পুঁজির সঞ্চারপথ চিহ্নিতকরণে মার্কস, লেনিন ও আজকের সময়

নীলোৎপল বসু

কার্ল মার্কস থেকে ভি আই লেনিন। এই পর্বে দুনিয়াজুড়ে মানবসমাজের অস্তিত্ব ও সময়োপযোগী রূপান্তর প্রসঙ্গে বহু চিন্তা-ভাবনা, তত্ত্ব একে অন্যের সাথে বিতর্ক, সংঘাতে জড়িয়েছিল। মার্কস একটি কথাতেই মানব ইতিহাসের সারাংশ উন্মোচিত করে দেন- ‘আজ অবধি দুনিয়ার সমস্ত ইতিহাসই হল শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস’। আজকের অবস্থাটা কেমন? সারা পৃথিবীতে অসাম্য, দারিদ্র্য, ক্ষুধা কিংবা বেকারি সবই অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। এমন অবস্থার জন্য দায়ী ফিনান্স ক্যাপিটাল নির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনীতি। আজকের দুর্বিষহ অবস্থাই নতুন করে মার্কস ও লেনিন’কে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।

Marx near Death

বিপ্লবী ঐতিহ্যের বহমান ধারা

‘হাউ টু চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড, রিফ্লেকশনস অন মার্কস অ্যান্ড মার্কসিজম’ বইয়ের ভুমিকায় প্রখ্যাত মার্কসবাদী ঐতিহাসিক এরিক হবসবম আজকের সময়ে মার্কসবাদের প্রেক্ষিত তুলে ধরেন।

সেই লেখাতেই রয়েছে-  “১৯৯০ নাগাদ বিশ্বায়িত বন্দোবস্ত হিসাবে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সেটিই হল সেই দুনিয়া, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-তে মার্কস যার বর্ণনা দেন। ১৯৯৮ সালে যখন সেই ছোট্ট পুস্তিকাটি প্রকাশনার ১৫০ বছর ঠিক তখনই দুনিয়াজুড়ে মার্কসকে পুনরাবিষ্কারের হিড়িক উঠল। মনে রাখতে হবে ঐ পর্বেই ‘অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন’ ক্রমশ জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে। সোশ্যালিস্টরা ততদিনে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন, মার্কসকে তুলে ধরলেন পুঁজিবাদীরাই। একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে- ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের পত্রিকা ‘ইনফ্লাইট’-র সম্পাদক একদিন আমার সাথে যোগাযোগ করেন। নিয়মিত ঘুরে বেড়ান এমনসব আমেরিকান ব্যবসাদারেরাই সেই পত্রিকার আশি শতাংশ পাঠক। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রসঙ্গে আমারই কোনও একটি লেখার অংশবিশেষ পত্রিকায় প্রকাশের অনুমতি চান সেই সম্পাদক। তার ধারণা তার পাঠকেরা ম্যানিফেস্টো প্রসঙ্গে কিছু বিতর্কে নিশ্চয়ই আগ্রহী হবেন। এমন আগ্রহের কথা শুনে আমি কিছুটা মজাই পেয়েছিলাম। আরেকবার- তখন নতুন শতাব্দী একেবারে দোরগোড়ায়, মধ্যাহ্নভোজের সময় জর্জ সরোস ও আমি একেবারে সামনাসামনি বসেছি। হঠাৎ তিনি জানতে চাইলেন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো সম্পর্কে আমার কি ধারণা। এইসব বিষয়ে তার সাথে আমার মতপার্থক্য সকলেরই জানা। আমি চাইছিলাম না দুপুরের খাওয়ার সময়টুকুতে অহেতুক তর্ক শুরু হোক। তাই কিছুটা রেখেঢেকেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানালাম। উনি বলতে শুরু করলেন- ‘এই মানুষটা (অর্থাৎ মার্কস), আজ থেকে দেড়শ বছর আগেই পুঁজিবাদ নিয়ে এমন কিছু আবিষ্কার করে গেছে যা আমাদের মাথায় রাখা উচিত ছিল’।” এই ঘটনা আসলে পুঁজিবাদের চরিত্র, এর অভ্যন্তরীণ ঐতিহাসিক বৈপরীত্যসমূহের গতিময়তা এবং তার প্রভাবে উদ্ভূত সংকটকে ব্যখ্যায় মার্কসের দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণ কতদূর কার্যকরী ছিল তাকেই তুলে ধরে।

এই প্রসঙ্গেই হবসবম আরও বলেন- “২০০৮ সালের অক্টোবরে লন্ডন ফিনান্সিয়াল টাইমসে পুঁজিবাদের নাভিশ্বাস উঠছে বলে শিরোনাম প্রকাশিত হয়। মার্কস পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন বলে আর কোনও সন্দেহই রইল না। ১৯৩০’র পর বিশ্বায়িত ফিনান্স পুঁজি এইবার একেবারে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, বিপদ এড়াতে কোনও পথই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর সাথেই মনে রাখতে হবে বিংশ শতাব্দীতে যেভাবে বিচার করা হত তার তুলনায় একবিংশ শতাব্দীতে মার্কস অবশ্যই অন্যরকম হবেন।” মার্কসের ঐতিহাসিক আবিষ্কার কার্যত চিরায়ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয় এই কারনেই।

পুঁজির চরিত্র উন্মোচনে মার্কস  

‘পুঁজি’র প্রথম খন্ডের ২৫তম অধ্যায়েই পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত চরিত্র প্রসঙ্গে মার্কস এক অসাধারণ ব্যখ্যা দিয়েছেন। একথা ঠিক যে মার্কসের আলোচনা প্রধানত শিল্প পুঁজিকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়েছে। শিল্প পুঁজির গতিপ্রকৃতির আলোচনায় যে প্রবণতার কথা মার্কসের লেখায় বারে বারে উঠে এসেছে আজকের প্রেক্ষিতে ফিনান্স পুঁজির ক্ষেত্রেও সেই প্রবণতাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মার্কস লিখছেন ‘পুঁজি হিসাবে ব্যবহৃত বিপুল ধনসম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে চলার সাথেই পুঁজিপতিদের হাতে সম্পত্তির কেন্দ্রীভবনও বৃদ্ধি পায়। এরই প্রভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি সহ গোটা পুঁজিবাদী উৎপাদিকা ব্যবস্থাটি আরও বিস্তৃতি লাভ করে... এই প্রক্রিয়ার অভিঘাতেই ছোটখাটো পুঁজিপতিরা বড় পুঁজির মালিকদের দ্বারা উৎখাত হয়। পুঁজির মালিকানা ক্রমশ বহুর হাত থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে, সেই বিপুল সম্পত্তি জমা হয় কতিপয়ের হাতে। পুঁজি কেন্দ্রীভবনের এহেন প্রক্রিয়ায় একজনের থেকে আরেকজনের হাতে পুঁজি সঞ্চারিত হওয়া ও তার দ্বারা উৎপাদন ব্যবস্থা জারী রাখার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটিকেই বাতিল করে দেয়... একদিকে বিরাট পরিমাণ পুঁজি পাহাড়ের মতো কারোর হাতে জমা হতে থাকে, আরেকদিকে বহুজন নিজেদের সবকিছু হারায়। পুঁজির সঞ্চয় (অ্যাকুমুলেশন), ঘনীভবন (কনসেন্ট্রেশন) ইত্যাদি প্রক্রিয়ার তুলনায় পুঁজি কেন্দ্রীভবনের (সেন্ট্রালাইজেশন) এই গোটা প্রক্রিয়াটি একেবারেই আলাদা।’

লগ্নী পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদঃ লেনিনের সুনির্দিষ্ট অবদান

আজকের পৃথিবীতে বিশ্বায়িত লগ্নী পুঁজির সক্রিয়তা প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) নিজেদের বোঝাপড়াকে নিরন্তর সময়োপযোগী করে চলেছে। সেই উদ্দেশ্যেই ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘মতাদর্শগত বিষয়ে সিদ্ধান্তসমূহ’ গৃহীত হয়।

এই দলিলেই উল্লেখ করা হয়েছে- বিশ্বায়নকে পার্টি তার সমগ্রতার ভিত্তিতে উপলব্ধি করতে চায়। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ গতিময়তাকে মার্কসের ব্যখ্যাকে ভিত্তি করেই কতিপয়ের মালিকানাধীন পুঁজির সঞ্চয় ও ঘনীভবনের পদ্ধতিকে আমরা চিনেছি। পুঁজিবাদের চরিত্র প্রসঙ্গে মার্কসের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনাকে আত্মস্থ করেই লেনিন সাম্রাজ্যবাদী যুগের সূচনাকাল চিহ্নিত করেছিলেন, একচেটিয়া পুঁজি থেকে সাম্রাজ্যবাদের বিকাশকে ব্যখ্যা করেছিলেন। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় হিসাবে সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক সত্ত্বাকে উন্মোচিত করেছিলেন লেনিন। রণনীতির ক্ষেত্রে সঠিক অবস্থানের জন্যই তৎকালীন প্রেক্ষিতে সঠিক রণকৌশল নির্মিত হয়েছিল যার ফলে শ্রেণি সংগ্রাম আরও তীব্র আকার নেয়। সেই শ্রেণি সংগ্রামই ইতিহাসে প্রথমবার সর্বহারা বিপ্লব সফল করে- ১৯১৭ সালের অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।

সাম্রাজ্যবাদের ব্যখ্যায় লেনিন পাঁচটি প্রধান বৈশিষ্টের উল্লেখ করেন।

১) উৎপাদন ও পুঁজি উভয়ই ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এবং এহেন কেন্দ্রীভবন দুনিয়াজুড়ে একচেটিয়া পুঁজির জন্ম দিয়েছে। সেই একচেটিয়া পুঁজিই আজকের পৃথিবীতে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূল।

২) ব্যাংক পুঁজি ও শিল্প পুঁজি একে অন্যের সাথে মিলেছে এবং জন্ম দিয়েছে লগ্নী পুঁজির। এরই ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এক আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী।

৩) পণ্য রপ্তানি ব্যবস্থার পাশাপাশি পুঁজির রপ্তানিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পোঁছে গেছে।

৪) দুনিয়াজুড়ে প্রতিষ্ঠিত একচেটিয়া পুঁজিবাদী গোষ্ঠী বিশ্ববাজারকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে।

৫) শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলি গোটা পৃথিবীটাই নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদী বিকাশেরই সেই নির্দিষ্ট স্তর যখন বিশ্ববাজারে একচেটিয়া মালিকানা ও লগ্নী পুঁজির আধিপত্য কায়েম হয়েছে; যখন পুঁজির চলাচল এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে; যখন আন্তর্জাতিক ট্রাষ্টগুলি বিশ্ববাজারকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা শুরু করেছে। এই সময়েই সর্ববৃহৎ পুঁজিবাদী দেশ গোটা দুনিয়াটাই নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারার কাজটি মিটিয়ে নিয়েছে। (লেনিনের সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড-২২, পৃষ্ঠাঃ ২৬৬-২৬৭)

শিল্প পুঁজির সাথে ব্যাংক পুঁজির সমন্বয়সাধনের ফলে কিভাবে লগ্নী পুঁজির বিকাশ ঘটছে লেনিন সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন, সেই যুগের ভিত্তিতে এর সুনির্দিষ্ট পর্যালোচনাও করেছিলেন। পুঁজিবাদের গুনগত পরিবর্তন ঘটেছে যার প্রভাবে অতীতে লগ্নী পুঁজি যে কায়দায় চলেছে তার থেকে অনেকদূর এগিয়ে এসে এই বন্দোবস্ত এক নতুন জমানার সুত্রপাত ঘটাবে- সাম্রাজ্যবাদই এর পরিণতি। এই সুত্রায়ন লেনিনের সেই পর্যালোচনারই সারাংশ ছিল।

নিজের যুগের রাজনৈতিক বিশ্বপরিস্থিতিকে সঠিকভাবে ব্যখ্যা করতে ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ’ই ছিল লেনিনের নীতি। তৎকালীন পৃথিবীতে বিভিন্ন শ্রেণির আন্তঃসম্পর্কের সঠিক পর্যালোচনা করেই রাশিয়ায় বিপ্লব প্রসঙ্গে ‘সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থিতে আঘাত হানো’ রণকৌশলের বিকাশ ঘটিয়ে ছিলেন তিনি। সাম্রাজ্যবাদের যুগে লগ্নী পুঁজি ক্রমাগত নিজের আধিপত্য বাড়িয়ে চলবে, বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া বিকশিত হতে হতেই নির্মিত হবে লগ্নী পুঁজির এক আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী যারা সমস্তকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে (ফিনান্সিয়াল অলিগার্কি)- সমসাময়িক পরিস্থিতির ব্যখ্যায় গভীর অবধি পৌঁছে যেতে সক্ষম লেনিন এই সত্য অনুধাবন করেছিলেন। পুঁজির অন্যান্য সমস্ত রুপভেদই যখন লগ্নী পুঁজির আধিপত্যের নিচে চাপা পড়বে ঠিক তখনই সাম্রাজ্যবাদ লগ্নী পুঁজিকে নিজের সাথে যুক্ত করে নেবে এবং হয়ে উঠবে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর- এই ছিল লেনিনের যুক্তি। এর সাথেই তিনি ‘পুঁজি রপ্তানি’র ধারনাটিকে যুক্ত করেছিলেন। ‘লগ্নী পুঁজি একসময় গোটা পৃথিবীজুড়েই নিজের জাল বিস্তার করবে’- লেনিনের এই ভবিষ্যৎবানী সঠিক ছিল। তিনি এও বলেছিলেন- ‘সাম্রাজ্যবাদের প্রধান বৈশিষ্টই হল লগ্নী পুঁজি, শিল্প পুঁজি নয়’।

সাম্রাজ্যবাদের যুগে লগ্নী পুঁজিই হয়ে উঠবে প্রধান প্রবণতা- শুধু তাই নয়, আরও আরও মুনাফা লুট করতে গিয়ে অন্যান্য সমস্ত পুঁজিবাদী কাঠামোকেই ক্রমশ গিলে খাবে এই সত্য লেনিনের বোঝাপড়ায় স্পষ্টই ছিল। আজ যাকে আমরা নয়া-উদারবাদ বলছি সেই ব্যবস্থা লেনিনের বক্তব্যকেই সঠিক প্রমাণ করেছে।

vladimir_lenin_Image

মার্কস-লেনিনের প্রাসঙ্গিকতা ফিরে আসে কেন?

আজকে পরিস্থিতিতে বিশ্বায়িত দুনিয়ায় শ্রেণিশক্তিসমূহের রাজনৈতিক আন্তঃসম্পর্কের চিত্রটি কেমন? বিশ্ব রাজনীতিতে শ্রেণি ভারসাম্য ক্ষমতাবানের দিকে হেলে রয়েছে। এই অবস্থাই সাম্রাজ্যবাদকে ক্রমবর্ধমান মুনাফা লুটের সুযোগ করে দিচ্ছে। এর মোকাবিলায় আক্রান্ত দেশগুলির জনসাধারণের বিভিন্ন লড়াই-সংগ্রাম উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধও গড়ে তুলছে। এই অবস্থাতেই পুঁজির নতুন করে কেন্দ্রীভবন ঘটছে, এভাবেই আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির জন্ম হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়ায় পুঁজিবাদের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্টই হল সেই আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয়ের সুযোগে এইসব দেশকে পুনরায় পুঁজিবাদের দখলে নিয়ে আসতে পেরে পুঁজির এহেন কেন্দ্রীভবন বাড়তি শক্তিও অর্জন করেছে।

বিশ্ব পুঁজিবাদের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে। প্রযুক্তিবিজ্ঞানের বিকাশ বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং-র মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক লুট চলছে, আরেকদিকে সস্তায় শ্রমশক্তি নিয়োগের সুযোগও করে নেওয়া হয়েছে। সেই বন্দোবস্ত পুঁজির সঞ্চয়কে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

অতীতের বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রের নির্দিষ্ট স্বার্থান্বেষী ধারণা থেকে লগ্নী পুঁজি মুক্ত হয়ে গেছে, বর্তমানে লগ্নী পুঁজি সবটাই আন্তর্জাতিক চরিত্রের - লেনিনের সময়ের সাথে আজকের অবস্থার ফারাক এটাই। আগেকার অবস্থায় উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি নিজের নিজের স্বার্থ অনুযায়ী বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইত। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির যুগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির অভ্যন্তরীণ শত্রুতা আর সেভাবে সক্রিয় না। এই ব্যবস্থা পুঁজিবাদী শিবিরের অভ্যন্তরীণ রেষারেষিকে স্তিমিত করে রেখেছে বলা চলে, অন্তত সাময়িকভাবে তো বটেই। এর জোরেই গোটা দুনিয়া জুড়ে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি নিজেকে কার্যত বিনা বাধায় সক্রিয় করে তুলেছে। এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেরই একটি ভুল হয়। নিজেকে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজিতে রূপান্তরিত করেছে বলে লগ্নী পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের ব্যখ্যায় লেনিনের পর্যালোচনা আজকের দুনিয়ায় আর চলে না- কেউ কেউ এমনটাই বলতে চান। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের ব্যখ্যায় লেনিনের পর্যালোচনা মোটেই বাতিল করা চলে না।

লেনিনের সময়ের তুলনায় যা বদলেছে তা আসলে ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতি’টি। সেই পরিস্থিতি যার সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ করেই লেনিন নিজের সময়ে আগামিদিনের কর্তব্য স্থির করেছিলেন। মনে রাখতে হবে আগামী ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মদতে লগ্নী পুঁজিই যে প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে একথা লেনিনই বলেছিলেন- আজকের পরিস্থিতি প্রমাণ করছে লেনিনই সঠিক। ২২ এপ্রিল, ৫ মে। দুটি বিশেষ তারিখ। প্রথমটি লেনিনের জন্মদিবস, পরেরটি কার্ল মার্কসের। এরা দুজন সেই মানুষ যারা গোটা বিংশ শতাব্দী জুড়ে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক ছিলেন। একবিংশ শতাব্দীতেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তারাই বিপ্লবী চেতনার কেন্দ্রে রয়েছেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ; কি এমন রয়েছে এই মতবাদে যা আজও সক্রিয়? এমন অভূতপূর্ব প্রাসঙ্গিকতার কারণ অনুসন্ধানে লেনিনের বক্তব্যই যথাযথ হবে- ‘এই মতবাদ শুধু যে বিজ্ঞানসম্মত তাই নয়, বৈপ্লবিকও বটে’।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন