কামদুনি থেকে বিলকিস - সোমা দাশ

নিউ ইন্ডিয়া বা এগিয়ে বাংলায় মহিলারা নির্যাতিতা হচ্ছেন। ধর্ষিতা হচ্ছেন ৭ থেকে ৭০। সব ঘটনায় অভিযোগ দায়ের হয় না থানায়। লজ্জা বা পারিবারিক সম্মান বাঁচাতে অনেক পরিবার গোপন রাখে অত্যাচারের কাহিনী। স্থানীয় প্রভাবশালী দুষ্কৃতিদের ভয়ে ও অর্থের প্রলোভনে অভিযোগ হয়না এমনও হয়। এরপর আছে থানার অভিযোগ না নেওয়া। পুলিশি উদাসীনতা এমনকি হেনস্থার শিকারও হতে হয় নির্যাতিতাকে। দুর্ভাগ্যের হলেও অনেক সময় সরকারি ক্ষমতা, অর্থের দাপটে থানা চলে যায় অপরাধীদের পক্ষে। এতো প্রতিবন্ধকতার পরেও যেসব অভিযোগ নির্যাতিতা, ধর্ষিতা বা নিহতের পরিবার দায়ের করে, তাতে বেশিরভাগ সময় ন্যায়বিচার মেলে না। বিচার নেই দেশে ও রাজ্যে।

স্লোগান থেকে বিজ্ঞাপনে, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সবাই শোনেন 'বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও'। রাজ্যে এমন প্রচার সরকার করে যে মনে হয় মহিলাদের আর কোনো সমস্যাই নেই। অথচ মাত্র ২৮% ধর্ষক বিচারে সাজা পায়। রাজ্যে মাত্র ২.৫%। কামদুনিতেও ধর্ষকরা ছাড়া পেল, মুক্ত হয়ে গেল। অথচ নির্যাতিতার পরিবার, গ্রামবাসীরা জানেন ছাড়া পাওয়ারা সবাই ধর্ষক। এরা ছাড়া পাওয়ায় ভয়, আতঙ্ক তৈরি হয় নির্যাতিতার পরিবারের মনে। সাক্ষী থেকে অভিযোগকারীদের ওপর চাপ বাড়ে মামলা প্রত্যাহার করানোর জন্য। আজ কামদুনিতে সেটাই ঘটতে যাচ্ছে।

২০১৩ সালের ৭ই জুন, কামদুনি গ্রামে ঘটেছিলো, সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা। সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফিরবে বলে কলেজ ছাত্রীটি বাস স্ট্যান্ড থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। কিন্তু তার বাড়ি ফেরা আর হয়নি। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় মেয়েটি। ৯ জন ধর্ষক মিলে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে, দু পা চিরে মেরে ফেলে দিয়েছিলো মেয়েটিকে। শিউরে উঠেছিল বাংলা সহ গোটা দেশ। শুরু হলো প্রতিবাদ। নাগরিক সমাজ ও বামপন্থী মহিলা সংগঠনগুলি পথে নামলেন। সারা বাংলার দাবি ছিল খুনি, ধর্ষকদের চরমতম শাস্তি। ছোট্ট গ্রাম কামদুনিতে তখন তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের যাতায়াত বাড়তে থাকলো। শুরু হলো গ্রামবাসীদের হুমকি দেওয়া, ভয় দেখানো। লড়াই কিন্তু থেমে থাকল না। প্রতি মাসের ৭ তারিখ, কামদুনির অস্থায়ী শহীদ বেদীর সামনে, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি সহ অন্যান্য বামপন্থী মহিলা সংগঠনগুলির উদ্যোগে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলো অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে শপথ সভা। চলতে থাকলো আইনি লড়াই। প্রায় তিন বছর পর ব্যাংকশাল কোর্ট রায় দিলো নৃশংসতম এই ঘটনার। তিনজনের ফাঁসি তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। অভিযুক্তরা মানতে পারল না এই রায়। হাইকোর্টে গেল মামলা। পাঁচ বছর মামলা চলার পর গত ৬ অক্টোবর ২০২৩ এই মামলার রায় বেরোলো। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন আসামি খালাস হয়ে গেলো। তিনজন ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত আসামির একজন বেকসুর খালাস এবং অন্য দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই রায় কামদুনি সহ গোটা রাজ্যের মানুষকে বিস্মিত ও হতাশ করেছে। কামদুনির আন্দোলনে যাঁরা প্রথম থেকে ছিলেন তাঁদের আশাহত করেছে। বিচারের ওপর আস্থা, বিশ্বাসের জায়গা অনেকটা টলে গেছে। অন্যদিকে খুশি হয়েছে অপরাধীরা। চরমতম অপরাধের পরেও বেকসুর খালাস হওয়া যায়, এই নিদর্শন দুষ্কৃতিদের মনে সামান্য যে ভয়টুকু ছিলো তা দূর হয়ে যাবে। কামদুনির কেস হিস্ট্রি তাদের কাছেও অন্য কারণে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।

অভিযোগ সরকার, পুলিশ এবং সিআইডির দিকে। কি চেয়েছিলো সরকার এই মামলায়, ১২ জন সরকারি আইনজীবীকে বদল করেছে। সরকারি কৌশলী বদল হয়েছে ১৬ বার। ৫৫ জন সাক্ষীর বয়ান গ্রহণ করা হয়নি। এমনভাবে কেস ডায়েরি লেখা হয়েছে বা সাজানো হয়েছে যাতে অপরাধীরা খালাস হয়ে যেতে পারে। বাংলা এখন চালাচ্ছে অপরাধীরা। মন্ত্রী, বিধায়কদের কেউ জেলে, কেউ লাইনে আছে। বিজেপির সাহায্য না থাকলে, তারাও জেলেই থাকতো। ব্যাপক দুর্নীতির যত কারবার বাংলায় চলছে, তা এই দুষ্কৃতিদের ছাড়া চলবে না। চাকরির নামে টাকা তোলা, চিটফান্ডের টাকা চুরি, কয়লা, গরু, বালি পাচার, ভোট লুট, ছাপ্পা, সিন্ডিকেট চালানো এসবের জন্য ওদের লাগে। তাই তৃণমূল সরকার দায়বদ্ধ অপরাধীদের মুক্ত করতে। এরাই তৃণমূলের সম্পদ। তাই অসংখ্য নারী নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশের সাহায্যে মুক্ত জীবন উপভোগ করছে খুনি ও ধর্ষকরা। লজ্জা, অসম্মান নিয়ে, ভয়-ভীতির মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হতে হচ্ছে নির্যাতিতারাই।

বিচার পেয়েছে দিল্লির নির্ভয়া। হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট বহাল থেকেছে নিম্ন আদালতের রায়। বিচার পায় নি উন্নাও, হাথরস। উন্নাও এর ঘটনায় অভিযুক্ত বিজেপির বিধায়ক। ধর্ষণের মামলা প্রত্যাহার করাতে একের পর এক খুন হয়েছেন নির্যাতিতার বাবা, আত্মীয়, পরিজন। আদালতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সবাইকে মেরে ফেলে মুক্ত হতে চেয়েছিলো বিজেপির বিধায়ক। কি ভয়ংকর বিজেপি সরকারের পুলিশ! হাথরসে উচ্চ বর্ণের কয়েকজন যুবক দলবদ্ধ ভাবে ধর্ষণ করেছিলো এক দলিত তরুণীকে। উচ্চবর্ণের কাছে দলিতরা অচ্ছুত হলেও, দলিত মহিলাদের দেহের প্রতি লালসাই দেখা যাচ্ছে। পরে হাসপাতালে বেশ কিছু দিন লড়াই করে মেয়েটি মারা যায়। পুলিশ মেয়েটির দেহ পুড়িয়ে দেয়। পুলিশ, নিহত তরুণীর দেহ বাড়ির লোকেদের হাতে অন্তেষ্টিক্রিয়ার জন্যেও তুলে দেয়নি। কোর্ট এই মামলায় চার অভিযুক্তের তিনজনকেই বেকসুর খালাস করে দেয়। ১৫ ই আগস্ট ২০২২ লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রী নাটকীয় কায়দায়, নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ৭৫ বৎসর উদযাপন চলছিলো তখন। অমৃত মহোৎসবে পালন করলো বিজেপি শাসিত গুজরাট সরকার। মুক্তি দিল ১১ জন সাজা প্রাপ্ত ধর্ষকের। যারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত ছিল বিলকিস বানোর করা মামলায়। ২১ বছরের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস। তার কোলে তিন বছরের সালেহা। ২০০২ সাল। গুজরাটে চলছে সংখ্যালঘু নিধন। বিলকিস, তার সন্তান ও পরিবারের উপর ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীদের চরম আক্রমণ হয়েছিলো। বিলকিস, তার মা ও বোন দলবদ্ধ গণধর্ষণের শিকার। এরা সারাক্ষণ মুসলমানের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে চলে। অথচ মুসলমান নারীর দেহে যৌন লালসা মেটাতে কোন আপত্তি ছিল না তাদের। তার আগে অবশ্য তিন বছরের সালেহাকে বিলকিসের কোল থেকে কেড়ে থেতলে মেরে ফেলেছিল তারা। ১১ জন ধর্ষক খুনিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত করেছিলো আদালত। গুজরাটে নয়, মামলা হয়েছিলো মুম্বাইয়ে বিশেষ সিবিআই আদালতে।

লড়াই একমাত্র পথ।
দাবি আদায় করতে হবে লড়াই করেই। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য, নারীর মান, সম্মান, অধিকার রক্ষার জন্য সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি সহ সমস্ত বামপন্থী মহিলা সংগঠনের লড়াই চলবে সমাজের সব অংশের মহিলাদের যুক্ত করেই। আমরা পথেই আছি।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন