Lenin Day

লেনিন দিন স্মরণে মার্কস - মিনতি ঘোষ

২২ এপ্রিল ২০২৩ (শনিবার)

২২শে এপ্রিল। আজ কমরেড লেনিনের জন্মদিন। ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন , তার ডাকনাম ছিল সাশা । ১৮৭০ এ জন্ম। ঠিক তাঁর বাহান্ন বছর পূর্বে জন্মে ছিলেন কার্ল হেনরিখ মার্কস। মার্কস ও এঙ্গেলস মিলিতভাবে রচনা করেন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো বা কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। মার্কস-এঙ্গেলস এর সেই অমোঘ বানী - ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। সাল ১৮৪৮ বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর জয়োল্লাস। ধনতন্ত্রের বুকে কাঁপন। কার্ল মার্কসের মতবাদ বা মার্কসবাদ একটি বিজ্ঞান। বিশ্ব প্রকৃতি ও সমাজ বিকাশের বিজ্ঞান। মার্কসবাদ দিয়েছে আমাদের এক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী। মার্কসীয় মতবাদের দর্শন ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এঙ্গেলস প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন। মানুষের সমাজের আগ্রগতি তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। প্রকৃতি থেকে চাহিদা অনুযায়ী রুপান্তর ঘটে। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে।

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও

ইতিপূর্বে বিভিন্ন দার্শনিকেরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন পৃথিবীকে। হেগেল প্রমুখ দার্শনিকেরা তার অন্যতম। বির্বতনবাদের জনক ডারউইন। তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন মানব সৃষ্টির মূল রহস্য। আদম আর ইভের গল্প নয়। মার্কস দেখিয়েছেন কিভাবে মানব সমাজের বিকাশ ও অগ্রগতি নিরন্তর ঘটে চলেছে। পরস্পর বিরোধী শক্তিগুলির সংঘাতের মধ্য দিয়ে যে নতুন বিকাশের জন্ম হয় মার্কসবাদী তত্ত্বে তাকেই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলা হয়। প্রথমে প্রকৃতি তারপর মানুষের বা সমাজ জীবনে তার প্রয়োগ হয়েছে তাকে বলা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মার্কস দেখিয়েছেন গতিই বস্তুর ধর্ম। সবটাই পরিবর্তন ঘটছে অগ্রগতির লক্ষ্যে। সমাজ জীবনের ক্ষেত্রেও একই ধারা ঘটে চলেছে। মানুষ কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না। স্ব-বিরোধ শক্তিগুলির সাথে সংঘাতের মধ্য দিয়ে নতুন ব্যবস্থার জন্ম দিচ্ছে। দ্বন্দ্বমূলক দর্শনের মূল কথা কিছুই চূড়ান্ত নয়। এই বস্তুবাদী দর্শন ভাববাদী দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত। ভাববাদীরা বলেন মনো জগতের চিন্তা ই বাস্তব জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। মার্কস বলেছেন - “বস্তু মনের সৃষ্টি নয়, মনই হল বস্তুর চরম বিকাশ মাত্র।” একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়েই ক্রমবিকাশ ঘটে। তা কখনও পেছনের দিকে হাঁটে না। সামনের দিকে চলে এবং উচ্চতর পর্যায়ে ওঠে। দাস সমাজ ব্যবস্থা থেকে সামন্ততান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সর্বশেষ পর্যায়ে সাম্যবাদ। তা কোন অলীক কল্পনা নয়।

ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এক নতুন শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। শ্রমিক শ্রেণী। নিজের শ্রমের বিনিময়ে তাঁর চলা। শৃঙ্খল ছাড়া যাদের হারাবার কিছু নেই। কিন্তু জয় করবার জন্য আছে সমগ্র দুনিয়া। মার্কসের জীবদ্দশাতেই কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহারের প্রয়োগ ঘটেছিল ১৮৭১এ। পৃথিবীতে প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্র প্যারি কমিউন। সমস্ত অংশের গরীব শ্রমিকশ্রেণী, সমস্ত অংশের মহিলাদের লড়াই এবং মৃত্যু বরন কালজয়ী হয়ে আছে। মাত্র ৭২দিন টিকে ছিল। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্ছেদ তারা ঘটাতে পারেনি। শাসকের নির্মম আঘাতে ব্যর্থ হয়েছিল ‘প্যারি কমিউন’। কিন্তু মার্কসবাদের অভ্রান্ততা প্রমাণ করেছিল। পুঁজিবাদ বিকশিত হবার পাশাপাশি তার কবর খননকারীদেরও জন্ম হয়েছিল। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হওয়া সম্ভব। কিন্তু জার শাসিত পশ্চাদপদ রাশিয়ায় কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে প্রথম মার্কসবাদের সফল প্রয়োগ সোভিয়েত ইউনিয়ন বলশেভিক অর্থাৎ রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। মার্কসবাদ সৃজনশীল বিজ্ঞান তা প্রমানিত হলো। তিনি প্রমাণ করলেন মার্কসবাদ বিজ্ঞান - কোন আপ্ত বাক্য নয়। চলার পথ নির্দেশিকা। জারের আমলে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে কিভাবে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ঔপনিবেশিক দেশগুলিকে টুকরো টুকরো করে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেবার চক্রান্ত করেছিল তার ইতিহাস সুদীর্ঘ।

পৃথিবীতে প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্র প্যারি কমিউন

১৯১৪-১৯১৮ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। রাশিয়া মিত্রশক্তিতে যোগ দেয়। এর মধ্যে রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ, বিপুল সৈন্য ও নিরীহ মানুষের ক্ষয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাঝে বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে ৭-১৭ই নভেম্বর (অক্টোবর) বিপ্লব সংগঠিত হলো। ১৯০৫ সালে বিপ্লবের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক আঘাত হেনে বিপ্লব সম্পন্ন করতে হলে চাই লৌহদৃঢ় শৃঙ্খল। বিপ্লবী বাহিনী ছাড়া বিপ্লব হয় না। নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণী। তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য শ্রমজীবী জনগণের অর্জিত অধিকার, শিল্প ও কৃষিকে বিকশিত করা। রাশিয়ায় কৃষি, জমি ও শান্তির শ্লোগানের ভিত্তিতে জনগণকে সংগঠিত করা। তার প্রথম ধাপ একটি ডিক্রি জারি করে সমস্ত জমি কৃষকদের হস্তান্তরিত করেছিল। আর একটি ডিক্রি জারি করে রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

১৯২০ সালের শরতকালে ক্রেমলিনে লেনিনের পড়ার ঘরে বসে বিশ্ববরেণ্য শ্রমিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের সাথে আলোচনায় বললেন - “সুস্পষ্ট মতবাদের ভিত্তিতে আমাদের একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলন গড়ে তুলতেই হবে। একথা স্পষ্ট যে, মার্কসীয় মতবাদ ছাড়া কোন সুষ্ঠ বাস্তব কাজ সম্ভব নয়। এই প্রশ্নের উপর আমাদের, কমিউনিস্টদের নীতি সম্পর্কে সবচেয়ে সূস্পষ্ট ধারণার প্রয়োজন।” এই বক্তব্যেই নারীদের সম্পর্কে লেনিনের পরিষ্কার স্বচ্ছ মত অনুভূত হয়।

বিপ্লবের পর মাত্র আট বৎসর তিনি বেঁচেছিলেন, কিন্তু নারীর সমানাধিকার ও নারীমুক্তির লক্ষ্যে নানা সময়ে বক্তব্যের পাশাপাশি কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করেছেন। রান্নাঘরের জীবন থেকে মুক্তি দিতে যৌথ কিচেন। যৌথ খামার তার দৃষ্টান্ত। সোভিয়েত রাশিয়াতে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃতি হয়।

সোভিয়েত রাশিয়াতে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃতি হয় , যার অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন লেনিন ও ক্লারা জেটকিন ।।

মহান নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব ছড়িয়ে পরেছিল সারা দুনিয়ায়। এক তৃতীয়াংশ “বিশ্ব সমাজতন্ত্রের পতাকাকে উর্দ্ধে তুলে ধরেছিলেন। সেই ব্যবস্থা আজ আর নেই। চরম দক্ষিণপন্থী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি টিঁকে থাকার লক্ষ্যে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক কুৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। ধণতন্ত্র আজ চরম সংকটের মুখে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমস্ত বিশ্বের মানুষ রুখে দাঁড়াচ্ছেন। বির্পযস্ত পুঁজিবাদ নিজের সংকটকে আড়াল করতে পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে সামনের সারিতে এনে দারিদ্র, বেকারী, অপুষ্ঠি, ক্ষুধা, চাকরীর নিরাপত্তাহীনতাকে আড়াল করতে চাইছে। অপর দিকে আমাদের দেশে ধর্মকে হাতিয়ার করেছে। সমাজের বিকাশের ধারায় ভাববাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ধর্ম। সাধারণ মানুষ বেশিরভাগ ধার্মিক। নিজ নিজ ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রেখে চলেন।

কিন্তু আজ ধর্মকে ব্যবহার করে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর মধ্যে হিংসা, অবিশ্বাসের বাতাবরন তৈরীতে সচেষ্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। আর.এস.এস, বিজেপি ও তার শাখা সংগঠনগুলি ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করে হিন্দু রাষ্ট্রের শ্লোগান দিয়ে সংখ্যালঘু মানুষকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অপরদিকে সংখ্যালঘু মৌলবাদী শক্তিও সক্রিয়। ধর্মের প্রতিযোগীতা চলছে টি.এম.সি, বিজেপির মধ্যে। ভারতবর্ষে নানা ভাষা, নানা মত, নানা খাদ্যাভ্যাস, নানা পরিধানের বৈচিত্র নিয়েই ঐক্যবদ্ধ ছিল। আজ সেই ঐক্যকে ভাঙতে চাইছে যারা তাদের বিরুদ্ধে আমাদের তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। 
বিপ্লবের পর রাশিয়ার বিভিন্ন জনজাতি গোষ্টি নিজ নিজ ভূখন্ড এক করে সোভিয়েত রাশিয়া গড়ে তুলেছিল। উন্নতির শিখরে উঠেছিল। স্বল্প কথায় তার ব্যাখ্যা করা যাবে না।

জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানী, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী, “দাস ক্যাপিটাল” এর রচয়িতা, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্কসের ব্যক্তি জীবন ছিল অসীম কষ্ট ও ত্যাগের। দেশ থেকে দেশান্তরি হতে হয়েছিল শুধু শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি ছিলেন বিশ্বনাগরিক। অনুরুপ কমরেড লেনিনকেও বারবার নির্বাসিতের জীবন কাটাতে হয়েছে বলশেভিক পার্টি গঠনের অপরাধে। সাইবেরিয়ার প্রবল ঠান্ডায় তিনি অসুস্থ হয়েছেন। মাত্র ৫৪ বৎসর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কাছে মার্কসবাদ লেনিনবাদ একই সাথে উচ্চারিত হয় এবং আগামী দিনেও হবে।

আমাদের দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে আগাম সতর্কতা নিয়ে ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষ দল তৃণমূল, সাম্প্রদায়িক বিজেপির বিরুদ্ধে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ সমস্ত দলের ঐক্য রক্ষা করা এই মুহূর্তে জরুরী। “লেনিন ভেঙ্গেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ। অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।”


শেয়ার করুন

উত্তর দিন