"আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়" - অঞ্জন বসু

জন্মের দ্বিশতবর্ষে শ্রদ্ধায় ও স্মরণে মহাকবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত

আজ যে মানুষটির জন্মদিন তিনি শুধু বিখ্যাত কবিই নন,তিনি একাধারে নাট্যকার এবং প্রহসন রচয়িতাও বটে ,এই মানুষটিই বাংলার কাব্য জগতে "সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের " প্রবর্তক,মূলত এই অমিত্রাক্ষর ছন্দেই তিনি রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে রচনা করেন তার শ্রেষ্ঠ রচনা "মেঘনাদ বধ মহাকাব্য " |

হ্যাঁ আজ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিন ,যিনি ১৮২৪ সালের ২৫ শে জানুয়ারী অবিভক্ত বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদিহি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ,বাবা রাজনারায়ণ দত্ত ও তার প্রথমা পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র পুত্র ছিলেন |

মধুসূদন দত্তের শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় তার মা জান্হবী দেবীর কাছেই, তিনি রামায়ণ,মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্যের সঙ্গে পরিচিত হন ,পরে পাশের গ্রাম শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুতফুল হকের কাছে তিনি বাংলা,আরবী,ফার্সী প্রভৃতি ভাষা শিক্ষা গ্রহন করেন |

তেরো বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং কলকাতায় থাকাকালীন কিছুদিন তিনি একটি স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং পরে হিন্দু কলেজ (বর্তমানে প্রেসীডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে) এ ভর্তি হন , মেধাবী ছাত্র হবার কারণে তিনি তৎকালীন ওই কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসনের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন , ওই কলেজেই গৌরদাস বসাক,রাজনারায়ণ বসু,প্যারীচরণ সরকার প্রমুখেরা ছিলেন তার সহপাঠী |

১৮৪৩ সালে তিনি রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়ের কাছে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের বিষয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং ওই বছরের ১৩ ই ফেব্রুয়ারি "ওল্ড মিশন চার্চ" নামে অ্যাংলিকান চার্চে মধুসূদন দত্ত খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন | পাদ্রী ডিলট্রি তার নামকরণ করেন "মাইকেল মধুসূদন দত্ত " | তাঁর এই ধর্মান্তরিত হবার বিষয়টি তৎকালীন সমাজে তুমুল আলোড়ন ফেলে দেয়,এবং তাঁর পিতা রাজনারায়ণ দত্ত একমাত্র পুত্রকে "ত্যাজ্যপুত্র " করেন |এই সময়ে মধুসূদন দত্ত শিবপুরের বিশপস কলেজে ভর্তি হন,রাজনারায়ণ তাকে ত্যাজ্যপুত্র করলেও চারবছর তার শিক্ষার ব্যয়ভার গ্রহণ করেছিলেন,কিন্তু চারবছর পরে তিনি অর্থসাহায্য করা বন্ধ করে দেন |

এই কলেজে পড়াকালীন তার সঙ্গে কয়েকজন মাদ্রাজীর বন্ধুত্ব হয় ,পড়া শেষ করেও তিনি চাকরী যোগাড় করতে ব্যর্থ হন তখন তিনি মাদ্রাজীদের সঙ্গে মাদ্রাজে চলে আসেন |

এখানেই কিছু খ্রীষ্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরী পান ,কিন্তু বেতন খুব একটা বেশি ছিলো না বলে তিনি অর্থকষ্টের সম্মুখীন হন ,এই সময়ই মাইকেল মধুসূদন দত্ত "দ্য ক্যাপটিভ লেডি " নামক কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন |

এখানে থাকাকালীন তিনি রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে ইংরেজ যুবতীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ,উভয়ের সম্পর্ক ছিলো মাত্র আটবছর , কিছুদিন পরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এমিলিয়ে হেনরিয়েটা সোফিয়া নামে এক ফরাসী যুবতীকে বিবাহ করেন ,তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো আমৃত্যু , এইসময়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার দ্য ক্যাপটিভ লেডির এক কপি তার গৌরদাস বসাককে পাঠান ,যা পড়ে উচ্ছ্বসিত হন জে ই ডি বেথুন ,তিনি মধুসূদন দত্তকে পরামর্শ দেন ফিরে এসে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে এবং ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলকাতায় ফিরে আসেন |

যাইহোক মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংল্যান্ডে যান,কিন্তু সেখানের জলবায়ু ও বর্ণবৈষম্যের কারণে ১৮৬০ সালে তিনি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে চলে যান | বিদেশে থাকাকালীন মাইকেল মধুসূদন দত্ত খুব ই অর্থকষ্টের সম্মুখীন হন,দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়েন তখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এর আর্থিক সাহায্যে তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা সমাপ্ত করে ভারতে ফিরতে সফল হন |

সাহিত্যকর্ম :

কাব্যগ্রন্থ :

"বীরাঙ্গনা (কাব্যগ্রন্থ)

ব্রজাঙ্গনা

দ্য ক্যাপটিভ লেডি

মহাকাব্য :

মেঘনাদ বধ কাব্য

সনেট

চতুর্দশপদী কবিতাবলী

নাটক :

শর্মিষ্ঠা

কৃষ্ণকুমারী

মায়াকানন

পদ্মাবতী

প্রহসন

বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ

একেই কি বলে সভ্যতা প্রভৃতি |

বাংলা ভাষায় যে নতুন ধারা ও ছন্দের প্রবর্তন করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার জন্যে বাংলাভাষা ও বাঙালী চিরদিনই তাঁর কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবে |

আজ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ২০১ তম জন্মদিনে তাকে জানাই প্রণাম ও শ্রদ্ধান্জলি |

"জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে

চিরস্থির কবে নীর হায় রে জীবন নদে "


শেয়ার করুন

উত্তর দিন