আজ ৫ মে, ২০২২ পৃথিবীর মহান দার্শনিক কার্ল মার্কসের (১৮১৮-১৮৮৩) জন্মদিন। জন্মের এত বছর বাদেও দুনিয়া জুড়ে আলোচনা হচ্ছে মার্কসকে নিয়ে, তার মতবাদকে নিয়ে। জন্মদিনে ফুল, মালা আর লাল সেলাম দিয়ে নিয়মমাফিক স্মৃতি তর্পণ নয়। আতস কাঁচের নিচে রেখে মার্কসবাদের রীতিমত তন্নিষ্ঠ অনুসন্ধান।
নিপীড়িত মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রতীক্ষায় ছিল তাদের মুক্তির দর্শনের, দর্শনও খুঁজে পায়নি নিপীড়িত মানুষের ঠিকানা। মার্কস এঙ্গেলস দেখা করিয়ে দিলেন একের সঙ্গে অপরকে। অবশেষে দর্শন খুঁজে পেল প্রলেতারিয়েতকে আর শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত প্রলেতারিয়েত পেল তাদের মুক্তির দর্শন মার্কসবাদ।
কার্ল মার্কস এবং তার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, সংগ্রামের সাথী, কমরেড ইন আর্মস, তার চিন্তার পরিপূরক চিন্তাবিদ ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫) এই দুজনে মিলে সমাজ, দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে যে যে ভাবনা চিন্তাকে সূত্রায়ত করেছেন সেগুলোই সম্মিলিতভাবে মার্কসবাদ। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস এবং হেরোডিটাসের ভাবনা বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকে।
এখন প্রশ্ন মার্কসবাদকে আমরা গ্রহণ করব কেন?
এক কথায় উত্তর মার্কসবাদ মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেছে।
এ কথা যদি সত্য হয় তবে আবারও প্রশ্ন আসে, তাহলে মার্কস এঙ্গেলসের আগে এই পৃথিবীতে কি কেউ মানুষের মঙ্গলের কথা ভাবেননি?
নিশ্চয়ই ভেবেছেন। মার্কস এঙ্গেলসের জন্মের হাজার হাজার বছর আগে থেকে সে ভাবনা বহমান। গ্রিসের সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, এপিকিউরাস, চীনের কনফুসিয়াস, ভারতের গৌতম বুদ্ধ, ইউরোপের টমাস মুর, চার্লস ফুরিয়ে, রবার্ট ওয়ান, হেগেল, ফয়েরবাখ সহ আরও আরও অনেকে মার্কসএঙ্গেলসের আগেই আন্তরিকভাবে, হৃদয় দিয়ে মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেছেন।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত মনীষী যদি মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে থাকেন তবে তাদের বাদ দিয়ে মার্কসের মতবাদ কেন?
এর সুনির্দিষ্ট দু'টি কারণ।
এক) মার্কস-এঙ্গেলস তাদের পূর্ববর্তী পৃথিবীর যা কিছু শিক্ষা এবং মূল্যবোধ যেগুলি প্রগতির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তখনও প্রাসঙ্গিক, সেগুলিকে তারা গ্রহণ করেছেন।
দুই) মানুষের কল্যাণের কথা ভাবার প্রশ্নে মার্কস এঙ্গেলসের ভাবনাটা ছিল তাদের পূর্বসূরিদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।
পূর্বসূরিরা চেয়েছিলেন প্রচলিত ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রেখে নির্যাতিত মানুষের খানিকটা বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য। বাড়তি কল্যাণ।
মার্কস এঙ্গেলস ও পথেই যাননি। তারা বললেন, যে ব্যবস্থা দেশের ৮০% থেকে ৯০% মানুষকে কষ্টে রাখে সেই ব্যবস্থাটাকেই বদলাতে হবে।
Thesis on Feuerbach-এ মার্কস বললেন, "The Philosophers have so far interpreted the world in various ways, the point, however is to change it." অর্থাৎ দার্শনিকরা নানাভাবে এই জগৎটাকে ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু আসল কথা হলো একে পরিবর্তন করা।
এই 'পরিবর্তন' কথাটা মার্কসবাদে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রগতির স্বার্থে, সচেতনভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই হলো বিপ্লব। যে কারণে মার্কসবাদ বিপ্লবী মতবাদ।
মার্কস এঙ্গেলসের আগে এই পরিবর্তন বা সমাজবদলের কথা কেউ কখনো বলতে পারেননি। আসলে ভাবতেই পারেননি। এখানেই মার্কসবাদের স্বাতন্ত্র্য এবং শ্রেষ্ঠত্ব।
Eighteenth Brumaire of Louis Bonapart-এ মার্কস লিখলেন : মানুষই ইতিহাস রচনা করে কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষের সৃষ্ট ইতিহাস সবসময়ই প্রগতির পথ অনুসরণ করে। অনেক সময় পরিস্থিতির শিকার হয়ে সেই ইতিহাস মানব সভ্যতার কানাগলিতে পথ হারায়। আর তখনই ইতিহাসের পাতা জুড়ে অবস্থান করে হিটলার-মুসোলিনি-তোজো-ফ্র্যাঙ্কোরা। এ দেশে নরেন্দ্র মোদী আর রাজ্যে মমতা ব্যানার্জিরা।
ফরাসি দার্শনিক প্রুধোঁ তাঁর 'ফিলোসফি অফ পভার্টি' গ্রন্থে মার্ক্সের মতবাদকে দারিদ্র্যের দর্শন বলে তাচ্ছিল্য করেন। এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে প্রত্যুত্তরে মার্কস লিখলেন, 'Poverty of Philosophy' বা 'দর্শনের দারিদ্র্য'। সেখানে তিনি বললেন, যে দর্শন সাধারণ মানুষকে এগোনোর দিশা দেখাতে পারেনা, ইহকালের থেকে পরকাল নিয়ে বেশি ভাবে সেইসব দর্শনই আসলে দারিদ্র্যে পরিপূর্ণ। এভাবেই মার্কস সওয়াল করলেন হতদরিদ্র নিপীড়িত-বঞ্চিত-শোষিত সাধারণ মানুষের পক্ষে।
তাই মার্কসবাদ শোষিত মানুষের মতবাদ। সাধারণ মানুষের মতবাদ। মানব মুক্তির মতবাদ। একই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক মতবাদ।
বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়ক বললেন : I think Marxism analyses the contemporary world in a way which no body else did. Lenin had said the strength of Marxism lies in the fact that it is true. The point is that it is a genuine scientific discovery. অর্থাৎ আমি মনে করি মার্কসবাদ যেভাবে সমসাময়িক বিশ্বকে বিশ্লেষণ করেছে সেভাবে আর কেউ করেননি। লেনিন বলতেন : মার্কসবাদ সত্য, সেটাই তার শক্তি। আসল কথা হল এটা যথার্থ বিজ্ঞানসম্মত আবিষ্কার।
পৃথিবীটা কেমন হওয়া উচিত বা কেমন হলে ভালো হয়, সে ব্যাপারে কোনো সুসমাচার মার্কস-এঙ্গেলস দেননি। তারা ইতিহাসের ফেলে আসা পথের বিভিন্ন বাঁক মোড়ে আলো ফেলে বোঝার চেষ্টা করেছেন অতীত থেকে বর্তমানে এর গতিপথটা কী? আর তারই ভিত্তিতে চিনতে চেয়েছেন ভবিষ্যতের অভিমুখ কোন্ দিকে হতে পারে। এ ব্যাপারে নিজেদের মনগড়া কোন কথা তারা বলেন নি। এ হেন বস্তুনিষ্ঠ, বৈজ্ঞানিক, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজটাকে দেখেছেন বলেই তাদের দর্শন সত্যের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে।
মার্কস এঙ্গেলসের অসামান্য অবদান শ্রেণীর ধারণা।
মানব সমাজের ইতিহাসে শ্রেণী কতটা গুরুত্বপূর্ণ, শ্রেণিসংগ্রামের ভূমিকা কি? এইসব প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দিলেন মার্কস এবং এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইস্তেহারের পাতায়। সেখানে তাদের সুস্পষ্ট উচ্চারণ, "The History of all hitherto existing society is the History of Class Struggles." অর্থাৎ আজও পর্যন্ত মানব সমাজের সমগ্র ইতিহাস হল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস।
শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করবার লক্ষ্যে মার্কস-এঙ্গেলস জার্মানির শ্রমিক সংগঠন 'লিগ অব জাস্ট'-র সাথে যুক্ত হন। এই সংগঠনের স্লোগান ছিল, 'সব মানুষ ভাই ভাই'। আপাতদৃষ্টিতে এটি খুব সুন্দর স্লোগান বলেই মনে হয়। কিন্তু মার্কস এঙ্গেলস দেখালেন শ্রমিক শোষণকারী মালিক এবং শোষিত শ্রমিক কখনোই ভাই ভাই হতে পারে না। শ্রমিক শোষিত হয় বলেই উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয়। আর সেই কারণেই মালিক মুনাফা করতে পারে। শ্রমিক শোষিত না হলে মালিকের মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয় না। শুধু তাই-ই নয়, শ্রমিক যত বেশি শোষিত হবে মালিকের তত বেশি মুনাফা হবে। অর্থাৎ শ্রমিক যত বেশি অত্যাচারিত হবে মালিক ততই লাভবান হবে। সেক্ষেত্রে শ্রমিক আর মালিক কি ভাই ভাই হতে পারে?
এই নতুন শ্রেণি চেতনায় সমাজকে শিক্ষিত করলেন মার্ক্স-এঙ্গেলস। উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টিকারী নিপীড়িত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত শ্রমিকরা হলো শোষিত শ্রেনী। আর অত্যাচারী, উদ্বৃত্তমূল্য ভোগকারী মালিকরা হলো শোষকশ্রেণী। দেশ-কাল-জাত-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নিরপেক্ষভাবে শ্রমিকরা যুগ যুগ ধরে শোষিত আর মালিকরা শোষক।
মার্কস শেখালেন শ্রেণী সম্পর্কে এই বৈজ্ঞানিক, বস্তুনিষ্ঠ সম্যক চেতনাই হল শ্রেণিচেতনা। এর নিরিখে সহজেই বোঝা যায় কে আমার বন্ধু আর কে নয়। লড়াইয়ের সময় কাকে সঙ্গে নিতে হবে আর কার বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। ব্যারিকেডের এপারে কে থাকবে আর ওপারেই বা কে।
এই শ্রেণী চেতনার কষ্টিপাথরে বিচার করেই কমিউনিস্ট ইস্তেহার এর শেষ লাইনে মার্ক্স এঙ্গেলসের দৃপ্ত আহ্বান, 'দুনিয়ার মজদুর এক হও'।
এখানে লক্ষণীয় মার্কস-এঙ্গেলস কখনোই ঝান্ডার রং বিচার করে শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ হতে বলেননি। আবিশ্ব শ্রমিকশ্রেণী শোষণের শিকার তাই শোষণহীন সমাজ গড়ার সংগ্রামে তাদের সকলকেই প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকের দেশ-কাল-ভাষা-ধর্ম-বর্ণ এবং পতাকার রং কোনটাই এই শ্রেণীবোধের উর্ধ্বে নয়।
আজ Identity Politics বা পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতির নাম করে মানুষকে ভাগ করার চেষ্টা করা হয়। ধর্মের নামে, জাতের নামে, লিঙ্গের নামে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এর বিপ্রতীপে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার একটাই হাতিয়ার : শ্রেণী ঐক্য গড়ে তোলা। আমাদের মনে রাখতে হবে Identity Politics is the Politics of Representation and Class Politics is the Politics of Emancipation. অর্থাৎ পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি হল প্রতিনিধিত্বের রাজনীতি আর শ্রেণী রাজনীতি হল মানুষের মুক্তির সংগ্রামের রাজনীতি।
যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকে বদলাতে হবে তার স্বরূপটা কেমন? তন্নিষ্ঠ অনুসন্ধান করে মার্কস সেই সত্যকেই তুলে ধরলেন 'দাস ক্যাপিটাল' এর পাতায় পাতায়।
মার্কস এই গ্রন্থে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, প্রতারণা বা অসম বিনিময়ের জন্য শোষণ ঘটে না। বাজারে শ্রমিক প্রতারিত হয়েছে বলে উদ্বৃত্তমূল্য সৃষ্টি হয় না। কারণ এটি কোন নীতি নৈতিকতার প্রশ্ন নয়। আসলে পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে শোষণ। পুঁজিবাদ থাকবে অথচ শোষণ থাকবে না - এ কখনো সম্ভব নয়। এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনিবার্যতা এবং একই সঙ্গে কদর্যতা।
মার্কস বললেন, পুঁজি হল মৃত শ্রম। রক্তচোষা বাদুড়ের মত জীবন্ত শ্রম শুষে সে বেঁচে থাকে। পুঁজির মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটি রন্ধ্র দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে কদর্য পুঁজ-রক্ত। তাই পুঁজিবাদ হল ক্লেদাক্ত পুঁজিবাদ।
পুঁজির এই চরিত্রকে আরও পরিষ্কার করে তুলে ধরতে তিনি ক্যাপিটাল গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ৩১-তম অধ্যায়ের পরিশেষে একটি ফুটনোটে তুলে ধরলেন টি.জে. ডানিংয়ের একটি মূল্যবান বক্তব্য।
সেখানে বলা হলো, যথেষ্ঠ মুনাফা পেলে পুঁজি খুবই সাহসী হয়। ১০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে সে যেকোন জায়গায় ব্যবসা করতে পারে। ২০ শতাংশ মুনাফায় তার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ৫০ শতাংশ মুনাফা দেয় ঔদ্ধত্য। ১০০ শতাংশ মুনাফা মানবিকতার সব নীতিগুলিকে পদদলিত করবার সাহস জোগায়। ৩০০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে হেন কোন অপরাধ নেই যা সে করতে পারে না। এমনকি মালিককে ফাঁসিকাঠে পর্যন্ত ঝোলাতে পারে।
এভাবেই মার্কস আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন পুঁজি ও পুঁজিবাদের আসল নগ্ন চেহারা।
শোষণ ছাড়া পুঁজিবাদ টিঁকতে পারেনা। তাই শোষণহীন সমাজ গড়ার লড়াই মানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই।
পুঁজি সম্পর্কে মার্কসের ন্যায় নির্মোহ ব্যাখ্যা আর কেউ করতে পারেননি। যা এতদিন বাদেও সারা পৃথিবীকে স্বীকার করতে হচ্ছে।
সেকারণেই ২০০৮ সালে বিশ্বের আর্থিক মন্দার কারণ খুঁজতে গিয়ে ভ্যাটিকানের প্রাসাদে বসে পোপকে উল্টাতে হয় ক্যাপিটালের পাতা।
মিউনিখের আর্চবিশপ কার্ডিনাল রেইনহার্ড জার্মান সাপ্তাহিক 'দ্য মিরর'কে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন পুঁজিবাদ নিয়ে কার্ল মার্কসের ব্যাখ্যা নির্ভুল।
ব্রিটেনের কুলীন পত্রিকা 'গার্ডিয়ান' লিখল বিশ্বমন্দার ছয় মাসের মধ্যে মার্কস এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ইস্তেহারের বিক্রি বেড়েছে ৯০০ শতাংশ আর ক্যাপিটালের বিক্রি বেড়েছে ৩০০ শতাংশ।
বিবিসি সমীক্ষা করে ২০০০ সালে ঘোষণা করেছিল, সহস্রাব্দের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, Thinker of the Millennium হলেন কার্ল মার্কস।
কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশের পর ১৭৪ বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী। ক্যাপিটালের প্রথম খন্ড প্রকাশের পর ১৫৫ টা শীত বসন্ত অতিক্রান্ত। তবুও মার্কসবাদকে উপেক্ষা করা যাচ্ছেনা। মার্কসবাদ সম্পর্কে বলা হয়, কেউ একে সমর্থন করতে পারেন, কেউ এর বিরোধিতা করতে পারেন কিন্তু কেউ-ই একে অস্বীকার করতে পারবেন না। এখানেই মার্কসবাদের শক্তি। এই মার্ক্সবাদকে পাথেয় করেই জারি থাকুক শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম।
ক্রেমলিন এর উপর থেকে লাল পতাকা নেমে যাবার পরই আহ্লাদে আটখানা বিশ্ব পুঁজিবাদ। ঘোষণা করা হল মার্কসবাদের দিন শেষ। বলা হল TINA (There is no alternative)। অর্থাৎ পুঁজিবাদের কোন বিকল্প নেই।
এই প্রেক্ষাপটে বিশিষ্ট মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়ককে সাংবাদিকরা সকৌতুকে প্রশ্ন করলেন, মার্কসবাদের সবচেয়ে বড় গবেষণাগার সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল। এখনও আপনি মার্কসবাদে আস্থা রাখেন? অধ্যাপক পট্টনায়ক ততোধিক কৌতুক করে বললেন, প্রেমের সবচেয়ে মূল্যবান সৌধ তাজমহল ভেঙে গেলে কি পৃথিবী থেকে ভালোবাসা মুছে যাবে! তখন কি মানুষ ভালোবাসা ছেড়ে দেবে?
সত্যিই নিস্তার নেই পুঁজিবাদের, সাম্রাজ্যবাদের আর আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির। মাঝেমধ্যেই দু'দিন অন্তর তাদের ঘোষণা করতে হয়, মার্কসবাদ মৃত। একটা মৃত জিনিসকে কতবার মৃত বলতে হয়! কেন মৃত বলতে হয়? বলতে হয় কারণ ওরা সবচেয়ে ভালো করে জানে যে মার্কসবাদ মৃত নয়। খুব বেশি করে জীবিত। তাই বারংবার এই উচ্চারণ। ওরা ভয় পায় লন্ডনের হাইগেট সমাধিক্ষেত্রে ১৩৯ বছর ধরে শুয়ে থাকা মানুষটাকে। কার্ল মার্কসকে, তার মতবাদকে। ওরা কি শয়নে, কি জাগরণে মার্কসের জুজু দেখে।
১৮৪৮-এর ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত কমিউনিস্ট ইস্তেহারের প্রথম লাইনেই মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছিলেন, A specter is haunting Europe, spectre of Communism. (ইউরোপ কমিউনিজমের জুজু দেখছে)। আর এখন গোটা পৃথিবী জুড়ে অসাম্যের প্রতিনিধিদের মার্কসবাদের ভূত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
আজও তাই, রাশিয়ার নির্বাচনে লাল পতাকার ভোট বৃদ্ধি হোক বা ইস্তানবুলে কমিউনিস্টদের বিশাল জনসভা, পেরুর নির্বাচনে বামপন্থীদের জয় বা নরওয়েতে দক্ষিণপন্থার পরাজয় ‐ সবেতেই পুঁজিবাদ মার্কসের জুজু দেখে। কারণ এই মার্কসই তো প্রথম পুঁজিবাদের চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন : ভুল, তোমরা ভুল। তোমাদের পথ ভুল। তোমাদের নীতি ভুল। তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভুল। তোমরা না চাইলেও একদিন না একদিন পৃথিবীটা বদলাবে এবং বদলাবেই।
ধ্রুপদী অর্থনীতি পুঁজিবাদকে দেখেছিল একটি সার্বজনীন ব্যবস্থা হিসেবে। মার্কস এই সার্বজনীনতার ধারণাকে ভেঙে দিয়ে দেখালেন যে পুঁজিবাদ মানব সভ্যতার একটি পর্যায় মাত্র। সেই নিরিখেই এর বিচার করতে হবে। যে কারণে ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদরা মূল্যের ধারণা, মুনাফা, মজুরি ও খাজনার আলোচনা করলেও উদ্বৃত্ত মূল্যের ধারণা উপস্থিত করতে পারেননি। মার্কস অত্যন্ত সার্থকভাবে উদ্বৃত্ত মূল্যকে সমাজের সামনে তুলে ধরলেন। আর শ্রমিকদের তৈরি করা এই উদ্বৃত্ত মূল্যের আত্মসাৎ- ই যে
শ্রমিকের শোষণ এবং মালিকের মুনাফা, তাও স্পষ্ট করে দেন।
এতদিন কেউ জানত না শ্রমিক কিভাবে শোষিত হয়? কে তাকে শোষণ করে? এখন সব কিছু স্ফটিকের মত স্বচ্ছ হয়ে গেল। পুঁজি সম্পর্কে এতদিন যে ধারণাটা অস্পষ্ট ছিল তাকেও স্পষ্ট করে তুলে ধরলেন কার্ল মার্কস। তিনি বোঝালেন, পুঁজি মানে টাকা-কড়ি, বাড়ি-গাড়ি, জমি-জিরেত, যন্ত্রপাতি কোনটাই নয়। পুঁজি হলো একটা সামাজিক সম্পর্ক। যে সম্পর্কের কারণে টাকা, বাড়ি, জমি, মেশিন পুঁজিতে পরিণত হয়।
সংজ্ঞায়িত করলে বলা যায় পুঁজি হলো একটা বিশেষ ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে একটা নির্দিষ্ট সামাজিক উৎপাদন সম্পর্কের প্রকাশ মাত্র।
একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কেউ যদি বাড়িতে তাঁত বুনে কাপড় তৈরি করে নিজেরা ব্যবহার করেন তখন সেটা পুঁজি নয়। কিন্তু যখন শ্রমিক দিয়ে তাঁতে অনেক কাপড় বুনে মুনাফার জন্য বিক্রি করা হয়, তখন সেই তাঁত পুঁজিতে পরিণত হয়।
এইভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মার্ক্স পুঁজি ও পুঁজিবাদকে আমাদের চিনতে শিখিয়েছেন। মার্কসপুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সম্পর্কগুলি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বার করেছিলেন। কারণ তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল একটি বাস্তব সম্মত বিপ্লবী প্রকল্প ( practico revolutionary project ) উপস্থিত করা।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী টেরি ঈগলটন ২০১১-তে প্রকাশিত, "Why Marx Was Right" গ্রন্থে একটি চমৎকার কথা বললেন।
মার্কসবাদ অচল, মার্কসবাদ শেষ প্রভৃতি নানা তির্যক মন্তব্য শুনতে শুনতে ক্লান্ত ঈগলটন বললেন, "There is only one problem with this otherwise alluring vision. Marxism is a critique of capitalism - the most searching,
rigorous, comprehensive critique of its kind ever to be launched.
It is also the only such critique that has transformed large sectors of the globe. It follows, then, that as long as capitalism is still in business, Marxism must be as well. Only by superannuating its opponent can it superannuate itself. And on the last sighting, capitalism appeared as feisty as ever."
অর্থাৎ "এই লোভনীয় দৃষ্টিভঙ্গির শুধুমাত্র একটিই সমস্যা আছে। মার্কসবাদ হল পুঁজিবাদের সমালোচনা। পুঁজিবাদ সম্পর্কে আজও পর্যন্ত যা যা বলা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে অনুসন্ধানী, কঠোর এবং ব্যাপক সমালোচনা। এটিই একমাত্র সমালোচনা যা পৃথিবীর বড় বড় ক্ষেত্রকে বদলে দিয়েছে। অতএব যতক্ষণ পুঁজিবাদের কারবার থাকবে ততক্ষণ মার্কসবাদকেও থাকতে হবে। শুধুমাত্র তার প্রতিপক্ষকে রিটায়ার করিয়ে তবেই এই মতাদর্শ অবসর গ্রহণ করতে পারে। এবং এখনো পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদ বরাবরের মতোই চনমনে আছে ।"
এই উক্তির মধ্য দিয়ে কত সহজে আজকের দিনে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নটি অধ্যাপক ঈগলটন আমাদের সামনে তুলে ধরলেন।
যদিও পুঁজিবাদ শেষ হলেই মার্কসবাদের কাজ শেষ হয়ে যায় না। মার্কস এঙ্গেলস বর্ণিত সাম্যবাদী সমাজ অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে মার্কসবাদের হাত ধরে আমাদের আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। পুঁজিবাদ তাদের কাজ করুক আর আমরা জারি রাখি আমাদের পথ চলা।