Marx 2022

দারিদ্র্যের দর্শনের জবাবে দর্শনের দারিদ্র

দর্শনের দারিদ্র অথবা মেধার মধ্যবিত্তি ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন মার্কস।

মার্কসবাদের তিনটি উপাদান সম্পর্কে আজকের দুনিয়া পরিচিত। ইংলন্ডের অর্থনীতি, জার্মানির দর্শন এবং ফরাসি দেশের সমাজতান্ত্রিক ধারণা, এই তিনের সংশ্লেষে নির্মিত হয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদি তত্ত্ব। এর সারাংশ হল শ্রেনি শোষণ অবসানের লক্ষ্যে সচেতন শ্রেনিযুদ্ধই শিকড় থেকে উপড়ে ফেলবে জীর্ণ-পুরাতন রাষ্ট্র ব্যবস্থা, গড়ে তুলবে নতুন সমাজ, নতুন মানুষ। এই তত্ত্ব নির্মাণে মার্কসকেও একরকম যুদ্ধই করতে হয়েছিল। বিপ্লবী মতাদর্শ প্রচারের দায়ে শাসকের আইন তাকে দৌড় করিয়েছে এক দেশ থেকে আরেক দেশ, নিজের সন্তানকে হারিয়েছেন – কফিন কেনার পয়সাটুকু যোগাড় করতে না পেরে সারারাত শিশুর শব বুকে চেপে ধরে থেকেছেন কার্ল ও জেনি। তবু মার্কস হেরে যাননি, অদম্য মনোভাবকে দমিয়ে রাখতে পারেনি বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থা। মেধার জগতেও আরেক যুদ্ধে নেমেছিলেন তিনি, সেই লড়াই ছিল ভদ্রতার মুখোশ পরে শোষণের পক্ষে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ যুক্তি হাজির করনেওয়ালাদের বিরুদ্ধে।

প্রুধোঁর লেখা বই 'দারিদ্র্যের দর্শন'
জনসমক্ষে বক্তব্য রাখছেন প্রুধোঁ

দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি - এই বিষয়গুলি সমাজের মাথায় বসে থাকারা নিজেদের দখলে রাখে। সরাসরি না হলেও রাজানুগ্রহে নিবেদিত প্রাণ কিংবা উচ্ছিষ্টভোজী মেধাসম্পদের অধিকারীগণ সমাজ-শিক্ষকের ভূমিকায় মানুষকে যুগের পর যুগ ধরে বুঁদ হয়ে থাকতেই শিখিয়েছেন – ঈশ্বরের দয়া ভিক্ষায়, অজানা ভবিষ্যতের ভয় দেখিয়ে অথবা শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইতে জেতার দিশা খুঁজে না পেয়ে পরাজিত অসহায়তার বর্ণনা কীর্তন করে। ধ্রুপদী দর্শন কিংবা অর্থশাস্ত্রের কিছুটা হলেও আত্মঅহংকার ছিল, ভাষায় অলংকারের ঝনঝনানি সহ তারা বুক ঠুকে প্রচার করেছিল কেড়ে নেওয়া, লুঠে নেওয়া আসলে যোগ্যতারই ন্যায্য অধিকার। শোষণ-বঞ্চনার এহেন ধ্রুপদী উপলব্ধি জনসাধারনকে খুশি করতে ব্যার্থ হয়। স্পার্টাকাসের সময় থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজ প্রচলিত হওয়ার আগে অবধি মানব সমাজের যাবতীয় লিখিত ইতিহাসই রুপান্তরিত হয় শ্রেনি সংগ্রামের ইতিহাসে। নতুন সমাজে (বুর্জোয়া) নতুন শাসক (পুঁজিবাদী) যথেষ্টই ইতিহাস সচেতন, তাই তার প্রয়োজন হয় নতুন ধরনের ভাড়াটে মেধার – যারা অতীতের সমস্ত অত্যাচার, বঞ্চনার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হলেও বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রা’টিও কাড়বে না, বরং চলতি ব্যবস্থার পক্ষেই জনমত নির্মাণে ও জনরোষ দুর্বল করে দিতে সক্রিয় থাকবে।

ফরাসি বিপ্লব গোটা পৃথিবীতেই নতুন সম্ভাবনার প্রচার করে দেয়। মানুষ বুঝতে পারে মুক্তিযুদ্ধে জিতে যাওয়া সম্ভব। যে প্রশ্নে জনসাধারনের মধ্যে সংশয় এবং মেধাবৃত্তিকারদের মধ্যে বিতর্ক হয় তা হল কোন পথে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি? মিলটন কবিতা লিখে জানিয়ে দিলেন সম্ভাব্য পথ – Better to reign in hell, than serve in heaven! অর্থাৎ শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই কোন ব্যাক্তিইচ্ছা নির্ভর বিষয় না, এ এক বস্তুগত সত্য, যতদিন শোষণ থাকবে – তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহও থাকবে। এহেন পরিবেশে শ্রেনি সংগ্রামের ময়দানে সর্বহারাকে একা করে দিতে, কথার ভারে ও ধারে তাদের গুলিয়ে দিয়ে নির্বীর্য করে তুলতে আসরে নামলেন একদল পন্ডিত। বাগ্মিতায় ভরপুর তাদের কথা শুনতে মানুষ ভিড় করতেন, সেই সুযোগকে ষোল আনার উপরে আঠারো আনা কাজে লাগিয়ে তারা প্রচার চালালেন রাজনীতি খুবই খারাপ ব্যাপার, আসল কথা হল অর্থনৈতিক বঞ্চনার অবসান ঘটানো। সুন্দর এবং সহজ কথায় এহেন প্রচারের আড়ালে লুকিয়ে রাখা সত্য যার কানে অশনি সংকেত দিল তিনিই কার্ল মার্কস।

অর্থনীতিবাদ অথবা যাকে আজকের দুনিয়ায় মধ্যবিত্ত সংস্কারবাদ (অথবা সুবিধাবাদ) বলা হয়, সেসবের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল মার্কসকে। ১৮৪৭ সালের ফ্রান্স, মার্কস তখন সেদেশের বাসিন্দা। পিয়ের জোসেফ প্রুধোঁ প্রকাশ করলেন ‘দারিদ্র্যের দর্শন’, ইংরেজিতে ফিলোজফি অফ পভার্টি। বইয়ের পাতায় পাতায় বর্ণনা দিলেন রাষ্ট্রের মূলোচ্ছেদ প্রয়োজন বটেই, তবে তা হবে ব্যাক্তি মানুষের সততা, যোগ্যতা এবং নৈতিকতার উপরে ভর করেই, রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলে কিছুই হবে না কেননা পচে গলে যাওয়া সমাজব্যবস্থা মানুষকে এতটাই দুর্নীতিপরায়ণ করে তুলেছে যে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক সংগ্রামে কোনকিছুই বদলাবে না। এই বক্তব্যে প্রাচীন ঋষিদের বানীর ঝাঁঝ রয়েছে, অর্থনীতির নামে নৈরাজ্যের শাণিত উদ্দেশ্য রয়েছে এবং সবচাইতে বেশি যা আছে তা হল সর্বহারার শ্রেণি রাজনীতিকে অকর্মণ্য করে দেওয়ার রাজনীতি! মধ্যবিত্ত শ্রেনি নিজের সামাজিক অবস্থানের কারনেই চিরকাল দোদুল্যমানতায় আক্রান্ত, শোষণমুক্তির প্রতি তার আগ্রহ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিটোল, গোলাপ বিছানো পথেই সেই মুক্তি আসা চাই বলে নিজেদের নির্বাক বাসনাকে তত্ত্বের মোড়কে জাহির করে তারা। অর্থাৎ একদিকে বুর্জোয়াদের ভোগসর্বস্ব জীবনের প্রতি মোহ আরেকদিকে নিপীড়িত, নির্বিত্ত মানুষের দুর্দশা দেখে ভয় ও বিদ্রোহের মেজাজে ভরপুর মধ্যপন্থী শ্রেনিচেতনা। সেই সময় ফ্রান্সে এহেন শ্রেণি বৈশিষ্টেরই সর্বোৎকৃষ্ট মেধা ছিলেন প্রুধোঁ। বুদ্ধিজীবীতার আড়ালে শাসকের পক্ষেই, স্থিতাবস্থার পক্ষেই অবস্থান নেওয়া সংশয়ী মনোভাবই যার, যাদের চেতনার মুল কথা। লেনিন এদের দাঁড়ে বসা টিয়াপাখি বলে অভিহিত করেছিলেন।

marx profile

প্রুধোঁ যা কিছু বলেছেন, লিখেছেন, প্রচার করেছেন তাকে বিপ্লবী চেতনার মধ্যবিত্ত সংস্করণ বলাই সঠিক, এধরণের কথাবার্তায় মানুষকে আকর্ষণের ক্ষমতা বেশি হয় কারন তাতে বিপদের সম্ভাবনা কম, সংকট মোচনে দায়-দায়িত্ব কম। নিকট লক্ষ্য হিসাবে রাষ্ট্রের সামনে দেনা-পাওনার হালখাতা খুলে ধরে শাসকের চরিত্র কিংবা রাজনৈতিক সংগ্রামে শ্রেণির ভূমিকা প্রসঙ্গে নিরুত্তর থাকলেও কাজ চলে যায়। এহেন রাজনীতি আসলে জনরোষ কমাতে সেফটি ভাল্ভের মতো কাজ করে, প্রুধোঁ’ও তাই করছিলেন। আর তাই নিজের তত্ত্বের নাম দিয়েছিলেন 'দারিদ্র্যের দর্শন', অর্থাৎ একদিকে সমাজ বদলের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই দুঃখ-কষ্ট লাঘবের মহৎ প্রচেষ্টা, আরেকদিকে তত্ত্বের জায়গায় অর্থনীতির নামে জনগণকে নিষ্ক্রিয়তায় অভ্যস্ত হতে বাধ্য করা।

মার্কস সিদ্ধান্ত নিলেন মানব মুক্তির প্রকৃত দিশা নির্ধারণে যে দর্শনশাস্ত্র অপারগ, তাকে শেষ বিদায় জানানোর সময় এসেছে। যদিও প্রুধোঁর মতবাদের জবাবে মার্কস যা লিখলেন তাকে আরও কুড়ি বছর পরে প্রকাশিত ক্যাপিটালের দার্শনিক, অর্থনৈতিক ভ্রূণ বলা চলে। প্রুধোঁর 'দারিদ্র্যের দর্শন'র বিরুদ্ধে ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে ফরাসি ভাষায় ব্রাসেলস এবং প্যারিস থেকে প্রকাশিত হল মার্কসের লেখা ‘দর্শনের দারিদ্র’, পভার্টি অফ ফিলোজফি। দুরমুশ করে দেওয়া হল মেধার মধ্যবিত্তি। বিংশ শতাব্দিতে অরগ্যানিক ইন্টেলেকচ্যুয়ালস'দের ভূমিকা ব্যখ্যা করতে গিয়ে আন্তোনিও গ্রামশি যা কিছু লিখেছেন বলা যায় তারই সুত্রপাত ঘটেছিল মার্কসের লেখায়।

বইটিতে দুটি অধ্যায়, প্রথম ভাগের শিরোনাম সায়েন্টিফিক ডিসকভারি, দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক অর্থনীতির অধিবিদ্যক গুণাবলী। বইয়ের ছত্রে ছত্রে প্রুধোঁর মতবাদকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপে, তীক্ষ্ণ ভাষায় ছিন্নভিন্ন করেছেন মার্কস। যারা অর্থনীতির গোড়ার কথা জানতে আগ্রহী তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য এই রচনা। অর্থনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় প্রজ্ঞার আস্বাদন ছাড়াও উচ্চমানের ব্যাঙ্গসাহিত্যের নিদর্শন হিসাবেও বইটি আমাদের সংগ্রহে রাখা উচিত। মস্কোর প্রোগ্রেস পাবলিশার্স প্রকাশিত (১৯৭৮) বইতে উল্লিখিত রয়েছে - "পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পণ্য এবং অর্থ পরিচালনার চক্রাকার পদ্ধতি ব্যখ্যা করতে গিয়ে প্রুধোঁ তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন, আগের বিষয় পরে ঠেলেছেন। যদিও বিনিময় মূল্যকে বুঝতে গেলে আমাদের বিনিময় ব্যাপারটাকে বুঝতে হবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে তার ভুল হয়নি। বিনিময় পদ্ধতি বুঝতে প্রয়োজন হবে শ্রম বিভাজনকে বোঝার। আবার তাকে বুঝতে গেলে সমাজে শ্রম বিভাজনের দরকার হল কেন, এটাই সবার আগে উপলব্ধি করতে হয়। এই যে প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা, ঠিক এখানেই প্রুধোঁর ভ্রান্তি। শ্রমবিভাজনের প্রাথমিক শর্তটি বুঝতে যুক্তিগ্রাহ্য অনুমানই হল একমাত্র পথ। অথচ প্রুধোঁর কথামত কোনকিছু, এমনকি ইশ্বর সম্পর্কেও যদি অনুমান করতে হয় তবে তা হবে ভয়ানক অপরাধ, এমন করলে ঈশ্বরকে অস্বীকারই করা হবে। তাহলে নিজের বইতে প্রুধোঁ বিনিময় মূল্যকে আগাগোড়া অজ্ঞাত বিষয় বলে চিহ্নিত করেও কি করে শ্রম বিভাজনকে জ্ঞাত বিষয় বলে অনুমান করে নিলেন?"

এই ছোট অনুচ্ছেদই এটুকু বুঝতে সাহায্য করে, কথার জাল বিছিয়ে যারা মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখতে চায়, প্রকৃত প্রজ্ঞার মুখোমুখি হলে তাদের কি অবস্থা হতে পারে...

প্রুধোঁ'কেও মুখোমুখি হতে হয়েছিল, মার্কসের।

মার্কসের লেখা সেই বইয়ের সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ব্যাখ্যার পরিসর এই প্রবন্ধে নেই, মূলত প্রুধোঁর মতবাদটি আসলে কি ছিল যার জবাবে মার্কস’কে কলম ধরতে হল সেটাই আমাদের মূল প্রসঙ্গ। তাহলেও, ‘দর্শনের দারিদ্র’ বইয়ের প্রথম সংস্করণে যে ছোট মুখবন্ধটি মার্কস লিখেছিলেন তার উল্লেখ বিনা এই লেখা শেষ করা অন্যায় হবে –

“প্রুধোঁ খুবই হতভাগ্য একজন। গোটা ইউরোপে কেউই তাকে সঠিক চিনে উঠতে পারলেন না। ফ্রান্সে লোকজন মনে করেন তিনি একজন শক্তসমর্থ জার্মান দার্শনিক, ফলে সেদেশে নিকৃষ্টমানের অর্থনীতিবিদ হিসাবে তার পরিচিতি আটকে রাখা যায় নি। জার্মানির জনগনের চোখে তিনি অতি ধুরন্ধর একজন ফরাসি অর্থনীতিবিদ, সুতরাং জঘন্য দার্শনিকের তকমা জূড়ে গেছে তার নামের সাথে। একইসাথে একজন জার্মান এবং একজন অর্থনীতিবিদ হিসাবে তার দ্বৈত-পরিচিতি যে আসলে এক ভয়ানক ভ্রান্তি, এর বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ জানানো উচিত।

প্রুধোঁর মতামতের সমালোচনার নামে আমরা যে জার্মান দর্শনকেই তুলোধোনা করেছি আবার একইসাথে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র সম্পর্কেও যথেষ্ট টিপ্পনী করতে হয়েছে, প্রশংসা পাওয়ার কোনরকম সুযোগ ছাড়াই এহেন কাজ করে যাওয়া যে কতটা কষ্টকর, এই বইটি পড়তে বসে পাঠক সেকথা নিশ্চিত উপলব্ধি করবেন”।

ব্রাসেলস, ১৫ জুন, ১৮৪৭                                                                              কার্ল মার্কস

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ        


শেয়ার করুন

উত্তর দিন