সর্বগ্রাসী ক্ষমতার লালসায় সিক্কার এপিঠ ওপিঠ ....জয়দীপ মুখার্জী

৪ মার্চ, ২০২১ বৃহস্পতিবার

তৃতীয় পর্ব



আরএসএস -এর লক্ষ্যই হলো, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে ‘হিন্দু’ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। এই নিয়ে তাদের কোনো রাখঢাক নেই। তারা দেশের সংবিধান মানে না। সেটা নিয়েও তাদের তেমন লুকোছাপা নেই। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ‘হিন্দু জাতি’তে রূপান্তরের ভাবনাই আরএসএস -এর ‘হিন্দুত্ব’। ‘হিন্দু’ কারা, এই প্রশ্নের উত্তরে সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার তাঁর ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, অভিন্ন রাষ্ট্র, অভিন্ন ধর্ম, অভিন্ন জাতি, অভিন্ন সংস্কৃতি যাঁরা সিন্ধু নদের পাড়ের ভূখন্ডে হিমালয় থেকে ভারত মহাসাগরের উপকুল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসী তাঁরাই হিন্দু। তাঁর দ্বিজাতি তত্ত্বে বাকিরা দ্বিতীয় শেণীর নাগরিক। অর্থাৎ, হিন্দু ধর্মের বৈচিত্র্য, বিভাজন কে অগ্রাহ্য করে একীকরনের লক্ষ্যে ভারতের বহুত্ববাদকেই অস্বীকার করে আরএসএস। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের কোনও ভূমিকা ছিল না। ব্রিটিশ পরাধীনতা কখনই যে তাদের যন্ত্রনা নয়, সেটাও একেবারে পরিস্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন সঙ্ঘের আরেক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ গ্রন্থে। স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৩৯ -এ প্রকাশিত ঐ বইয়ের, ‘বাঞ্চ অফ থটস্‌’ অধ্যায়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের তোয়াক্কা না করে তিনি জানিয়েছিলেন, ভারতের জন্য তিনটি আভ্যন্তরীন হুমকি বহিরাগত অন্য যে কোনো বিপদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। সেগুলি হলো, মুসলমান, খ্রীষ্টান এবং কমিউনিস্টরা। সাভারকার এবং গোলওয়ালকার দুজনেরই দাওয়াই ছিল, জার্মানি বা ইতালিতে যেমন ইহুদি, বেদুইন, লিবিয়ান এবং কমিউনিস্টদের গণহত্যা করে ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল ভারতেও ‘হিন্দুত্বের’ লক্ষ্যে তেমনই কিছু করা উচিত। আরএসএস -এর এই লক্ষ্য পথে রাজনৈতিক হাতিয়ার হলো বিজেপি। আরএসএস’ই মুখ, বিজেপি হলো তাদের মুখোশ।

ধর্মনিরপেক্ষ ভারত’কে ‘হিন্দু’ রাষ্ট্র-এ রূপান্তর এবং একটা ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য পথে আরএসএস এবং বিজেপি উভয়েই তাদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি ঘটাতে তৎপর। কোন সন্দেহ নেই, এপ্রশ্নে তারা পরস্পরের পরিপূরক। বিশেষত ২০১৪ -এ কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার গঠিত হওয়ার পর তাদের বিস্তার উত্তরোত্তর বেড়েছে। আরএসএস -এর অভ্যন্তরীন রিপোর্ট হলো, দেশের ৩৭,১৯০ টি অঞ্চলে ৫৯,০০০ টি শাখা গঠন সম্পুর্ণ হয়েছে। শাখার ওপরে জনবসতির ঘনত্বের নিরিখে ৬০-৯০ টি বুথ নিয়ে একেকটি মন্ডল। দেশের ৬০ শতাংশ ব্লকেই এখন মন্ডল গঠনের কাজ সম্পুর্ণ। ২০২৪ -এর মধ্যে এই কাজ একশো শতাংশ করে ফেলা হবে। সারা দেশে আরএসএস -এর স্বেচ্ছাসেবী ৬০ লক্ষ (২০১৯ পর্যন্ত)। দেশের সেনা বাহিনী, প্রশাসনিক স্তর, বিচারালয়, ২৪ টি রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা সর্বত্র তাদের বিস্তার। প্রশাসনিক স্তরে বিভিন্ন পদে কর্মরত ৩০০০ স্বেচ্ছাসেবী। বিজেপি’র ছত্রছায়ায় আরএসএস বেড়ে উঠবে বা, ঠিক তার উল্টোটায় বিস্ময়ের কিছু না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিজেপি’র গরহাজিরাতেও কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের সংগঠনের বিস্তারে নিরবে সহায়তা করে যায় সেটা অবশ্যই আরএসএস -এর উপরি পাওনা। এখানেই আরএসএস এবং বিজেপি’র সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জীর সম্পর্কের অদৃশ্য রসায়ন।

বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেসের লাগাতার নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও ষড়যন্ত্রে আরএসএস-বিজেপি যে ওতপ্রোত ভাবে সহায়তা করেছিল এটা এখন আর কারও অজানা নয়। আরএসএস -এর অভ্যন্তরীন রিপোর্টেও এর উল্লেখ রয়েছে। মমতা ব্যানার্জীও কোনোদিন প্রকাশ্যে আরএসএস -এর আদর্শের বিরোধিতা করেননি। উপরন্তু তাঁর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এরাজ্যে আরএসএস -এর বিস্তার উত্তরপ্রদেশের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক। বৃদ্ধির হার ২৪ শতাংশ। তাদের অভ্যন্তরীন রিপোর্ট জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে আরএসএস -এর ১৭৪৬ টি শাখা দৈনিক কাজ করে চলেছে। এই শাখাগুলির সভ্যদের ৬০ শতাংশের বয়সসীমা ২০-৪০ বছরের মধ্যে। সদস্য বেড়েছে ৫০ শতাংশের কিছু বেশি। রাজ্যের ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী মোট পাঁচটি জোনে ভাগ করে তারা তাদের সাংগঠনিক কাজ চালাচ্ছে। এগুলি হলো, উত্তরবঙ্গ, রাঢ় বঙ্গ (দক্ষিণ-পশ্চিম), নবদ্বীপ (দক্ষিণ-মধ্য), হুগলী-মেদিনীপুর (দক্ষিণাংশ) এবং কলকাতা। গত ৫ বছরে এরাজ্যে আরএসএস ৩৩০ টি স্কুল খুলেছে। এতে নথিভূক্ত ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ৬৬,৫০০ জন। প্রত্যেকটি স্কুলেই আধুনিক পাঠ্যক্রমে পড়ানোর পাশাপাশি, আরএসএস -এর মতাদর্শগত প্রশিক্ষণ, আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ এবং হিন্দুত্বের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য, মমতা ব্যানার্জী সরকারের শিক্ষা দপ্তরের অনুমোদনক্রমে একেবারে কুঁড়ি থেকেই মগজ ধোলাইয়ের পাকা বন্দোবস্ত।

এ তো গেল একদম প্রথাভূক্ত শিক্ষার অন্দরে আরএসএস -এর বিস্তারের রিপোর্ট। প্রথাগত স্কুলের বাইরেও চলছে কয়েক হাজার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সরাসরি আরএসএস -এর আর্থিক আনুকুল্যে বিভিন্ন এনজিও (শাখা সংগঠন) -এর নামে চলা এরকম প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা বর্তমানে ৫৪০০ টি। শিশু বয়স থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত সকলের জন্য সেখানে পাঠের ব্যবস্থা। সরস্বতী বন্দনা, ভারত মাতার পুজা, ছত্রপতি শিবাজি ও রাণা প্রতাপ সিংহের গৌরব গাথা, রামায়ন, মহাভারত, মোঘলসহ ভারতের বিভিন্ন অহিন্দু শাসকের অত্যাচারের কাহিনী, সাভারকার-গোলওয়ালকারের লেখা বইয়ের অংশ সেখানকার পাঠ্য। ফ্রেন্ডস্‌ অফ ট্রাইবাল সোসাইটি (এফটিএস), শ্রী হরি সতসঙ্গ সমিতি (এসএইচএসএস), বনবাসী কল্যাণ আশ্রম (ভিকেএ), রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতী (আরএসবি) এর একেকটি পরিচালনার দায়িত্বে। বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরএসএস -এর ভাতাপ্রাপ্ত সংগঠকরা সেখানে ‘হিন্দুত্বের’ জন্য ‘চরিত্র নির্মাণ’ -এর কাজ করে চলেছেন। ইতিহাস চর্চার বৈজ্ঞানিকভিত্তিকে ধ্বংস করে দিয়ে অলীক, অযৌক্তিক, বিশ্বাস নির্ভর ইতিহাস ও বুদ্ধিবৃত্তির সাম্প্রদায়িকীকরণের আঁতুড়ঘরগুলির ষোল আনা শ্রীবৃদ্ধি মমতা ব্যানার্জীর নিরব সহায়তার বাস্তব প্রতিফলন।

গত ৫-৭ জানুয়ারি গুজরাটের আহমেদাবাদে আরএসএস -এর মহাসভায় সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভগবতের পৌরহিত্যে পশ্চিমবঙ্গসহ পাঁচরাজ্যের আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি’র রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ নিয়ে চুলচেরা আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় প্রাধাণ্য পেয়েছে এরাজ্যের নির্বাচন। সভা থেকে সাংগঠনিক বিন্যাস অনুযায়ী কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে বিজেপি’র পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনের প্রস্তুতিতে বিজেপি’র সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা’কে নির্ণায়ক দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস -এর বিস্তারে সকলেই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বলাই বাহুল্য, আরএসএস -এর এই সন্তোষ জ্ঞাপন আসলে মমতা ব্যানার্জীর প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরই নামান্তর।
VOLUNTEERS OF INDIA'S HARDLINE HINDU GROUP RASHTRIYA SWAYAMSEVAK SANGH (RSS) OR NATIONAL VOLUNTEERS CORPS, PRAY IN CALCUTTA.

বিভাজনের রাজনীতির প্রসারে সহায়ক একটা উর্বর জমি আরএসএস-বিজেপি’র বড্ড বেশি প্রয়োজন। একথা এখন কারো অজানা নয় যে, আরএসএস -এর ভরসাতেই কংগ্রেস ভেঙ্গে মমতা ব্যানার্জী নতুন দল তৈরি করেছিলেন। বিনিময়ে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বিজেপি’কে জায়গাও করে দিয়েছিলেন তিনি। তারপর কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রিসভায় রেলমন্ত্রীর পদলাভ এবং ২০০৪ পর্যন্ত বিজেপি’র প্রতিটি মন্ত্রিসভায় ঠাঁই লাভ আরএসএস -এর প্রতিদান। কিন্তু এই দান-প্রতিদানে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে সংগঠনের শ্রীবৃদ্ধি যে তেমন ঘটার নয় সেটা সঙ্ঘের নেতারা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন। কেননা, ব্রিটিশ আমলেই সতীদাহ রদ, বাল্য বিবাহ রদ, নারী শিক্ষার অধিকার, বিধবা বিবাহ এরকম অসংখ্য সমাজ সংস্কারমুখী আন্দোলনের পথ বেয়ে নবজাগরণের এই মাটিতে বিভাজনের বীজ ফলদায়ক নয়। দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা ছিল বামফ্রন্ট সরকার। সেটাও স্বাধীনোত্তর ভারতে শুরু হওয়া তেভাগা আন্দোলনের পথ বেয়ে শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারি-মহিলা-যুব সমাজের দীর্ঘ সংগ্রামে অনেক ঘাম রক্তের ফসল। তাই কৌশল বদলে গেল। অনেক নৈরাজ্য ও ষড়যন্ত্রের বিনিময়ে ২০১১ তে ‘পরিবর্তন’ সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল রাস্তা। রাজনৈতিক বিস্তারের চাইতেও সামাজিক পরিসরে সাংগঠনিক বিস্তার ঘটানোর প্রক্রিয়া শুরু হলো। রাম নবমী, শিবলিঙ্গের পুজা, গণপতি উৎসবের মতো ধর্মীয় পুজার প্রচার বাড়ানো হলো। পাহাড়ে পরিচিতিস্বত্তাকে ইন্ধন আর দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে এদেশে চলে আসা ছিন্নমূল পরিবারগুলির মধ্যে তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচার। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতের জাতীয়তা বিরোধী, হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্য সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে ভ্রান্ত প্রচার আরএসএস -এর বিভাজনের কৌশল। কোনও সন্দেহ নেই, বামপন্থীদের ওপর সরকারের ছত্রছায়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের হিংসাত্মক স্বৈরাচারি আক্রমণ তাদের পথকে সুগম করেছে। পাশাপাশি, মমতা ব্যানার্জীর তোষামদের রাজনীতিও আরএসএস-বিজেপি কে সুবিধা করে দিয়েছে। ২০১৯ -এর নির্বাচনে এর প্রতিফলন বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা গেছে। এরই প্রেক্ষাপটে আসন্ন নির্বাচনে অদৃশ্য বোঝাপড়ার রসায়নে রাজ্যে যুযুধান দুটি দল। দুদলেরই অভিন্ন লক্ষ্য বাম, গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে আরও দুর্বল করে দেওয়া। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং মানুষের তীব্র ক্ষোভ থেকে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সুযোগ নিতে বিজেপি-ও মরিয়া।

তাই এবার বিজেপি’র নতুন প্রচার কৌশল, রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে দরকার একই দলের ডাবল ইঞ্জিনের সরকার।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন