লেনিন— সর্বহারা বিপ্লবের পথপ্রদর্শক, শোষণহীন — উন্নততর সমাজ গড়ার কাণ্ডারী : শ্রীদিপ ভট্টাচার্য

লেনিন— সর্বহারা বিপ্লবের পথপ্রদর্শক, শোষণহীন — উন্নততর সমাজ গড়ার কাণ্ডারী
লেনিন — এই নামটি আজও সমগ্র দুনিয়ার মেহনতী মানুষ অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথে উচ্চারণ করে চলেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে দেশে দেশে সংগ্রামরত মেহনতী মানুষ তথা সাধারণ জনগণের মধ্যে আজও সমানভাবে শিহরণ তোলে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নাম। শোষণহীন, উন্নত সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার সংগ্রামের সাথে সমার্থক লেনিনের নাম। সর্বহারা বিপ্লবের মতবাদ তথা শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলার মতবাদ উপস্থিত করেছিলেন মানব সভ্যতার অন্যতম দুই শ্রেষ্ঠ সন্তান কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদকে রুশ দেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করে সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লবের মাধ্যমে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র অর্থাৎ সর্বহারার রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে নেতৃত্ব দিলেন কমরেড লেনিন।
রুশ বিপ্লব সফল করার লক্ষ্য সফল করার সাথে বিশ্বের দেশে দেশে বিশেষ করে অনুন্নত, পরাধীন দেশগুলির বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তোলার কার্যধারায় লেনিন অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ও নেতৃত্ব দিলেন। দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলন ও আন্দোলন-সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় শ্রমিকশ্রেণিকে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসীন করার ক্ষেত্রে লেনিন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। সর্বহারার বিপ্লবী সংগ্রামের ধারায় পরাধীন দেশগুলি তথা উপনিবেশগুলিতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামগুলিকে যুক্ত করা কমরেড লেনিনের অন্যতম অবদান।

তৃতীয় আন্তর্জাতিক গড়ে তোলায় নেতৃত্ব দিলেন লেনিন
১৯১৭ সালে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক রুশ দেশ গড়ে উঠল। এই সময় থেকে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশকে কেন্দ্র করে বিশ্বের ঔপনিবেশিক শক্তির অধীন পরাধীন দেশগুলিতে একদিকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশ স্থাপন করা ও এই দেশগুলিতে বিপ্লবী শক্তি কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতী মানুষরে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার বিষয়টির প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছিল কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি (রুশ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি এই নামেই পরিচিত ছিল)। তৃতীয় আন্তর্জাতিক, যার প্রতিষ্ঠায় কমরেড লেনিনের ছিল সর্বাধিক অগ্রগণ্য ভূমিকা, তার প্রথম কংগ্রেস থেকেই (১৯১৯-এর মার্চ মাসে) এই বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছিল। আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে কমরেড লেনিন উপনিবেশগুলির সংগ্রাম, শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। উপনিবেশগুলির জাতীয় পুঁজিপতি যারা বিদেশী শাসনের অবসানের লক্ষ্যে সংগ্রামে রত তাদের সাথে কমিউনিস্টদের যৌথভাবে উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া প্রয়োজন একথা জোরের সাথে কমরেড লেনিন বললেন। ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সম্পর্কিত দলিলে ভারতের কমিউনিস্ট প্রতিনিধি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রাসঙ্গিক সংযোজন গ্রহণ করা হয়েছিল। এটা তো সঠিক, ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনে সংকীর্ণতা পরিহার করার ক্ষেত্রে তৃতীয় আন্তর্জাতিক এবং লেনিনের উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের তত্ত্ব অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল।

মার্কসবাদের সমৃদ্ধকরণে লেনিন
লেনিন এক অসাধারণ মার্কসবাদী। মানব সভ্যতায় জ্ঞানের অগ্রগতির ধারায় মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। জ্ঞানের অগ্রগতির ধারায় গড়ে উঠেছে মার্কসবাদ। অষ্টাদশ শতাব্দীর জ্ঞানের তিনটি শ্রেষ্ঠ ধারাকে মার্কসবাদের উৎস বলে তিনি চিহ্নিত করলেন। জার্মান দর্শন, ইংলন্ডের অর্থনীতি ও ফ্রান্সের সমাজ বিপ্লবের তত্ত্বকে মার্কসীয় মতবাদের উৎস হিসাবে ব্যাখ্যা করলেন। মার্কসীয় মতবাদের তিনটি উপাদান, মার্কসীয় দর্শন, মার্কসীয় অর্থনীতি ও মার্কসীয় সমাজ বিপ্লবের তত্ত্ব। শুধুমাত্র মার্কসীয় মতবাদকে ব্যাখ্যা করাই নয়, সমকালীন পরিস্থিতিতে মার্কসীয় মতবাদকে তিনি সমৃদ্ধ করলেন। তাঁর এই অবদানের জন্যই ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের মতবাদকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হিসাবে চিহ্নিত করা হলো।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে ও প্রথম দুই দশকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন নতুন আবিষ্কার ঘটছিল। এই আবিষ্কারগুলির বিকৃত ব্যাখ্যা বস্তুর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। এই সুযোগে প্রতিক্রিয়াশীলদের তরফ থেকে ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ অর্থাৎ মার্কসীয় দর্শনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে প্রকৃতি বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারগুলিকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন অর্থাৎ মার্কসবাদী দর্শনকে সমৃদ্ধ করলেন, এই দর্শনকে খাটো করার প্রয়াসকে পরাস্ত করলেন। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যু না হলে মার্কসীয় দর্শন প্রসঙ্গে অতি উন্নত একটি পুস্তক রচনার কাজ তিনি সম্পূর্ণ করতে পারতেন। ‘ফিলজফিকাল নোট বুকস’ (Philosophical Note Books) অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়ে গেছে। যদিও এই নোট বুক এক অতি উন্নতমানের দর্শন সংক্রান্ত দলিল।
সাম্রাজ্যবাদের যুগকে প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ্য করলেন লেনিন। মার্কস ও এঙ্গেলস-এর জীবিতকালে সাম্রাজ্যবাদ-এর পরিপূর্ণ রূপ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাননি। লেনিন সাম্রাজ্যবাদের যুগ প্রত্যক্ষ করে তাকে বিশ্লেষণ করলেন। ‘সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপ’ আবার ‘সাম্রাজ্যবাদ হলো ক্ষ‍‌‌য়িষ্ণু পুঁজিবাদ’ — এভাবেই লেনিন ব্যাখ্যা করলেন। ব্যাখ্যা করলেন লগ্নীপুঁজি — যা শিল্প পুঁজি ও ব্যাঙ্ক পুঁজির মিলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। লেনিনের লগ্নীপুঁজি [finance capital]-র বিশ্লেষণকে ভিত্তি করেই বর্তমানের আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজি [International Finence Capital] তথা বিশ্বায়নকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে। এভাবেই মার্কসীয় অর্থনীতির তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করলেন লেনিন। তিনি এটাও দেখালেন, সাম্রাজ্যবাদের যুগ প্রলেতারিয় অর্থাৎ সর্বহারা বিপ্লবের যুগের পূর্বাহ্ন।
বিপ্লবের তত্ত্বকে বিকশিত করলেন তিনি। সর্বহারা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করল সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণি রুশ দেশে লেনিনের নেতৃত্বে। রাষ্ট্র ও বিপ্লবের বিষয়টি উন্নততর হলো। সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের স্তর সম্পর্কিত ধারণা বিকশিত করার ক্ষেত্রে কমরেড লেনিনের রয়েছে অসাধারণ অবদান। জাতীয় মুক্তির বিপ্লব, গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণা তিনি বিস্তৃতভাবে উপস্থিত করলেন। ভারতের তৎকালীন জাতীয় মুক্তির লড়াই শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ভারতের কমিউনিস্টদের কর্তব্য ‍‌তিনি বিশেষ করে স্মরণ করালেন।
প্রতিক্রিয়ার সমস্ত মতাদর্শগত আক্রমণকে মোকাবিলা করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদকে আরো পুষ্ট করার ক্ষেত্রে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করলেন কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ অর্থাৎ লেনিন।

কমিউনিস্ট পার্টি ও লেনিন
সর্বহারার বিপ্লব ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্য পূরণের চাবিকাঠি হলো সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব বিপ্লবী পার্টি অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি। শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টির রূপরেখা কার্ল মার্কস কমিউনিস্ট লীগ ও পরবর্তীকালে প্রথম আন্তর্জাতিক-এর কার্যধারার মধ্য দিয়ে উপস্থিত করেছিলেন। মার্কসীয় মতবাদ প্রয়োগ করে রুশ বিপ্লবী সংগ্রাম সফল করতে গিয়ে পার্টি সম্পর্কিত ধারণাকে সমৃদ্ধ করলেন, উন্নত করলেন কমরেড লেনিন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে কমিউনিস্ট পার্টি। অন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক চরিত্রের হলো কমিউনিস্ট পার্টি। শ্রেণি আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ময়দান থেকেই গড়ে ওঠে এই পার্টি ও পার্টির সদস্য। সর্বহারার নেতৃত্ব, সর্বহারার সর্বোচ্চ বাহিনী যা শৃঙ্খলার দ্বারা আবদ্ধ, এই হলো কমিউনিস্ট পার্টি। দেশের ও পার্টির স্বার্থকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে যে কোন স্বার্থত্যাগের জন্য প্রস্তুত এমনই হলেন কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য। স্ব-আরোপিত শৃঙ্খলার দ্বারা আবদ্ধ, সমষ্টিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে চলতে অভ্যস্ত, উন্নত জীবনবোধ ও চেতনা, সততা, কুসংস্কার—কূপমন্ডুকতা ও ধর্মান্ধতা মুক্ত মনন — এটাই তো হলো কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যের পরিচয়। পার্টি সংগঠনের প্রধানতম দায়িত্বের একটি হলো দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মার্কসীয় মতবাদ প্রয়োগ করে বিপ্লবের পথ, শোষণহীন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রস্তুত করা। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণের ক্ষমতা কমিউনিস্ট পার্টিকে অর্জন করতেই হবে। ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ, এটাই হলো দ্বান্দ্বিকতার মর্মবস্তু’—কমরেড লেনিনের শিক্ষা। প্রকৃত বিপ্লবী পার্টি হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে গড়ে তুলতে হলে এই শিক্ষা কমিউনিস্ট পার্টিকে আত্মস্থ করতে হবে। আপসহীন বিপ্লবী এটাই কমিউনিস্ট পার্টির পরিচয়। তবে বিপ্লবী সংগ্রাম সফল করার প্রয়োজনে কৌশলের নমনীয়তা (শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে কোন বিচ্যুতি প্রদর্শন না করে) না থাকলে যে কোন পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে ভূমিকা পালন সম্ভব নয়।
কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের গুণগত মানের প্রশ্ন বাদ দিয়ে এই পার্টি গড়ে ওঠে না। কে হবে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য? যারা পার্টির কর্মসূচীকে মান্যতা দেন এবং গঠনতন্ত্রকে স্বীকার করেন, তারা সকলে কি পার্টি সদস্য হবেন? এই নিয়ে তীব্র বিতর্কে কমরেড লেনিনের সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল — কমিউনিস্ট পার্টি বিতর্কের ক্লাব নয়, এটা বিপ্লবের পার্টি। এই পার্টির নিরন্তর বিপ্লবী কার্যধারায় সর্বসময়ে অংশগ্রহণ যিনি করবেন, তিনি এই পার্টির সদস্য হওয়ার উপযুক্ত। পার্টি কর্মসূচী ও গঠনতন্ত্রকে গ্রহণ করার সাথে সাথে পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী কার্যধারায় নিরন্তর অংশগ্রহণ না করতে পারলে পার্টির সদস্য হওয়া সম্ভব নয়। শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টিতে ‘নিষ্ক্রিয়তা’ বলে কোন শব্দ থাকার সুযোগ নেই। এ পার্টি হলো সক্রিয় বিপ্লবীবাদের পার্টি। আমাদের অভিজ্ঞতা কি? কমরেড লেনিনের শিক্ষানুযায়ী বিপ্লবী পার্টি সদস্যর গুণাবলী কি আমরা অর্জন করতে পেরেছি? এব্যাপারে দুর্বলতা মুক্ত হতেই হবে, কমরেড লেনিনের শততম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। সকলকে সক্রিয় সদস্যে পরিণত হতেই হবে।
পার্টি দ্বারা নির্ধারিত ন্যূনতম কর্তব্য আমাদের সকলকে পালন করতেই হবে। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মানব সমাজ, যেখানে শোষণ-অত্যাচারের চিরতরে অবসান ঘটবে, বৈষম্যের সম্পূর্ণ অবসান হবে, এমন উন্নত ও সমৃদ্ধ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার পথের দিশারী মানব সভ্যতার ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদ যে মার্কসবাদ, তাকে ভিত্তি করেই সমস্ত কার্যধারা পরিচালনা করছে কমিউনিস্ট পার্টি। গর্ববোধ নিয়ে ও মহান লক্ষ্যে অবিচল থেকেই, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র কর্মীদের বর্তমানের জটিল সময়ে দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে।

বিবেচনায় রাখতেই হবে বর্তমান ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ —
২০২৪ সালে যখন আমরা কমরেড লেনিনের শততম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছি, তখন আমাদের ভারতে এক অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। প্রায় দশ বছর ধরে কেন্দ্রে আসীন আরএসএস-বিজেপি’র সরকার। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রের সরকার আগ্রাসীভাবে নয়া উদারনীতির পথ ধরে চলেছে। কর্মহীনতা, দারিদ্র্য, বুভুক্ষা, বৈষম্য ভারতে ক্রমবর্ধমান। রুটি-রুজি ও অধিকার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের জীবন দুর্বিসহ। দেশের তরুণ প্রজন্মের জীবন আজ বেকারী গ্রাস করেছে। মহিলা, আদিবাসী, দলিতসহ পশ্চাদপদ অংশ সকলে আক্রান্ত। মূল্যবৃদ্ধি ভয়াবহ, মানুষের জীবনের দাম ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। আদানি-আম্বানি ও বিলিওনিয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। মানুষের প্রতিরোধ-আন্দোলন দমন করার নীতিগুলিকে মোদী সরকার আরো ভয়ঙ্কর রূপ দিতে বদ্ধপরিকর।
 ভারতের মর্মবস্তু অর্থাৎ বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র সর্বাধিক আক্রমণের মুখে। ‘হিন্দুত্ববাদ’ প্রতিষ্ঠার নামে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’র নিদর্শনগুলিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। ভারতের ইতিহাসকে সুপরিকল্পিতভাবে বিকৃত করা হচ্ছে, ছদ্মবিজ্ঞানের সাহায্যে বিজ্ঞানকে প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে। যুক্তিবাদকে ধ্বংস করার মরিয়া প্রয়াস চলছে। এই বিপদ থেকে ভারতকে রক্ষা করার জন্য আরএসএস-বিজেপি-কে পরাস্ত করতেই হবে।
 পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৩ বছর ধরে চরম দুর্নীতিবাদ-স্বৈরাচারী ও অত্যাচার-সন্ত্রাসের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণকারী সরকার চলছে। মানুষের মতামতকে তোয়াক্কা না করে লুঠেরা-তোলাবাজদের নিয়ে এই সরকার চলছে। বিশাল পরিমাণ ও অকল্পনীয় দুর্নীতির তথ্য প্রতিদিন সামনে আসছে। তৃণমূল ও বিজেপি বোঝাপড়া করে এই রাজ্যে ‘বাইনারি’ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া প্রয়াস চালাচ্ছে। প্রতিবাদ ও আন্দোলনের শক্তি বামপন্থীদের দুর্বল করার লক্ষ্যে খুব পরিকল্পিতভাবে বিজেপি-তৃণমূলের ‘বাইনারি’ রাজনীতি চলছে। এই রাজ্যে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস উভয় শক্তিকে পরাস্ত করার ঐতিহাসিক কর্তব্য আজ গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল শক্তির সামনে।
 সামনে লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচন সমগ্র দেশ ও এই রাজ্যের ইতিবাচক ভবিষ্যতের জন্য এক অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম। এই সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছে। এই রাজ্যে বামপন্থীদের সামনে কর্তব্য, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও তৃণমূলকে পরাস্ত করতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে অগ্রসর হতে হবে। সেই লক্ষ্যে বুথ স্তর থেকে শক্তিশালী সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তুলতেই হবে। দৃঢ় সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলতে এটা এই মুহুর্তের জরুরী সাংগঠনিক দায়িত্ব।
 বিশ্ব প্রলেতারিয় বিপ্লবের উজ্জ্বল নক্ষত্র, মহান নেতা ও শিক্ষক কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের বর্ণময় ও প্রতিভাদৃপ্ত জীবন এবং সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাঁর শততম মৃত্যুবার্ষিকীতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে দেশের ও রাজ্যের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে সঠিক দায়িত্ব পালনে আমাদের অগ্রসর হতেই হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন