কনক মুখোপাধ্যায় ও তাঁর রাজনীতি : মালিনী ভট্টাচার্য....

৩০ ডিসেম্বর ২০২১ (বৃহস্পতিবার)

বিগত সত্তরের দশক থেকে এদেশের নারী আন্দোলনের কর্মীরা শুনে আসছেন যে মেয়েদের মধ্যে যে সংগঠন কাজ করে তাকে রাজনীতি নিরপেক্ষ হতে হবে। এর পাশাপাশি নারীবাদের কিছু ধারা থেকে এসেছে শ্রেণিরাজনীতির বদলে লিঙ্গরাজনীতিকে মানবসভ্যতার মূল দ্বান্দ্বিকতা হিসাবে দেখার তত্ত্ব। অথচ কনক মুখোপাধ্যায়ের মতো যাঁরা আমাদের দেশে নারী আন্দোলনের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন, তাঁদের কাউকেই কোনো অর্থে অরাজনৈতিক বলা যাবে না, সর্বহারার শ্রেণি রাজনীতি যদিও সবাই করেননি। তাঁদের কেউ গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন বা সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্র থেকে তালিম নিয়েছেন, কেউ জলেজঙ্গলে লড়াই করেছেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিক হিসাবে, আবার কেউ পূর্বোক্ত ব্রিটিশবিরোধী লড়াইগুলির মধ্য দিয়ে, কেউ বা সরাসরি পৌঁছেছেন শ্রমিককৃষকের মুক্তির আহ্বানে কমিউনিস্ট পার্টির রণভূমিতে। যেমন, কনক মুখোপাধ্যায়।

রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার তত্ত্ব বা লিঙ্গরাজনীতিকে সমাজবিবর্তনের আদিনীতি বলে ধরার যুক্তি কোথা থেকে এসেছিল? বেশির ভাগ সমাজব্যবস্থাতেই শ্রেণিবিভাজনই শুধু থাকে না, পুরুষ এবং অ-পুরুষের (শুধু নারী নয়) মধ্যে অধিকার এবং মর্যাদার কড়া বিভাজন পুরুষের হাতেই সামাজিক নিয়ন্ত্রণের রাশ তুলে দেয়। এমনকী, যারা নিজেরা নিয়ন্ত্রিত বর্গের মানুষ মেয়েদের ওপর কর্তৃত্ব তারাও চায়। তার প্রতিচ্ছবি পড়ে সবরকম আন্দোলনের মধ্যেও, তা শুধু গান্ধিবাদী আন্দোলন বা সশস্ত্র বিপ্লবীদের কার্যকলাপের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, অবাঞ্ছিত হলেও তার প্রকাশ ঘটে এমনকী সর্বহারার ট্রেড ইউনিয়ন এবং পার্টিসংগঠনে। এসব সংগ্রামে নারীর কাজ পুরুষবিপ্লবীর সহায়িকা হিসাবে এবং তারই প্রাধান্যের ছত্রছায়ায়-- এদৃষ্টিভঙ্গি কমিউনিস্ট আন্দোলনেও যে ছায়া ফেলে তার প্রমাণ খোদ রুশ বলশেভিক পার্টি সম্বন্ধে ক্লারা জেটকিনের কাছে লেনিনের উক্তিঃ অনেক কমরেডের চামড়ার ওপরটা আঁচড়ালেই ভিতরের প্রাধান্যকামী চেহারা বেরিয়ে পড়ে। লেনিন বলেন, এলড়াই লম্বা লড়াই। শ্রমিকশ্রেণির পার্টি রাষ্ট্রের দখল নিলেও নারী-পুরুষের সম্পর্কের ‘আবহমানতা’ নিজে থেকেই কেটে যায় না এযুক্তিকে কমিউনিস্টদেরও মান্যতা দিতে হয়। সত্তর দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই অরাজনৈতিকতার স্লোগান আমাদের কিছুটা মুশকিলে ফেলেছে। মুশকিলটা সম্ভবত ঘটেছে এইজন্য যে এযুক্তির থেকে একধাপ এগিয়ে যাবার চেষ্টা করার বদলে আমরা তার বৃত্তের মধ্যেই রয়ে গেছি। একথা মেনে নিয়েছি যে সমাজে যেহেতু সবশ্রেণির মেয়েরাই কোনো না কোনোভাবে পুরুষতন্ত্রের শিকার এবং নারী আন্দোলন করতে গেলে তাদের সবার পাশেই দাঁড়ানো প্রয়োজন তাই ‘শ্রেণিসংগঠনে’র যে রাজনৈতিক অভিমুখ থাকে, রাজনীতিনিরপেক্ষতার খাতিরে আমাদের সংগঠনে তাকে গৌণ স্থান দিলেই চলে। সেক্ষেত্রে ‘সমাজসেবী’ সংগঠনের সঙ্গে আমাদের বিশেষ তফাৎ থাকে না।

Clara Zetkin interviews Lenin on the women's question

কনক মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রজন্মের পূর্বসূরীদের স্মরণ করার একটি বড়ো লক্ষ্য এধরনের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হওয়া। ‘অটোনমাস’ নারীসংগঠন বলে যারা নিজেদের শ্রেণিরাজনীতির ‘সংকীর্ণতা’ থেকে পৃথক বলে ঘোষণা করে, একশ্রেণির নারীর ওপর আরেক শ্রেণির নারীর কর্তালি থেকে তারা নিজেদের মুক্ত রাখতে পেরেছে কী? আর যারা ‘অরাজনৈতিকভাবে’ মানবসেবা করছে বলে থাকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-সহ সেসব সংগঠনের ভাঁওতাবাজি আজ আর অপ্রকাশ্য নয়, যেমন ধরা পড়ে গেছে উপরোক্তদের হিংস্র আক্রমণের সামনে অরাজনৈতিক ‘লিবেরাল’দের লজ্জাজনক পশ্চাদপসরণ। কনক মুখোপাধ্যায়দের অসংকোচ রাজনীতিমনস্কতা, একসময়ে এ আই ডবলিউ সি-র থেকে আলাদাভাবে যা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির জন্ম দিয়েছিল, অথচ জাতীয় সংকটে যৌথ আন্দোলন থেকে বিরত থাকেনি, তার তাৎপর্য আমাদের বুঝতে হবে।

এখানে কনক মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের যে গতিপথ তিনি নিজেই চিহ্নিত করেছেন তাঁর অসাধারণ স্মৃতিচারণমূলক রচনা ‘মনে মনে’তে, তার কিছু উদাহরণ দিয়েই উপরের কথাগুলিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করব। যশোরে স্কুলে পড়তে স্বাধীনতা আন্দোলনের ছোঁয়াচ নিয়েই কনক কমিউনিস্ট পার্টির সংস্রবে আসেন কমিউনিস্ট আইনজীবী কৃষ্ণবিনোদ রায়ের মাধ্যমে। ইনি তার সঙ্গে যেসব আলোচনা করতেন বা যেসব বই পড়তে দিতেন তার মধ্যে অনুসন্ধিৎসু কিশোরীকে প্রথমেই সবচেয়ে বেশি ছুঁয়েছিল এই কথা যে কমিউনিস্টরা সর্বহারার মুক্তিসংগ্রামের অংশহিসাবেই দেখে মেয়েদের সামাজিক মুক্তির প্রশ্নটিকে। একই রাজনীতির অংশ এই দুইধরনের লড়াই, একটা আগে একটা পরে নয়। কমিউনিস্ট ছাত্রসংগঠন, পরে পার্টিতে তাঁর অংশগ্রহণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের একটি তরুণীর নিজের জীবনে একের পর এক বেড়া ভেঙে এগনো।

রাজনীতি করবেন বলেই যশোর থেকে কলকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হওয়া, তাঁর শ্রেণির মেয়েদের যেখানে যেভাবে চলে যাওয়ার কথা নয় সেখানে অকুতোভয়ে কোনো পুরুষ-কমরেডের স্ত্রীপরিচয়ে হাজির হয়ে যাওয়া, বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে তাঁর গতিরোধের চেষ্টা করা হলে বাড়ি ছেড়ে কমিউনে এসে ওঠা, পুলিশের নজর এড়িয়ে শ্রমিক এলাকায় সংগঠনের কাজ করতে যাওয়া—এসবের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত মেয়েদেরও অনেকের জীবনে যে বেড়াভাঙ্গার আকুলতা আত্মপ্রকাশ করে তার প্রতিচ্ছবি তো রয়েইছে, কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হল এ শুধু সাময়িক ব্যক্তিগত বেপরোয়াপনা নয়, যে মতাদর্শ তিনি গ্রহণ করেছেন আসলে তারই অভিমুখে নিজের সমগ্র জীবনকে ঢেলে গড়ার লাগাতার সচেতন সংকল্প। ধরা যাক জীবনসঙ্গী সরোজ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপের দিনটির কথা, মিটিংশেষে লাজুক ছেলেটি তাঁকে বাড়ির পথে এগিয়ে দেবার কথায় আমতা আমতা করলে তাঁর নিঃসংকোচ উক্তিঃ একা বাড়ি ফিরতে গিয়ে যদি পুলিশ ধরে তাহলে বলব আমি এমন এক পার্টিতে কাজ করি যেখানে ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে রাস্তায় হাঁটতে চায় না! ধরা যাক তাঁদের বিবাহের কাহিনি, যেখানে আয়োজন নেই, আড়ম্বর নেই, আছেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, যিনি নবদম্পতিকে নিয়ে একটি সিনেমা দেখতে চলে যান। যৌথ কর্মজীবনের সূচনায় উৎসবের চিহ্ন এইটুকুই। পারিবারিক প্রয়োজনে তাঁরা যখন যৌথ সিদ্ধান্ত নেন, কনক একটি চাকরি নেবেন এবং পার্টিসম্পাদক ভবানী সেনকে জানাতে যান সেকথা, তিনি রেগে আগুন হয়ে বলেন, পার্টি মেম্বার হয়ে নিজের সিদ্ধান্ত কীভাবে নিজে নেন? কনকের অকুতোভয় উত্তরঃ পার্টির কাজ স্বেচ্ছামূলক, কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না, আমি নিজের ইচ্ছাতেই সারাজীবন তা করব, ভাববেন না-- শুনে ভবানী সেন হেসে ফেলে তাঁর কথা মেনে নেন। ১৯৪৮-৪৯ সালে পার্টি যখন নিষিদ্ধ, প্রকাশ্য সমাবেশে পুলিশের লাঠি-গুলি প্রায় নিয়মে পরিণত একটি ছোটো শিশুর মা কনক সমস্ত ভয় আড়ষ্টতা কাটিয়ে সেই প্রতিবাদে যোগ দিতে চলে যান, ধরা পড়ে শিশুটিকে ছেড়ে দীর্ঘদিন জেলে কাটান, এতো সেই নারীজীবনকে ঢেলে গড়ার রাজনীতিরই অঙ্গ। রাজনীতি না থাকলে গ্রামে থেকে কৃষক-আন্দোলনে মেয়েদের সামিল করার কাজ করা যায়?

পার্টিবৃত্তের বাইরে যেখানে কাজ করছেন সেখানে এই কনক মুখোপাধ্যায়ের জনসাধারণের কাছে যদি কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে তাহলে তা তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই, কোনো রাজনীতিনিরপেক্ষতার অবদান তা নয়। তাঁকে শাসক ও প্রশাসন বা তাদের অনুগামীরা যদি বর্জনীয় মনে করে তা সেই রাজনীতির গৌরব। শ্রেণিপরিচয় যাই হোক, পুরুষতন্ত্রের চাপে বিপর্যস্ত যে কোনো মেয়ে আশ্রয়ের আশ্বাস পেতে পারে এই রাজনীতির সান্নিধ্যে, কারণ গদিয়ান ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে এক বিকল্পের প্রত্যয় নিয়ে এই রাজনীতি কাজ করে। তাদের অনেকে সেই প্রত্যয়ের শেষ ধাপ পর্যন্ত হয়তো যেতে ইচ্ছুক থাকে না। সেটা শ্রেণিচরিত্রের নিয়ম হতে পারে, সর্বক্ষেত্রে তার কারণ আন্দোলনের দুর্বলতা নয়। আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি কমিউনিস্ট পার্টির সব সদস্য বিপ্লবের চূড়ান্ত ধাপ পর্যন্ত যেতে রাজি থাকবেন? এটা তো একটা প্রক্রিয়া। কনক মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষের গতিশীল জীবন কাউকে দূরে সরায় না। যারা মানবমুক্তির লক্ষ্যে অভিযাত্রী, তাদের কি কোনো জল-অচল ব্যবধান দিয়ে নিজেদের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আলাদা রাখার অভিমান সাজে? তাঁদের রাজনীতি তো এটাই। অবিরল চেতনাবিকাশের প্রক্রিয়ায় নিজেদের পাশাপাশি সবাইকে যুক্ত করার হিম্মৎ একমাত্র তারাই তো রাখে। কনক মুখোপাধ্যায় যে রাজনীতির পথ নিজের জন্য বেছেছিলেন, প্রকৃত অর্থে মানবিক রাজনীতি সেপথ ছাড়া আর কোথায় আছে?


শেয়ার করুন

উত্তর দিন