Site icon CPI(M)

কার্ল মার্কস-জাগছেন,জাগাবেন।

৫ মে ২০২০


এ বারের ৫ মে মার্কস বেঁচে থাকলে বয়েস পেরিয়ে যেত ২০২ বছর।১৮৮৩ সালে তিনি চলে গেছেন। এঙ্গেলস ও চলে গেলেন ১৮৯৫-এ। তারপর দুনিয়া কত পাল্টে গেল। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার বুক থেকে উঠে এল রক্ত করবীর মত রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। লেনিনের নেতৃত্বে। দেশে দেশে তৈরি হল কমিউনিস্ট পার্টি । আমাদের দেশেও ১৯২০-এ । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ফ্যাসিবাদ কে হারিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুন দুনিয়ার দুয়ার খুলে দিল। পূর্ব ইউরোপের একাধিক দেশ সহ চীন , ভিয়েতনাম ,কিউবা, গণতান্ত্রিক কোরিয়া ইত্যাদি দেশ সমাজতন্ত্রের পথে গেল। ভারত এবং একাধিক তৃতীয় বিশ্বের দেশে উপনিবেশ বাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম জিতল।


মার্কসবাদের নানান অপপ্রয়োগের জন্য ১৯৮৯-এ নেমে এল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশ গুলিতে মহা বিপর্যয়। টুকরো হয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোশ্লোভাকিয়া এবং আগেই বিপথে চলা যুগোশ্লাভিয়া । পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যেকার দেওয়াল ভাঙা হল মহা হুল্লোড়ে । ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বললেন ‘ইতিহাসের অবসান’ অর্থাৎ ‘ মানুষের মতাদর্শগত বিবর্তনের এই হল শেষ বিন্দু এবং এবার মনুষ্যসৃষ্ট সরকারের চূড়ান্ত একমাত্র রূপ হবে পশ্চিমি উদার গণতন্ত্রের দুনিয়াব্যাপী
বিস্তার’।



২০০৮ -এ ধনতান্ত্রিক বিশ্বে এল প্রবল সংকট – সব প্রাইম ক্রাইসিস। প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তারপর গোটা ইউরোপে, ক্রমে তৃতীয় বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল অভাবিতপূর্ব মন্দা – সংকট । আপাতডাগর বিশ্ব পুঁজিবাদের পতন ঘটল। বেকারের সংখ্যা বাড়ছে । ছাঁটাই চলছে। ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া । সামাজিক নিরাপত্তার মূল্যছেদ হচ্ছে। যে আমেরিকা ছিল নয়নের মণি তার মূর্ছা ও পতন হল। জনগণের করের টাকায় জমা সরকারি তহবিল ভেঙে বেসরকারি আর্থিক সংস্থাগুলোকে উদ্ধার করা হল – সোজা কথায় যা লোকসানের জাতীয়করণ। চীনসহ সমাজতান্ত্রিক দেশ গুলো এই সংকট থেকে অনেকটা রেহাই পেল। ভারতে ইউপিএ -২ সরকার। বামপন্থীরা সমর্থন করছিল। সরকারের উদার অর্থনীতির জোরালো প্রবক্তারা বেসরকারিকরণ , রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ চাইল। বামপন্থীদের কট্টর বাধায় তা সম্ভব নয় । তাই ভারত এই সংকট থেকে কিছুটা রেহাই পেয়েছিল। অবশ্য ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কারণে সিপিআইএম পরে সরকার থেকে সমর্থন তুলে নিলে মনমোহন সিং বলেছিলেন ‘ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পেলাম’। এবার উদার অর্থনীতির রথযাত্রা।



সাবপ্রাইম সংকটের মূলে ছিল চাহিদা বা বুর্জোয়া অর্থনীতির চাঁচাছোলা ভাষায় ‘প্রকৃতি’ চাহিদার অভাব। দেখা দিল ‘অতিউৎপাদনের সংকট। এই সংকটের কথাই মার্কস ও এঙ্গেলস লিখেছিলেন , এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে বুর্জোয়ারা যে পথ নেয় তা সংকটকে এড়ানোর বদলে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তোলে। এ হল সংকটের নাগপাশ । পুঁজিবাদী ব্যাবস্থা যতদিন থাকবে এ থেকে মানবসমাজ পরিত্রাণ পাবে না।


যে ফুকুয়ামা আমেরিকার বর্বর ইরাক যুদ্ধকে পর্যন্ত সোৎসাহ সমর্থন করে ছিলেন, তিনি দুনিয়া জুড়ে উদার অর্থনীতির এই বন্ধ্যা এবং ভয়ঙ্কর প্রকৃতি দেখে ২০১৮- য় বললেন ‘ এই সন্ধিক্ষণে মার্কসের কথা গুলো কিছু বিষয়কে সত্য বলে আমার মনে হচ্ছে। মার্কস অতি উৎপাদনের সংকটের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন মেহনতিদের দারিদ্রায়নের কথা….’। ১৯৩০- এর দশকের বিশ্ব মন্দার পরে ২০০৮ – এর সাবপ্রাইম সংকট থেকে উদ্ভূত মারাত্মক মন্দা পরিস্থিতি যেন কার্ল মার্কস কে আবার মনে করিয়ে দিল। পশ্চিমের শহরগুলোয় বইয়ের দোকানে খোঁজ পড়ে ক্যাপিটাল – এর খন্ড গুলোর। কেন আসে এমন সংকট ?
আজ উদার অর্থনীতির নামে দেশ দেশান্তরের পাঁচিল ভেঙে লগ্নিপুঁজির উদ্দাম ছুটে চলার জেরে চরম সমস্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে একের পর এক দেশে কাগজেকলমে হয়ত কোথাও আর্থিক বৃদ্ধি ঘটছে ফোর্বস পত্রিকায় তালিকাভুক্ত বাঘা ধনীদের সম্পদের স্ফীতি ঘটছে, কিন্তু সত্য হল দুনিয়ায় বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের দ্রুত নিঃসস্বভবন। ধনীরা যদি পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ হয় তবে ৯৯ শতাংশ হল আকাঁড়া নিঃস্ব। ‘তোমরা ১, আমরা ৯৯’ এই শ্লোগান লেখা প্ল‍্যাকার্ড হাতে মার্কিন মুলুকের নিউ ইয়র্ক শহরে পুঁজিবাদের প্রাণকেন্দ্র ওয়াল স্ট্রিটে প্রতিবাদমুখর তরুণ তরুণী অবস্থানে বসল। ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের সেই সূচনা। ২০১১-র সেপ্টেম্বরে।
এক মাসের মধ‍্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল দুনিয়ার শহরে শহরে। মোট ৮২টি দেশের ৯৫১টি শহরে আন্দোলন বিস্তার লাভ করল। আমাদের কলকাতা এবং মুম্বাইয়েও ছেলেমেয়েরা বসে পড়ল। এমনকি আমেরিকার সদাদোসর ইজরায়েলের তেল আভিভও এই কক্ষপথ থেকে বাদ পড়ল না।
লন্ডনের হাইগেটের সমাধিক্ষেত্রে প্রায় দুশ’ বছরের প্রাচীন এক দার্শনিক কার্ল মার্কসের যেন পুনরুত্থান ঘটল। প্রায় এই সময়েই সারা দুনিয়ার মেহনতি মানুষ দেশে দেশে মজুরি বৃদ্ধি, শ্রমসময় হ্রাস, অবসরপ্রাপ্তদের সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে আওয়াজ তুলল। ধর্মঘটে দেশ স্তব্ধ। সংগঠিত শিল্পে কাজ কমছে। ঠিকা শ্রমিকদের নিয়ে কারখানা চালানোর রীতি চালু হয়ে গেল। আমাদের দেশে প্রায় সবকটি ট্রেড ইউনিয়ন ভারতজোড়া সাধারণ ধর্মঘট পালন করল এবছরই ৮ জানুয়ারি। আগেও তারা করেছে। শুধু শ্রমিকেরা নয়, ফসলের দাম না পাওয়া কৃষক, যথাযথ মজুরি না পাওয়া খেতমজুর গত বছর মার্চ মাসে নাসিক থেকে মুম্বাই পর্যন্ত ১৮০ কিলোমিটার পথ লঙ মার্চে নেমেছে।
কিন্তু পুঁজিবাদী ব‍্যবস্থার এই পৌনঃপুনিক সংকটের হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। মার্কস এই কথাটিই আমৃত্যু বুঝিয়েছেন পুঁজির মালিকের কাছে সর্বহারা মানুষ নিছক বাঁচবার দায়ে তার শ্রমশক্তি বিক্রি করতে বাধ‍্য হয়। তার তো আর কিছুই নেই। কিন্তু সে শ্রমশক্তির প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত থাকে। তৈরি করে উদ্বৃত্ত মূল্য। মালিক যা আত্মসাৎ করে।
সর্বহারাদের সতর্ক করে তাই মার্কস লিখেছিলেন, মজুরিপ্রথার ভিতরে সাধারণভাবে যে মজুরদের দাসত্ব রয়েছে সে কথা বাদ দিলেও ‘শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিদিনকার লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফলাফল নিজেদের মধ‍্যে অতিরঞ্জিত করে দেখা উচিত নয়’। তবু এই লড়াই চালু রাখতে হবে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে। একে লঘুকরে দেখাও হবে হঠকারিতা। ‘কিন্তু সর্বহারাকে বিশেষত তাদের অগ্রণী অংশকে, মনে রাখতে হবে ন‍্যায‍্য শ্রমদিবসের জন্য ন‍্যায‍্য মজুরি-এই রক্ষণশীল নীতির বদলে তাদের উচিত পতাকায় এই বিপ্লবী মন্ত্র মুদ্রিত করা-মজুরি প্রথার অবসান চাই’। স্পষ্টত শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তির একমাত্র পথ বিপ্লবের মাধ‍্যমে পুঁজিবাদের উৎ…। পুঁজিবাদের একের পর এক প্রায় অমীমাংসাসাধ‍্য সংকটে জর্জরিত মানুষকে বারবার ফিরে যেতে হয় কার্ল মার্কসের কাছে।
যেমন ফিরতে হচ্ছে এই বিশ্ববিপর্যয় কোভিড-১৯ অতিমারীর সময়ে। প্রবল প্রতাপান্বিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অতিমারীর কাছে চূড়ান্ত অসহায়, ব্রিটেনও তাই। টি এস এলিয়টের ভাষায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যেন ‘ফাঁপা মানুষ’ মনে হয়। তার শূন‍্যগর্ভ চিৎকার অসহায় রোগাক্রান্তের মৃত‍্যুকালীন আর্তনাদের মত লাগে। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন সব দেশ করোনায় আক্রান্ত। মৃত‍্যুমিছিলের শেষ নেই।
অথচ অন‍্যদিকে চীনের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, সে মহাবলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টক্কর লাগানোর মত শক্তিধর। কিন্তু ‘তুচ্ছ’ ভিয়েতনাম? অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সীমান্ত-ছোঁয়া কিউবার মত ছোট্ট এক দেশ? তারা তো অতিমারীর বিরুদ্ধে হার মানেনি! কিউবার চিকিৎসকেরা নিজের দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে ছুটে গেছে ইতালিতে। চীনই বা কি করে সংক্রমণের প্রথম কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও ক্রমশ সামলে ওঠে?


এর একটাই কেন্দ্রীয় কারণ। এসব দেশেই স্বাস্থ্য পরিষেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষার অধিকারেরই মত। নবগঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন তাই করেছিল। এই চরম প্রতিকূলতার মধ্যে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে কিছুটা সমঝোতা করতে হলেও মানুষের বাঁচবার অধিকারকে সমাজতন্ত্র পুঁজিপতি হাঙরের মুখে ছেড়ে দেয়নি। অথচ যে ব্রিটেনে একদা ন‍্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের গুণ গাইত সবাই, সেখানেও ক্রমশ ব‍্যক্তিপুঁজির দ্রুত দাপট বাড়ছে। বেসরকারিকরণ ক্রমবর্ধমান। চিকিৎসক ও স্বাস্থ‍্যকর্মীরা অসহায় বোধ করছেন। মার্কিন মুলুকে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল ‘ওবামাকেয়ার’-এর মত যৎকিঞ্চিৎ স্বাস্থ‍্যপরিষেবাও তুলে দেওয়া। মানুষ ঠকেছে, ট্রাম্প জিতেছে। যেমন এদেশে মানুষ ঠকেছে। এখানে তো স্বাস্থ্যপরিষেবার পাইকারি বেসরকারিকরণ হচ্ছে। সংক্রমণের আসল তথ্য নানান কেরামতিতে গোপন করা হচ্ছে। যেটুকু সরকারি পরিষেবা আছে তাও অপ্রতুল। একমাত্র দীপশিখা জ্বলছে বামপন্থীশাসিত কেরালায়। কিছুদিন আগেই সেই সরকার মোকাবিলা করেছে ভয়াবহ প্লাবনের। ফের এসেছে অতিমারীর সংকট। কিন্তু কেরালা টলেনি। জিতছে।
করোনাও একদিন কোণঠাসা হবে নিশ্চয়। তখন হানা দেবে পুঁজিবাদী দুনিয়ার ভয়ংকর রকম অর্থনৈতিক সংকট। ডাকসাইটে স‍্যাঙাত পুঁজিপতিদের কর ছাড় দিতে হবে, সম্পদকর বসানো যাবে না, শ্রমিক ছাঁটাই চলবে, আরো বেকার বাড়বে, শ্রমসময় আরো বাড়বে। যাকে বলা হয় ‘লুম্পেন উন্নয়ন’। বাড়তি মুনাফার নৃশংস লোভে মানুষ ও প্রকৃতির ভারসাম্য টুটে গেছে। মার্কস বলেছিলেন, মুনাফা বাড়ানোর জন্য পুঁজিপতিরা সব পারে। তাই পারছে।
১৮৭৬ সালে এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘প্রকৃতিকে জয় করে আমরা মানুষেরা যতই বেশি বড়াই করি, প্রত‍্যেকটি জয়ের প্রথম ধাপেই আমরা যা চাই সেই ফল পাই। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারে সবটা একেবারে পাল্টে যায়, অপ্রত্যাশিত সব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় যা প্রথম জয়লাভকে নিশ্চিহ্ন করে’।এরপর কোন মূর্খ মার্কসবাদকে অস্বীকার করবে? মার্কস জেগে উঠছেন। মানুষকে জাগাবেনই।

শেয়ার করুন