স্তালিনের সুনির্দিষ্ট অবদান - জ্যোতি বসু

২১ ডিসেম্বর ২০২০ ,সোমবার ...

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মার্কসবাদী - লেনিনবাদীরা স্তালিন জন্মশতবর্ষ পালন করছেন। আমাদের পার্টি সিপিআই(এম) পার্টির সমস্ত ইউনিটকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা বিপ্লবী, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা , সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্যের পরিচালক , বিশিষ্ট মার্কসবাদী - লেনিনবাদী তাত্ত্বিক এবং লেনিনের শ্রেষ্ঠ শিষ্য ও উত্তরাধিকারী মহান স্তালিনের জন্মশতবর্ষ পালন সংগঠিত করার নির্দেশ দিয়েছে। জন্মশতবর্ষ পালন এই বছরের ২১ ডিসেম্বর অবধি চলবে। জন্মশতবর্ষ পালন কেন্দ্র করে মিটিং , বৈঠক, সাহিত্য বিক্রয় ইত্যাদির মাধ্যমে স্তালিনের বৈপ্লবিক শিক্ষাগুলিকে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে আমাদের ব্যাপকভাবে পৌঁছে দিতে হবে।



স্তালিনের জীবনের শেষদিককার কতকগুলি ভুল, বিচ্যুতি ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একটি মহল এই মহান মার্কসবাদী - লেনিনবাদীর ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করার এবং তাঁর মূল্যবান বৈপ্লবিক অবদানগুলি নস্যাৎ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিল। স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশ কংগ্রেস ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত হলো। সেই পার্টি - কংগ্রেস থেকেই স্তালিনকে নস্যাৎ করার সুপরিকল্পিত অভিযান শুরু করা হয়। বিংশ কংগ্রেসে প্রদত্ত ক্রুশ্চেভের রিপোর্ট এবং প্রতিনিধিদের এক 'গোপন' অধিবেশনে প্রদত্ত "গোপন" রিপোর্ট থেকে বিশ্ববাসী বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ, সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমজীবী মানুষ এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন জানতে পারল যে, স্তালিন গুরুতর ধরনের ভুল করেছিলেন, তিনি পার্টিরীতি লঙ্ঘন করেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক আইন ভঙ্গ করেছিলেন। ফলে আন্ত:পার্টি গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছে, ইত্যাদি । ক্রুশ্চেভ এবং অন্য নেতৃবৃন্দ অবশ্য সে সময় স্বীকার করেছিলেন যে, স্তালিনের ভুল ও ত্রুটি -বিচ্যুতি সত্ত্বেও সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এগিয়ে গেছে। তাহলে কীভাবে এগিয়ে গেলো। ক্রুশ্চেভের ভাষায় , সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত জনগণের জন্যেই এটা সম্ভব হয়েছে; এক্ষেত্রে স্তালিনের কোনো অবদান বা ভূমিকা ছিল না।

এটা এক চমকপ্রদ ও অত্যাশ্চর্য যুক্তি। বাস্তব ঘটনা হলো , স্তালিন ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির একজন শীর্ষনেতা। স্তালিনের সম্মতি ছিল না এমন কোনো সিদ্ধান্ত সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গ্রহণ করেছে , এ ধরনের কোনো খবর আমাদের কাছে নেই । আমাদের কাছে বরং বিপরীত খবরই আছে, অর্থাৎ বলশেভিক পার্টি এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি - যাতে স্তালিনের ভূমিকা , অবদান ও সমর্থন ছিল না। অতএব বর্তমান নেতৃত্বের যুক্তি আজগুবিই শুধু নয়, হাস্যকর ও বটে।

স্তালিনের একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহকর্মী মহান বলশেভিক কমরেড কিরভ ১৯৩৩ সালে স্তালিন সম্পর্কে যা বলেছিলেন , তার উল্লেখ এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক হবে : "কমরেডগণ , আমাদের পার্টির কার্যকলাপ , তার কৃতিত্বের কথা বলতে হলে , আমাদের অর্জিত বিরাট সাফল্যের মহান সংগঠকের কথা না বলে পারবো না। আমি কমরেড স্তালিনের কথা বলছি।"

"আমাকে বলতেই হবে, আমাদের পার্টির মহান প্রতিষ্ঠাতা যাকে দশ বছর আগে আমরা হারিয়েছি, কমরেড স্তালিন হলেন তার প্রকৃত গুণসম্পন্ন দক্ষ উত্তরাধিকারী এবং কমরেড লেনিন যে উদ্দেশ্য সাধনের কাজ আমাদের হাতে সমর্পণ করে গেছেন কমরেড স্তালিন হলেন তার ধারাবাহিক রক্ষাকারী।" ( এস এম কিরভ : নির্বাচিত বক্তৃতা ও প্রবন্ধাবলী , ১৯১২-৩৪, রুশ সংস্করণ )

এখানে ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা সম্পর্কে কিছু না বলে পারছি না। বস্তুবাদী ধারণা ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে অস্বীকার করে না। জনসাধারণই ইতিহাস রচনা করেন। কিন্তু এই ইতিহাসে ব্যক্তি বিশিষ্ট ভূমিকা পালনে সক্ষম, তবে কতকগুলি শর্তে ।



এঙ্গেলস বলেছেন : "আমরা নিজেরাই আমাদের ইতিহাস সৃষ্টি করি, কিন্তু সৃষ্টি করি সর্বাগ্রে অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট কতকগুলি পূর্বস্থিতি ও অবস্থার মধ্যে । এদের মধ্যে অর্থনৈতিক পূর্বস্থিতি ও অবস্থাই শেষপর্যন্ত নির্ধারক হয়। কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি - এমনকি মানব মনকে আচ্ছন্ন করে থাকে যে ঐতিহ্য, তা - ও একটা ভূমিকা গ্রহণ করে, যদিও সে ভূমিকা চূড়ান্ত নির্ধারক নয়।" ( ই ব্লক সমীপে এঙ্গেলস : মার্কস- এঙ্গেলস পত্রবলী )

স্তালিন চমৎকারভাবে ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার ব্যাখ্যা করেছেন: "বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভূমিকা অথবা জনগণের দ্বারাই ইতিহাস রচিত হয়, মার্কসবাদ আদৌ এর কোনোটাই অস্বীকার করে না। জনগণই ইতিহাস রচনা করেন। কিন্তু জনগণ তাঁদের কল্পনার তাগিদে বা হঠাৎ তাঁদের মনের খেয়ালে ইতিহাস সৃষ্টি করেন না। প্রত্যেক নতুন বংশধররা জন্মেই কতকগুলি নির্দিষ্ট বিদ্যমান তৈরি অবস্থান সম্মুখীন হন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একমাত্র সেইটুকুই মূল্য, যে পরিমানে তাঁরা এই অবস্থাগুলি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, বুঝতে পারেন কিভাবে তা বদলাতে হবে।" ( স্তালিন : জার্মান লেখক এমিল লুডউইগ - এর সঙ্গে কথোপকথন , ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৩১ )।

স্তালিন- পরবর্তীকালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পার্টি - নেতৃত্ব এক অর্থে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভূমিকা অস্বীকার করেননি। এদের বক্তব্যগুলি থেকে একটিমাত্র সিদ্ধান্তেই আমরা আসতে পারি , অর্থাৎ স্তালিনের কালে সবগুলি ব্যর্থতার দায়িত্ব স্তালিনের , আর সাফল্যগুলির দায়িত্ব কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত জনগণের ।



একে আর যা কিছু আখ্যা দেওয়া যাক না কেন, মার্কসবাদ - লেনিনবাদী আখ্যা দেওয়া যায় না। স্তালিন - পরবর্তী কালের সোভিয়েত পার্টি - নেতৃত্বে স্তালিন সম্পর্কে এই মূল্যায়ণ আদৌ মার্কসবাদ - লেনিনবাদসম্মত নয় , আদৌ বিজ্ঞানসম্মত ও নয়।

বিংশ কংগ্রেস হতে স্তালিনকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেবার যে অভিযান শুরু হয়, তা পরবর্তী কংগ্রেস অর্থাৎ একবিংশ কংগ্রেসে চরম পরিণতি লাভ করে। কংগ্রেস চলাকালীনই স্তালিনের মৃতদেহ মসোলিয়াম থেকে টেনে বের করে এনে মাটিতে কবর দেওয়া হয়।

তৎকালীন সোভিয়েত নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছিলেন , স্তালিন সম্পর্কে মূল্যায়ন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, অতএব অন্য দেশসমূহের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি এ ব্যাপারে জড়িত নয়। এই নেতৃত্ব হয় বুঝতে পারেননি, নয় বুঝেও না বোঝার ভান করেছিলেন যে, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকাশে স্তালিনের বিশিষ্ট অবদান ও ভূমিকা ছিল। স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি ছিল অন্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির কাছে আদর্শ - স্থানীয়। স্তালিন সম্পর্কে কোনো বিরূপ সমালোচনা অন্য দেশগুলির কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে বাধ্য এবং করেছেও।



প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের একটা পরিণতি আছে। স্তালিন ছিলেন মার্কসবাদ - লেনিনবাদের বৈপ্লবিক তত্ত্ব ও কাজের প্রতিকস্বরূপ, তিনি ছিলেন বিশ্ব প্রলেতারীয় বিপ্লবের শ্রেষ্ঠ রণনীতিবিদ , অমর লেনিনের শিক্ষাগুলির ধারক ও বাহক। স্তালিনের নামকে কলঙ্কিত করার , তাঁর অবদানকে নস্যাৎ করার চেষ্টার অর্থ হলো - মার্কসবাদ - লেনিনবাদকে কলঙ্কিত করা , সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে প্রলেতারীয় একনায়কত্ব-এর ভূমিকাকে নস্যাৎ করা, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিচ্ছেদ ঘটানো এবং এইভাবে সাম্রাজ্যবাদীদেরই সাহায্য করা।



এটা নিছক তত্ত্বগত বক্তব্য নয়, বাস্তবেও তাই -ই ঘটেছে। আমি ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি, বিংশ কংগ্রেস থেকেই স্তালিনকে কলঙ্কিত করার, তাঁর অবদান নস্যাৎ করার চেষ্টা চলেছে । এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই যে, ১৯৩৮ সালে স্তালিন কর্তৃক রচিত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক কমিশন দ্বারা অনুমদিত " সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)- র ইতিহাস সংক্ষিপ্ত পাঠ " সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে স্তালিনের সংগৃহীত রচনাবলীর প্রকাশ ও প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারপর ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস তিন - চার বার প্রকাশ করা হয়েছে এবং পরে আবার তার প্রচারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই বইগুলিতে বলতে গেলে স্তালিন নামে কোনো ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যাবে না।

কিন্তু স্তালিনের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও অবদানগুলি ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়া যাবে না। আমরা ধরে নিলাম জীবনের শেষভাগে স্তালিন কতকগুলি ভুল করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক আইন , পার্টিরীতি ইত্যাদি লঙ্ঘন করেছিলেন। কিন্তু আমাদের কাছে এমন কোনো বিস্তারিত বাস্তব তথ্য নেই , যার ভিত্তিতে আমরা এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারি । উল্লেখ্য যে , সমালোচনাকারী নেতৃত্ব স্তালিনের তত্ত্বগত ভুলগুলি এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে অন্ততঃ উল্লেখ করেননি। বিংশ কংগ্রেস শেষ হবার বহুদিন বাদে সম্ভবত তাঁরা কিছু ভুল আবিষ্কার করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক আইন ভঙ্গ, পার্টিরীতি লঙ্ঘন , ব্যক্তিপূজা ইত্যাদির সম্পর্কে অভিযোগগুলিই এখনও অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে।
ষাটের দশকে অবিভক্ত পার্টির জাতীয় পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা কয়েকজন আলোচনার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলাম। মস্কোতে আমি দু'জন শীর্ষস্থানীয় তাত্বিকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম স্তালিনের ত্রুটি - বিচ্যুতি সম্পর্কে আপনার এখন যা বলছেন , তাঁর জীবদ্দশায় সেগুলির কথা কি আপনাদের একবারও মনে হয়নি ? আমরা এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাইনি।

স্তালিনকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব । স্তালিন কে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে হলে মার্কসবাদ - লেনিনবাদী ও তার জয়যাত্রাকে মুছে ফেলতে হয়। কিন্তু মার্কসবাদ - লেনিনবাদী অমর। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্তালিনের রচনাবলী প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু এই রচনাবলী নষ্ট করে দেবার ক্ষমতা কারুরই নেই। স্তালিনের ঐতিহাসিক অবদান বোঝার ক্ষেত্রে এই রচনাবলী অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ।

এখানে আমি মার্কসবাদ - লেনিনবাদের বৈপ্লবিক তত্ত্ব ও কাজের ব্যাখ্যায় , সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার সংগ্রামে , আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকাশে স্তালিনের সুনির্দিষ্ট অবদানের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণী দিয়ে এই প্রবন্ধ শেষ করব । স্তালিনের ঘটনাবহুল বৈপ্লবিক জীবনকে মোটামুটি পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায় : (১) প্রাক বিপ্লবকালীন ,
(২) অক্টোবর বিপ্লবকালীন ,
(৩) সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের যুদ্ধ চলাকালীন ,
(৪) সমাজতন্ত্র গঠনের সংগ্রাম চলাকালীন এবং
(৫) সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসাধারণের মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধ চলাকালীন।




জে ভি স্তালিন ( জুগশভিলি ) তিফলিস (ককেশিয়া ) প্রদেশের গোরি শহরে ১৮৭৯ সালে ২১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮৮ সালের শরৎকালে তিনি গোরিয় ধর্মীয় স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৫ বছর বয়সে বৈপ্লবিক আন্দোলনে যোগদান করেন ও বে-আইনী মার্কসীয় সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন।



১৮৯৬-৯৭ সালে স্তালিন বিদ্যালয়ে মার্কসীয় পাঠচক্র পরিচালনা করেন এবং ১৮৯৮ সালের আগস্ট মাসে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ান সোশ্যাল - ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির তিফলিস শাখার সদস্যভুক্ত হন। ১৮৯৯ সালে ২৯ মে মার্কসবাদ প্রচারের "অপরাধে" স্তালিন ধর্মীয় বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হন।

১৯০০ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন লেনিনের 'ইস্ক্ৰ'আ' প্রকাশিত হতে শুরু হয়, তখনই স্তালিন তাঁর নীতির সঙ্গে পুরোপুরি একমত হন। তখনই তাঁর কাছে পরিষ্কার হয় যে, লেনিন হলেন একটি প্রকৃত মার্কসবাদী পার্টির স্রষ্টা , একজন নেতা ও শিক্ষক।



প্রাক বিপ্লবকাল , যুব - বয়সেই একজন মার্কসবাদী - লেনিনবাদী তাত্বিক হিসাবে স্তালিন তাঁর প্রতিভার পরিচয় দেন। ১৯০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জর্জিয়াতে "বরদজোলা" নামে প্রথম বে- আইনী সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক কাগজ প্রকাশিত হয়। এর প্রথম সংখ্যা (সেপ্টেম্বর, ১৯০১)- র সম্পাদকীয় লেখেন স্তালিন । মার্কসবাদী পত্রিকা হিসাবে ইস্ক্রার পরই স্থান ছিল বরদজোলার। পত্রিকার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে স্তালিন লেখেন : "জর্জিয়ার সোশ্যাল - ডেমোক্র্যাটিক সংবাদপত্রকে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কিত সমস্ত প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দিতে হবে, নীতি সম্পর্কিত সমস্ত প্রশ্নের ব্যাখ্যা করতে হবে। সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীর ভূমিকা সম্পর্কে তত্ত্বগত ব্যাখ্যা দিতে হবে এবং শ্রমিকশ্রেণী যে সমস্ত বিষয়ে মুখোমুখি হয়, তার উপর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আলোকপাত করতে হবে। "
( স্তালিন : সংক্ষিপ্ত জীবনী, মস্কো, ১৯৫১)

বরদজোলার পরবর্তী সংখ্যায় ( নভেম্বর -ডিসেম্বর ১৯০১), রাশিয়ান সোশ্যাল- ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি ও তার কর্তব্য" শিরোনামায় স্তালিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এতে স্তালিন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সঙ্গে স্বতস্ফূর্ত শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের ভূমিকার উপর জোর দেন, শ্রমিকশ্রেণীর একটি স্বাধীন রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তাকে তিনি তুলে ধরেন।

১৯০৩ সালে রাশিয়ান সোশ্যাল - ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির ককেশীয় ইউনিয়ন কমিটির একটি গোপন ছাপাখানা স্তালিনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিফলিসে প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানাটি ১৯০৬ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। এই চাপাখানাতেই লেনিনের "গ্রামের গরীবদের প্রতি " ,সর্বহারা ও কৃষকের বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব" এবং স্তালিনের "সংক্ষেপে পার্টির মধ্যে মতানৈক্য প্রসঙ্গে " ও অপর কয়েকটি পুস্তক ছাপা হয়।

স্তালিনের নেতৃত্বে ১৯০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাকু শ্রমিকদের একটি ধর্মঘট হয়। এই ধর্মঘট ১৩ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। বলশেভিক পার্টির ইতিহাসে লেখা হয়েছে : "এই ধর্মঘট ছিল রাশিয়ায় বিরাট বৈপ্লবিক ঝড়ের আগমনবার্তা ঘোষণাকারী ব্রজনির্ঘোষের মতো । "

১৯০৫ সালের গোড়ার দিকে রচিত ' সংক্ষেপে পার্টির মধ্যে মতানৈক্য প্রসঙ্গে' পুস্তিকায় স্তালিন লিখেছেন : শ্রমিক আন্দোলনকে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করতেই হবে। প্রয়োগগত ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে তত্বগত চিন্তাধারার মিশ্রণ ঘটাতেই হবে। আর এইভাবে স্বতঃস্ফূর্ত শ্রমিক আন্দোলনকে সোশ্যাল - ডেমোক্র্যাটিক চরিত্রে রূপায়িত করতে হবে। লেনিনের ঐতিহাসিক রচনা " কি করিতে হইবে" -র সঙ্গে স্তালিনের এই রচনার প্রত্যক্ষ মিল আছে। ১৯০৬ এবং ১৯০৭ সালে জর্জিয়ান ভাষায় লিখিত স্তালিনের 'নৈরাজ্যবাদ না সমাজতন্ত্রবাদ' শিরোনামায় প্রবন্ধগুলিতে স্তালিন মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সূত্রগুলি নিয়ে তত্ত্বগত আলোচনা করেছেন। এটি স্তালিনের একখানি অত্যন্ত মূল্যবান তত্ত্বগত রচনা।

১৯০২-১৯১৩ সালের মধ্যে স্তালিনকে সাতবার গ্রেফতার করা হয় এবং ছয়বার নির্বাসনে পাঠানো হয়। পাঁচবার তিনি নির্বাসন থেকে পালিয়ে আসেন।

সমাজতান্ত্রিক গঠনের পথে বাধা ছিল প্রচুর। লেনিনবাদ বিরোধীদের তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয় বলশেভিক পার্টিকে। স্তালিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টিকে ট্রটস্কি , জিনোভিয়েভ , বুখারিনের ন্যায় প্রখ্যাত তাত্বিক ও পন্ডিতদের সঙ্গে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী তত্ত্বগত লড়াইয়ে অবতীর্ন হতে হয়। এইসব প্রসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত নেতাদের বিরুদ্ধে তত্ত্বগত লড়াই করে সঠিক লাইনে পার্টি ও সরকারের কাজ চালু করা একটা বিরাট কাজ। বিরোধী পক্ষের সঙ্গে বিরোধের বিষয়বস্তু ছিল অনেকগুলি। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : একটিমাত্র দেশে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা ইত্যাদি । এই তীব্র মতাদর্শ গত তত্ত্বগত দ্বন্দ্বে স্তালিন আর একবার সেই সময়কার শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী - লেনিনবাদী হিসাবে তাঁর প্রতিভার পরিচয় দেন।



১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের যুক্তি অধিবেশনে প্রদত্ত রিপোর্টে স্তালিন বলেছেন : (ক) সোভিয়েত ইউনিয়ন কৃষিপ্রধান দেশ থেকে শিল্প প্রধান দেশে পরিণত হয়েছে।
(খ) সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শিল্পক্ষেত্রে পুঁজিবাদী শক্তির উচ্ছেদ সাধন করেছে।
(গ) সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কৃষিক্ষেত্র থেকে শ্রেণী হিসাবে কুলাকদের উৎখাত করেছে।
(ঘ) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বেকারী সমস্যার বিলোপ করেছে।
(ঙ) দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সর্বশাখায় সমাজতন্ত্রের বিজয়ের ফলে মানুষের হাতে মানুষের শোষণের অবসান ঘটেছে।
[সি পি এস ইউ (বি) -র ইতিহাস সংক্ষিপ্ত পাঠ্য ]।




স্তালিনের সুদৃঢ় নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি যদি লেনিনবাদ বিরোধী চক্রগুলিকে বিচ্ছিন্ন ও পর্যুদস্ত করার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে শিল্প ,কৃষি ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে শক্তিশালী না করতো , তাহলে হিটলারের প্রবল পরাক্রমশালী তথাকথিত "অপরাজেয়" নাৎসি বাহিনীর আক্রমনের কতটা মোকাবিলায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে শিল্প ,কৃষি ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে শক্তিশালী না করতো, টা হলে হিটলারের প্রবল পরাক্রমশালী তথাকথিত "অপরাজেয়" নাৎসী বাহিনীর আক্রমণের কতটা মোকাবিলায় সোভিয়েত ইউনিয়ন সক্ষম হতো- সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। স্তালিন ও বলশেভিক পার্টির এই সুনির্দিষ্ট অবদান তুলনাহীন । এই অবদানের বাস্তব - কাহিনী ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে কেউই সক্ষম নয়।
হিটলার - বাহিনী ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে এবং শুরু হয় সোভিয়েত জনগণের মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধ । প্রচন্ড ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে সোভিয়েত জনগণের ঐতিহাসিক বিজয় সোভিয়েত ইউনিয়ন কেই শুধু ফ্যাসিবাদের কবল থেকে বাঁচায়নি , সমগ্র দুনিয়াকেও বাঁচিয়েছে। স্তালিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন : এই মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত জনগণ একা থাকবে না। আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আমাদের সংগ্রাম ইউরোপ ও আমেরিকায় জাতিসমূহের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। স্বাধীনতার জন্য ও দাসত্বে র বিরুদ্ধে এবং হিটলারের ফ্যাসিস্ট - বাহিনীর ক্রীতদাসে পরিণত করার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেসব জাতি , এই সংযুক্তি হবে সেই সব জাতির যুক্তফ্রন্ট ।" (স্তালিন: মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধ ) । এই ভবিষ্যৎ - বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়।

স্তালিন সামরিক রণনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন - ক্রুশ্চেভের এই কুৎসার সমুচিত জবাব দিয়েছেব স্তালিনের নেতৃত্বে যেসব সেনাপতি কাজ করেছেন তাঁরা। শুধু লালফৌজের সেনাপতিরাই নন, স্তালিন - বিরোধী এবং কমিউনিস্ট - বিরোধী অনেক লেখক ও রাজনীতিবিদ ও ( চার্চিল ,আইজাক ,ডিয়টশার প্রমুখ) স্তালিনের সামরিক জ্ঞান, দক্ষতা ইত্যাদি সম্পর্কে সপ্রশংস মন্তব্য করেছেন।

স্তালিনের শেষ বয়সের ভুল, ত্রুটি ও বিচ্যুতিগুলির যদি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন গভীর পর্যালোচনা করতো - তা হলে আমরা কিছু নতুন আলোক পেতাম। ভবিষ্যতে যাতে এই ভুল না হয়, তা সুনিশ্চিত করার জন্যই এই পর্যালোচনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি।



এই দুর্বলতা ও বিচ্যুতিগুলি সত্ত্বেও বিশ্বের একজন সেরা বিপ্লবী, সেরা মার্কসবাদী - লেনিনবাদী হিসাবে স্তালিনের নাম বৈপ্লবিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন