বিজেপির কৃষি আইন - তৃণমূল কি সত্যিই বিরোধী ..? শমীক লাহিড়ী

৭ ডিসেম্বর ২০২০ ,সোমবার

'পার্লামেন্টে কৃষি বিল পাসের দিনটি ব্ল্যাক সানডে।'
'আমরা কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিরোধী।'
'দিল্লির কৃষদের আন্দোলনে আমাদের নৈতিক সমর্থন আছে।'
মমতা ব্যানার্জী
...................মমতা বন্দোপাধ্যায়

মুখ ও মুখোশ

২০১৪ সালে তৃণমূলের সরকার কৃষি সংক্রান্ত একটা আইন পাশ করেছিল।

কি আছে এই আইনে? এই আইনে মাঠে ফসল কেনবার অধিকার বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দেওয়া হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তি, কোম্পানী, সংস্থা, কো-অপারেটিভ সোসাইটি, সরকারি সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা অথবা এজেন্সি-কে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কেনার অধিকার দেওয়া হয়েছে ( Sec -2, Clause 3 CA, CB)। এই আইনেই ‘কমিশন এজেন্ট’ নিয়োগের অধিকারও দেওয়া হয়েছে ক্রেতাকে (Sec - 2, Clause - 4D)। অর্থাৎ দালালি ব্যবস্থাকে বৈধ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এই আইনে।

এমনকি সরাসরি বিদেশে রপ্তানি এবং বিদেশ থেকে আমদানি করার অধিকারও দেওয়া হয়েছে এজেন্টদের, ২০১৪-র তৃণমূল সরকারের তৈরী করা এই আইনে। এই আইন অনুযায়ী যে কোন ব্যক্তি বা কোম্পানী নিজে বাজার তৈরি করার লাইসেন্সও পেতে পারে। অর্থাৎ বৃহৎ কোম্পানী অথবা তার নিযুক্ত দালাল কেবলমাত্র কৃষকের কাছ থেকে ইচ্ছেমত দামে ফসল কিনতে পারবে তাই নয়, ক্রমশ সমগ্র কৃষি বাজারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার অধিকারও এই আইনে পেয়েছে।


২০১৪ সালে তৃণমূলের সরকার কৃষি সংক্রান্ত একটা আইন পাশ করেছিল, সেই আইন অনুযায়ী কৃষকের কাছ থেকে ইচ্ছেমত দামে ফসল কিনতে পারবে তাই নয়, ক্রমশ সমগ্র কৃষি বাজারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার অধিকারও এই আইনে পেয়েছে।




নূন্যতম সহায়ক মূল্য ও বাজার মূল্য

এই আইনে কোথাও বলা হয়নি 'সরকার নির্ধারিত সহায়তা মূল্য'-র চাইতে কম মূল্যে কোনো কোম্পানী বা ব্যক্তি চাষীর কাছ থেকে ফসল কিনতে পারবে না। অর্থাৎ বৃহৎ কোম্পানী অথবা তাদের নিযুক্ত দালালদেরই হাতে কৃষকের ফসলের দাম নির্ধারণ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। যেমন আলু চাষীর কাছ থেকে ৬/৬.৫০টাকা প্রতি কেজি দরে আলু কিনেছে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফড়ে-দালালদের কোম্পানী, অথচ বাজারে আলুর দাম উঠেছিল কেজি প্রতি ৪০টাকারও বেশী। খোলা বাজারের এই নীতির ফলে আলুর দাম কিন্তু চাষী নির্ধারণ করছে না, নির্ধারণ করছে বহুজাতিক কর্পোরেট অথবা দালালরা। এইভাবে দালালরা চাষীর কাছ থেকে ঐ দামে আলু কিনে হিমঘরে মজুত রেখে ৩৫টাকা কিলো দরে বিক্রি করছে।

অর্থাৎ কৃষকের ফসল বিক্রির স্বাধীনতা এবং উপযুক্ত মূল্য পাওয়ার স্বাধীনতা থাকবে বলে যে দাবী নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দোপাধ্যায় করছেন, তা সর্বৈব অসত্য।

দিল্লিতে কৃষকরা ১০ দিন লাগাতার ধর্ণায় বসে মোদি সরকারের আনা একই আইনের বিরুদ্ধে
দিল্লিতে কৃষকরা ১০ দিন লাগাতার ধর্ণায় বসে মোদি সরকারের আনা একই আইনের বিরুদ্ধে।

বিজেপি'র আইনের কার্বনকপি
অবাধ দালাল রাজকে বৈধতা দিয়েছে তৃণমূল সরকার The West Bengal Agricultural Produce Marketing (Regulation) (Amendment) Act XXVII 2014 আইনের মাধ্যমে (২০১৪ সালে বিধানসভায় পাশ করা আইন, ২১শে জানুয়ারী, ২০১৫ সালে গেজেট নোটিফিকেশন হয়)।

২০০৩ সালে তৎকালীন এন.ডি.এ. সরকার (যেখানে শ্রীমতী মমতা বন্দোপাধ্যায় মন্ত্রী ছিলেন) দেশের সব রাজ্য সরকারগুলির কাছে কৃষি সংক্রান্ত একটি ‘মডেল আইন’ তৈরি করে পাঠিয়েছিল। তখনও বিজেপি’র মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের কৃষি বিপনণ ব্যবস্থা দেশী-বিদেশী বৃহৎ কর্পোরেট কোম্পানীগুলির হাতে তুলে দেওয়া। ক্ষমতায় এসে এই আইন তৈরি করে বিজেপির সেই ইচ্ছা ২০১৪ সালে শ্রীমতী মমতা বন্দোপাধ্যায় কার্যকর করেন।



আর একটা তৃণমূলের তৈরী আইন

২০১৭ সালের ৩১শে মার্চ তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার আর একটি আইন কার্যকরী করে - The West Bengal Agricultural Produce Marketing (Regulation) (Amendment) Act XVI 2017। এই আইনে কৃষি পণ্যের ই-ট্রেডিং বা অনলাইন বাণিজ্য ও বিক্রি বৈধ ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। ১৯৭২ সালে APMC (Agricultural Produce Marketing Committee) আইন তৈরী করে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। কিন্তু এই আইনকে তারা কার্যকরী করেনি। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে এই আইন কার্যকর করে। APMC আইন মূলত তৈরী করা হয়েছিল কৃষিজাত পণ্যের বিপনণে দালাল রাজের অপসারণ এবং কৃষকদের ফসলের উপযুক্ত দাম পাওয়ার ব্যবস্থাকে কার্যকরী করতে। আমাদের রাজ্যেও নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা তৈরী করেছিল বামফ্রন্ট। যেহেতু এই বাজার সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং কৃষকদের অংশগ্রহণে পরিচালিত হতো, তাই একদিকে দালালদের দূরে রাখা সম্ভব হতো এবং অপরদিকে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পেতে পারতো। আবার একই সাথে কৃষক তার ইচ্ছেমতো অন্য যে কোন বাজারেও ফসল বিক্রি করতে পারত।

সমবায় ধ্বংস

একই সাথে বামফ্রন্টের আমলে কয়েক হাজার কৃষি সমবায় সংস্থা গড়ে উঠেছিলো, যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করত স্থানীয় কৃষকরাই। এরা কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে নিত এবং সরকারের কাছে সরাসরি বিক্রি করত। এই ব্যবস্থা কৃষকদের সরাসরি সরকারী সহায়তা মূল্য পেতে সাহায্য করত।

ক্ষমতায় এসে শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষি সমবায়গুলিসহ প্রায় ২০ হাজার সমবায় সরকারী অধ্যাদেশ জারি করে বাতিল করেন। এর ফলে সমগ্র বাজার চলে যায় কিছু অর্থবান ক্ষমতাশালী দালালদের নিয়ন্ত্রণে। এরপর ২০১৭ সালে APMC আইনের পরিবর্তন করে রাজ্যের কৃষিপণ্যের বাজার ও বিপণনকে সম্পূর্ণ সরকারী নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করলেন তিনি।

এটা তিনি করেছিলেন ২০১৭ সালে বিজেপি সরকারের পাঠানো মডেল আইন অনুযায়ী। এভাবেই রাজ্যে ঘুরপথে কৃষিপণ্য বিপনণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে দালাল ও বৃহৎ কোম্পানীর হাতে অনেক আগেই তুলে দিয়েছিলেন শ্রীমতী বন্দোপাধ্যায়। এমনকি এই দুটি আইনের মাধ্যমে ঘুরপথে চুক্তি চাষের অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে।

দিল্লিতে কৃষকরা ১০ দিন লাগাতার ধর্ণায় বসে মোদি সরকারের আনা একই আইনের বিরুদ্ধে।

বাংলায় সংগ্রহ মূল্যের প্রকৃত চেহারা

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার ধানের সংগ্রহ মূল্য ঠিক করে দেয়। শুনে মনে হয় কৃষক দালালদের হাত থেকে মুক্ত এই বাংলায়। বাস্তব কি তাই?

সরকারি ধান সংগ্রহ কেন্দ্রে গেলে জমির কাগজপত্র, ব্যাঙ্ক একাউন্ট ইত্যাদি নানাবিধ বাহানায় চাষীদের ঘোরানো হয়। এছাড়া বহু জমির মালিক নিজে চাষ না করে অন্যকে দিয়ে চাষ করায়। যে চাষ করছে, তার কাছে জমির মালিকানার কাগজ স্বাভাবিকভাবেই থাকে না। তাই সরকার সেই চাষীর থেকে ধান নেয়না। সেই চাষী তখন ফড়ে দালালদের কাছে ১০/১২ টাকা কেজি দরে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। আর সেই ফড়ে দালালরা ঐ ধান নিয়ে সরকারের কাছে বিক্রি করে দাম পাচ্ছে ১৮.৮৮ টাকা প্রতি কেজি। এইসব ফড়ে দালালরাই শাসক দলের মূল শক্তি গ্রামাঞ্চলে। কোনো চাষ না করে স্রেফ দালালি করে ৭/৮টাকা প্রতি কেজিতে মুনাফা করছে। ২০১৯-২০ সালে সরকার মোট ৪৮৫কোটি ৮৩লক্ষ ৪৩হাজার ৮০০ কেজি ধান সরকার কিনেছে। তার অর্থ চাষীদের প্রাপ্য ৩৮৮৭ কোটি টাকা প্রতি বছর ফড়ে দালালরা মেরে দিচ্ছে (গড়ে কেজি প্রতি ৮ টাকা)। চাষীরা রক্তে ঘামে তৈরী করা ফসল ফড়েদের কাছে জলের দামে বিকিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে ।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পাওয়া সরকারি ক্ষতিপূরণ চলে যাচ্ছে জমির মালিকের কাছে, ভাগচাষী অর্থাৎ যারা প্রকৃত চাষ করছে সে কোনও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না।

কি চান - প্রচার না সত্যি বিরোধিতা?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময়েই প্রচারের আলোয় থাকতে চান। তাই হয়তো ঘন্টা খানেক পেটোয়া সংবাদ মাধ্যমগুলোকে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় হেঁটে আত্মপ্রচারের উত্তম ব্যবস্থা করবেন। নিজের দলের ১/২ জন সাংসদকে ঘন্টাখানেকের জন্য দিল্লিতে অবস্থানরত কৃষকদের কাছে পাঠিয়ে, 'নৈতিক সমর্থন'-র প্রচার করবেন।

কিন্তু এখন রাজ্য সরকারকে পরিষ্কার বলতে হবে, যদি সত্যিই তারা মোদি সরকারের আনা ৩টে কৃষি আইন বাতিলের পক্ষে থাকেন তাহলে, ১) কবে বিধানসভায় কেন্দ্রের কৃষি আইন বিরোধী প্রস্তাব আনবেন, ২) নিজের সরকারের তৈরি ২টি আইন কবে বাতিল ঘোষণা করবেন, এবং ৩) ফড়ে দালাল হঠিয়ে রাজ্যে বাতিল করে দেওয়া ২০০০০ চাষীদের সমবায় কবে ফিরিয়ে দেবেন?

বামফ্রন্টের আমলে কয়েক হাজার কৃষি সমবায় সংস্থা গড়ে উঠেছিলো, যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করত স্থানীয় কৃষকরাই


এই কাজগুলো না করে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আনা আইনগুলোর লোক দেখানো বিরোধিতা অর্থহীন।

মমতা বন্দোপাধ্যায় এ রাজ্যে জমি চোর, মহাজন, ফড়েদের সুবিধার ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিধি আগে থেকেই করে দিয়েছেন। এমনকি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনও রাজ্যে ধীরে ধীরে শিথিল করা হয়েছে। যে কারণেই আলুচাষীর কাছ থেকে ৬/৬.৫০ টাকায় আলু কিনে হিমঘরে মজুত রেখে ফড়ে-দালাল বাজারে ৩৫/৪০টাকা প্রতি কেজি বিক্রী করতে পারছে। রাজ্য সরকার নীরব দর্শক। কেন্দ্রের ঘোষিত কৃষি নীতির অনেক কিছুই মোদিজি'র অনেক আগেই ঘোষিতভাবেই প্রয়োগ করা শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল সরকার।

তাই, তৃণমূলের কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরোধীতা এবং বামেদের লড়াই এক নয়। ওদের লোক দেখানো লড়াই ভোটের তাগিদে। আর বামপন্থীদের লড়াই দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত সাধারন চাষীদের স্বার্থে লাগাতার ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া




শেয়ার করুন

উত্তর দিন