Romila Thapar 1

ধর্মনিরপেক্ষতা ও ভারত (১ম পর্ব)

রোমিলা থাপার

ভারতীয় সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বলতে গেলে, শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার, ধর্মনিরপেক্ষতা নিছক রাজনীতির ঊর্ধ্বে একটি ধারণা, যদিও আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলি একে রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত করেছে। একটি পার্টি একে তত্ত্বগতভাবে গ্রহণ করেছে কিন্তু ঠিকঠিকভাবে একে বাস্তবে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকেছে, অন্য পার্টি একে নিছক রসিকতায় পরিণত করেছে, কারণ দলটির আদর্শগত ভিত্তিই আসলে সাম্প্রদায়িক। ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন অথবা বিরোধিতা, কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক স্লোগান নয়। এটা আমরা কেমন সমাজ চাই এই ভাবনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। সম্ভবত এ জন্যই এই ভাবনা স্বাধীনতা পাওয়ার ঠিক পরবর্তী সময়কালে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে আর বর্তমান সময়কালে তাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা চলছে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ হলো আমরা ভারতবর্ষের সমাজকে যে দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছি তা পরিবর্তনের চেষ্টা করা। যদি ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভারতবর্ষের সংবিধান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে গণতন্ত্র এক অভাবনীয় ভবিষ্যতের শিকার হয়ে পড়বে।

যাই হোক, যদি আমরা তত্ত্ব ও বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ চাই, তাহলে আমাদের প্রথমে নিজেদেরকে ধর্ম, জাত অথবা ভাষার ভিত্তিতে পরিচিত করা বন্ধ করতে হবে এবং প্রাথমিকভাবে নিজেদেরকে একটি জাতির সমান অংশ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এই করার দায়িত্ব রাষ্ট্র, নাগরিক এবং নাগরিকদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিকভাবে নিতে হবে, আর এটা শুধু এখন তত্ত্বগতভাবে গ্রহণ করলে হবে না, বাস্তবে একে প্রয়োগ করতে হবে। ধর্ম, জাতপাত, ভাষা ও আঞ্চলিকতা সংক্রান্ত পরিচিতি অবশ্যই এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে চলে যাবে। এই পরবর্তী পরিচিতি যে প্রাথমিক পরিচয়ের কথা, নাগরিক অধিকারের কথা আমরা বলছি তার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। যার ফলশ্রুতিতে সরকার কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করতে পারবে না, যা সে এখনও পর্যন্ত করে আসছে। আমি ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে ওঠা এই শব্দগুলোর মধ্যে দিয়ে কি মানে করতে চাইছি, সেটা বোঝাবার মধ্যে দিয়েই আমার কথা শুরু করতে চাইছি। ধর্মনিরপেক্ষ হচ্ছে এমন একটা ভাবনা যা পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মসম্প্রদায় সংশ্লিষ্ট নয়, একেবারেই আলাদা। ধর্মনিরপেক্ষতা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আয়ত্তে রাখার ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকাকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এই বিষয়টিকে ন্যায্য প্রমাণ করার জন্য ধর্মসম্প্রদায়ের ভূমিকা নৈতিকতা বজায় রাখার জন্য জরুরি—এভাবে উপস্থাপিত করা হয়। কিন্তু নৈতিকতার ভিত্তি তো ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে কোনো একটি ধর্মসম্প্রদায়ের বিষয় নয়, এটি সমগ্র সমাজের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। ধর্মনিরপেক্ষতা কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না, কিন্তু সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে ধর্মসম্প্রদায়ের নামে যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয় তার থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র রাখে, আলাদা রাখে। এই পার্থক্য একেবারে মৌলিক। আর শেষ পর্যন্ত, ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে যাওয়া হলো সেই পদ্ধতি যার মধ্যে এই সমাজ পরিবর্তিত হয় এবং এই পার্থক্যকে চিনতে পারে, চিহ্নিত করতে পারে।

ধর্মনিরপেক্ষতা কী এবং কী নয়

১৮৫১ সালে যখন প্রথম ব্যবহৃত হয়, তখন ধর্মনিরপেক্ষতার একটি প্রধান অর্থ ছিল। এটা তখন সুষম ও সুস্থ মানবসমাজ গড়ে তোলা ও রক্ষা করার জন্য মানুষের তৈরি করা নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত আইনগুলিকে বোঝাত। এই আইনগুলি কোনো ঐশ্বরিক প্রভাবে সৃষ্টি হয়নি, আর এগুলি কার্যকরী করার জন্য কোনো ঐশ্বরিক কর্তৃত্বের দরকার পড়েনি। যাঁরা এই সমাজ সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের যুক্তি ও সংবেদনশীলতার উপর ভিত্তি করে সমাজের জন্য যা সবচেয়ে ভালো, সাধারণভাবে স্বীকৃত সেইসব সহনশীলতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের ভাবনা, তারই উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এর কর্তৃত্ব। সেই কর্তৃত্বই আইনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব, যুক্তবাদী চিন্তা, বিতর্ক এবং আলোচনার মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছে সামাজিক মূল্যবোধ। কোনো একটি ধর্মসম্প্রদায়, জাত অথবা শ্রেণির জন্য নয়, গোটা সমাজের সমস্ত মানুষের নৈতিকতার ধারণাকে যুক্ত করার জন্য এটা দরকার ছিল।

এর মানে হলো এই যে, যে সব আইন ও সামাজিক মূল্যবোধের দ্বারা সমাজ পরিচালিত হয়, তাকে আইন হিসেবেই দেখতে হবে, পালন করতে হবে, কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে তা স্বীকৃত হবে না। জাত, ধর্ম নির্বিশেষে এই আইনের নিজস্ব ক্ষমতা আছে। ধর্মীয় ভাবনার সঙ্গে আলাদা আলাদা বিশ্বাস আর দেবতার প্রতি আস্থা এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা মিলেমিশে আছে। যদিও, সাধারণ আইনগুলির স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা ধর্মনিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভরশীল, এর জন্য কোনো ধর্মের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। অতএব, ধর্মনিরপেক্ষতা, যেমনভাবে কখনো কখনো বলা হয়ে থাকে—ধর্মকে অস্বীকার করা নয়, বরং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধর্মের কর্তৃত্বমুক্ত করা। এবং এই সংজ্ঞাকেই আমি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেব।

এই তত্ত্ব বিরাট অংশের মধ্যে আলোচিত হওয়ার বিবিধ ফলাফল দেখা দেয়। তার মধ্যে একটি হলো মানুষকে ধর্মীয়ভাবে সঠিক এমন ভাবনা থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার কথা বলা। আবার, এটা ধর্মীয় ভাবনাকে একেবারে বাতিল করে ছুঁড়ে ফেলার কথা বলে না, কিন্তু সামাজিক ব্যবহারকে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার কথা বলে। আগে যেমন ভয় ছিল যে এই ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনা মানুষকে অনৈতিক করে তুলবে তা আইনের সঙ্গে শাস্তির বিষয়টি যুক্ত হওয়ার ফলে অমূলক প্রমাণিত হয়েছে, কারণ আইনের শাস্তি এই জীবনে তাৎক্ষণিকভাবেই প্রযোজ্য হয়। অধিকাংশ ধর্মীয় নিয়মকানুনের মতো এই শাস্তি পরের জীবনের জন্য অপেক্ষা করে না। অতএব, এটা মানুষকে আইনের উপযোগিতা বুঝতে শেখায় এবং এই ভাবনা সবসময়ের জন্যই দরকারি। মানুষ যখন এর প্রয়োজন বুঝতে পারে, তখনই আইন মানার শক্তিও বৃদ্ধি পায়।

মানুষ যখন কোনো বিষয় বা ঘটনার কারণ নিয়ে ভাবে, তখনই বোঝা যায় সে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখেছে। চিন্তার জন্ম হয় শিক্ষা থেকে। এখানেই আসছে সমস্ত বিষয়কে একটি ঐশ্বরিক পরিকল্পনা হিসেবে দেখা এবং ঈশ্বরের বিধান বলে সব ছোটোখাটো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারার অক্ষমতার বিষয়টা। অতএব, শিক্ষা ধর্ম বা বিশ্বাস নির্ভর ভাবনা নিরপেক্ষ অথবা প্রমাণের উপর ভিত্তি করে চিন্তা করতে শেখায়। কিন্তু সামাজিক আইন রচনা শুরু হয় প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। কখনও কখনও তা কিছুটা কল্পনাবাহিত হয় কিন্তু শেষপর্যন্ত যুক্তি দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যায়। অতএব, আইনের ব্যাখ্যা ও এই বিষয়ের আলোচনা শিক্ষার একটি জরুরি অংশ হয়ে দাঁড়ায় এবং ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে ওঠার চিন্তাকে উন্মুক্ত করে।

ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছে মানুষের ব্যক্তিগত আবেগাশ্রিত প্রয়োজন থেকে। এরপর এটা বিস্তৃত হয় মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং তার বাইরে জগৎসংসার কেমন করে চলছে তার ব্যাখ্যায়। এই সবটাই তাকে অতিজাগতিক শক্তির দিকে নিয়ে যায়। এবং কৃতজ্ঞাতায় আনত করায়। ক্রমশ, এই ব্যক্তিগত ধর্ম জটিল ধর্মভাবনায় সংহত, সংগঠিত হয় এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলে সমাজ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রক ভূমিকা গ্রহণে উচ্চাভিলাষী করে তোলে। এই পরিবর্তনের ফলে ধর্ম তার নিজস্ব বিশ্বাস আর সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিয়ন্ত্রক ভূমিকার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের মাধ্যমে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। কোথাও কোথাও তার ক্ষমতা সরকারি কর্তৃপক্ষ তথা রাষ্ট্রের সমান সমান হয়ে ওঠে। এই বিষয়টিতে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধর্মের নিয়ন্ত্রণের থেকে আলাদা রাখতে চায়। এই পার্থক্যটা স্পষ্ট হওয়া দরকার কারণ প্রায়শই এই বিষয়টা আমাদের নজর এড়িয়ে যায় যখন আমরা বলি, ধর্মনিরপেক্ষতা সমস্ত রকম ধর্মীয় ভাবনাকেই অগ্রাহ্য করে।

ধর্মনিরপেক্ষতা অতঃপর আরেকটি অতিরিক্ত অর্থ বহন করে। রাষ্ট্রের যেমন ক্ষমতা আছে মানবসমাজ সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন আর তা পালন করার, তেমনি তাকে ধর্মের সাথে স্পষ্ট ফারাক বজায় রাখতে হবে, কারণ ধর্ম তার বিশ্বাস আর দেবতার কাছ থেকেই কেবল তার সব কাজের মান্যতা পায়, যোগ্যতা অর্জন করে। উভয়ের কর্তৃত্ব অর্জনের ক্ষেত্র স্পষ্টতই আলাদা।

সামাজিক আইন সমাজের মেরুদণ্ড। এই আইনের উচিত মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা রক্ষা করা আর নিশ্চিত করা যাতে কারো জীবনযাপন ও কাজকর্মের ক্ষেত্রে কোনোরকম বঞ্চনা বা পার্থক্য না এসে তাকে বিঘ্নিত করে। জীবনচক্রের সমস্ত ক্ষেত্র যেখানে আইনের দরকার পড়ে, যেমন, জন্মমৃত্যু রেজিস্ট্রেশন, বিবাহ এমনকি, বিবাহ বিচ্ছেন, সম্ভানসস্তুতির শিক্ষা যার মধ্যে দিয়ে তারা সামাজিক মানুষ হয়ে ওঠে, পেশা এবং চাকরি, উত্তরাধিকার, বিশেষত সম্পত্তির ক্ষেত্রে এই আইনি সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইসব বিষয়গুলি সাধারণ দেওয়ানি আইনের (Civil Law) আওতায় আসে। এই যোগাযোগটিকে কার্যকর করতে হলে, সামাজিক আইনগুলি যাতে জাতিধর্ম নিরপেক্ষভাবে ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা যা আধুনিক রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক মৌলিক সুযোগসুবিধার আওতায় পড়ে সেগুলি পাওয়ার উপযোগী হয়। যদি দেওয়ানি আইনগুলি সর্বজনীন ও সমান হয়, যা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে শেষপর্যন্ত হওয়া উচিত, তাহলে রাষ্ট্রের উচিত তা কার্যকর করার গ্যারান্টি তৈরি করা। এক্ষেত্রে কোনোরকম কোনো বিভাজন একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।

অতএব ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থায় ধর্মীয় কর্তৃত্বের ধারণা চালু থাকলে তাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। এটা কেবলমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হয়। এই বিতর্ক কখনও কখনও ওঠে ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো শক্তপোক্ত বেড়া নেই, কিন্তু তাদের মধ্যে পারস্পারিক আলোচনার মধ্য দিয়ে নীতিগত ফারাক বজায় রাখা যেতেই পারে। এর ফলে ধর্মীয় বিশ্বাসগুলির মধ্যে অথবা ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে অন্যতর ভারসাম্য তৈরির সুযোগ করে দেয়। আইনের সামনে যেহেতু সব ধর্মই সমান, যেহেতু আইন কোনো ধর্মের প্রাধান্যই সামগ্রিকভাবে স্বীকার করে না, সেহেতু রাষ্ট্রের কাছে সব ধর্মেরই সমান অধিকারের আইনি ব্যবস্থা থাকা দরকার। যদিও এই ভাবনার মধ্যে একটি মাত্রা নির্ধারণ করা আছে, যাতে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ সামাজিক আইনগুলি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ আর না পায়।

ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা

এটা সেই আলোচনা নয়, যেখানে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা সংজ্ঞায়িত হয় সবধর্মের সহাবস্থান নামে। কেবলমাত্র সহাবস্থানই এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়, কারণ এতদসত্ত্বেও পৃথক ধর্মের কারণে অসমব্যবহার করা হয়, এমনকি তাদের ছোটো করাও হয়ে থাকে। আইনের চোখে সহাবস্থান ও সমমর্যাদা অবশ্যই এক্ষেত্রে প্রথম ধাপ। কিন্তু এ প্রশ্ন তো আমাদের করতেই হবে যে আমরা কতদূর যেতে চাই এবং এর পরের ধাপটা কি।

এই সহাবস্থানের ভিত্তির উপর নির্দিষ্ট হওয়া সংজ্ঞা নানা কারণেই অসম্পূর্ণ যেহেতু ধর্মের এক্তিয়ার বা কর্তৃত্ব সম্পর্কে এর থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। এর উদ্দেশ্য অবশ্যই রাষ্ট্র আর ধর্মের মধ্যে কোনো বেড়া তৈরি করা নয়। এই ভাবনার লক্ষ্য দেওয়ানি ক্ষেত্রের অধীনে থাকা কার্যকলাপের সঙ্গে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনের এক্তিয়ারের সীমানা নির্দিষ্ট করা। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই সাম্য বজায় থাকা জরুরি—যেমন প্রয়োজন কোন আইনকে কোন কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করবে তা নির্দিষ্ট করা। সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে, ধর্মের সহাবস্থান আছে কিন্তু সাম্য এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি সত্য হিসেবে তেমনভাবে বিদ্যমান। নয়, এমনকি কেউ কেউ একথাও বলে থাকে এটা বাস্তবত অনুপস্থিত। এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকরা নিজেদের ধর্মীয় সংগঠন থেকে আবশ্যিক দূরত্ব বজায় রাখে না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা যেভাবে জানি এরা কখনও কখনও পরস্পরের মধ্যে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ।

কেউ কেউ একথা বলে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করে থাকে যে এটি একটি পাশ্চাত্য চিন্তা এবং ভারতবর্ষের সঙ্গে তা মেলানো যায় না। জাতীয়তাবোধ ও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও কি একই কথা বলা উচিত হবে, এগুলিও তো স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তা? আর নিশ্চয় করে নয়া উদার অর্থনীতির আন্তর্জাতিকতা পাশ্চাত্যের আরও গভীর পদচিহ্ন হিসেবে স্বীকৃত হবে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন করার অর্থ পাশ্চাত্য চিস্তার পদনত হওয়া নয়, বরং আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের পরিবর্তনকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। জাতি রাষ্ট্র হিসেবে এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান সময়ে এটা সারা বিশ্বের ভাবনাও বটে। আমরা গণতন্ত্রকে সবচেয়ে উপযোগী ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিয়েছি, যদিও এটা আমাদের কাছে একেবারে নতুন। আমি এভাবে যুক্তি দিতে চাইব যে, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গতিশীল রাখার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়।

এখন নির্দিষ্টভাবে ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখা যাক এবং অতীতে ধর্ম ও সমাজকে কিভাবে দেখা হতো তার সাথে তুলনা করে বর্তমানে আমাদের সময়ে একে কিভাবে দেখা হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করব। আমার যুক্তি হলো আমরা যেভাবে বিষয়গুলিকে উপলব্ধি করি, উপনিবেশবাদ তা থেকে আমাদের অনেকটা বিচ্যুত করেছে এবং আমরা প্রশ্নহীনভাবে তা মেনে নিয়েছে। যে কোনো উদ্দেশ্যমূলক সামাজিক পরিবর্তন যার বড়ো আকারের ফলাফল আছে তা সামলানো অনেকটা সোজা হয়ে যায় যদিও পূর্ববর্তী ইতিহাসের চেহারাটা কেউ ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে। দেখতে পায়। আজকের দিনটা, অবশ্যই, অতীতের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়। সমাজ ও ধর্মের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ভারতবর্ষে ধর্ম কিভাবে কাজ করেছে, সেই ভাবনা নিয়ে আমরা নাড়াচাড়া করেছি। এই ভাবনাগুলি এসেছে ভারতীয় ধর্ম সম্পর্কে ঔপনিবেশিক ধারণা থেকে, যা আমরা যথাযথ প্রশ্ন না করেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছি।

ধর্ম সম্পর্কে ঔপনিবেশিক ধারণা

ঔপনিবেশিক ধারণাগুলির ভিত্তি ছিল ইউরোপীয় সমাজের ধর্ম সম্বন্ধে ইউরোপীয়দের অভিজ্ঞতা। ইউরোপের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়শই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ব্যাখ্যা করা হতো চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সীমারেখা হিসাবে। এটিকে সাধারণত একের সঙ্গে অপরের সম্পর্ক হিসেবেই দেখা হতো, যেহেতু ধর্ম বলতে সেক্ষেত্রে একটি ধর্মকেই বোঝাতো। এই ভাবনা এত দৃঢ়ভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছিল যে অতীতে ক্যাথলিক বিশ্বাসকে যারা প্রশ্ন করত তাদের অবিশ্বাসী বলে কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো। তাদের কাউকে কাউকে পুড়িয়ে মারা হতো, আবার গ্যালিলিওর মতো অনেককে ইনকুইজিশনের সম্মুখীন হতে হতো। যদিও পরবর্তীকালে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম অনেকটা খোলামেলা হয়েছিল, কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই ঔপনিবেশিকদের সঙ্গে ধর্মের পরিচয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তারা ভারতীয় ধর্মকে বিচার করেছিল। ভারতীয় ধর্ম ও সমাজ সম্পর্কে সাম্প্রতিক চর্চা থেকে এটা মনে হয় যে এই বিষয়ে ঔপনিবেশবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক ছিল না এবং তার পুনরানুসন্ধান প্রয়োজন। ঔপনিবেশবাদী দৃষ্টিতে ভারতীয় সমাজকে দুইটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করে তার ছবি তুলে ধরা হয়েছিল হিন্দু ও মুসলমানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল দুটি একমুখী ধর্মীয় সত্তা হিসেবে যারা জন্মসূত্রেই পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। এবং তাদের এই পারস্পরিক শত্রুতার জন্য বাইরে থেকে কোনো শক্তির এদের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার বলে মনে করা হয়েছিল। এটাই ঔপনিবেশবাদী শাসনের সপক্ষে যুক্তি হিসাবে খাড়া করা হয়েছিল। যেভাবে অনেক ইতিহাসবিদ দেখিয়েছেন -ভারতবর্ষের ইতিহাসে, বিশেষত মধ্যযুগের ইতিহাসে দুটি ধর্মের ক্ষমতা দখল ও বিভাজনের ছবি আঁকা আছে। ঔপনিবেশিক নীতির ফলেই সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে সামাজিক সম্প্রদায়ের ভাবনা চালু হয়েছিল। এটিই পরবর্তীকালে একগামী ধর্মের ভাবনাকে সংহত করেছিল এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উৎসাহিত করেছিল। স্থায়ী সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর ভাবনা অবশ্যই গণতন্ত্রের পরিপন্থী। গণতন্ত্রে একটি বিশেষ মতকে যখন বেশিরভাগ লোক সমর্থন করে তখনই তাকে সংখ্যাগুরু বলা হয়, যারা এই সমর্থক দলে যোগ দেয় তারা আগে থেকে কোনো সংগঠিত দলভুক্ত হিসেবে পরিগণিত হয় না। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অতএব, কোনো পূর্বনির্ধারিত ধর্ম, জাতি অথবা ভাষাগত সত্তার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে না। বিষয়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জনভিত্তিও পরিবর্তিত হয়। সুতরাং সংখ্যাগুরু অথবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো স্থায়ী সদস্য হয় না।

উপনিবেশবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদীরা এই ছবির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছেন, কারণ বৃহত্তর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাকে সকলকে মিলিয়ে নিতে হয়, সব মতকে যুক্ত করতে হয় এবং তা করতে হয় একটা ভাগাভাগির ইতিহাসের উপর। ভাগাভাগির ইতিহাস খুব জটিল। এক্ষেত্রে আমি এরিক হবসমকে উদ্ধৃত করতে চাইব, যিনি বলেছেন, আফিমের নেশাগ্রস্তদের ক্ষেত্রে যেমন পোস্তদানা একটি ভূমিকা পালন করে, ইতিহাসও জাতীয়তাবাদ গঠনে ভূমিকা পালন করে। এটিই উৎস, এটিই সত্তা সম্পর্কিত ধারণার জম্মদাতা। উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একমুখী চরিত্রকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় না। এই ভাবনা এদের বৈরিতামূলক ভাবনাকে অস্বীকার করে ও সহাবস্থানের তত্ত্বের দিকে চোখ ফেরায়। এটিই তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার সংক্রান্ত ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ সফল হয় না। এর অন্যতম কারণ হলো ভারতীয় ধর্ম সম্পর্কে ঔপনিবেশিক ধারণাই এখন যাকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বলা হয়, তার মূল ভিত্তি, হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই ভারতবর্ষের এই সাম্প্রদায়িক দৃশ্যপট রচনা করেছে। অন্য কথায় বলতে গেলে, উপনিবেশবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদ এবং উভয় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ভারতীয় ধর্ম সম্পর্কিত উপনিবেশবাদী স্থাপত্যের উপরেই রচিত হয়েছে, যদিও প্রথমজনের ঋণ এক্ষেত্রে অনেক কম, আর দ্বিতীয়জন এই ভিত্তির উপরই তার ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এক শতাব্দীরও আগে, এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিল মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভা। এগুলি ধর্মীয় মৌলবাদ ছিল না, বরঞ্চ এগুলি ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সমাবেশ গড়ে তোলার আদর্শ। আজকের যুগে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, শিখ ও অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠন সকলেই আছে, একটি রাজনৈতিক এলাকায় প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য সামাজিক আইনগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্বিগ্ন ও উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস খণ্ডিত নয়, এটি বিভেদমূলক ও বৈরিতামূলক হয়ে উঠেছে। এজন্যই ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে লড়াই আসলে মিলিত ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করা আর একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতী করে তোলার অপপ্রয়াস মাত্র।

তাহলে আমরা তো এই প্রশ্নটা করতেই পারি যে, আগেকার যুগে কীভাবে ভারতীয় ধর্ম তার কাজ করত। আমরা কি আমাদের অতীতের দিকে বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকিয়ে দেখেছি? আমরা কি অতীতে ধর্মীয় সংগঠনগুলির ভূমিকা খতিয়ে দেখেছি? এই সংগঠনগুলি কেমন চেহারা নিয়েছে, কিভাবে তাদের কর্তৃত্ব প্রকাশ করেছে এবং সমাজের কোন অংশগুলি থেকে তারা সমর্থন পেয়েছে?

১৯শে আগস্ট ২০১৫, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে

আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার স্মৃতি বক্তৃতায় প্রদত্ত ভাষণ

অনুবাদ : মন্দিরা ঘোষাল


শেয়ার করুন

উত্তর দিন