মার্কস, নতুন প্রযুক্তি ও আগামী সমাজ

সাত্যকি রায়

ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের তাত্ত্বিক প্রকল্পটিতে প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল না। এর কারণ মূলত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের প্রভাব। পুঁজির বিকাশের জন্য শ্রমের মজুরি জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধির মধ্যে দিয়েই একটি ন্যূনতম জীবন মানে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে ধরা হয়েছিল। মার্কস প্রথম দেখালেন যে জনসংখ্যার ওঠা পড়ার দীর্ঘ অপেক্ষার বদলে পুঁজিবাদ প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষকে যন্ত্রের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে এবং শ্রমের মজুত বাহিনী তৈরি হয়। এই মজুত বাহিনীই মজুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয় দিনের কাজের ঘণ্টা সীমিত হওয়ার পরে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়ানোর অন্যতম উপায় হল উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তি মানে শুধুমাত্র মেশিন নয় তার সাথে সাথে তার উপযুক্ত শৃঙ্খলাপরায়ন মানুষ তৈরি করা পুঁজিবাদের অন্যতম লক্ষ্য। ক্যাপিটালে মার্কস বিস্তৃত আলোচনা করেছেন কিভাবে কারখানার অভ্যন্তরে পুঁজির আধিপত্য প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে শ্রমের উপরে কার্যকরী হয়। এই আধিপত্য শুধুমাত্র মানুষকে মেশিনের ছন্দের অনুগত করে তোলে তাই নয়, শ্রমের অর্জিত দক্ষতা যন্ত্রবদ্ধ করার ফলে যন্ত্রের কর্তৃত্ব কার্যকরী হতে থাকে। আবার এই যন্ত্রের মালিকানা যেহেতু পুঁজির, যন্ত্র সম্বন্ধিত দক্ষতা পুঁজির গুনাবলী হিসেবে সমাজের কাছে এবং শ্রমিকের কাছেও প্রতিভাত হয়, যা শ্রমিকের মনে পুঁজির প্রতি আনুগত্য তৈরি করতে সাহায্য করে।

পুঁজিবাদের অধীনে প্রযুক্তি পুঁজির কর্তৃত্ব মেনে চলবে এবং শ্রমিকের স্বশাসন খর্ব করার চেষ্টা করবে, এটাই মার্কসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল। কিন্তু প্রযুক্তির বিকাশকে মার্কস সর্বদাই মানব সভ্যতার বিকাশের একটি অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে দেখেছেন।  কারণ প্রযুক্তি আসলে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলির আত্তীকরণের মধ্যে দিয়ে মানুষের জীবনকে আরও সহজ করে তোলার নিরন্তর প্রক্রিয়া। পৃথিবীর অন্যান্য জীবজন্তুও বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে থাকে। মানুষই একমাত্র প্রজাতি যে শুধু নিজের বাঁচার তাগিদে প্রকৃতির সঙ্গে লিপ্ত হয় না। সে একটি প্রজাতি হিসেবে চারপাশের প্রকৃতিকে পরিবর্তিত করার সাথে সাথে নিজেও পরিবর্তিত হতে থাকে। এ কারণেই অন্যান্য জীবজন্তুর চাহিদা প্রায় অপরিবর্তিত থেকে যায় এবং তাদের পছন্দের স্থানও অপরিবর্তনীয় বলা যেতে পারে। অথচ মানুষ তার চারপাশকে পরিবর্তন করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের চাহিদারও পরিবর্তন ঘটাতে থাকে, নতুন জায়গা নিজের বাসযোগ্য করে তুলতে পারে এবং নতুন নতুন পছন্দসই ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতে পারে।

একথা ঠিক যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব অধিকাংশ সময় কর্মরত মানুষের মনে আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে।  উনবিংশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের বেশ কিছু আগে থেকে এবং বিশেষত শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময় ইংল্যান্ডে এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মেশিন রায়ট ও লুডাইটদের মেশিন বিরোধী আন্দোলন আমরা জানি। কিন্তু মেশিন সব সময় মানুষের ভূমিকাকে প্রতিস্থাপিত করে এরকম নয়। প্রিন্টিং প্রেস অথবা অটোমোবাইলের আবিষ্কার যে পরিমাণ মানুষকে কর্মচ্যুত করেছে তার কয়েক গুণ বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে।  অথবা বিভিন্ন কম্পিউটার সফটওয়্যার মানুষের দক্ষতাকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছে প্রতিস্থাপন ব্যতিরেকে। শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি সরাসরি চলতি কর্মসংস্থানকে সংকুচিত করলেও ওই নতুন প্রযুক্তির আনুষঙ্গিক ক্ষেত্রে অনেক কর্মসংস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

একথা মনে রাখা দরকার যে কোন প্রযুক্তিই ইতিহাসে সব মানুষের জন্য সমান সুখকর হয়ে ওঠেনি। বেশি বয়সের মানুষ নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে একটি গোটা প্রজন্মকে সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। এই কারণেই প্রযুক্তির উন্নয়ন পৃথিবীর ইতিহাসে  বিরোধের মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে। যে মানুষ কাজ হারাবে সেই মানুষ নিজের অধিকার ও জীবন-জীবিকা রক্ষার লড়াই করবে এটাই স্বাভাবিক এবং দেশে-দেশে নানা পর্বে তাই হয়েছে। এই বিরোধ বা সংঘর্ষ যেমন সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে অনিবার্য, আবার দীর্ঘমেয়াদী সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তির অগ্রগতিও অনিবার্য। সমকালীন সময়ের বিরোধ এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে এই সংঘর্ষই ঠিক করে দেয় প্রযুক্তির সুফল সমাজে কিভাবে বন্টিত হবে। কিভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ উৎপাদনের এই রূপান্তরকে ন্যূনতম ক্ষতির বিনিময় সংগঠিত করতে পারছে তা প্রযুক্তি বিকাশেরও অন্যতম পূর্বশর্ত।

পুঁজিবাদে যেহেতু প্রযুক্তির উন্নতি ঘটানোর প্রচেষ্টাটি মুনাফা নির্ভর তাই অনেকাংশে তা স্বত:স্ফূর্ত। এর সামাজিক প্রভাব স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে কি হতে চলেছে তা কোন পুঁজিপতি ভাবে না, ভাবার কথাও না। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ও অন্য পুঁজিপতিকে পরাস্ত করে গড় মুনাফার চেয়ে এগিয়ে থাকার লক্ষ্যে পুঁজিপতিরা এই ধরনের প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করে থাকে, এটা এক প্রকার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বাধ্যবাধকতা। যন্ত্রের ব্যবহারে একই কাজে কম মানুষ লাগবে এটাই তো কাঙ্খিত। কিন্তু গোটা সমাজের বিচারে কোন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মোট কর্মসংস্থান কমে আসবে এরকম হওয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একটি অপরিকল্পিত ব্যবস্থা এবং সে কারণেই সমাজে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির গতি ও কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির গতির মধ্যে কোন সামঞ্জস্য থাকে না।  অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ব্যবহার মোট বেকারের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলে।  একারণেই প্রযুক্তির বিকাশের সামাজিক পূর্বশর্তটি হল এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াটিকে যতটা সম্ভব যন্ত্রণাহীন করে তোলা।  বিংশ শতাব্দীতেও যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে উন্নত পুঁজিবাদী দুনিয়ায় বহু মানুষের কাজ চলে গেছিল।  আবার অন্যদিকে বিশেষত বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার, অটোমোবাইল ও রেলের প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশ, শিল্পের ও শিল্প সম্বন্ধিত পরিষেবার বিকাশ ইত্যাদি সামগ্রিক অর্থনীতিতে অনেক নতুন কাজ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। এ কারণেই বিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির বিরুদ্ধে ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো কোন যন্ত্র বিরোধী সংঘর্ষ দেখা যায়নি। পুঁজি বনাম শ্রমের সংঘর্ষ মেশিন বনাম মানুষের সংঘর্ষের পরিবর্তে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি জনিত আয়ের সুষম বন্টনের সংঘর্ষে পরিণত হল।

আমরা আবার একটি প্রযুক্তি বিপ্লবের সম্মুখীন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অফ থিংস, ন্যানো টেকনোলজি,  রোবটিক্স ইত্যাদির ব্যবহার ক্রমবর্ধমান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ উন্নত দেশগুলিতে ইতিমধ্যেই ব্যাপক হারে রুটিন কাজগুলিকে প্রতিস্থাপিত করে চলেছে। পূর্বের মেশিন আসলে মানুষের কায়িক শ্রমকে যন্ত্রবদ্ধ করেছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট মানুষের চিন্তা পদ্ধতিকে যন্ত্রবদ্ধ করছে। ঠিক যেভাবে মেশিন পুঁজির আওতায় থাকার কারণে শ্রমের উপর কর্তৃত্ব বাড়িয়েছিল, একইভাবে আধুনিক প্রযুক্তিও শ্রমের উপরে পুঁজির কর্তৃত্বকে বাড়িয়ে তুলবে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অচিরেই মানুষের চিন্তা ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপিত করতে পারবে। এর কারণ হল মানুষ যা করতে পারে তার সবটা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না, যাকে ‘পোলানি প্যারাডক্স’বলা হয়। মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তাকে যন্ত্রবদ্ধ করতে হলে ওই চিন্তাকে প্রথমত ভাষা বা সংকেতে রূপান্তরিত করতে পারা জরুরী। যে সমস্ত কাজকে এই সংকেতের সাহায্যে প্রকাশ করা সম্ভব শুধুমাত্র সেই ধরনের কাজেই যন্ত্র মানুষকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে। কিন্ত তার বাইরে বিস্তৃত চিন্তার জগত রয়েছে যা মানুষ আজও ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ একটি মেশিন চালানো শুধুমাত্র ম্যানুয়াল পড়েই করা সম্ভব নয়।  তার সাথে মানুষের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত ভিত্তিক চিন্তা, বুদ্ধি, বিবেচনা ইত্যাদি সংযুক্ত হয়। অথবা কাউকে যদি বলা যায় যে সাইকেল চালানোর পদ্ধতি ভাষায় প্রকাশ করে লেখ। এই সহজ কাজটি করা আজও অসম্ভব।

পুঁজিবাদ সর্বদা চায় মানুষের দক্ষতাকে যন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করতে তার কারণ যন্ত্র কথা বলতে পারেনা, প্রতিবাদও করতে পারে না। ফলে শ্রমের উপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যান্ত্রিকীকরণের প্রক্রিয়া যেমন জারি রয়েছে তার সাথে সাথে মানুষের মস্তিষ্কের সেই অংশও প্রসারিত হচ্ছে যা আজও অব্যক্ত বা যা কোন কাঠামোয় রূপান্তরিত করা যায়নি। তবে এ কথা ঠিক যে আজ যা সংকেতে রূপান্তরিত করা যায়নি তা ভবিষ্যতেও সম্ভবপর হবে না এরকম কোন কথা নেই, কিন্ত সাথে সাথে সেই অব্যক্ত বা ট্যাসিট নলেজের অংশও বাড়তে থাকবে।

 নতুন প্রযুক্তির পূর্ণ সামাজিক প্রভাব কি হতে চলেছে তা এখনই ভবিষ্যৎবাণী করা সম্ভব নয়।  স্টিম এনজিন আবিষ্কার হয়েছিল ১৭৪৮ সালে।  অর্থনীতিতে তার সামগ্রিক প্রভাব উপলব্ধ হয়েছিল ১৮৬৫ সালের আগে নয়।  একইভাবে ইলেকট্রিক ডায়নামোর আবিষ্কারের প্রায় ৪০ বছর বাদে তা জল ও বাষ্প শক্তিকে শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে প্রতিস্থাপিত করেছিল।  অতএব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অন্যান্য নতুন প্রযুক্তি সামগ্রিক অর্থনীতিতে কি প্রভাব ফেলবে তা আজও অজানা।  কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, যেহেতু এই ধরনের প্রযুক্তি মূলত জ্ঞানকেন্দ্রিক তাই স্বল্প শিক্ষিত মানুষদের কর্মসংস্থানের উপযোগী কোন সম্ভাবনা এই প্রযুক্তির ফলে তৈরি হবে এরকম আশা করা কঠিন।

এ কথা ঠিক যেখানে সরাসরি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কাজের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে পুরোপুরি মানুষকে যন্ত্রের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা কঠিন।  যেমন গৃহস্থালি রক্ষণাবেক্ষণ, সুপারভাইজিং, নার্সিং অথবা কেয়ার ওয়ার্ক, জিম ট্রেনার, বিউটি পার্লার ইত্যাদির যান্ত্রিক প্রতিস্থাপন কঠিন।  অতএব কিছু কম দক্ষতার কাজের চাহিদা বাড়তে পারে কিন্তু এগুলি অবশ্যই কম আয়ের কাজ।  অন্যদিকে বেশি দক্ষতার কাজ যেমন রোবোটিক ইঞ্জিনিয়ার বা সাংকেতিক বিশ্লেষকের চাহিদা তৈরি হলেও সাধারণ দক্ষতার মানুষদের তা অধরাই থেকে যাবে।  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল প্রযুক্তির এই রূপান্তরের পর্যায়ে উপযোগী দক্ষতা অর্জন যদি শুধুমাত্র নিজেদের পকেটের পয়সার উপরে নির্ভর করে, তাহলে একটা বড় অংশের গরিব মধ্যবিত্ত মানুষ আগামী প্রযুক্তির যুগে কর্মসংস্থানের সুযোগ হারাবে।

আজকের সময়ের প্রযুক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তা জ্ঞানকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে মূল্য সৃষ্টিতে ফিজিক্যাল রিসোর্সের ভূমিকা কম।  অন্যান্য সমস্ত উপকরণের থেকে জ্ঞান এ কারণেই আলাদা যে তা অন্যের সাথে আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে কমে যায় না, বরং বৃদ্ধি পায়।  নতুন প্রযুক্তি বিকশিত হয় উৎপাদক ও ব্যবহারকারীর মধ্যেকার ক্রমাগত আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে।  ইন্টারনেটের মধ্যে দিয়ে কোটি কোটি মানুষ প্রতি মুহূর্তে নিজেদের সঙ্গে অন্যদের চিন্তা ভাবনা ও পছন্দের আদান প্রদান করে চলেছে।  এর ফলে বিপুল তথ্য ভান্ডার তৈরী হচ্ছে যা প্রযুক্তির বিকাশের জন্য অন্যতম কাঁচামাল।  উৎপাদনের এত গভীর সামাজিকীকরণ অতীতে হয়নি।  মার্কস গ্রুন্ডরিসে আলোচনা করেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে যখন কোন একটি সৃষ্টির উপর কোন একজন ব্যক্তি মানুষের পূর্ণাঙ্গ দাবি আর থাকবে না এবং সেই সময় ব্যক্তিগত শ্রম ভিত্তিক মূল্যের ধারণাটিও ক্রমাগত অচল হতে থাকবে।  নির্দিষ্ট ব্যক্তিগত দক্ষতার পরিবর্তে যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তা হল সামাজিকভাবে সৃষ্ট জ্ঞান।  এই সামাজিক ভাবে সৃষ্ট বিস্তৃত তথ্য ও জ্ঞান যদি গুগল, আমাজন, ফেসবুকের মত ছয় সাতটা আন্তর্জাতিক কর্পোরেট সংস্থার নিয়ন্ত্রনে চলে যায়, তবে ওই জ্ঞান শুধু যে মুনাফার লক্ষ্যেই সীমিত হয়ে যাবে তাই নয়, তা মানুষের ভবিষ্যৎ পছন্দ অপছন্দকেও নিয়ন্ত্রণ করবে।

অন্যদিকে কর্মসংস্থান বাদ দিয়ে সমাজে উৎপাদিত সম্পদের বন্টন কিভাবে হবে তা পুঁজিবাদের জানা নেই। পুঁজিবাদে শ্রমশক্তি মুনাফা সৃষ্টির কাজে নিযুক্ত হলেই একমাত্র শ্রমিকের আয়ের ন্যায্যতা তৈরি হয়। তাই আয় একমাত্র কর্মসংস্থানের মধ্যে দিয়েই সম্ভব।  অতএব বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মচ্যুত হলে সমাজের উৎপাদিত দ্রব্যের ক্রেতা কারা হবে? পুঁজিবাদ এই প্রশ্নের নিরসন করতে চাইছে আয় স্থানান্তরের বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে। অর্থাৎ পুঁজিবাদ তার মৌলিক ভিত্তি থেকে সরে এসে আয়কে কর্মসংস্থান থেকে বিযুক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে।

আসলে নতুন প্রযুক্তির উপযোগী উৎপাদন কাঠামো এবং বন্টন সমাজের মৌলিক পরিবর্তন দাবি করে।  জ্ঞানকেন্দ্রিক উৎপাদন হতে হবে অনেক বেশি মুক্ত এবং পারস্পরিক সহযোগিতা নির্ভর। একই সাথে নতুন প্রযুক্তির বিকাশের উপযোগী সমাজে কাজের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সমাজের উৎপাদনে যে কাজের ইতিবাচক ভূমিকা আছে, সেই কাজেরই সমাজের কাছ থেকে প্রাপ্তির ন্যায্যতা আছে।  এই ধরনের কাজকে পুঁজিবাদ চিনতে পারে না কারণ এর মধ্যে অনেক কাজই মুনাফা সৃষ্টির কাজে নাও লাগতে পারে।  একারণেই একমাত্র সংহতি ভিত্তিক প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক একটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জ্ঞান-কেন্দ্রিক প্রযুক্তির বিকাশকে সুনিশ্চিত করতে পারে।  এটাই আগামী দিনের সমাজবাদ।  আর এই সামাজিক ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ সামাজিক পরিকল্পনা ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের দৈনন্দিন গণতান্ত্রিক তালমিল সৃষ্টির উপযোগী যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আজকের পৃথিবীতে একান্ত ভাবেই বাস্তব।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন