জেল খানার পাঠচক্র ও দীনেশ মজুমদার : সব্যসাচী চ্যাটার্জী

১ জুন , ২০২২ (বুধবার)

লেনিন জেলখানাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলে অভিহিত করতেন। বাংলার ইতিহাসের পাতায় এমনই এক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছিল দমদম জেল, ১৯৬৫ - ৬৬ সাল। কে বন্দী নেই? মুজফফর আহমেদ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, মোহিত মৈত্র, বিনয় চৌধুরি, সুধাংশু দাশগুপ্ত সবাই। সুতরাং জেলখানাই তখন হয়ে উঠল এই সব বন্দী কমরেডদের মতাদর্শ চর্চার প্রাণকেন্দ্র। বছর বত্রিশের তুখোর সংগঠক এক ছাত্র নেতাও ছিল তাঁদের সঙ্গে জেলে। তাঁর কাছে তখন জেলখানা সত্যিই এক বিশ্ববিদ্যালয়। জেলে বসেই সেইসময় মুজফফর আহমেদ লিখছেন 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা'। তাঁর সেই কাজের জন্য বাইরে থেকে কাজী নজরুল সম্পর্কে বই আসতো ট্রাঙ্কে করে। সেই সব বই সাজিয়ে রাখার ও পড়তে কাকাবাবুকে সাহায্য করত ছেলেটি। দমদম জেলে বন্দী কমিউনিষ্ট কর্মী ও নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়সে ছোটছিল সে। পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের দোতলায় চায়ের পর্ব শেষ হলেই সবাই নিজের নিজের সেল থেকে চেয়ার টেনে মিলিত হতেন সকলে। একত্রে পড়াশুনো ,পাঠচক্র ,প্রমোদ বাবু জোরে জোরে স্টেসসম্যান পড়তেন,ছেলেটিও থাকত ও শুনত,অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিত।

একদিন সুধাংশু বাবুকে জিজ্ঞেস করল "সুধাংশুদা, মার্কসবাদী তত্ত্ব পড়ার একটা গাইডলাইন তৈরি করে দিন, এখনই তো পড়ার সময়, জেলের সময়টা তত্ব অনুশীলনে ব্যবহার করতে চাই। 'স্বাধীনতা সংগ্রামী আন্দামান সেলুলার জেল থেকে কমিউনিষ্ট পার্টিতে আসা সুধাংশু দাশগুপ্ত ছেলেটিকে যে সিলেবাস বানিয়ে দিয়েছিলেন তা ছিল এইরকম।

১. এঙ্গেলসের 'Socialism Scientific and Utopian'
২. মার্ক্স এঙ্গেলসের 'Manifesto of The Communist Party'
৩. 'A short course of History of CPSU'

এর সাথে দিয়েছিলেন মার্কস এঙ্গেলসের কয়েকটি চিঠি বিশেষত সংশোধন বাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ও সঠিক কমিউনিষ্ট পার্টি গঠনের তত্ব কথা বোঝার জন্য বিশেষত সার্কুলার লেটার।
জেলখানার বাইরে গিয়ে পড়তে বলেছিলেন ।
১.লেনিনের State and Revolution বা রাষ্ট্র ও বিপ্লব।
২.লেনিনের Left wing Communism and Infantile Disorder, বা বামপন্থী কমিউনিজমঃ শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা।

ছেলেটি পড়েছিল। মিলিয়ে নিয়েছিল সেই ছেলেবেলার থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার সঙ্গে। ঢাকার শৈশব, কৈশোরের সঙ্গে।রেলকলোনীর লড়াকু মজুরদের লড়াইয়ের সঙ্গে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার রেলশ্রমিক নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রার্থী জ্যোতি বসুর ভাষণের সঙ্গে। স্কুলের চিলেকোঠায় অমুল্য সেনের উদ্যোগে সত্যেন সেনের ক্লাসের অভিজ্ঞতার আলোকে।

১৯৪৯ শের ভাষা আন্দোলন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। সেই প্রতিবাদ সভাতেই প্রথম বক্তৃতা দিয়েছিল ছেলেটা। তারপর ছিন্নমূল জীবন। দাঙ্গা বিদ্ধস্ত হয়ে সপরিবারে কলকাতা আসা। বেলেঘাটা ও হাওড়া হয়ে রানাঘাট। রূপশ্রী কলোনীর ক্যাম্প জীবন। সংগঠনের জীবন লড়াইয়ের জীবন। ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি ( মার্কসবাদী) র সঙ্গে জীবন। গড়ে তোলা ছাত্র আন্দোলন,যুব আন্দোলন।

গড়ে তুলেছিলেন গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন। ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি , সম্পাদক কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য। লিখেছিলেন বেকারী বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্ব নিয়ে। কাজের অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবীর এটি হল প্রামাণ্য দলিল।

সময়টা আজকের মতই টালমাটাল। সময়টা ছিল আজকের মতই ঘটনা বহুল। যুদ্ধ,দাঙ্গা,দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ সব একত্রে নেমে এসেছিল । কাগজ নিয়ে, ধর্ম নিয়ে দেশ নিয়ে টানাটানি, ভাষা নিয়ে উৎপীড়ন। যেমন সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছিল। এখানে যেমন বিজেপি দেশদ্রোহী, মোল্লাদের চর বলে কমিউনিষ্টদের সেদিনের পূর্ব পাকস্তানেও বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা ঘোষণার দাবীতে আন্দোলনরত কমিউনিষ্টদের হিন্দুদের চর বলা হয়েছিল। তাদের সপরিবারে চলে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। বাষট্টির ভারত চীন যুদ্ধের আবহে, ঠিক আজকেও চীনের দালাল বলা হয়, সেদিনও এই ছেলেটিকেও চীনেশ মজুমদার বলে ডাকত সেদিনের দেশপ্রেমিক ট্যাবলেট খাওয়া লোকেরা, এবং সংশোধনবাদীরা। পাত্তা না দিয়ে সে বেঁচে ছিল মাথা তুলে, নেতৃত্ব দিয়ে, লড়াই করে, খরস্রোতা নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার হিম্মত নিয়ে। তত্ব ও সংগঠন মিলিয়েই ছেলেটি হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় নেতা। তিনি কমরেড দীনেশ মজুমদার। জিতেছিলেন জনপ্রতিনিধি হিসাবে একাত্তর, বাহাত্তর ও সাতাত্তরে তিন তিনবার। হয়েছিলেন বামফ্রন্ট সরকারের চীফ হুইপ। মাত্র সাতচল্লিশ বছরের জীবনের শেষে যাঁর স্মরণ সভায় জ্যোতি বসু বলেছিলেন, "অসংখ্য মানুষ এখনো বাইরে আছেন। তাঁদের টেনে আনতে হবে আমাদের দিকে। ছাত্র, যুব, শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষকে আনতে গেলে দীনেশের ধরনের নেতা তৈরি করা প্রয়োজন"।

গণনাট্যের সাধন গুহ লিখেছিলেন-

"সামনে নদী খরস্রোতা ঘূর্ণীপাকের ধার
দুঃসাহসীবকে আছে যে সাঁতার দেবে জলে
আমি পারি, বলত হেঁকে দীনেশ মজুমদার
এবং নদীপার হত সে অর্জিত কৌশলে
ছদ্মবেশী আততায়ীর বিষের পাত্র নিয়ে
মুখের কাছে তুলেও সে বিষ করত না সে পান
সব চাতুরি বুঝিয়ে দিতো স্নিগদ্ধহাসি দিয়ে,
তুনীরে তার স্থির রাখত শত্রুঘাতী বান।"

ঋণঃ কমরেড দীনেশ মজুমদার স্মরণে, সুধাংশু দাশগুপ্ত।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন