34 years Of LeftFront 1

প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্বে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে

প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্বে ধোয়াঁশার জায়গা আছে কি?

দেবাশিস চক্রবর্তী

পশ্চিমবঙ্গে সংগঠিত বামপন্থী দলের কর্মী- সমর্থকদের বাইরেও অসংখ্য মানুষ রয়েছেন যাঁরা চিন্তায় বামমুখী। বহুদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের মননে বামপন্থা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে। বামপন্থী আন্দোলনের সাধারণভাবে সমর্থক, কখনো সমালোচক, এমন মানুষ প্রায় প্রতি পাড়াতেই রয়েছেন।

34 years Of LeftFront 1

এই মানুষজনের মধ্যে সচেতন ভাবেই কিছু ধোঁয়াশা তৈরির চেষ্টা চলছে। এক ধরনের চেষ্টা সংবাদমাধ্যমে তাত্ত্বিক-আধা তাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলে। বামপন্থীদের ভোট দিয়ে কী হবে? বামপন্থীরা কি বিজেপি-র মত দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে ভোট ‘ভাগ’ করতেই সাহায্য করছে না? আরেক ধরনের তৎপরতা রাজনৈতিক শক্তির তরফে। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, ‘বামপন্থী বন্ধুরা ভোট নষ্ট না করে আমাদের ভোট দিন’। তৃণমূল পাড়ায় পাড়ায় বলছে সংযুক্ত মোর্চা তো জিতবে না, বিজেপি-কে আটকাতে তৃণমূলকেই ভোট দিন। বিজেপি পাড়ায় পাড়ায় বলছে, সংযুক্ত মোর্চা তো জিতবে না, তৃণমূলকে হারাতে বিজেপি-কেই ভোট দিন।

পশ্চিমবঙ্গে লড়াই হচ্ছে প্রগতি আর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। এটি সহজ সত্য, এটি যে কোনো বিশ্লেষণের মৌল ভিত্তি। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা প্রগতির মূল রাজনৈতিক ধারা। এবারে বামপন্থীরা সব দিক থেকেই বামপন্থাকে পুনরুজ্জীবিত করতে আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছে। তরুণতর প্রার্থী দেবার কথাই ধরা যাক। এই তরুণরা কারো ভাগ্নে-ভাইপো নন, ছোট-বড় গণ আন্দোলনে মধ্যে দিয়ে এসেছেন, পুলিশের মার খেয়েছেন, জেলে গেছেন। একটা নতুন প্রজন্ম সামনে এসেছে যারা ভবিষ্যতের বামপন্থাকে, রাজনৈতিক প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এরা শুধু বয়সেই তরুণ নন, চিন্তায় কর্মসূচিতে এরা এমন উপাদান যুক্ত করতে পারে যা ভবিষ্যতের চলার পথে আবশ্যিক। সমসাময়িক দুনিয়ার কথা প্রতিফলিত হতে পারে এদের মাধ্যমে। এ শুধু বামপন্থার প্রাপ্তি নয়, রাজ্যেরও প্রাপ্তি।

বামফ্রন্টের ইশ্‌তেহার রঙচঙে নয়, কিন্তু পড়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছে খুবই ঝকমকে। এমন অনেক নতুন কথা, নতুন চিন্তা তার মধ্যে রয়েছে যা একদিকে বামপন্থীদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ইতিবাচক ফলের প্রতিফলন, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে এগনোর রূপরেখা। যেভাবে এই ইশ্‌তেহার সমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার দলিল হয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বামপন্থীরা কথোপকথনের এক নতুন পরিসর তৈরি করছে।

যে বিপদের মধ্যে আমরা রয়েছি, যে বিপদের আশঙ্কা আমাদের ঘিরে রয়েছে সেখানে সস্তা রাজনীতি দিয়ে উদ্ধার পাওয়া যাবে? বামপন্থীরা ছাড়া, তাদের মুখ্য ভূমিকা ছাড়া শ্রমজীবীর ওপরে অর্থনৈতিক আক্রমণ, সাংবিধানিক মূল্যবোধ-গণতন্ত্রের ওপরে আক্রমণ এবং বিভাজনের বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে? বামপন্থাকে শক্তিশালী না করে বাংলায় (এবং অন্যত্রও) প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে? এখানে বিভ্রান্তি তৈরি প্রতিক্রিয়ার শক্তিকেই সাহায্য করবে।

বামপন্থীরা এখানে একা লড়ছে না। কেননা তার সামূহিক বাস্তবতা নেই। বিজেপি এমন একটা বিপদ যার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সম্ভব ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিকে, সংগঠনকে, ব্যক্তিকে সমবেত করা জরুরী। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এমন একটি শাসক দল যারা বিজেপি এবং তাদের নিয়ন্ত্রক আরএসএস-র বৃহত্তর রণনীতির পক্ষে সাহায্যকারী। আরএসএস-বিজেপি তৃণমূলকে তৈরি করতে সাহায্য করেছে, বাড়তে সাহায্য করেছে, কমিউনিস্টদের দুর্বল করতে সাহায্য করেছে এবং তারপর তৃণমূলের জায়গায় নিজেদের আধিপত্য সরাসরি কায়েমের চেষ্টায় নেমেছে। বিজেপি যেমন দেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তুলনীয় নয়, তৃণমূলও তেমন দেশের অন্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ‘আপাতত তৃণমূল’ বলে তাই কিছু হয় না, যেমন ‘আপাতত বিজেপি’ বলে কিছু হয় না।

প্রশ্ন তোলা হচ্ছে মোর্চা তো বিজেপি-র সুবিধা করে দিচ্ছে। বিজেপি-বিরোধী ভোট কাটছে।

ঠিক উলটো। তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে মাত্রায় ক্ষেপে রয়েছেন মানুষ, বিকল্প না থাকলে গোটাটা বিজেপি-র ঝুলিতে যেত। আগে তো তৃণমূল হঠাই বলে উপায়ান্তর না পেয়ে বিজেপি-কে ভোট দিতেন। এখন সে পথে কাঁটা। মোর্চা দাঁড়িয়ে যাওয়ায় বিজেপি-র দিকে ভোট যাওয়া আটকে যাবে। বামপন্থাকে, মোর্চাকে দ্বিধা না রেখে সমর্থন করলে বিজেপি-কে প্রতিহত করার কাজটা আরো সহজ হয়। বিজেপি-কে প্রতিহত করা আমাদের রাজ্যের দীর্ঘস্থায়ী ভবিষ্যতের পক্ষে জরুরী।

তাহলে তৃণমূলের সুবিধা করে দিচ্ছে মোর্চা?

এটাও ঠিক উলটো। বিজেপি-কে ভোট দেবেন না, কিন্তু উপায় নেই দেখেই ‘যাই হোক চোর-জোচ্চোরগুলোকেই দিই’ বলে যাঁরা তৃণমূলকে ভোট দিতে যাচ্ছিলেন তাঁরা থমকে দাঁড়িয়েছেন। বিজেপি-র বিরুদ্ধে যদি ভোট দিতেই হয় তাহলে তৃণমূলকে দেব কেন, সম্ভাব্য বিজেপি-কে দেব কেন, মোর্চাকে দেব না কেন— এই প্রশ্ন উঠে গেছে। এই প্রশ্নের আওয়াজ বাড়ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী যখন দেখিয়ে দিয়েছে বিজেপি-র প্রার্থী তালিকায় প্রাক্তন তৃণমূলের ভিড়। তৃণমূলের এমন একজন নেতার নাম কেউ বলতে পারেন যিনি ভোটের পরে বিজেপি-সঙ্গী হবে না, তা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়?

সংযুক্ত মোর্চা সরকার গড়বে? অলীক কল্পনা হয়ে যাচ্ছে না?

সংযুক্ত মোর্চা একটা বিকল্প। ধীর স্থির নীতিভিত্তিক বিকল্প। রাজনৈতিক ভাবে জরুরী, নৈতিক ভাবে জরুরী। এরাজ্যের মানুষের জন্য এমন একটা বিকল্প তৈরি দরকার ছিল। এখন সেটা সম্ভব হয়েছে। বাকিটা লড়াই। লড়াই যখন অলীক নয়, তখন নির্বাচনী সম্ভাবনাই বা অলীক হবে কেন?

ত্রিশঙ্কু হলে বামেরা কী করবে?

ত্রিশঙ্কুর কথা উঠছে তাহলে। ‘ত্রি’ কথাটাই তো এতদিন ত্রিসীমানায় ছিল না। কাটুম আর কুটুম, হাট্টিমা আর টিম, ভজু আর গজু –এর বাইরে তো কিছু ছিল না। এখন বোঝা যাচ্ছে মিডিয়ার হাইপে আর হুইপে ‘সুইপ’ হবে না। যাই হোক, সংযুক্ত মোর্চা গ্যালারিতে বসতে ময়দানে যায়নি। সরকার গড়ারই চেষ্টা করবে। ‘ত্রিশঙ্কু’ না প্রফেসর শঙ্কু, গণনার দিন রাতে বোঝা যাবে।

সবই তো ভালো, আইএসএফ-র সঙ্গে বামেরা হাত মেলাল কেন?

আইএসএফ-কে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে চিহ্নিতও করা হচ্ছে। কে সাম্প্রদায়িক? কাকে এই অভিধায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে? দুনিয়ার কোথাও বামপন্থীরা সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে হাত মেলায়? বামেদের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে পাগলেও প্রশ্ন তোলে না। আইএসএফ-র সঙ্গে সমঝোতায় আপত্তি? আইএসএফ এমন কী করেছে যার জন্য তাদের ‘সাম্প্রদায়িক’ বলা যাবে? তারা ঘোষিত ভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছে। শুধু সংখ্যালঘু মুসলিমদের পার্টিও না, তফসিলি, দলিত, অনগ্রসর অংশের জন্য লড়বে বলে অভিমুখ ঠিক করেছে। আব্বাস সিদ্দিকি ধর্মীয় মানুষ বলেই সাম্প্রদায়িক? আইএসএফ-র প্রার্থী তালিকা কী প্রমাণ করছে? একটির পর একটি জনসভায় সিদ্দিকি ধর্ম-জাতপাত নির্বিশেষে গরিব মানুষের অধিকার রক্ষার কথা বলছেন, কাজের প্রশ্ন তুলছেন। আগেই বলছিলাম বামপন্থীরা কথোপখথনের এক নতুন পরিসর তৈরি করেছে। দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, পিছিয়ে পড়া মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বরাবরই বামপন্থীদের সঙ্গে রয়েছেন। শ্রেণির আন্দোলন থেকেই তাঁরা বামপন্থার সঙ্গী। কিন্তু একটা বড় অংশই বামপন্থার বাইরে, এমনকি প্রতিক্রিয়ার খপ্পরে পড়ছেন। সামাজিক বৈষম্যের প্রশ্ন, শ্রেণির প্রশ্ন একসঙ্গে না জুড়লে এই মানুষদের টেনে আনা যাবে না। ঠিকই যে এ শুধু ভোটের দু’মাসের কাজ নয়। কিন্তু শক্তিবন্ধনকে আরো বাড়ানো যায় কিনা, তার অমোঘ পরীক্ষা হচ্ছে। মনে রাখা ভালো সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা দাপট দেখালে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতাও বেড়ে ওঠে। যদি পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে তৎপর হত, সেটি কি খুব ভালো হতো? আইএসএফ এবং বামপন্থীদের সঙ্গে তাদের নির্বাচনী সমঝোতা অনেকটাই সেই বিপদকে রুখে দিয়েছে। একসঙ্গে উভয় সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়ানোর কাজ করছে সংযুক্ত মোর্চা। 

প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্বে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়াই ভালো। অস্বচ্ছতা, ধোঁয়াশা, মনে এক মুখে এক এ সময়ে আত্মঘাতী হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন