উঠুক অবাধ্যতার ঢেউ -কনীনিকা ঘোষ

৮ অক্টোবর ২০২০
ওয়েবডেস্কের প্রতিবেদন:


চলুন আজ বরং আমরা একটু অন্যরকম গল্প করি। কঙ্গনা রানাওয়াত, রিয়া চক্রবর্তী বা মেগা স্টারদের প্রতি মুহূর্তের হিসাব না রেখে, আমরা বরং আমাদের দেশের যে কোনো রাজ্যের কোনো গ্রামের বা শহরের দিন আনা দিন খাওয়া ও যুগ যুগ ধরে গালি খেতে খেতে আর অবহেলা পাওয়াকেই দস্তুর বলে মনে করা দলিত-আদিবাসী-তপশিলিদের ঘরের মেয়েদের রোজনামচাটা কেমন তাই নিয়ে একটু কথা বলি। জানি এতে আপনি আশ্চর্য হবেন, হঠাৎ এদের নিয়ে কথা কেনো? এই হাঘরেদের জীবনে কী এমন আছে না আছে! না কোনো রোমাঞ্চ না আছে কোনো উত্তেজনা। তাহলে এই বোরিং বিষয় নিয়ে কিসের কথা ! আসলে এই মেয়েগুলোর কথা আজ কেউ না চাইলেও, খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। কেন জানেন? কারণ আমার দেশ-আমার সংবিধান জীবনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও, আজ এই মেয়েদের একের পর এক ধর্ষণ এবং খুন অথবা ধর্ষিতা আর অত্যাচারীতা হয়ে তাদের মৃত্যু তাদের এই অধিকারটা পর্যন্ত কেড়ে নিচ্ছে। তাই তো উত্তরপ্রদেশের হাথরস বা বলরামপুর বা আমাদের রাজ্যের ডেবরা বা রাজগঞ্জ খবরের শিরোনামে। তাই সন্ধ্যায় টেলিভিশনের চ্যানেলে অথবা সকালের খবরের কাগজে আপনার প্রিয় টপিককে ঠেলে আপনাকে দেখতে অথবা পড়তেই হচ্ছে এইসব খবর। যদিও একদিকে এই খবর আপনার গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আর একদিকে এই বীভৎসতায় আপনিও বোধহয় বিচলিত হচ্ছেন, আপনার মনেও উঁকি দিচ্ছে, যে আজ আপনি যদি মহিলা হন তাহলে আপনি কি so called “উচ্চবর্ণের” বা খানিকটা “affluent” বলেই নিরাপদ, আর যদি পুরুষ হন তাহলে আপনার ঘরের মহিলা সে, মেয়ে, বোন, মা বা স্ত্রী যেই হোক না কেনো সুরক্ষিত তো! তাই আজ টিনসেলের জগৎ ছেড়ে বরং সাধারণ মেয়েদের কথা আমাদের একটু আলোচনা করা দরকার।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জী উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ

কিছুদিনের মধ্যে বারবার মেয়েদের উপর অত্যাচার আর নির্যাতনের খবর যেন রুটিনে পরিণত হয়েছে। থম্পসন রয়েটার্স ফাউন্ডেশান যেমন বলছে ভারত আজ মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়, তেমনই NCRB এর রিপোর্ট আমাদের বাংলা, মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসায় শীর্ষস্থান অধিকার করেছে। উন্নয়নের বাগড়ম্বরে ভাসিয়ে দেওয়া মোদী বা দিদি কি জানেন না, জনসংখ্যার অর্ধেক যে মেয়েরা, তাদের এই অবস্থা থাকলে আসলে এই “উন্নয়ন” ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছুই না !

দলিত পরিবারের ছয় ভাইবোনের সব থেকে ছোট মেয়েটি একফালি জমিতে চাষের কাজ করছিল। তাকেই ওড়না ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ, একজন নয় পরপর, পৈশাচিক উল্লাসের তীব্রতায় মেয়েটির মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। তারপর হাত-পা । না তারপরেও নিস্তার পায়নি সে। মেয়েটির যন্ত্রণার কান্না আর্তচিৎকার যাতে শোনা না যায় তাই জিভ কেটে ফেলা হয়। তারপর আবার অত্যাচার, আবার- আর তারপরেই টানা লড়াইয়ের শেষে, দিল্লীর সফদর্জং হাসপাতালে মৃত্যু, আর হাথরস শিরোনাম। ভাইরাল হওয়া ভিডিও কি আমাদের সমস্ত সত্তা ধরে টান মারলো? সন্তানহারা মায়ের আকুতি কি যোগী আদিত্যনাথ এর রাজ্যের বীভৎসতাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ! ছিনিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা দেহ কি আমাদের রাজ্যে কাজ করতে আশা পরিযায়ী শ্রমিক, রামশংকর ঝাঁর মেয়ে স্বপ্না ঝাঁর কথা মনে করিয়ে দিল – বোধ হয় একটু বিচলিত হয়েছিল সত্তা- তাই সর্বস্তরে এই প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে, কিন্তু একে তো স্তিমিত হতে দেওয়া চলবে না কারণ এতো নিছক হাথরস বা মধ্যমগ্রামের ঘটনা না, এ যে নিত্যদিন ঘটে চলেছে। আসলে এমনিই তো লিঙ্গবৈষম্য আমাদের আজও প্রতিক্ষেত্রে। ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনায় পুরুষ আধিপত্যের তো থাকেই, আর যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন বিজেপি ও আরএসএসের মতো মনুবাদী দর্শনের প্রতিভূরা, তখন মেয়েরা যে আরও হিংসার বলি হবে, আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে, এ তো স্বাভাবিক। এই মানুবাদী দর্শনের হাত ধরেই মেয়েদের বিরুদ্ধে অত্যাচার আর সমাজের নিম্ন বর্ণের বিরুদ্ধে অত্যাচার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, কারণ এই মনুবাদই এক আসনে বসায় শূদ্র কুকুর আর মেয়েদের। সগর্বে ঘোষণা করে যজ্ঞের উচ্ছিষ্ট দেওয়া যায় নারী, শূদ্র আর কুকুরকে। আপনি মিল খুঁজে পাচ্ছেন তো, একই মনোভাবের। যখন বিজেপির বিধায়ক সুরেন্দ্র সিং হাথরসের ঘটনার পর বলেছেন ধর্ষণ কমাতে গেলে মা বাবারই দায়িত্ব মেয়েদের সংস্কারী করে গড়ে তোলা- হায়রে ভারত ! কুলদীপ সিং সেঙ্গার বা সন্তোষ গাঙ্গোয়ার এর মতো বিজেপির নেতা মন্ত্রীরা যখন মেয়েদেরকে নিয়ে নানান কুরুচিকর মন্তব্য করেন বা কেউ ‍ অভিযুক্ত হন মেয়েদের অত্যাচারের ঘটনায় তখন কি আর আপনাদের অবাক লাগে! তখন আপনার বিবেক ভাবেই এরা তো এই রকমই, কিন্তু তথাকথিত দেশপ্রেমের উগ্র উন্মাদনায় বা “ওদের” টাইট দেওয়ার জন্য প্রতিদিন তৈরি করা প্রচারে ভেসে গিয়ে আপনি প্রতিবাদ করেন না। যখন ৩৭০ ধারা রদ কে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বিজেপির নেতা মন্ত্রীরা বলেন এরপর আর কোনো কাশ্মিরী সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে বাধা থাকবে না তখন আপনার শিক্ষিত সচেতন অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করতে চায় কিন্তু কাশ্মীরে জমি কিনতে পারার একটানা হোয়াটসএ্যাপীয় প্রচারে আপনি ভুলে যান, জমি কেনা দূরে থাক, এদের শাসনে আপনার চাকরিটাই প্রশ্নচিহ্ন এর মুখে। এভাবেই ওরা বয়ে নিয়ে চলে সেই দর্শন। মেয়ে মানেই ভোগের বস্তু, গেয়ে চলে পুরুষ আধিপত্য, তথা পিতৃতন্ত্রের জয়গান। আর আপনারও মনে হয়, সত্যিই 'মেয়েরা বেশি বেড়েছে'। শাঁখা সিঁদুর না পরলে সে ঠিক নয় এইরকম কথা যে মেয়েদের অধীনস্থ রাখারই পরম্পরা, তা কি আপনার মনে উঁকি দেয় না, তলিয়ে ভাবলে অবশ্যই দেয় কারণ, আপনারা যে অনেকেই জানেন বৈদিক যুগেও নারীদের জন্য নির্দিষ্ট ছিলো এই নিদান, “ তাকে অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ থাকতে হবে নাহলে তার শক্তি ক্ষয় হয়।“

এই একই রকম ভাবে তো, রাজ্যের মন্ত্রী নেতারা মেয়েদের চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করেন বা প্রশাসনের বশংবদ কমিশনের প্রধান রাজগঞ্জের দলিত নাবালিকা মেয়ের ধর্ষণের ঘটনাকে 'প্রেম ঘটিত ঘটনা' বলে উল্লেখ করেন। যেন প্রেমঘটিত ব্যাপার হলেই ধর্ষণের অধিকার জন্মায় ! আর মাননীয়া নিজের দ্বায়িত্ব অস্বীকার করে নীরব থাকেন। আচ্ছা ভেবে দেখুন না, এইরকম মনোভাব কি এই তথ্যপঞ্জির জন্ম দেয় না, যে দেশে প্রতি ১৬ মিনিটে ধর্ষিতা হন একজন মহিলা। মহিলা প্রতি সংগঠিত অপরাধের মাত্রা গত বছরের তুলনায় বাড়ে ৭%, আর বাংলা সত্যিই 'এগিয়ে', এগিয়ে নারীর বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনায়। অনেক তথ্য চেপেও NCRB এর রিপোর্টে বাংলা এ প্রশ্নে শীর্ষস্থানে । বলুনতো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছেন, উত্তরপ্রদেশ আর আপনার প্রিয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে? যখন প্রান্তিক দলিতদের প্রতি মনুবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর বাহকরা ভোট ছাড়া অন্য সময়ে ঘৃণার মনোভাব পোষণ করে যখন যোগী আদিত্যনাথরা বলেন "দলিতরা দাস হয়েই জন্মেছে, তাই দাসত্ব করাই তাদের পবিত্র কর্তব্য।" বা প্রধানমন্ত্রী জন্ম থেকেই স্থির হয়ে যায় মানুষের কাজ বলে মন্তব্য করে বর্ণাশ্রমকেই স্বীকৃতি দেন আর মাননীয়া সুকৌশলে দলিত মেয়েদের হোস্টেল বন্ধ করে দেন তখন কি বুঝতে অসুবিধে হয় কেন প্রতিদিন বাড়ছে দলিতদের প্রতি অত্যাচার,কেন প্রতি ১৬ মিনিটে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা দলিতরা আক্রান্ত হন বা আমাদের রাজ্যে বীরভূম এর চরিচা অথবা জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জের মতো ঘটনা আজ এতো frequent। আসলে এটাই দৃষ্টিভঙ্গী।এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই হাথরসে রাজ্য সরকার দলিত ধর্ষিতার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর বদলে নেমে পড়ে ধর্ষকদের সমর্থক উচ্চবর্ণের মানুষদের সংগঠিত করতে অথবা আমাদের রাজ্যে কখনো শাসক দলের ছত্রছায়ায় ধর্ষককে 'reputed person': আখ্যা দেওয়া হয়। কখনওবা পার্ক স্ট্রিটের সুজেটের ঘটনাকে 'ছোটো ঘটনা ' বলা হয়। মাননীয়ার ভাষণে 'Globally এখন সব Open' বলে লঘু করে দেওয়া হয় অপরাধকে। তাই ভাবুন রাজ্যে – দেশে আপনার নিরাপত্তার জন্যই আপনাকে প্রতিবাদের বনহিশিখা জ্বালাতে হবে কি না !

আপনি, আপনারা তো রামমোহন রায়, প্রীতিলতা, রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,বিদ্যাসাগরেরই উত্তরসূরী, তাই আজও আপনার মূল্যবোধ আপনাকে ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠতেই তাড়িত করছে। আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলুন, পথে নামুন। তাকিয়ে দেখুন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া হাথরসের ধর্ষিতার মায়ের আকুতি শুনে আপনার সাথে মিছিলে যাবে বলে দাঁড়িয়ে আছে সদ্য কলেজে ওঠা যুবতী। অপরিকল্পিত Unlock এর এই সময় যানবাহনের সমস্যাকে হেলায় পাশ কাটিয়ে, মধ্যবয়সী মানুষটি মাননীয়ার নাটকের মিছিলকে ঘৃণা করে আমাদের সাথে মিলবে বলে অপেক্ষা করছে। চলুন সবাই মিলে পাহাড় থেকে সাগরে তুলি অবাধ্যতার ঢেউ। যে ঢেউয়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যাক মনুবাদী দর্শনের মিথ্যে অহংকার আর চটকদারী বাগড়ম্বরের ফাঁপা বুলি। জয়ী হোক আমার আপনার মর্যাদা...অধিকার।




শেয়ার করুন

উত্তর দিন