লড়াইয়ে লুলা, ‘আশার আলো’ ব্রাজিলে

বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য

১৯৮৯, কয়েক সপ্তাহ ধরে একটা গান বাঁধতে চেষ্টা করছেন হিলটন আকিওলি। যে গানের সুর আর কথাগুলো হতে চলেছে পরবর্তী সময়কার বিশ্ব ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ও মোড় ঘোরানো রাজনৈতিক নেতার উত্থানের। শেষ পর্যন্ত শীতকালের এক সকালে ছন্দ ধরা দিল আকিওলির গানে— ‘লুলা লা— একটা তারা ঝলমল করছে। লুলা লা— একগুচ্ছ আশার আলো দেখা যাচ্ছে।’

লুলা দ্য সিলভা। একজন গরির চর্মকারের ছেলে থেকে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। পরবর্তীতে গোটা পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে ব্রাজিলের প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি। আকিওলির সুরেলা গানটা ছিল তাঁকে নিয়েই। যদিও লুলা প্রথম তিনটে নির্বাচন হেরেছিলেন। ১৯৮৯, ১৯৯৪ এবং ১৯৯৮-তে। কিন্তু ততদিনে ব্রাজিলে বামপন্থার ভিত শক্ত হয়ে গিয়েছে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ফলস্বরুপ ২০০২ তে ওয়ার্কার্স পার্টির লুলা ৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি। ব্রাজিলের গরিব শ্রমজীবী মানুষের তখন বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস। ২০১১-তে লুলা যখন রাষ্ট্রপতি পদ ওয়ার্কার্স পার্টিতে তাঁর উত্তরসূরি দিলমা রুসেফের হাতে ছেড়ে যাচ্ছেন, তখন ব্রাজিলের দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কমে হয়েছে ৪০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে। আর জনগনের মধ্যে লুলার সমর্থনের হার ৮৩ শতাংশ। এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। পশ্চিমের তাবড় তাবড় সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যে লুলাই তখন পৃথিবীর জনপ্রিয়তম রাষ্ট্রনেতা।

সেই ট্রেড ইউনিয়ন নেতাই আজ ফের একবার ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে। এ’বছর অক্টোবরে নির্বাচন। সাজানো দুর্নীতির দায়ে যারা লুলাকে ২০১৮ সালে জেলে পাঠিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধেই। যদিও সহজ ছিল না লুলার এইভাবে ফিরে আসাটা। এপ্রিল, ২০১৮। কোনও তথ্যপ্রমান ছাড়াই অভিযুক্ত করা হয় লুলা দা সিলভাকে। ভুয়ো মামলায় একতরফা দোষী সাব্যস্ত। হাস্যকরভাবে মোট ২৬ বছরের জেলের সাজা। ২০১৮-তেই ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। জেলে থেকেই বরাবরেই মতই জনপ্রিয়তায় এক নম্বরে ছিলেন লুলা। ধারেকাছে কেউ নেই। জনমত সমীক্ষায় সবচেয়ে কাছের প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ব্যবধান। কিন্তু বিচারব্যবস্থার চালাকিতে প্রার্থী হতে পারলেন না।

বিপর্যয় ঘটে গেল ব্রাজিলে। জিতে এলেন ব্রাজিলের ‘ট্রাম্প’ বলে পরিচিত প্রাক্তন সেনা আধিকারিক উগ্র দক্ষিনপন্থী বোলসোনারো। লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতি চলতে শুরু করল উল্টোপথে। নয়া উদারবাদের ভয়াবহ দিকটা গ্রাস করে ফেলল ব্রাজিলকে। তারপর করোনা এসে করে দিল আরও সর্বনাশ। ঠিক ট্রাম্পের মতই অযোগ্য ও অপদার্থভাবে করোনাকে মোকাবিলা করে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুকে ছুঁয়ে ফেললেন বোলসোনারো। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের বিশেষজ্ঞদের কোনরকম পরামর্শে কর্ণপাত না করে নিজের মতো চলেছেন বলসেনারো। ব্রাজিলে মারা গেলেন সাড়ে ছয় লক্ষ মানুষ। বেকারি ও দুর্নীতির আজ চরম সীমায় ব্রাজিল। কোভিডের সময়ে স্রেফ দুবেলা উপোষ করেই ছিলেন দেশের মোট জনসংখ্যার নয় শতাংশ মানুষ, আর কোনরকমে একবেলা খেয়ে থেকেছেন দেশের কুড়ি শতাংশ মানুষ। দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির হার ছুঁয়েছে পনের শতাংশে। লুলা ও তাঁর ওয়ার্কার্স পার্টি ব্রাজিলকে যে সামাজিক সুরক্ষার আসনে বসিয়ে গেছিলেন, সেই ব্রাজিল আজ খাদের কিনারে।  গোটা বিশ্ব দেখেছে ট্রাম্প ও মোদীর সাথেই পাল্লা দিয়ে তাঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলসেনারো কিভাবে ব্রাজিলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটা দেশের সবকিছু কর্পোরেটের হাতে তুলে দিয়েছেন, কিভাবে নির্বিচারে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ আমাজনকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিভাবে দেশের বিরোধীদের তথা বামপন্থীদের ওপর অত্যাচার নামিয়ে এনেছেন, ধ্বংস করেছেন গনতন্ত্রকে, জাগিয়ে তুলেছেন বর্ণবাদকে।

তাঁর ওপর সাজানো মামলার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিলেন লুলা। কোনরকম তথ্য প্রমান না পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই লুলার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাজা সোজাসুজি খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এডসন ফাচিন। তিনি পরিস্কার ভাষায় বলেন— ব্রাজিলের দক্ষিণের শহর কারিতিবার আদালত যে দুর্নীতি মামলায় লুলাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং জেলে পাঠিয়েছে, সেই মামলা বিচার করার তাদের কোনও এক্তিয়ারই নেই।

নভেম্বর ২০১৯। ব্রাজিল জুড়ে সেদিন উচ্ছ্বাস । কারন ঐদিনই যে আগামী নির্বাচনে লুলার প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দরজা খুলে গেছিল। সেদিন সাউ বার্নাদো দো ক্যাম্প শহরে এবিসি মেটাল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সদর দপ্তরের সামনে ভিড়ে উপচে পড়ে লুলার মুক্তির সমাবেশ। ঠিক ৫৮০ দিন আগে এখান থেকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল লুলাকে। উদ্বেল জনতার সামনে লুলা মুষ্টিবদ্ধ হাতটি ছুড়ে দেন আকাশের দিকে। বিরোধী উগ্র দক্ষিণপন্থার উদ্দেশে শোনান হুঁশিয়ারি, ‘আমি শুধু ওদের বলতে চাই: আমি ফিরে এসেছি! দেখা হবে ২০২২ সালে!’ পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে।

লুলা মুক্তির পরে স্বাভাবিকভাবেই ঝাঁঝ বেড়েছে বলসেনারো বিরোধী আন্দোলনে। বৃত্তটা বড় করেছেন লুলা। ওয়ার্কার্স পার্টির সাথেই অন্যান্য বাম, মধ্য-বাম সহ প্রগতিশীল সাতটি দলকে একজোট করেছেন। করোনা একটু কমার পরে গত অক্টোবরেই বলসোনারোকে অপসারণের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন ব্রাজিলের লক্ষ লক্ষ মানুষ। একযোগে দেশটির ১৬০টির বেশি শহরে এই বিক্ষোভ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল । শুধু বিক্ষোভই না, বলসোনারোকে ইমপিচমেন্টের দাবিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে শতাধিক আবেদন করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে একাধিক ইস্যুতে তদন্তের অনুমোদনও দিয়েছেন ব্রাজিলের সর্বোচ্চ আদালত। তবে নিজের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই মানতে নারাজ বলসোনারো।

এর মধ্যেই ব্রাজিল সরকারের জনপ্রিয়তা নিয়ে একটি জনমত সমীক্ষা করেছে অ্যাটলাস ইনস্টিটিউট। সেখানে দেখা গেছে, এই মুহূর্তে ব্রাজিলের ৬১ শতাংশ বাসিন্দা মনে করেন, দেশ পরিচালনায় বলসোনারো সরকারের কর্মকাণ্ড একেবারেই সন্তোষজনক নয়। আরও এক জনমত সমীক্ষায় প্রকাশ, আগামী নির্বাচনে ফাইনাল রাউন্ডের ফলাফল হতে চলেছে লুলার পক্ষে ৫১ শতাংশ ভোট এবং বলসোনারোর পক্ষে ৩৬ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ ১৫ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে এই মুহূর্তে লুলা এগিয়ে। আর মাত্র পাঁচ মাস। ইতিমধ্যেই গত ৭ ই মে সাও পাওলোর সমাবেশ থেকে লুলা সরকারিভাবেই নিজের প্রার্থীপদ ঘোষণা করেছেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন– ‘ব্রাজিলের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করা জরুরী। আমি এখনও লড়াই করার জন্য যথেষ্ট তরুণ আছি। রাজনীতি আমার শরীরের রক্তে মিশে গেছে। আর নতুন করে রাজনৈতিক লড়াই শুরুর একটি কারণ আছে। ১২ বছর আগে রাষ্ট্রপতির অফিস ছাড়ার পর এখন দেখছি যে, গরিবদের স্বার্থে আমি যে সমস্ত নীতি তৈরি করেছিলাম তা ধ্বংস হয়ে গেছে। স্বৈরাচারী ও বর্ণবিদ্বেষী শাসকের হাত থেকে ব্রাজিলকে উদ্ধার করা জরুরী’।

লুলা তাঁর বক্তব্যে জোর দিয়েছেন আফ্রিকার সাথে ব্রাজিলের সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের ব্যাপারেও। লুলার মতে আফ্রিকার কাছে ব্রাজিল ঋণী। এই ঋণ টাকা পয়সার নয়। এই ঋণ সংহতির। কালো মানুষদের ওপর ৩৫০ বছরের অত্যাচারের ইতিহাসের ঋণ। আফ্রিকার ইতিহাস, কালো মানুষদের সংগ্রামের ইতিহাস প্রতিটা স্কুলের সিলেবাসে থাকবে যাতে বাচ্চারা ভবিষ্যতে কখনও কোন আফ্রিকান বা কালো মানুষকে ছোট মনে না করে। আসলে এইসব প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার বিপরীত পথে হেঁটেছেন ট্রাম্পের বন্ধু বলসোনারো, ফলে আজ ব্রাজিলের সমাজে বেড়েছে ঘৃণা, হিংসা ও কুসংস্কার। যার সাথে অনেকে মিল পাবেন আজকের ভারতের। বামপন্থী লুলার লড়াই তাই এই ফ্যাসিস্ত অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধেও। লুলার নিজের মতে এই নির্বাচনে জয়ের চেয়েও বেশি ব্রাজিলের পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। অর্থনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে লুলা চাইছেন লাতিন আমেরিকার এক এবং অভিন্ন একটি ডিজিটাল মুদ্রা, যেটা গোটা মহাদেশের ব্যবসা বানিজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং বলা বাহুল্য লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল স্বাভাবিকভাবেই তাতে নেতৃত্ব দেবে। এই অভিন্ন মুদ্রার ফলে গোটা লাতিন আমেরিকার মহাদেশের সব দেশগুলোর মধ্যে একতাও বাড়বে।

আজকের ব্রাজিলের পরিস্থিতি বদলাতে লুলা নিজে আশাবাদী, বলছেন– যেটা হয়ে গেছে সেটা অতীত, ফের একবার নতুন ব্রাজিল তৈরি করতে তিনি প্রস্তুত । ব্রাজিলে আজ একুশের যুবক-যুবতী থেকে থেকে সত্তরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মনেও ফের একবার আকিওলির বিখ্যাত মেলোডিটা উঁকি দিচ্ছে: ‘লুলা লা— একটা তারা ঝলমল করছে। লুলা লা— একগুচ্ছ আশার আলো দেখা যাচ্ছে।’


শেয়ার করুন

উত্তর দিন