেন সোশ্যাল ডেমোক্রেসি অর্থাৎ রাজনৈতিক মধ্যপন্থাই হল পুঁজি এবং শ্রমের মাঝে দ্বন্দ্বের সমাধান স্বরুপ। আজকের দুনিয়া তার অবস্থানকে আরও বামদিকে ঠেলে দিয়েছে, “পুঁজি এবং গণতন্ত্রের মধ্যে যে সহাবস্থানের সম্পর্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছিল তথাকথিত ‘শীতল যুদ্ধ’ যুগের সমাপ্তির সাথেই তা ভেঙ্গে যায় এবং নয়া উদারবাদ পুঁজি বনাম শ্রমের চিরায়ত দ্বন্দ্বকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে” – স্ট্রীক এখন এই মতেই দৃঢ়।

আজকের দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা যাদের করায়ত্ব সেইসব সংস্থাসমুহ (ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, ইন্টারন্যাশনাল মানিটরি ফান্ড বা আই এম এফ ইত্যাদি)-কে নিয়ন্ত্রন করার মতো কোন কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তি নেই। আর্থিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলিকে তাদের ইচ্ছামতো মুনাফা বাড়িয়ে চলার রাস্তা করে দেবে এমন সরকারকেই তারা ক্ষমতায় বসাচ্ছে। আগামি দিনগুলিতে এমন এক পৃথিবী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে যেখানে যাবতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন (প্রচলিত অর্থে) কার্যত ধ্বসে পড়বে, সারা দুনিয়াজূড়ে প্রতিষ্ঠা হবে কতিপয় বাণিজ্য গোষ্ঠীর শাসন এবং জনজীবনে নেমে আসবে আর্থিক অবনমনের ভয়াবহ ফলাফল – এহেন ভবিষ্যৎকেই স্ট্রীক নাম দিয়েছেন ‘পর্যায়ক্রমিক অবনমন’।

সামির আমিন

ডিলিংকিং আজকের অর্থব্যাবস্থায় এক নতুন শব্দবিশেষ ( প্রখ্যাত মার্কসবাদী অর্থশাস্ত্রী সামির আমিন এই শব্দ ব্যবহারে একটি বইয়ের শিরোনাম করেছেন) – রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ডিলিংকিং ব্যবহৃত হয় আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজির যে জাল সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে তার থেকে মুক্ত হবার উপায় হিসাবে। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির একচ্ছত্র ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্থানীয় – এলাকাভিত্তিক বিকল্প রাজনৈতিক সংস্থাসমুহই (যেখানে সাধারন মানুষ নিজেদের উন্নতিসাধনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করতে পারবেন) পারে জনগনের জন্য প্রকৃত অর্থে গনতান্ত্রিক এবং উন্নয়নমূলক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে। স্ট্রীক নিজের লেখায় উল্লেখ করেছেন – “স্থানীয় রাজনৈতিক সংস্থাসমুহের হাতে যতদূর সম্ভব আর্থিক উন্নয়ন সম্পর্কিত ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়া একান্তই প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক লগ্নীসংস্থাসমুহের জাল কেটে বেরোতে পারলে তবেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। মূলত শ্রমজীবী মানুষের গরিষ্ঠতা নির্ভর এইসব রাজনৈতিক বিকল্পগুলিই নিশ্চিত করবে জনগনের সমবেত আশা-আকাংখা এবং সেই লক্ষ্যে প্রকৃত উন্নয়ন সম্পর্কিত যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা যা অদূর ভবিষ্যতে পুঁজিবাদের বিকল্প হিসাবে একটি স্থায়ী অর্থনৈতিক কাঠামোর দিশা দেখাবে।”

এই প্রসঙ্গেই উলফগ্যাং স্ট্রীকের একটি সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয় ফ্রন্টলাইন পত্রিকায়। সেই কথাবার্তায় আরও স্পস্ট হয়ে যায় স্ট্রীক ঠিক বলতে চেয়েছেন। এক কথায় বললে তার বক্তব্যের নির্যাস ” পুঁজিবাদের প্রস্থান অনিবার্য ” – এই নিবন্ধের আগ্রহ সেখানেই। আধুনিক পুঁজিবাদ যখন মুনাফার নিশ্চিতকরনই অর্থশাস্ত্র সম্পর্কিত গবেষণার একমাত্র আলোচ্য বিষয় বলে দেখাতে চাইছে তার প্রতিঅবস্থানে একজন গোটা ব্যাবস্থাটারই ধ্বংস সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনা তুলছেন – এহেন আলোচনা আমরা এড়িয়ে যেতে পারিনা।

স্ট্রীকের সাথে ফ্রন্টলাইন পত্রিকার যে কথাবার্তা হয় তারই একটি নির্যাস (বাংলায় অনুবাদ করে) এই নিবন্ধে তুলে ধরা হলঃ

“আমাদের জীবদ্দশাতেই পুঁজিবাদের ধ্বংস প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হবে – এখনই হয়ত একথা বলার সময় আসেনি কিন্তু নয়া উদারবাদের ভিতরে এমন পাঁচটি সাধারন বৈশিষ্ট দেখা যাচ্ছে যা পৃথিবীজূড়েই জনগনের দুর্দশার মূল কারন। ক্রমান্বয়ী আর্থিক অবনমন, বাজারের উপরে কতিপয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একচেটিয়া রাজত্ব, জনজীবনে প্রয়োজনীয় পণ্য ব্যবহারে গুরুতর অভাব, সার্বিক দুর্নীতি এবং দুনিয়াজূড়ে নৈরাজ্যের প্রতিষ্ঠা এগুলিই হল সেই পাঁচ বৈশিষ্ট। লাগামহীন মুনাফা কিংবা বাজারের উপরে মানবিক নিয়ন্ত্রন কায়েম করতে পারে এমন একটিও প্রতিষ্ঠান বাকি নেই যা পুঁজিবাদ ধ্বংস করেনি। আমার বক্তব্য হল এর ফলে আগামিদিনে এমন অনেক ঘটনা ঘটতে চলেছে যা অভূতপূর্ব – ‘জেলখানার নোটবুক’-এ এমন কিছুরই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন আন্তনিও গ্রামশি।

আন্তনিও গ্রামশি

পুঁজিবাদ কিংবা আধুনিক পুঁজিবাদ যাই বলা হোক না কেন তার সাথে আমাদের সরাসরি যুদ্ধ হবে না এ কথা আমি বলছি না, কিন্তু এই মুহূর্তে সারা পৃথিবী জুড়ে সেই যুদ্ধ চালানোর মতো কোনো কেন্দ্রীয় বাহিনী নেই। আমার এই কথায় কেউ হতাশ হতে পারেন, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য বাস্তব অবস্থা কে ব্যাখ্যা করা। পুঁজিবাদ যেভাবে একটি অখন্ড আন্তর্জাতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে তার বিপরীতে লড়াই চালাতে আমাদেরও একটি কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন ছিল – ‘ শীতল যুদ্ধ ‘ শেষ হবার সাথে সাথেই সেই সম্ভাবনা নষ্ট হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এলাকাভিত্তিক কিছু পুঁজিবাদ বিরোধী রাজনীতি চর্চিত হচ্ছে – এ ধরনের স্থানীয়, বিচ্ছিন্ন বিকল্প রাজনীতির চর্চা পুঁজিবাদের গতিপথে অল্পবিস্তর বাধা দিতে পারলেও তাকে সমূলে উৎখাত করতে পারে না।


ঐতিহাসিকভাবে পুঁজিবাদবিরোধী বিভিন্ন সংগ্রাম গুলি শ্রমজীবী মানুষকে ঘুরপথে পুনরায় পুঁজিবাদের কবলে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। এ ধরনের সংগ্রামসমুহ স্থানীয়ভাবে জনজীবনে চাহিদার ব্যাপক সংকট তৈরি করেছে যাকে কাজে লাগিয়ে পুঁজিবাদ পুনরায় নিজের মুনাফার রাস্তা খুঁজে নিয়েছে। পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রামে দুনিয়ার সমস্ত প্রান্তে ঘটে চলা প্রতিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেই একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে, নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে একে অন্যকে সমৃদ্ধ করতে হবে – আমাদের কর্তব্য সেই কাজ সম্পাদনা করা। এক কথায় বলা যায় মানব জীবন এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির পুঁজিবাদবিরোধী মডেল নির্মাণ করতে হবে।


যতদিন পুঁজিবাদ নিজের জাতীয় চরিত্র বজায় রেখে চলেছে অর্থাৎ কোন একটি দেশের জাতীয় অর্থনীতিরই সে নিয়ন্তা ছিল ততদিন সোশ্যাল ডেমোক্রেসিকে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলতো। যে মুহূর্তে পুঁজিবাদ আন্তর্জাতিক লগ্নির জোরে নিজেকে একটি বিশ্বব্যবস্থায় রূপান্তরিত করেছে সেই থেকেই সোশল ডেমোক্রেসি তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অকার্যকর হয়ে গেছে। শেষ তিন দশক ধরে চলা মুক্ত বাণিজ্য নীতি এবং অনিয়ন্ত্রিত বাজার নীতির নামে পশ্চিমী সভ্যতার বিভিন্ন দেশীয় সরকারগুলিকে আক্ষরিক অর্থেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির হাতের পুতুলে পরিণত করা হয়েছে। এইসব সরকারগুলির একমাত্র কাজ গুটিকয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর করায়ত্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটির বারে বারে মালিকানা পুনর্বণ্টন ব্যাতিত আর কিছুই নয়। নয়া উদারবাদের যুগে শ্রমজীবী মানুষ প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন অথচ সমাজব্যবস্থার চালিকা শক্তি হিসাবে যে শ্রেণী ভারসাম্য বিদ্যমান তার পরিবর্তন সাধনে তারা আন্তর্জাতিকতার অবস্থানে আদৌ ঐক্যবদ্ধ নন। এরই ফলে কিছুতেই ব্যবস্থাটার বদল হচ্ছে না। আজকের দিনে পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রামের মূল দুর্বলতা এখানেই।

আমি মনে করি মার্কসবাদ বলে যা কিছু আমাদের ঐতিহ্য তা আজকের দুনিয়ায় যতটা প্রাসঙ্গিক তেমনটা আগে কখনো ছিল না। অবশ্য একথা উপলব্ধি করতে মার্কসবাদ চর্চা প্রয়োজন। মার্কস তার জীবদ্দশাতেই পুঁজিবাদের পতন দেখবেন বলে প্রত্যাশি ছিলেন – একারনেই তার গবেষণায় পুঁজিবাদ পতনোন্মুখ প্রমানিত হলেও নিজেকে টিকিয়ে রাখতে এই ব্যবস্থা কি কি করতে পারে সেই সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা বেশিদূর এগোয়নি। সেই কাজ করতে হবে আমাদের – সমসাময়িক যুগের মার্কসবাদীদের। পুঁজিবাদের পতন সম্পর্কে তার বলে যাওয়া কথাগুলি আঁকড়ে থাকার বদলে আজকের পরিপ্রেক্ষিতে তার আবিষ্কৃত উপায়সমুহের পুনঃপ্রয়োগে পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রামে জয়ী হবার রাস্তা বের করতে আমাদের গভীর মনোনিবেশ করা উচিত। মার্কস প্রমান করেছেন পুঁজিবাদ কোন দৈব-অভিপ্সা নয়, এ হল এক ঐতিহাসিক বন্দোবস্ত – অর্থাৎ এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা যার উৎপত্তি ঘটেছে বিদ্যমান সমাজের ভিতর থেকেই। শুরু আছে বলেই এই ব্যবস্থার একটা শেষও থাকবে – মার্কস সেই কথাই বলেছিলেন। মার্কসের যুক্তি ছিল মুনাফার হার না বড়িয়ে পুঁজিবাদ টিকে থাকতে পারবে না, অথচ পূঁজির ক্রমান্বয়ী কেন্দ্রীভবন মুনাফার হার হ্রাস করে চলবেই সুতরাং পুঁজিবাদ ধ্বংস হবে। মার্কসের লেখা “পুঁজি” (Capital) গ্রন্থের প্রথম খন্ড প্রকাশ হয় দেড়শ বছর আগে – আজও সেই পরিস্থিতি তৈরি হয় নি।

শেষ দশকগুলিতে আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজি যে কায়দায় একের পর এক দেশের জাতীয় অর্থনীতির কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে তারই প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেকার অশান্তিকে বিচার করতে পারি। বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিয়েছে নিশ্চিত, কিন্তু এই মনোভাবের শিকড় যে চেপে বসা আর্থিক দুরবস্থায় প্রোথিত তা মাথায় না রাখলে ভুল হবে – ব্রিটেন, স্পেন সকলেই এর শিকার। বড় দেশ এবং সেখানকার নাগরিকতার সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে বলেই তারা আত্ম-নির্ধারণের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে আলাদা হবার দাবি জানাচ্ছেন। এই দাবি হয় বৃহৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে স্বনিয়ন্ত্রিত রাজ্যের অথবা নিজেদের জন্য ছোট হলেও আলাদা দেশ সম্পর্কে দৃঢ় অবস্থানের। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেভাবে বহু দেশকে গাজোয়ারি করে এক দেখিয়ে ক্ষমতাধর বৃহৎ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছে তা জনগনের ইচ্ছার একেবারেই বিপরীত সিদ্ধান্ত।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেভাবে পপ্যুলিস্ট সরকারগুলি গড়ে উঠছে সেগুলিতে শুধু দক্ষিনপন্থীরাই রয়েছে এমন না, বামপন্থীরাও আছেন। দক্ষিনপন্থী সরকারগুলির ভিতরে একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট দেখা যাচ্ছে – এর প্রায় সবাই একনায়কবাদী চরিত্রের এবং বশংবদ সেনা ও পুলিশ কর্তৃক শাসন চালাতে অভ্যস্ত। এহেন সরকারগুলি গড়েই উঠেছে জনজীবনে দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থার সুযোগে প্রচলিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে তাদের সম্মিলিত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে, তারই ফলশ্রুতিতে আজকের পুঁজিবাদ যখন অতি দক্ষিনপন্থী রাজনীতির প্রয়োগে একের পর এক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে চলেছে তার বিপরীতে মানুষের প্রতিক্রিয়া গড়ে উঠছেনা অথবা প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই দুর্বল।

আজকের দিনে শরণার্থীদের জন্য স্থান সংকুলানের সমস্যা ইউরোপে ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এক্ষেত্রে জার্মানির নিজস্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে – তুরস্ক থেকে বহু শরণার্থী এদেশে এসেছেন, তাদের একটি অংশ এখানকার মূলস্রোতের সাথে মিশে যেতে চাইছেন আবার আরেকটি অংশ তুরস্কের একনায়ক এরদোগানের প্রতি সমর্থন জারী রাখতেই ব্যস্ত রয়েছেন – এদের সবার মূল সমস্যা একই, এরা চলতি রাজনৈতিক নৈরাজ্যের শিকার। জনসংখ্যা এবং জীবনযাত্রার মানে ভয়ানক তারতম্য শেষ অবধি ইউরোপের দেশগুলিতে শরণার্থী সমস্যা জিইয়ে রাখবেই – আসলে যাবতীয় সামাজিক সমস্যার গোড়ায় যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে তার সমাধান না হওয়া অবধি এই বিভীষিকা বিরাজ করবে।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কসবাদী অর্থশাস্ত্রীরা ডিলিংকিং-এর কথা বলছেন। আমার বক্তব্য হল জনগণের জীবনের দায়িত্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা কতিপয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে রাখা চলে না – স্থানীয় হোক কিংবা অন্যান্য যে স্তরেই হোক না কেন যত বিকল্প বন্দোবস্ত কার্যকরী হবে তত বেশি গনতান্ত্রিক পরিসর বিস্তৃতি লাভ করবে। গণ-কোঅপারেটিভ সংস্থা গড়ে তোলা এমনই একটা উপায় বলে আমি মনে করছি। এই লক্ষ্যে কৃষিকাজ, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ এবং স্বাস্থ্যপরিষেবা আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সবার আগে জনগণকে তাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তিটুকু সরবরাহ করতেই হবে, একমাত্র তখনই তারা ভবিষ্যতের উন্নত জীবনমান সম্পর্কে আশাবাদী হবেন, সেই লক্ষ্যে সক্রিয় হবেন।

আমি বইতে ‘ঋণজর্জর রাষ্ট্রব্যবস্থা’র কথা উল্লেখ করেছি। এহেন রাষ্ট্রকে বাজারের প্রতিযোগিতা মূলক পরিমণ্ডল টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে যার ফলে বেসরকারি মালিকানায় বিপুল মুনাফার সুযোগ তৈরি করতে ক্রমাগত জাতীয় অর্থনীতি থেকে সরকারকে হাত তুলে নিতে হচ্ছে। এর ফল হচ্ছে কার্যত রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতার ক্রমান্বয়ী হ্রাস – আর ঠিক সেখানেই আমার বক্তব্য যে, দেশের মধ্যে বাজারকে কাজ করতে দেওয়ার মানেই দুর্বল – অশক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামো না, এর ভিতরেও সরকার নিজেকে মজবুত রাখতে পারে। কার্যত মুক্ত অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে গেলে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রেরই প্রয়োজন হয় – সেটাই কারণ আজকের পৃথিবীতে নতুন করে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা মাথা চাড়া দেবার। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা কায়েম হতে পেরেছিল কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গণতন্ত্র এবং অর্থনীতিকে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিল। আজকের দিনে এহেন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থারই নাম আমি দিয়েছি “কনসোলিডেশন স্টেট”।


এই প্রসঙ্গেই থমাস পিকেটির অসাধারণ কাজ রয়েছে – তার লেখা “২১ শতকে পুঁজি” (Capital in the 21st Century) গ্রন্থে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিভাবে পুঁজিবাদ সমাজে অসাম্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায় এবং সেই কাজে পুঁজি এবং তথ্যকে কাজে লাগায়। তিনি অনেকটাই আশাবাদী অবস্থানে দৃঢ় যে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তেই এহেন অসাম্যের বিরুদ্ধে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। তবে আমি সরাসরি গোটা পৃথিবীতে একইরকম কর ব্যবস্থা কায়েম করা সম্পর্কে ইতিবাচক নই, যেমনটা তার ব্যাখ্যায় রয়েছে। আমার মনে হয় এমন কাজের বাধা হিসাবে কয়েকটি পদ্ধতিগত ত্রুটি ব্যতিরেকে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও দায়ী হবে।”

ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ

শেয়ার করুন