আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম। আমার একটি স্বপ্ন আছে। ছাপ্পান্ন বছর আগে মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষণের মর্মবস্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে পেয়েছে বৈধতা। তাঁর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি এখন গোটা মার্কিনমুলুকে। উপকূল থেকে উপকূলে। পশ্চিম উপকূলের লস অ্যাঞ্জেলস থেকে পূর্ব উপকূলের মিয়ামিতে।
২৮ আগস্ট, ১৯৬৩। ওয়াশিংটনে আড়াই লক্ষের বেশি মানুষের সমাবেশে মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন: আমার বন্ধুরা, আজ আমি তোমাদের বলছি, যদিও আমরা আজ এবং আগামী দিনগুলিতেও সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কিন্তু তাও আমি স্বপ্ন দেখি। এটি এমন একটি স্বপ্ন যার শিকড় আমেরিকার মানুষের স্বপ্নের গভীরে গেঁথে রয়েছে। আমি এমন একটি স্বপ্ন দেখি যেখানে একদিন আমাদের এই দেশ ঠিক মাথা তুলে দাঁড়াবে, অন্তর থেকে সে সত্যি সত্যি যা বিশ্বাস করে, তাকে নিয়ে বাঁচবে: ‘নিজের থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠা সেই সত্যগুলিকে আমরা আঁকড়ে ধরব, যেখানে সমস্ত মানুষই সমানভাবে গড়ে উঠবে।’
আজ ক্রোধে ফুটছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের রাস্তায় চলছে অবাধে ভাঙচুর। নিউ ইয়র্কের পথে দোতলা সমান আগুন জ্বলছে। কোথাও পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ছে। কোথাও পুলিশই হাঁটু মুড়ে ক্ষমা চাইছে বিক্ষোভকারীদের কাছে। সর্বোপরি, ঘেরাও হয়ে যাচ্ছে হোয়াইট হাউস। বিক্ষোভকারীদের ভয়ে বিশ্ব-কাঁপানো মার্কিন রাষ্ট্রপতি ঢুকে পড়ছেন গোপন বাঙ্কারে। হোয়াইট হাউসের মধ্যেই ওই বাঙ্কার তৈরি করা আছে জরুরি ঘটনা বা সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করার জন্য। দেশের নাগরিকরাই এখন ট্রাম্পকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন সেই বাঙ্কারে।
ক’দিন আগে ইকুয়েদরে জনরোষ এমন চেহারা নিয়েছিল যে রাজধানী থেকে প্রশাসনকে গুটিয়ে নিয়ে যেতে হয় অন্যত্র। বিশ্বাসঘাতক রাষ্ট্রপতি লেনিন (কাউটস্কি) মোরেনোকে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় রক্ষণশীলদের শক্ত ঘাঁটি গুয়াইয়াকুইলে, নৌবাহিনীর বাঙ্কারে। কিন্তু, তাই বলে ট্রাম্পকে! মিনসোটা প্রদেশের বৃহত্তম শহর মিনিয়াপোলিসে পুলিশের হাতে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে দাবানলের গতিতে। সপ্তাহ হলো, প্রতিবাদের বহর ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অন্তত ১৪০টি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ। কারফিউ জারি করতে হয়েছে অন্তত ৪০টি শহরে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত ৪,০০০ জনকে। তার মধ্যে পাঁচশ জনের বেশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক লস এঞ্জেলস থেকে। নামানো হয়েছে রিজার্ভ মিলিটারি ফোর্স ‘ন্যাশনাল গার্ড’। বিক্ষোভ মোকাবিলায় সেনা নামানোর হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। লক্ষণীয়ভাবে মার্কিন ক্ষমতা ও ধনসম্পত্তির কেন্দ্রগুলিতেই বিক্ষোভের মাত্রা সবচেয়ে চড়া। যেমন ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউস, তেমনই নিউ ইয়র্ক সিটিতে ট্রাম্প টাওয়ার। ভাঙচুর জর্জিয়ায় সিএনএন সদর দপ্তরে। মার্কিন বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে এবং নিজেদের দেশে বর্ণবাদ ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ।
উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ট্রাম্প যেদিন চরম অবজ্ঞায় ‘কুৎসিত দেশ’ বলেছিলেন, সেদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বসবাসরত অশ্বেতাঙ্গরা বুঝে গিয়েছিলেন তাঁদের রক্ষা করার মতো কেউ নেই। করোনায় বেআব্রু মার্কিন দম্ভ। দেখে মনে হচ্ছে যেন রোয়ান্ডা। মৃত্যু ১,০০,০০০ ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ লক্ষের উপর। আজ, এই মুহূর্তে ট্রাম্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা, প্রাক্তন গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি জনগণকে ‘মার্কিন জীবনধারার’ জন্য ‘আত্মত্যাগ করতে’ বলেছেন। যে ‘জীবনধারায়’ যখন যুদ্ধবিমানের প্রাচুর্য্য থাকে, তখন জীবনদায়ী ভেন্টিলেটর থাকে সাকুল্যে ১ লক্ষ ৬০ হাজার, যেখানে অসুস্থদের চিকিৎসার জন্য দরকার ১০ লক্ষের বেশি। যে জীবনধারায় দেশের অর্ধেক মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করে একটি বেতন পাওয়া থেকে আরেক বেতনের অপেক্ষায়, ৪ কোটি মানুষ রয়েছেন দারিদ্রের মধ্যে, ৮ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের হয় কোনও বীমাই নেই, অথবা যে বীমাটুকু আছে তাতে সামান্য চিকিৎসা পর্যন্ত হয় না, এবং ৫ লক্ষ এমন মানুষ আছেন, যাঁদের নেই মাথা গোঁজার কোনও জায়গা।
যে জীবনধারায় নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যু হয় পুলিশের নির্বিকার গুলিতে, বিপরীতে মিশিগানে বিক্ষোভরত সশস্ত্র নব্য-নাৎসিদের রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প সার্টিফিকেট দেন: ওরা সবাই ‘ভালো মানুষ’! লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণায় ‘স্বস্তিকা’ প্রতীক নিয়ে মিশিগানের আইনসভার সামনে প্রতিবাদ বিক্ষোভে শামিল হয় নব্য-নাৎসিরা। আর তা দেখে মিশিগানের ডেমোক্র্যাট গভর্নর গ্রেচেন হুইটনারকে ওইসব ‘ভালো মানুষদের’ সঙ্গে বোঝাপড়া করতে বলেন ট্রাম্প। এক টুইটে ট্রাম্প বলেন, ‘ওরা সবাই ভালো মানুষ। তবে ক্ষুব্ধ। ওরা নিরাপদে ওদের আগের জীবনে ফিরে যেতে চান। ওদের দিকে তাকান, ওদের কথা শুনুন, একটা বোঝাপড়ায় আসুন।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উগ্র দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলির উপর গবেষণা করে থাকে সাউদার্ন পভার্টি ল সেন্টার। তাদের সমীক্ষা বলছে, ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী সংগঠনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৫ শতাংশ।
করোনা মোকাবিলায় ট্রাম্পের হাতিয়ার বর্ণবিদ্বেষ। যে কারণে বিক্ষোভ দমনে রকের ভাষায় ‘হিংস্র কুকুর লেলিয়ে’ দেওয়ার হুমকি দেন। কিংবা চোখ রাঙিয়ে বলেন, ‘লুট শুরু হলে, শুরু হবে শুট (গুলি)।’ অন্যদিকে একুশে মে, মার্কিন ডাকসাইটে আর্থিক পত্রিকা ফরচুনে আর্তনাদ: মার্কিনমুলুকে প্রকৃত বেকারত্বের হার ছাড়িয়েছে সাড়ে ২২ শতাংশ। যা মহামন্দার সময়ে সর্বোচ্চ শিখরে (১৯৩৩) পৌছনো বেকারত্বের হার ২৫.৬ শতাংশের ঠিক নিচে। মার্কিন শ্রমদপ্তরের হিসেবে, মহামারির সময় (মধ্য-মার্চ থেকে) বেকারভাতার জন্য আবেদনপত্র জমা পড়েছে ৩ কোটি ৮৬ লক্ষ। যা মার্কিনমুলুকের ২১টি প্রদেশের মিলিত জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। মে মাসের গোড়ায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, ছাঁটাই কাজের ৪২ শতাংশই মুছে গিয়েছে পাকাপাকিভাবে। এপ্রিলের শেষে, আর মে’র গোড়ায় সেনসাস ব্যুরোর একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রাপ্ত বয়স্কদের ৪৭ শতাংশই, অথবা তাঁর পরিবারের কেউ মার্চের ১৩ তারিখ থেকে কাজ হারিয়েছেন। ৩৯ শতাংশের আশঙ্কা, তাঁর অথবা পরিবারের কেউ একজন আগামী মাসের মধ্যে কাজ হারাবেন। ১১ শতাংশ জানিয়েছে তাঁরা সময়মতো ভাড়া দিতে পারেননি, অথবা কিস্তির অর্থ মেটাতে পারেননি। আগামী মাসে দেওয়ার ব্যাপারে সংশয়ে ২১ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও প্রাণহানির শিকার হয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গরা। কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে সরকারের দিক থেকে নেওয়া হয়নি কোনও বিশেষ পদক্ষেপ। উলটে লাগাতার বর্ণবাদী নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। জীবন যন্ত্রণায় কৃষ্ণাঙ্গরা যখন ফুঁসছিলেন, ঠিক তখনই শ্বেতাঙ্গ এক পুলিশকর্তার হাতে নির্মমভাবে খুন হন কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড। মাটিতে পেরে ফেলে ওই পুলিশ কর্তা যখন হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে থাকে তাঁর ঘাড়, তখন ছটফট করতে থাকা ফ্লয়েডের শেষ আর্তি ছিল ‘প্লিজ, আমি শ্বাস নিতে পারছি না’, ‘আমাকে মারবেন না’। ‘আমিও শ্বাস নিতে পারছি না’ স্লোগান তাই দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে শহরে-শহরে। ঠিকই, মার্কিনমুলুকে বিলিওনেয়ার আর কতিপয় ধনী ছাড়া কে-ই বা ‘শ্বাস নিতে’ পারছেন! প্রতিবাদ-বিক্ষোভে তাই কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গরা। ছাঁটাই শ্রমিক থেকে বেকার যুবক।
এই বিক্ষোভের শিকড়ে রয়েছে আসলে বর্ণবাদ, জাতিবিদ্বেষ, অসাম্য আর সামাজিক অবিচারে। যে কারণে নিউ ইয়র্ক টাইমসে রেক্সোনা গে’র জিজ্ঞাসা, ‘করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আজ না হয় কাল আবিষ্কৃত হবে, কিন্তু আমেরিকার মতো মহান দেশে বর্ণবাদের যে বিষাক্ত ভাইরাস ছড়িয়ে আছে, তার টিকা কি আবিষ্কার করা যাবে? শুধু হ্যাশট্যাগের বর্ণবাদ-বিরোধিতা কি আমেরিকাকে রক্ষা করতে পারবে?’
আজ থেকে বহু বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতন্ত্রীদের প্রতি লেনিনের আবেদন ছিল তাঁরা যেন শেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধাচারণ করেন। এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। মার্কিনমুলুকে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের প্রতি শেতাঙ্গদের ঘৃণা, শোষণ এবং বর্ণের ভিত্তিতে নির্মিত ‘জাতীয়করণ’র ধারণা শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে তোলার পক্ষে অন্তরায়, দৃঢ়ভাবে মনে করতেন লেনিন। ১৯১৩-তে প্রকাশিত ‘ক্রিটিকাল রিমার্কস অফ ন্যাশনাল কোয়েশ্চেনস’-এ লেনিন লিখেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রদেশগুলির উত্তর ও দক্ষিণভাগে বিভাজন জীবনযাপনের সব শাখাতেই প্রতীয়মান হচ্ছে। উত্তরের প্রদেশগুলির বরাবরের ঐতিহ্য স্বাধীনতার, দাস মালিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের, তেমনি দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে রয়েছে দাস মালিকানা, কৃষ্ণাঙ্গদের উপর নিপীড়ন, যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে আক্রান্ত এবং সাংস্কৃতিক ভাবে পিছিয়ে (৪৪ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নিরক্ষর, যেখানে শেতাঙ্গরা মাত্র ৬ শতাংশ)। উত্তরের প্রদেশগুলিতে কৃষ্ণাঙ্গরা শেতাঙ্গ শিশুদের সঙ্গে একই স্কুলে পড়ে। দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের জন্য পৃথকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী’ বা ‘বর্ণভেদী’ স্কুল। আমার মনে হয় এটিই স্কুলগুলির ‘জাতীয়করণ’ একটি পূর্র্ণাঙ্গ দৃষ্টান্ত’। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র শান্তি, সৌভ্রাতৃত্ব, মানবতাই সভ্যতার পথ। যে স্বপ্ন একদিন দেখতেন মার্টিন লুথার কিং। যেমন বলেছিলেন তিনি ওয়াশিংটনের সমাবেশে।
‘আমার একটি স্বপ্ন আছে— একদিন জর্জিয়ার লালপাহাড়ে, একসময়ের দাসের সন্তান আর একসময়ের দাস-মালিকের সন্তান একসঙ্গে ভ্রাতৃত্বের আসনে বসতে সক্ষম হবে। আমার একটি স্বপ্ন আছে, একদিন, এমনকি মিসিসিপি প্রদেশ, যে প্রদেশটি ছটফট করছে অবিচারের উত্তাপে, যে ছটফট করছে শোষণ নিপীড়নের উত্তাপে, একদিন তা পালটে গিয়ে হয়ে উঠবে মুক্তি আর ন্যায়ের মরূদ্যান। আমার একটি স্বপ্ন আছে, আমার ছোট্ট চার সন্তান, একদিন এমন একটি দেশের মধ্যে বসবাস করবে, গায়ের রঙ দিয়ে আর তাদের বিচার করা হবে না, বিচার করা হবে চরিত্রের গুণাবলী দিয়ে।’
শেয়ার করুন