Site icon CPI(M)

Karl Marx: The Legacy

Marx A Legacy Cover

“The overthrow of bourgeoisie had been only decreed; the decree was not carried out” – পুঁজিবাদকে উপড়ে ফেলাই যে লক্ষ্য, সেই ঘোষণা হয়ে গেছে ; লক্ষ্যপূরণ হওয়া এখনও বাকি। ১৮৫২ সালে ল্যুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার লিখতে গিয়ে একজায়গায় উল্লেখ করেছেন মার্কস।

কার্ল হাইনরিখ মার্কস। দুনিয়াজূড়ে পন্ডিতমহল নানা সময় নানা পন্থায় যাকে কখনো মহান ঘোষণা করেছে, আবার কখনো কেতাবি বুলির আড়াল ব্যবহার করে অসম্মানিত করতে চেয়েছে। সেইসব বহুবিধ প্রচেষ্টার নিরলস চর্চায় যেন-তেন-প্রকারেণ জনসাধারণের চেতনা থেকে সাম্যবাদের ফলিত বিজ্ঞান মার্কসবাদকে দূরে রাখাই মার্কস পরবর্তী মানবেতিহাসে উপরতলার রাজনীতির মূলধারা।

প্রকৃতি বিজ্ঞানে যেভাবে ‘কেন এমন হয়?’ – এই বুনিয়াদী প্রশ্নকে আলোচনার কেন্দ্রে রেখে প্রথমে গ্যালিলিও, পরে নিউটনীয় বলবিদ্যার পরিসর পেরিয়ে কোয়ান্টাম মেক্যানিক্সের স্তরে উন্নীত হয়েছে ঠিক সেভাবেই ‘সমান সুযোগের সমাজব্যবস্থার’ পক্ষে যুক্তিসঙ্গত রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য ধারাসমূহ সময়োপযোগী কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর মাটি ছাড়িয়ে মহাকাশে পাড়ি দেবার কিংবা বস্তুকে ভাঙতে ভাঙতে আনবিক জগতে প্রবেশ করার পরেও যেমন প্রকৃতি বিজ্ঞানের মূল প্রশ্ন ‘কেন এমন হয় ?’ রয়ে গেছে তেমনই যেকোনো সমাজবিজ্ঞানের মূল সমস্যা আজও “কেন এমন হল ?” -কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। প্রকৃতি বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞানের মিল এবং অমিলের জায়গা এটাই।

‘কেন এমন হল’ – ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্ন করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন কার্ল মার্কস। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পথেই ধারণাসম্মত জ্ঞান এবং বিজ্ঞান-যুক্তি-প্রতিযুক্তিসম্মত জ্ঞানের যথাযথ সংশ্লেষে নির্মিত হল ইতিহাসের বিজ্ঞান – ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। পুঁজি গ্রন্থের সার কথা যদি হয় ‘উদ্বৃত্তের নির্মাণ ও তার অধিকার সম্পর্কে ধারণা’ তবে সেই উপলব্ধির সবচেয়ে উপযোগী প্রয়োগ হল ইতিহাসের সত্যকে প্রকাশ করায়। মার্কস সেই কাজ নিজেই শুরু করেছেন, আমাদের সেই ধারা বেয়ে কাজ এগোতে হয়।

মার্কসের হাতে পূঁজির রহস্য উন্মোচনের পরে একটা নতুন ধাঁধার জন্ম হল। বিজ্ঞানসম্মত অর্থশাস্ত্রের নতুন সীমাবদ্ধতা সামনে চলে এল। সেই ধাঁধার জোরেই আজও পুঁজিবাদ করেকম্মে খাচ্ছে! দেখা যাক সেই ধাঁধাটি কেমন এবং মার্কস কীভাবে সেই প্রশ্নেরও সমাধান করলেন।

কিছুটা ধীর কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন পথে ক্রমশ একটা বিশ্বব্যবস্থায় পরিণত হবার সময়েই একটা প্রকল্পনা (হাইপোথিসিস)-কে পুঁজিবাদ নিজের জন্মরহস্যের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। অথচ লোকঠকানো ব্যবসার গোড়াতেই সেই বিরাট গলদটি রয়ে গেছে। মার্কস দেখালেন পুঁজি কীভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে, সেই উদ্বৃত্ত মূল্য পুনরায় কীভাবে পুঁজি হিসাবে ব্যবহৃত হয় – আগের (অর্থাৎ বিনিময় চক্রের প্রথমার্ধের পর্বে) তুলনায় পুঁজি কলেবরে বাড়ে অনেকটাই এবং সেই পথেই সম্পদের নামে মুনাফার পাহাড় নির্মিত হয়। এই অবধি কথাও কোনো সমস্যা নেই, পাটিগণিত বোঝেন এমন যে কেউ পূঁজির চক্র এবং চক্রান্ত দুইই বুঝতে পারবেন। চক্রাকার পরিচলনের পথে যেটা সহজে ব্যাখ্যা করা যায়না তা হল – প্রথমে জন্ম নিল কে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা নাকি পুঁজি নিজেই? কারন, পুঁজি, পুঁজির বিনিয়োগ এবং জমি ও শ্রমশক্তি সম্বলিত পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যাবস্থা না থাকলে উদ্বৃত্ত মূল্য (যা পরে নিজেই পুঁজি হয়ে ওঠে) সৃষ্টি হতে পারে না আবার পুঁজি বিনিয়োগ না করা হলে সবার প্রথম ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাটা গড়ে ওঠে কীভাবে? এই চক্রাকার চরিত্রের ঘূর্ণাবর্তে জনসাধারণের মাথাটা গুলিয়ে দিতে পারছে বলেই পুঁজিবাদ নিজেকে বহুবিধ সংকট সত্বেও একটা বিশ্বব্যবস্থা হিসাবে টিকিয়ে রাখতে পারছে। মানুষের মনে কিছুটা হলেও এই ধারণা ঢুকিয়ে দিতে পারছে পুঁজি, মুনাফা এসব মানুষের চেতনায় শুরু থেকেই রয়েছে অতএব মুনাফার সংস্কৃতি – ভোগবাদী সংস্কৃতি এসব মানুষের নিজস্ব অস্তিত্বের মতোই জায়েজ! অন্যের প্রাপ্য চুরি করে নিজে ভালো থাকার ভাবনা মানুষের প্রবৃত্তিগত। মার্কস উপ্লব্ধি করেছিলেন পুঁজিবাদ শুধুই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা না, পুঁজিবাদ একটা সংস্কৃতি – একটা দর্শন। তাই তাকে ভাঙবার, বদলে দেবার লড়াইটাও শুধু অর্থশাস্ত্র সম্মত পথে করলে চলবে না, দুনিয়া বদলের নিজস্ব দর্শন নির্মাণ করতে হবে, নতুন সমাজের উপযুক্ত নতুন মানুষের জন্য প্রয়োজন হবে নতুন সংস্কৃতির। আর তাই ক্যাপিটাল গ্রন্থের পাতায় পাতায় গ্যেটে থেকে শুরু করে শেক্সপিয়রের রচনাংশের আধিক্য, ফুটনোটের অসাধারণ ব্যবহার।

মুনাফাকে জায়েজ প্রতিপন্ন করতে পুঁজিবাদের নিজস্ব যুক্তির পুরোটাই আগাগোড়া একটা বিরাট মিথ্যা। পুঁজি আছে এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সাহায্যে সেই পূঁজির চক্রাকার সঞ্চালনায় আজকের সভ্যতার মেরুদণ্ড অর্থাৎ মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলতে ধনতন্ত্রের রৈখিক পথকে অবরোহী যুক্তির (Step Down Approach) সাহায্যে ব্যাখ্যা করলেন মার্কস। কিন্তু বিনিয়োগযোগ্য সেই প্রথম পুঁজি কোথা থেকে এল? এখানেই মার্কসের দার্শনিক অনন্যতা – ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারনার সাথে অর্থশাস্ত্রের যুক্তির অমোঘ শরচালনার যৌথ আক্রমন। পুঁজিবাদ নিজেকে সমাজের গতিধারায় অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে তুলে ধরতে চায়, ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী পৃথিবীর বেশিরভাগ সম্পদের অধিকারী কতিপয় ধনীর মুঠোয় অথবা যোগ্যতমের প্রাপ্য এসব বলে তারা আসলে মুনাফা নির্ভর মানুষখেকো ব্যবস্থাটাকেই কায়েম রাখতে চায়। এমন মহান ইচ্ছাকেই রাজনীতির ভাষায় কায়েমি স্বার্থ (Vested Interest) বলে। কার্ল মার্কস ঈশ্বরের ইচ্ছায় বেশিরভাগ মানুষের নরকভোগ মেনে নিতে চান নি। তার আবিস্কারের সাফল্য সেখানেই। বিনিময়যোগ্য পুঁজি থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য আহরন যে আসলে বহুজনের শ্রমশক্তির ন্যায্য বিনিময় মূল্য চুরি করে গড়ে ওঠে শুধু এটুকু বুঝলেই মার্কস পুরোটা বোঝা যাবে না। মার্কস ওখানেই থেমে থাকেন নি, তেমনটা হলে তার নাম শুধু এক মহান পন্ডিত হিসাবেই চিহ্নিত হত। তার শিক্ষা পণ্ডিতম্মন্যতার সিমানা পেরিয়ে বিপ্লবী স্তরে পৌঁছে যায় যখন তিনি দেখিয়ে দেন পুঁজি সঞ্চয়ের প্রাথমিক প্রক্রিয়াই হল দুনিয়াজূড়ে রক্তস্নাত লুটতরাজ। এখানেই মার্কসীয় প্রজ্ঞায় আরোহী যুক্তির (Step Up Approach) প্রয়োগ। ধনতন্ত্রের মুখোশ টেনে ছিড়ে ফেলে তিনি প্রমাণ করলেন দুনিয়াজূড়ে সম্পদ লুঠ করেছে প্রাক পুঁজিবাদী সমাজের লুঠেরা নেতৃবর্গ এবং দুহাতে রক্তমেখে সেই লুটের টাকাতেই পুনিবাদের ভিত্তি নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি প্রমাণ করলেন পূঁজির আদিমতম সঞ্চয় কোন পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ফলা না বরং ঠিক তার উল্টো – পুঁজি ছিল বলেই ধনতন্ত্র নির্মিত হতে পেরেছে। সেই নির্মাণের ভিত দুনিয়াজূড়ে অসংখ্য অসহায় মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে পোক্ত হয়েছে। এই মহাপাপ থেকে পুঁজি এবং পুঁজিবাদ কারোরই মুক্তি নেই – কখনো হবে না। যে ব্যবস্থাটা নিজেই নিজের নামে ঢাক পিটিয়ে প্রচার করছে There is no alternative – সম্পদ সৃষ্টির মহান ও পবিত্র কর্তব্য সম্পর্কে নিজেদের উপরওয়ালার প্রেরিত দূত বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে তারা আসলে ছিল খুনি লুঠেরা – এখন হয়েছে চোর।    

মার্শাল থেকে শুরু করে স্মিথ অবধি অর্থশাস্ত্রীরা এই সত্যটুকু উন্মোচন করতে পারেন নি, ব্যার্থ হয়েছিলেন – হয়ত সেই অনুশোচনা থেকেই অ্যাডাম স্মিথ তার বইতে পুঁজিবাদের স্বরুপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে “অদৃশ্য হাত” বলে থেমে যান, আর এগোন না। মার্কস এদের কারোর অমর্যাদা করেন নি, এদের মতামতের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছিলেন যথাযোগ্য মূল্যায়ন সহ।

অর্থশাস্ত্র এবং ইতিহাস, জ্ঞানচর্চার দুটি বিজ্ঞানকেই আরও শক্তিশালী করলেন মার্কস, এগিয়ে দিলেন সামনের দিকে। জ্ঞানচর্চার স্বাভাবিক পদ্ধতিই হল মূল সমস্যার সমাধানে প্রথমে খণ্ড খণ্ড বিভিন্ন সমস্যার উত্তর খোঁজা পরে সেই সকল উত্তরকে একজায়গায় এনে একটি যথাযথ সংশ্লেষে মূল সমস্যার নিরসন। মার্কস সেই কাজটাই করেছিলেন। অর্থশাস্ত্রের একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তরে যা পেলেন তাঁকে প্রয়োগ করলেন ইতিহাসে আরেক প্রশ্নের সমাধানের লক্ষ্যে – সফলও হলেন। প্রায় কবর খুঁড়ে বের করে আনলেন পুঁজিবাদের ফসিল হয়ে যাওয়া রক্তপিপাসু, লুঠেরা চরিত্রকে। সম্পদ সৃষ্টি, কর্মসংস্থান এবং আধুনিক সভ্যতার নির্মাণ সবকিছুই পুঁজিবাদ করেছে ঠিকই – কিন্তু এই কাজ করার একমাত্র লক্ষ্য থেকেছে মুনাফা। দুনিয়াজূড়ে লুঠ চালিয়ে, দুহাতে রক্ত মেখে জমা করা অর্থের পাহাড় ভেঙ্গেই আজকের ধনতন্ত্রের সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে – কোন বিশেষ যোগ্যতা না, ওরা আসলে মানুষ খুন করেছিল। পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খন্ডের অষ্টম ভাগে ছাব্বিশ নম্বর অধ্যায়ের নাম “The Secret of Primitive Accumulation”। আর তাই পুঁজিবাদ এবং জনকল্যাণ আজও পৃথিবীর বুকে অস্তিত্বমান এক বিরাট oxymoron ব্যাতিত আর কিছুই না।

কার্ল মার্কসের বিপ্লবী শিক্ষার অন্যতম সার কথা এটাই।

খণ্ড-খণ্ড জানা, বোঝা জ্ঞান সম্বলিত বিশেষজ্ঞ নির্ভর ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা যখন নিজের সুবিধার্থে জনমানসে “নিজে ভালো থাকো” বলে প্রচার চালাচ্ছে সেই ব্যবস্থার বিপরীতে লড়াই করতে মার্কস – মার্কসবাদ আসলে হাতিয়ার। আমাদের সেই হাতিয়ার প্রয়োগে উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে।

এখান ওখান থেকে খামচে তুলে আনা মার্কসকে কখনো অর্থনীতি, কখনো দর্শন আবার কখনো ইতিহাসবেত্তা বলে প্রতিপন্ন করতে চাওয়া আসলে বিপ্লবী মেধার নামে প্রহসন। মার্কস এবং মার্কসবাদ দুটোই আসলে একটা সম্পূর্ণ মানবিক জীবনের মূর্ত রূপ – সেই জীবন যা স্বর্গচ্যুত হয়ে পৃথিবীতে নরকভোগ করতে আসেনি, বরং পৃথিবীর বুকেই প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে স্বর্গ নির্মাণের সংকল্প করেছে।

খিদের মুখে বেড়ে দেওয়া একথালা ভাত যতই খিদে পাক না কেন গ্রাস গ্রাস করেই খেতে হবে, কিন্তু খিদে মেটাতে পুরো থালার ভাতটাই শেষ করতে হবে – মাও সে তুং’এর শিক্ষা। মার্কস চর্চাও ঐ সম্পূর্ণতার অভ্যাস ব্যাতিত সাফল্য দেবে না। লক্ষ্যে পোঁছাতে হলে সম্যক চর্চার পরিশ্রমসাধ্য পথই বেছে নিতে হয় – মার্কস নিজেই তাই করে গেছেন সারাজীবন ধরে। মতামত নির্মাণ – প্রতি মতামত নির্মাণ এবং সেই দুইয়ের যথাযথ সংশ্লেষে সিদ্ধান্ত গ্রহন, দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সার কথাটি ভুললে চলে না।

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ

শেয়ার করুন