আজকের দিনে নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা - সূর্যকান্ত মিশ্র

৭ নভেম্বর ২০২৩ (মঙ্গল বার)

১৯১৭ সালের ৭ থেকে ১৭ নভেম্বর, রাশিয়াতে দশ দিনের বিপ্লবের মহাকাব্য জন রীড তাঁর ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ বইতে লিখেছিলেন। জার শাসিত রাশিয়াতে ঐ বছরেই পরপর গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পথপ্রদর্শক ছিলেন লেনিন। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে লেনিনের মূল অবদানগুলি হলো,

(১) বুর্জোয়া পার্লামেন্ট দুমায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত,

(২) বিপ্লবের জন্য আঘাতের চূড়ান্ত মুহূর্ত নির্ধারণ,

(৩) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সঙ্গে চুক্তি করে অনেকগুলির মধ্যে একটি ফ্রন্টকে বন্ধ করা,

(৪) সমাজতন্ত্র গঠনের জন্য প্রথমে ওয়ার কমিউনিজম এবং তারপরে নিউ ইকোনমিক পলিসি (NEP) রূপায়ন,

(৫) কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গঠন,

(৬) গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নীতির ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনের কাঠামো প্রণয়ন,

(৭) জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নের নিষ্পত্তি।

লেনিনের অসুস্থতার পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পার্টি ও সরকারের নেতৃত্বে এলেন স্তালিন। তিনিও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছেন সমাজতান্ত্রিক গঠনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দূরদর্শী স্তালিন আরেকটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের আশঙ্কাকে আগাম দেখতে পেয়েছিলেন। তার প্রস্তুতির জন্য তিনি একদিকে মূলত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে স্বনির্ভর অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ ও অন্যদিকে প্রতিরোধ নিশ্ছিদ্র নিশ্চিত করতে চেষ্টা করেছিলেন। জার্মানিতে নাৎসী পার্টি ও হিটলারের উত্থান, সুদাতেন দখল, ফ্যাসিস্ট ইতালির আবসিনিয়া দখল ইত্যাদি দেখেই স্তালিন সাম্রাজ্যবাদীদের অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছিলেন। তার আগেই তিনি ফ্যাসিবাদী জার্মানির আগ্রাসন প্রতিরোধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত করেনি। কারণ তারা তখন হিটলারকে মদত দিচ্ছিল ইউরোপের পূর্ব দিকে অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে অগ্রসর হতে। এই পরিস্থিতিতেই স্তালিন জার্মানির সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করেছিলেন, যদিও পরে তা খেলাপ করে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। ফ্যাসিবাদী জার্মানির আক্রমণে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংগ্রাম, লেনিনগ্রাদ ও স্তালিনগ্রাদের প্রতিরোধ, লাল ফৌজের লড়াই মানব ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অংশ হয়ে গিয়েছে। ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে স্তালিন সেই লড়াইতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাশাপাশি রুজভেল্ট ও চার্চিলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার জন্য। শেষপর্যন্ত লালফৌজই জার্মানির রাইখস্ট্যাগে লাল পতাকা উড়িয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিশ্ব ব্যবস্থার ভারসাম্যে বদল ঘটলো। পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয় পতাকা উড়লো। এসত্ত্বেও স্তালিনের মৃত্যুর পরে ক্ষমতায় বসে ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিশতম কংগ্রেসে স্তালিনের বিরুদ্ধে কুৎসামূলক দলিল পেশ করেছিলেন। গ্রোভার ফার’এর ‘ক্রুশ্চেভ লাইড’ বইতে এর বহু প্রমাণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই প্রসঙ্গে অবশ্যপাঠ্য আন্না লুইজস্ট্রং’এর ‘স্তালিন এরা’। সিপিআই(এম) ১৯৬৮ সাল থেকেই স্তালিনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উপাদানগুলির উল্লেখ করেও ব্যাক্তিপুজো ও সংশোধনবাদের নামে স্তালিনের প্রশ্নাতীত অবদানগুলি মুছে ফেলার বিরোধিতা করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংশোধনবাদী লাইনের শুরু বলা যায় এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংহতিও দুর্বল হতে শুরু করে। পরাক্রমশালী একটি কমিউনিস্ট পার্টির যে ক্ষয় ক্রুশ্চেভের আমল থেকে শুরু হয়েছিল তা শেষ হয় গর্বাচভের হাত ধরে।

লেনিনের শিক্ষা দেখিয়ে দিয়েছিল, নভেম্বর বিপ্লব পরবর্তী বিশ্বে বিরাজমান চারটি মূল দ্বন্দ্ব হলো - সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দ্বন্দ্ব এবং শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২৭ তম কংগ্রেসে (১৯৮৬) এই চারটি মৌলিক দ্বন্দ্বের কথা বলা হলেও নভেম্বর বিপ্লবের ৭০ তম বার্ষিকীতে গর্বাচভের ভাষণে তার অস্বীকার করা হয়। অখন্ড বিশ্ব, গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রৈকা, বোঝাপড়ার মাধ্যমে দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি কথা বলে গর্বাচভ শ্রেণী সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিসর্জন দিলেন। সেই অনুষ্ঠানেই গর্বাচভের ভাষণে প্রকাশিত এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের পার্টি সিপিআই(এম)’র আপত্তি নথীভূক্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ। কিন্তু তাঁকে আপত্তি জানাতে দেওয়া হয়নি, লিখিতভাবে আপত্তির কথা সিপিএসইউ’কে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। যদিও তা হয়নি। সিপিএসইউ’র ২৮ তম কংগ্রেসের (১৯৮৮) প্রচারিত খসড়াতেও শ্রেণী সংগ্রামের প্রয়োজন অগ্রাহ্য করে ‘মানবিক ও গণতান্ত্রিক’ ‘সার্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে একটি নিরাপদ ও সভ্য বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। আর ২৯ তম কংগ্রেসের খসড়ায় বলা হয়েছিল, ‘বর্তমান বিশ্বব্যাপী ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে যে নতুন সভ্যতা তৈরি হচ্ছে তা চিরায়ত শিল্পসমাজের অভ্যাসগত ধারণা, পরস্পর বিরোধী শ্রেণীতে তার স্পষ্ট বিভাজন, শ্রম ও পুঁজির মেরুকরণ, সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে সংঘাতের  কথা স্বীকার করে না।’ অবশ্য এই কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই গর্বাচভ নিজেই ডিক্রি জারি করে সিপিএসইউ’কে বেআইনী ঘোষণা করেন। ১৯৯১ সালের গণভোটের রায়কে লঙ্ঘন করে তিনি ঐ বছরের ২০ আগস্ট একটি নতুন ইউনিয়ন চুক্তিতে স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এর ফলশ্রুতিতে ৭৪ বছরের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এর আগে ও পরে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতেও এরকমই ঘটনাবলী ঘটে। যুগোস্লাভিয়াতে গৃহযুদ্ধ এবং দেশটির টুকরো হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসবের ফলে বিশ্বে ভারসাম্য সাম্রাজ্যবাদীদের অনুকূলে চলে গেলো।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র ১৯৬৮ সালে বর্ধমান প্লেনামে গৃহীত মতাদর্শগত দলিলে বিশ্বের মূল চারটি দ্বন্দ্বের গুরুত্ব বিশদে উল্লেখিত হয়। চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বিতর্ক নিয়ে সিপিআই(এম)’র অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে সেখানে। উল্লেখ্য, দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে চীনে বাম সংকীর্ণতাবাদী সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও তিন দুনিয়ার তত্ত্ব হাজির করা হয়েছিল। সোভিয়েতের পার্টির সংশোধনবাদের মতো এই সংকীর্ণতাবাদের সঙ্গেও সিপিআই(এম) সহমত হয়নি কখনো। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কিছু আগেই চীনের তিয়েনয়ানমেন স্কোয়ারে তথাকথিত ছাত্র অভ্যুত্থান ও একটি প্রতিবিপ্লবের আহবানের পিছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মদত ছিল। ছাত্রমৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে মিথ্যা প্রচারের স্রোত বইয়ে দেওয়া হয়েছিল। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দায়িত্বশীলভাবে তার মোকাবিলা করেছে, সেনা ও পুলিশকে সংযত করেছে। আমরা তাদের এই কাজকে সমর্থন করেছি। সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত সোভিয়েতে সফল হয়েছে, চীনে ব্যর্থ হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেসে তিয়েনয়ানমেন স্কোয়ারের ঘটনার পর্যালোচনা করে লেনিনীয় নিয়মনীতি পুণঃপ্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছে।

বিশ্ব রাজনীতির এই সমস্ত ঘটনাবলী নিয়ে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন দলিলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ১৯৯২ সালে সিপিআই(এম)’র চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে ‘কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে’ সমগ্র বিষয়ে পার্টির অবস্থানের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বিশদে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের, পৃথিবীর দুই বৃহৎ শাসক কমিউনিস্ট পার্টির থেকে বিভিন্ন সময়ে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত হয়েও সিপিআই(এম) সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদে অটল থেকেছে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির এই সমস্ত ঘটনার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে আমরা সব ক্ষেত্রে আগাম সচেতন ছিলাম এমন দাবি করতে পারি না। ১২ পার্টির দলিল (১৯৫৭) ও ৮১ পার্টির দলিলে (১৯৬০) স্বাক্ষরকারী হিসাবে আমরাও ‘সমাজতান্ত্রিক দেশে পুঁজিবাদের প্রত্যাবর্তন অসম্ভব’ ইত্যাদি ভুল মূল্যায়নের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলী তার সাক্ষ্য। সেই কারণে সিপিআই(এম) চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসের গৃহীত প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই তিরুবন্তপূরমে ২০০০ সালে পার্টি কর্মসূচীকেও সময়োপযোগী করেছে এবং ২০১২ সালে কোঝিকোড়ে বিশতম পার্টি কংগ্রেসে কয়েকটি মতাদর্শ বিষয় সম্পর্কে সর্বশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে পথ চলতে এই দলিলগুলির অনুশীলন প্রয়োজন।

অতীতের ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা নিতে না পারলে বর্তমান পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করা যাবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালের বিশ্বব্যবস্থার ভারসাম্য সমাজতন্ত্রের অনুকূলে গেলেও পুঁজিবাদী দেশগুলিতে তথাকথিত ‘স্বর্ণযুগ’ কায়েম হয়েছিল। কর্মসংস্থান, আয়, উৎপাদন বেড়েছিল। মার্শাল প্ল্যানের মাধ্যমে যুদ্ধোত্তর পুণর্নির্মানের জন্যই শুধু নয়, কেইনসীয় অর্থনীতির পথে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে তথাকথিত জনকল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার জন্যও এই ‘স্বর্ণযুগ’ কিছু বছর চলেছিল। সাতের দশকের কাছাকাছি দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত, তেল উৎপাদক ওপেক দেশগুলি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়, তার প্রভাব পড়ে সারা বিশ্বে। দ্বিতীয়ত, এই সময়ে ‘বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিপ্লব’ নতুন সুযোগ এনে দেয় পুঁজির সঞ্চলনের। কম্পিউটার ভিত্তিক ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতি পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে মুহূর্তের মধ্যে বিপুল পুঁজির স্থানান্তরের সুযোগ করে দিল। (এখানে লক্ষ্যণীয় সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির গর্বাচভ বিরোধী পলিট ব্যুরোর সদস্য লিগাচেভের ডায়েরি, যাতে তিনি ২০ বছর ধরে আলোচনা হলেও সোভিয়েত সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি সংক্রান্ত দলিল চূড়ান্ত করায় ব্যর্থতার কথা বলেছেন)। যাই হোক, এই সুযোগ ধরেই লগ্নি পুঁজি বিশ্বায়িত রূপ নিতে পেরেছিল, আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, গ্যাট, গ্যাটস, ট্রিপস, ট্রিম ইত্যাদি বিশ্বের উৎপাদন ও বাজারকে উন্মুক্ত করে দিল। পুঁজির বিশ্বায়ন হলো বটে, কিন্তু শ্রমের বিশ্বায়ন হলো না। এই হলো, নয়া উদারবাদের সূচনা যা বর্তমান সময়ে সঙ্কটকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলেছে। বিশ্বজুড়ে বৈষম্য বাড়লেও বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির কারণে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব স্তিমিত হয়ে গেলো, যদিও তা লুপ্ত হয়নি।

কিন্তু নয়া উদারবাদই এখন সঙ্কটে। ২০০৮ সালের মন্দা যা আমেরিকায় হাউসিং বাবল দিয়ে শুরু তা এখন দীর্ঘায়িত হয়েছে। এই অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির লগ্নিপুঁজি অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বিনিয়োগ হতে লাগলো। উদ্ভব হলো লুটেরা বা ক্রোনি পুঁজির। ফলে বৈষম্য আরও তীব্র হয়েছে, সঙ্কট কেবল দীর্ঘায়িত হয়েছে। এই লগ্নিপুঁজি কেবল উৎপাদন প্রক্রিয়ার উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ (appropriation) করে না, বরং কোনো উৎপাদন ছাড়াই লুটের বন্দোবস্ত (expropriation) করে যা পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের বর্তমান রূপমাত্র। এছাড়াও মন্দা বাড়তে থাকায় পুঁজি সমরাস্ত্র ও মারণাস্ত্র নির্মাণে বিনিয়োগ হচ্ছে যা মানুষের জীবনের জন্য কাজে লাগে না, কেবল মৃত্যুকে নিয়ে আসে। এই কারণেই আমরা ন্যাটোর সম্প্রসারণ ও আগ্রাসন, ইউক্রেনে যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে গণহত্যা দেখতে পাচ্ছি। প্রায় একশো বছর আগের একটা মহামন্দা ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছিল। এখনকার মন্দায় নয়া ফ্যাসিবাদ মাথা তোলার চেষ্টা করছে লগ্নি ও লুটেরা পুঁজির মদতে। দেশগুলিকে খন্ড খন্ড করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমিয়ে বাজার দখলের মহোৎসব হচ্ছে। শুধু দেশকেই ভাঙছে না, মানুষের ঐক্যকেও ভাঙছে। ভারতে আমরা এই কারণেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন, জাতি বর্ণ লিঙ্গ ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভাজনের বাড়বাড়ন্ত দেখতে পাচ্ছি। বিভাজনকে তীব্র করতে তথাকথিত উত্তর আধুনিকতাবাদ ও পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশজুড়ে সোসাল মিডিয়া, এনজিও ইত্যাদি ব্যবহার করে মাইক্রো লেভেল সোসাল ইঞ্জিনিয়ারিং করা হচ্ছে মানুষের ঐক্য ভাঙতে, শ্রমজীবীদের এক অংশের মধ্যে বিদ্বষ ছড়ানো হচ্ছে আরেক অংশের বিরুদ্ধে।

কিন্তু এটাই শেষ কথা বলতে পারে না। তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত, বিভাজনের এই সব অস্ত্র ব্যবহার করেও প্যালেস্তাইনের পক্ষে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের সংহতিকে ঠেকানো যায়নি। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে আমেরিকা ইজরায়েলের পাশে কোনো রাষ্ট্রই দাঁড়াতে পারেনি জনমতের কারণে। ইজরায়েলের বন্ধু হয়েও ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে থমকাতে হয়েছে। বিশ্বব্যাপী মানুষের সংহতির সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। চীনের জিডিপি বৃদ্ধি ও অর্থনীতিতে আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ঘটনা সমাজতন্ত্রের সাফল্যকেও স্পষ্টতর করে তুলছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের দেশে দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করেছিল। আজকের দিনে দুনিয়া জুড়ে খন্ড খন্ড যুদ্ধ যতো বাড়বে, সাম্রাজ্যবাদ ততোই বিচ্ছিন্ন হবে। আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক কর্পোরেট জোটের বিজেপি’কে বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করাই হলো বর্তমান সময়ের প্রধান কাজ। এই মূল লক্ষ্যে অবিচল থেকেই বাংলায় বিজেপি ও তৃণমূল বিরোধী সব শক্তিকে একজোট করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে হবে। এটাই হোক এই নভেম্বরের শপথ।

বিদ্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত


শেয়ার করুন

উত্তর দিন