‘আমার মুখের ভাষা ওরা কাইড়া নিতে চায়’

ড. নুরুল ইসলাম

সারা বিশ্ব জুড়ে সংখ্যালঘু অংশের মাতৃভাষা চরম সঙ্কটের মুখে। ভাষাগত সমস্যা সাংস্কৃতিক সামাজিক সমস্যাকেও নানাভাবে ডেকে আনে। মানুষ শিকড়হীন, আত্মপরিচয়হীন হয়ে পড়ে। বিখ্যাত ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কির কথায় ‘যে সমাজ তার মাতৃভাষা হারায়, সে তার স্মৃতিকে হারিয়ে ফেলে।’

নাইজেরিয়ান উপন্যাসিক চিমামান্দা অদিচি আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘একটি সংস্কৃতির ভাষা তার গল্প, ইতিহাস, মূল্যবোধ, প্রথা এবং ঐতিহ্যের ধারক বাহক। যখন একটি ভাষা মারা যায় তখন সেটি তার সংস্কৃতিকেও সাথে নিয়ে চলে যায়।’

বহু ভাষা-ধর্ম বিশিষ্ট দেশ বা জাতির পরস্পরের ভাষা. ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থই হলো সমাজে পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়ার রাস্তাকে প্রশস্ত করা, সম্প্রীতি-সংহতিবোধকে আরও উন্নত করা, শক্তিশালী করা। আধিপত্যবাদী মানসিকতা নিয়ে নয়, পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয় সংখ্যাগুরু অংশকে। এ কথা সব দেশের ক্ষেত্রেই সত্য।

আর তা না হয়ে উল্টোটা ঘটলে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই সংঘাত ঘটতে বাধ্য। যে ভাষায় কথা বলে মানুষ বড় হয়, সে ভাষা কেউ কেড়ে নিতে এলে মানুষ তাকে ক্ষমা করে না, প্রতিবাদ করে প্রতিরোধ করে। মাতৃভাষার জন্য মানুষ অকাতরে প্রাণবলি দিতেও পারে। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলন ঘটেছে যুগে যুগে, ভিন্ন ভিন্ন দেশে।

মাত্র বছর চারেক আগেই ২০২১ সালে স্পেনের সেনেট ‘আন্দালুসিয়ান’ ভাষাকে ‘প্রাকৃতিক ভাষা’ বা অবশ্য প্রয়োজনীয় ভাষারূপে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষাকে নিয়ে আন্দোলন তৈরি হয় সামাজিক মাধ্যমে লেখক গবেষকদের হাত ধরে। তারা এর জন্য 'সোসাইটি ফর দ্য স্টাডি অব আন্দালুসিয়ান' নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। তাঁরা দাবি করেন, আন্দালুসিয়ান ভাষা কোন উপভাষা নয়, এটি তাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাসেরই অংশ। তাদের এই দাবিকে স্পেনের 'ডিজিটাল ফ্রিডম' পত্রিকা ‘বামপন্থীদের দাবি’ হিসাবে আখ্যা দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত সামাজিক আন্দোলনের চাপেই স্পেনে অন্য ভাষার মতোই আন্দালুশিয়ান ভাষা স্বীকৃতি পায়।

১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহনসবার্গ শহরে স্কুল ছাত্ররা তাদের মাতৃভাষা ‘জুলু’তে শিক্ষাদান আর লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বা যোগাযোগের ভাষা হিসাবে ইংরেজি, এই দাবিতে শুরু করে ভাষা আন্দোলন। সেই সময় শ্বেতাঙ্গ বর্ণবিদ্বেষী সরকার বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যালয়ে জার্মান-ডাচ ভাষাকে চাপিয়ে দেয়। তখন ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলনের ঝড় তোলে। ১৬ জুন শিশু-কিশোর সহ শতাধিক মানুষের প্রাণ যায়, আহত হয় অনেক। ভাষার জন্য এই আন্দোলনকে বলা হপ্য 'সুয়েটো অভ্যুত্থান', আর বিষাদময় দিনটি পরিচিত 'ডে অব চাইল্ড'। এই ঘটনার পর থেকে আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসের শ্বেতাঙ্গ বিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে, তীব্রতর রূপ ধারণ করে। পরবর্তীকালে এই বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ সরকারের পতন ঘটে এবং জুলু ভাষা তার মর্যাদা ফিরে পায়।

১৯৬০ থেকে মার্কিন আদিবাসীরা দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তাঁদের নিজস্ব ভাষা রক্ষার দাবিতে আন্দোলনের মাধ্যমে ছিনিয়ে নেয় এই অধিকার। ১৯৯০ সালে ৩০ অক্টোবর মার্কিন কংগ্রেসে আইন পাশ করে তাদের ভাষা রক্ষা এবং সংরক্ষণ নিশ্চিত করা হয়। ফলস্বরূপ একাধিক অঙ্গরাজ্যে ইংরেজির আধিপত্য কমে ও আদিবাসী মানুষের ভাষা মর্যাদা পায়।

১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কংগ্রেস সরকার স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দি চাপিয়ে দিলে দক্ষিণ ভারতে মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয়। তিন বছর ব্যাপী এই আন্দোলনে শহীদ হন দু’জন এবং নারী শিশু সহ গ্রেপ্তার হন ১ হাজার ১৯৮ জন। ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস সরকারকে পদত্যাগ করতে হয় এবং ১৯৪০ সালে বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দি শিক্ষার আইন প্রত্যাহার করা হয়। তার চেয়েও বড় আকারের আন্দোলন তামিল ভাষার জন্য হয় ১৯৬৫ সালে। সেই বছর ২৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেয়। এই আন্দোলনে রাজ্যে দু’শোর বেশি মানুষ প্রাণ হারান। এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় মাদ্রাজ ও আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। ফলস্বরূপ ১৯৬৭ সালে সেই রাজ্যে কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং ডিএমকে বা দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম দল ক্ষমতাসীন হয়।

আসামে অহমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্ত নিলে আন্দোলন শুরু হয়। আসামের বরাক উপত্যকা শিলচর অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল বাংলাভাষী। অহমিয়া ভাষার পাশাপাশি বাংলাকেও সরকারি ভাষা রাখার দাবিতে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে জমায়েত হয় অসংখ্য মানুষ ১৯ মে, ১৯৬১। আসাম রাইফেলস নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করে। ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই সার্কুলার প্রত্যাহারের দাবিতে ভাষা আন্দোলনের জন্য শহীদ হন করিমগঞ্জে বিজন চক্রবর্তী। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলা ভাষাকেও যুক্ত করার দাবীতে শহীদ হন করিমগঞ্জের জগন্ময় দেব এবং দিব্যেন্দু দাস।

মানভূম অঞ্চলে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯১২ সালে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল এই ভাষা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৫৬ সালের আগে পুরুলিয়া জেলা বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সেখানকার স্কুল কলেজ ও সরকারি দপ্তরে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হয়। তার প্রতিবাদে মানভূমের সারা পুরুলিয়া এলাকা জুড়ে লাগাতর বন্ধ অবরোধ চলতে থাকলে ভারত সরকার মানভূম জেলা ভেঙে পুরুলিয়াকে আলাদা জেলা তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করে এবং বাংলা মাতৃভাষার স্বীকৃতি পায়।

মাতৃভাষা বাংলার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার আন্দোলন সারা বিশ্বে স্মরণীয় নানা কারণে। মাতৃভাষার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সেই দেশে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতর হয় এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে মুক্তি লাভ করে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তাদের ভাষা আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়েই ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে।

এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বা পটভূমি ভারতের স্বাধীনতা লাভ বা দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের অনেক আগে থেকেই। মোহাম্মদ আলী জিন্না ১৯৩৭ সালে উর্দু ভাষাকে ভারতের মুসলিমদের যোগাযোগের ভাষা রূপে প্রস্তাব করলে, এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাংলার মুসলিম লিগের প্রতিনিধি দল তীব্র বিরোধিতা করেন। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে চৌধুরি খলিকুজ্জামান ও জুলাই মাসে তৎকালীন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রখ্যাত ভাষাবিদ মহঃ শহীদুল্লাহ, মোহাম্মদ এনামুল হক সহ বহু বুদ্ধিজীবী তীব্র প্রতিবাদ জানান।

দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত হয় এবং সবক্ষেত্র থেকে বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করা হয়। এর বিরুদ্ধে ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের এক বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা করা ও সরকারি কাজে ইংরেজি উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের স্বীকৃতির জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তমিজ উদ্দীন খাঁনের নেতৃত্বে মুসলিম লিগের সকল সদস্য একযোগে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ফলে গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি বাতিল হয়ে যায়।

এর প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দানের দাবিতে। এই আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিব, শামসুল হক সহ মোট ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করলে ঢাকায় ১৩ থেকে ১৫ মার্চ ধর্মঘট হয়। এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ১৫ মার্চ সমস্ত আন্দোলনকারীকে মুক্তি, পুলিশি অত্যাচারের উচ্চ স্তরের তদন্ত, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে আট দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। শুধু তাই নয় মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে বিবৃতি দিতে হয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন 'রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই। '

কিন্তু ঠিক ছয় দিন পরেই ঘটলো উল্টো ঘটনা। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ ও ২৪ মার্চ দুটি জনসভায় ঘোষণা করেন, ‘State language of Pakistan is going to be Urdu, no other language’। শুধু তাই নয়, তিনি উর্দু ভাষার বিরোধী মানুষদের ইসলাম বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। অথচ উর্দু ভাষার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনও সম্পর্কই নেই। ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কোরান লিখিত হয়েছে আরবি ভাষায়। আরবি ভাষা আরব দেশের মানুষের ভাষা। আর উর্দু ভাষার জন্ম ভারতে মুঘল আমলে। আরবি ভাষার সঙ্গে উর্দু ভাষার কেবল মিল হরফ বা অক্ষরগত অর্থাৎ আরবি হরফে উর্দু ভাষা লেখা হয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি মিল উত্তর ভারতে প্রচলিত হিন্দি ভাষার সঙ্গে। এই ভাষার ক্রিয়াপদ, বচন, লিঙ্গ ইত্যাদি ব্যাকরণ বিধি সবকিছুই হিন্দি ভাষার নিয়ম অনুসারী। শুধু তাই নয়, আরবির তুলনায় উর্দুর হরফ সংখ্যা বেশি। আরবি ভাষার হরফ ২৮টি, কিন্তু উর্দু ভাষায় পে, টে, চে, ডাল, ড়ে, ঝে, গাফ ইত্যাদি কয়েকটি হরফ বা বর্ণ অতিরিক্ত আছে। এই বর্ণগুলি যুক্ত করা হয়েছে ভারতীয় হিন্দি ভাষার বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণের সুবিধার্থে।

পরে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠিত হলে, ১৯৫০ সালে ৬ ডিসেম্বর তাদের প্রতিবেদনে বাংলাকে আরবি অক্ষরের মাধ্যমে লেখার সুপারিশ করেন। এর প্রতিবাদে ছাত্ররা এক বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে নস্যাৎ করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু। তার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। পরদিন ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানির নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় ‘কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ’ গঠিত হয়। পরিষদ একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল সমাবেশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য মিটিং মিছিল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকবে এবং ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় সর্বত্র ১৪৪ ধারা ভাঙার।

সকাল ন'টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে হাজির হয়। পুলিশ অস্ত্র হাতে চারদিক ঘিরে রাখে। বেলা এগারোটা নাগাদ ছাত্ররা অবরোধ ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা ভেঙেই রাস্তায় নেমে পড়ে ১০০০ ছাত্র  এবং আইনসভার দিকে রওনা দেয়। বেলা তিনটার সময় পুলিশ ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। আব্দুল জব্বার, রফিক আহমেদ, আব্দুস সালাম, আবুল বরকত সহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। অলিউল্লাহ নামের একজন আট-নয় বছরের বালকও নিহত হয়। ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে অফিস দোকানপাট পরিবহণ সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্র আন্দোলন পরিণত হয় জনসাধারণের আন্দোলনে। রেডিও শিল্পীরাও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ধর্মঘট আহ্বান করে সম্প্রচার বন্ধ করে দেন।

২২ ফেব্রুয়ারি বেলা এগারোটা নাগাদ তিরিশ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে এগতে থাকে। পুলিশ জনতার উপর গুলি বর্ষণ করলে সেই দিন আরও চার জনের মৃত্যু হয়। একই দিনে নবাবপুর রোডের শোক মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণে শহীদ হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান বাদিউল্লা এবং আব্দুল আউয়াল। জনশ্রুতি, পুলিশ বেশ কিছু লাশ পাচার করে দেয়। নিহত আবুল বরকত, রফিউদ্দিনের পরিবার হত্যা মামলা দায়ের করতে গেলে উপযুক্ত কাগজের অভাবের অজুহাত দেখিয়ে সরকার মামলাটি গ্রহণ করেনি।

ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতের মধেই ১০ ফুট উঁচু আর ৬ ফুট চওড়া শহীদ মিনার তৈরি করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউরের পিতা, উপস্থিত ছিলেন দৈনিক আজাদ পত্রিকা সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। এই শহীদ মিনার ভেঙে দেয় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী। অবশেষে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৫৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে ১৯৬৩ সালে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয় যার উদ্বোধন করেন শহীদ বরকতের মা ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।

পাকিস্তানে বাংলাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দানের এই আন্দোলনে বহু মহিলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাহবুবা খাতুন, আনোয়ারা খাতুন, হালিমা খাতুন, চেমন আরা, লায়লা নূর, রওশন আরা, রিজিয়া খাতুন, সুফিয়া কামাল, নাদেরা বেগম প্রমুখ। ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের বাড়ির মহিলারা লুকিয়ে থাকা আন্দোলনকারীদের রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা, রাত জেগে পোস্টার লেখা, আহতদের শুশ্রূষা সহ নানাভাবে সহায়তা করা, আহতদের চিকিৎসার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থসংগ্রহ, আন্দোলকারী ছাত্রদের নিজেদের হস্টেলে লুকিয়ে রাখাই শুধু নয়, আন্দোলনের খরচ জোগানোর জন্য অনেকে গায়ের অলঙ্কার খুলে দেন। পুলিশের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে কলেজ ছাত্রীরা 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগান তুলে মিছিল করতেন।  অনেক নারীকে জেলও খাটতে হয়, কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত হন। এই সমস্ত ঘটনার পরিচয় পাওয়া যাবে আজাদ পত্রিকায়, ভাষা সৈনিকদের স্মৃতিচারণায় ও নানা বইতে। উল্লেখ্য, ৩১ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভায় ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে।’

একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনাকে নিয়ে বিখ্যাত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি রচনা করেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী এবং সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন করে সুরারোপ করেন। এই গানটি বহু ভাষায় অনুদিত হয়। ভাষা আন্দোলন নিয়ে অসংখ্য গান, কবিতা, নাটক, সিনেমা তৈরি হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের বিখ্যাত আব্দুল লতিফের আরেকটি গান,

‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।

ওরা কথায় কথায় আমায় শিকল পরাতে চায়।’

 ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম কেবলমাত্র বাংলাকে সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি প্রবল বঞ্চনার বিরুদ্ধে। বিশেষত ১৯৭১ সালে মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবলিদান বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্মরণীয় ঘটনা। আজ বিষ্ময়কর ভাবে মুজিবর রহমানকে চরমভাবে নিন্দিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকেই মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। যে পাকিস্তানের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য শহীদের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, আজ সেই পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদীরাই আস্ফালন করছে বাংলাদেশের মাটিতে।

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ তুলে ভারতে যারা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা করছেন তাদের ভূমিকা আরও ভয়ানক। যে কোন দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব সংখ্যাগুরু অংশের। গণতন্ত্রের অর্থই হলো সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরুর সহনশীলতা ও মর্যাদা প্রদান। ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে গণতন্ত্র থাকে না। আর গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে যেকোনও দেশেরই অবস্থা পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো চরম সংকটময় হতে বাধ্য। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন