মাতৃভাষায় ইশ্‌তেহার এবং রেড বুকস ডে -শান্তনু দে

২১ শে ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ (মঙ্গলবার)

একুশে: ভাষা দিবস। ২০০০ সাল থেকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি। এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশের শহীদরা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের প্রতিটি বর্ণমালার পাহারাদার। এবারে তার একাত্তর বছর।

একুশে: কমিউনিস্ট পার্টির ইশ্‌তেহারের প্রথম প্রকাশ। এবারে তার ১৭৫।

এই দুই মিলিয়েই একুশে ‘রেড বুকস ডে’। নিজের ভাষায় কমিউনিস্ট পার্টির ইশ্‌তেহার পাঠ। মাতৃভাষায় ইশ্‌তেহার-চর্চা।

ব্যাটেল অব আইডিয়াস


শুরু ২০২০ থেকে। প্রথমবারই পালিত হয় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ভেনেজুয়েলায়। নেপালি ভাষায় নেপালের পাহাড়ে তা যেমন পড়েছেন কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক সংগঠনের কর্মীরা, তেমনই পর্তুগিজ ভাষায় পড়েছেন ব্রাজিলের ল্যান্ডলেস ওয়ার্কার্স মুভমেন্টের কর্মীরা। স্প্যানিশ ভাষায় যেমন পড়া হয়েছে কিউবার স্টাডি সার্কেলে, তেমনই এই প্রথম সেসোথো ভাষায় (দক্ষিণ আফ্রিকার ১১টি সরকারি ভাষার একটি)। গায়েলিক ভাষায় যেমন পড়া হয়েছে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে কনয়ে বুকসে, তেমনই লেবাননের বেইরুটের কাফেতে আরবি ভাষায়।

শুরুর এই ভাবনাটা ছিল দিল্লির বামপন্থী লেফটওয়ার্ড বুকসের। সঙ্গে ছিল বাংলার ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, তামিলনাডুর ভারতী পুথাকলম, কেরালার চিন্তা, অন্ধ্রের প্রজাশক্তি, তেলেঙ্গানার নব তেলেঙ্গানা এবং বাম প্রকাশনা। লক্ষ্য ছিল একুশে দিনটি জায়গা করে নিক বিশ্বের বার্ষিক সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডারে। সেই লক্ষ্যেই ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব লেফট পাবলিশার্সের উদ্যেগে বিশ্বের বামপন্থী প্রকাশকদের নিয়ে গঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব লেফট পাবলিশার্স (আইইউএলপি)। এখন ইন্দোনেশিয়া থেকে কিউবার পঞ্চাশটির বেশি বামপন্থী ও প্রগতিশীল প্রকাশক এর সঙ্গে যুক্ত। গত তিনবছরে আইইউএলপি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে চারটি বই: লেনিন ১৫০, মারিয়েতেগুই, চে এবং প্যারি কমিউন ১৫০। প্যারি কমিউনের ১৫০-তম বার্ষিকীতে সাতাশটি প্রকাশনা সংস্থা একই দিনে একাধিক ভাষায় প্রকাশ করেছে একই বই। যা প্রকাশনার ইতিহাসে নজিরবিহীন।

১৯৯৯, কারাকাসে গিয়ে ফিদেল বলেছিলেন: ‘মারাত্মক শক্তিশালী সাম্রাজ্য’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘অবিরাম মতাদর্শগত যুদ্ধ চালাচ্ছে তাদের সমস্ত সম্পদ’ নিয়ে। আমাদের ‘জনগণকে তাই ন্যায্য মতাদর্শে সশস্ত্র করতে হবে।’ মানবতা রক্ষায় ও বর্বরতার বিরুদ্ধে নিরন্তর চালাতে হবে ‘ব্যাটেল অব আইডিয়াস’, মতাদর্শের সংগ্রাম।

একুশে ভাষা আন্দোলন


একুশের সংগ্রাম থেকেই বাঙালির জাতীয় চেতনার উন্মেষ। পরিণতিতে একাত্তরে মহান সশস্ত্র সংগ্রাম। স্বাধীন বাংলাদেশ।

তবে শুধুমাত্র ভাষার সংগ্রাম বা জাতীয় সংগ্রাম বললে একে রাজনৈতিক ভাষায় বুর্জোয়া বা পেটিবুর্জোয়া সংগ্রাম বলে চিহ্নিত করতে হয়। আসলে একুশের সংগ্রামের মধ্যে, একুশের চেতনার মধ্যে অনেক বেশি ছিল বামপন্থার উপাদান। একুশের সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন যারা তৈরি করেছিলেন, তাদের মধ্যে কমিউনিস্টরাই ছিলেন নেতৃত্বে। সেকারণে ভাষা আন্দোলনের ছিল না উর্দু বিদ্বেষ। এব্যাপারে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি ছিল খুবই সচেতন। কমিউনিস্টরা আন্তর্জাতিকতাবাদী। আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্টরা সচেতন ছিলেন, যাতে এই আন্দোলন উগ্র জাতীয়তাবাদে রূপ না নেয়। তাই ভাষা আন্দোলনের দাবি ছিল উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
ভাষার সঙ্গে আছে শ্রেণির সম্পর্ক। ভাষা আন্দোলনেরও আছে শ্রেণি বৈশিষ্ট্য।

ভাষা আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন বাংলার কৃষক সমাজ। না হলে এই আন্দোলন এতো জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারতো না। ১৯৫৪’র নির্বাচনে হতো না মুসলিম লীগের ভরাডুবি।

ভাষার দাবিতে শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে সেই আন্দোলন ছিল মুসলিম লিগ ও পাকিস্তান সরকারের সামগ্রিক শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্তের এক ব্যাপক আন্দোলন।

একুশে ইশ্‌তেহারের প্রথম প্রকাশ


নভেম্বর, ১৮৪৭: কমিউনিস্ট লীগের দ্বিতীয় কংগ্রেস থেকে ‘পার্টির তত্ত্বগত ও বাস্তব কর্মসূচী বিস্তৃতভাবে রচনা করা ও প্রকাশ করার’ (কমিউনিস্ট পার্টির ইশ্‌তেহার তৈরির) দায়িত্ব দেওয়া হয় মার্কস-এঙ্গেলসকে। কংগ্রেস শেষ হওয়ার পর ডিসেম্বরে মার্কস ফিরে যান ব্রাসেলসে। আর এঙ্গেলস প্যারিসে। তাঁদের উপর দায়িত্ব ছিল—  একসঙ্গে বসে লীগের একটি কর্মসূচী রচনা করা—  দূরে থাকার কারণে তা পালনে সমস্যা হয়। শেষে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে বছর ঘুরতেই জানুয়ারির শেষে লন্ডনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের থেকে মার্কস পান তাগাদাপত্র। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠাতে হবে পাণ্ডুলিপিটি, নতুবা ‘তাঁর বিরুদ্ধে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ চিঠিটি যখন পৌছয়, পাণ্ডুলিপিটি অবশ্য তার আগেই পাঠানো হয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে তা লন্ডনের পথে। লন্ডনের বিশপগেটে ৪৬ লিভারপুল স্ট্রিটের ছোট্ট একটি ছাপাখানায় ছাপানো হয় সেই পাণ্ডুলিপি।

একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৮। প্রকাশিত হয় ২৩-পাতার একটি ছোট্ট সাদাসিধে চেহারার পু্স্তিকা: কমিউনিস্ট পার্টির ইশ্‌তেহার। ভ্লাদিমির লেনিনের ভাষ্যে: ‘প্রতিভাদীপ্ত স্বচ্ছতা ও উজ্জ্বলতায় এই রচনাটিতে উপস্থাপিত হয় এক নতুন বিশ্ববীক্ষা— সমাজ জীবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সুসংগত বস্তুবাদ বিকাশের সবচেয়ে সর্বাঙ্গীন ও সুগভীর মতবাদ—  দ্বান্দ্বিকতা, শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব এবং নতুন কমিউনিস্ট সমাজের স্রষ্টা প্রলেতারিয়েতের বিশ্ব-ঐতিহাসিক বিপ্লবী ভূমিকা।’

এই কাজ মার্কস-এঙ্গেলসের সৃষ্টি হলেও, তার একটি অংশ এঙ্গেলসের ‘কমিউনিজিমের নীতি’ বইটির ভিত্তিতে তৈরি হলেও, মার্কসই দিয়েছেন এর ভাষা ও ভার। ইশ্‌তেহারের খসড়া পাণ্ডুলিপিটির একটি মাত্র পাতা খুঁজে পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায় এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাকে কমিউনিস্ট পার্টির দিকদর্শন যন্ত্রে পরিণত করতে মার্কস কী অক্লান্ত পরিশ্রমই না করেছেন। সঠিক শব্দ, বাক্য ও অনুচ্ছেদের জন্য তাতে অসংখ্য কাটাকুটি।

আজও প্রাসঙ্গিক


আজ তার ১৭৫ বছর। কী আশ্চর্য আজও তা সমান প্রাসঙ্গিক। যেন গতকাল লেখা হয়েছে।

খুব সম্ভবত, এই প্রথম অস্কার মঞ্চে কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহারের প্রত্যয়ী উচ্চারন। অস্কার নিতে উঠে ‘আমেরিকান ফ্যাক্টরি’ অন্যতম পরিচালক জুলিয়া রেইচার্ট শুনিয়েছেন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর অমোঘ আহ্বান, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’।

সংকট থেকে রেহাই পেতে বছরকয়েক আগে দ্য ইকনমিস্টের পরামর্শ, মার্কসকে পড়ুন। ‘বিশ্বের শাসকরা: কার্ল মার্কস পড়ুন!’ অষ্টাদশ ব্রুমেয়ারে মার্কসের অমোঘ লাইন ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি ঘটায় বটে, তবে ‘প্রথমবার যা হয় ট্র্যাজেডি, দ্বিতীয়বার তা হয়ে পড়ে প্রহসন।’ সেই বক্তব্য ধরেই উপশিরোনাম, ‘দ্বিতীয়বার, প্রহসন।’

নিবন্ধের সারকথা: ‘তাঁর দ্বিশতবর্ষে, পুঁজিবাদের ত্রুটি সম্পর্কে মার্কসের রোগ নির্ণয় এখনও বিস্ময়করভাবে প্রাসঙ্গিক।’

যদিও, এই সংকটের আগেও মার্কস ছিলেন একনম্বরে।

সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯। বি বি সি’র অনলাইন ভোট। বেছে নিতে হবে ‘সহস্রাব্দের সর্বকালীন সেরা চিন্তাবিদ’। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটন, এমনকি চার্লস ডারউইনকে বিরাট ব্যবধাণে পিছনে ফেলে একনম্বরে মার্কস।

আর এখন ‘ক্যাপিটাল’ পড়ার হিড়িক।

২০১৫, মেরিয়াম ওয়েবস্টার অনলাইন অভিধানে সবচেয়ে সন্ধানী শব্দ ছিল ‘সমাজতন্ত্র’।

২০১৬, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা, এই সহস্রাব্দের তরুণদের অধিকাংশই প্রত্যাখ্যান করেছে পুঁজিবাদকে। তিনভাগের একভাগ সমাজতন্ত্রের পক্ষে।

ব্রিটিশ গার্ডিয়ানে শিরোনাম, ‘দুই শতাব্দী হয়ে গেল, যে কোনও সময়ের তুলনায় মার্কস এখন নিজেকে মনে করছেন অনেক বেশি বিপ্লবী।’

নিউ ইয়র্ক টাইমসের উপসম্পাদকীয় পাতায় শিরোনাম ‘শুভ জন্মদিন, কার্ল মার্কস। আপনি ছিলেন সঠিক!’

সংকটের প্রথম বছর, ২০০৯। এই প্রথম দাস ক্যাপিটাল নিয়ে ছবি। করেছেন জার্মান পরিচালক আলেকজান্ডার ক্লুগ। ৫৭০-মিনিট, সাড়ে ন’ ঘন্টার দীর্ঘ ছবি। এবং ‘এক মিনিটও বাড়তি নয়।’ বলেছেন হেলমুট মার্কার, ডাকসাইটে জার্মান দৈনিক ‘তাগেসপিগেল’-এ।

বি বি সি’র ২০১৬’র খবর। অক্সফামের প্রতিবেদনে আর্তনাদ: ধনীশ্রেষ্ঠ ১ শতাংশের সম্পদের পরিমাণ বাকি ৯৯ শতাংশের চেয়ে বেশি। জোশেফ স্টিগলিৎজের কথায়, ‘এক শতাংশের, এক শতাংশের দ্বারা, এক শতাংশের জন্য।’

ভাবা যায় কোন বিশ্বে আমরা বাস করছি? ভেবেছিলেন মার্কস।

স্টিগলিৎজ আসলে নতুন কিছু বলেননি! বলে গিয়েছিলেন মার্কস। আজ থেকে ১৭৫ বছর আগে। কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহারে। ১ শতাংশ বনাম ৯৯ শতাংশের ভবিষদ্বাণী। জনসংখ্যার দশভাগের একভাগ বনাম নয়ভাগের কথা। উৎপাদন উপায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানে কমিউনিস্টদের কর্মসূচী নিয়ে পুঁজিবাদীদের অভিযোগের জবাবে মার্কস বলেছিলেন:

‘আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান চাই শুনে আপনারা আতঙ্কিত হচ্ছেন। অথচ, আপনাদের বর্তমান সমাজে জনগণের নব্বই জনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি তো ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে। অল্প কয়েকজনের হাতে সম্পত্তি থাকার একমাত্র কারণ হলো ওই দশভাগের নয়ভাগ লোকের হাতে কিছুই না থাকা। সুতরাং, আমাদের বিরুদ্ধে আপনাদের তীব্র ভৎসনা এই কারণে যে, সম্পত্তির অধিকারে এমন একটা রূপ আমরা তুলে দিতে চাই, যা বজায় রাখার অনিবার্য শর্ত হলো সমাজের বিপুল সংখ্যাধিক্য লোকের কোনও সম্পত্তি না থাকা।

এককথায়, আমাদের বিরুদ্ধে আপনাদের তীব্র ভৎসনা এই কারণে যে, আপনাদের সম্পদের উচ্ছেদ আমরা করতে চাই। ঠিক কথা, আমাদের সঙ্কল্প ঠিক তা-ই।’

পুঁজিবাদের একেবারে গোড়ায় লিখেছিলেন মার্কস। যে বছর মার্কসের জন্ম, ব্রিটেন তখন সবে বিশ্বের প্রথম রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা করছে। আর মার্কসের বয়স যখন সাত, তখন এই বিশ্বে প্রথম চলতে শুরু করেছে রেল। তখনও টেলিফোন আবিষ্কার হয়নি। ব্রিটিশ শিশুদের অর্ধেকই মারা যায় পাঁচ বছরের জন্মদিনের আগে। সেসময় কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহার।

আর এখন, এই আই-ফোনের যুগেও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক।

এটা ঠিক, মার্কস ফেসবুকের দূরদর্শন করেননি। কিন্তু তাঁর উপলব্ধিতে ছিল জুকেরবার্গের ‘বিজনেস মডেল’।

‘পুঁজিবাদ পৌছছে শিখরে, শেষে বিশ্ব প্রস্তুত মার্কসের জন্য।’ শিরোনাম ব্রিটিশ ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায়।

নিবন্ধের সারকথা, ‘দার্শনিকের (মার্কসের) পূর্বাভাস ছিল কেন্দ্রীভবন নিয়ে যাবে বিপ্লবের দিকে এবং জন্ম দেবে পুঁজিবাদ-উত্তর সমাজের— বিশ্বায়ন আমাদের নিয়ে চলেছে সেই অভিমুখে।’


শেয়ার করুন

উত্তর দিন