Lenin-Cover

আজকের সময় ও মতাদর্শগত সংগ্রাম

সূর্যকান্ত মিশ্র

মতাদর্শ সম্পর্কে কিছু আলোচনার জন্য আমাকে বলা হয়েছে।

মতাদর্শ একটি বিশাল প্রসঙ্গ, একটি বক্তব্যে তার বিশদ আলোচনা করা কঠিন। কিন্তু মূল কয়েকটি কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে, সেগুলিই আমার বক্তব্যে তুলে ধরার চেষ্টা করব। বর্তমান দুনিয়া, আমাদের দেশ ও রাজ্যের পরিস্থিতি অবস্থা বদলের দাবি জানাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতেই মতাদর্শগত প্রশ্নের সংগ্রামকে আমরা কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তাকে উপলব্ধি করতে হবে।

মতাদর্শের কয়েকটি উপাদান রয়েছে। দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে শুরু করে নন্দনতত্ত্ব অবধি সবই মতাদর্শের অন্যতম উপাদান। এই সকল উপাদানকে আলাদা করে বিচার করা হোক কিংবা সামগ্রিকভাবে মতাদর্শকে বিবেচনা করা হোক না কেন, মনে রাখতে হবে এগুলির কোনটিই কখনো শ্রেণী নিরপেক্ষ হয় না। শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় যে কোনও মতাদর্শ শেষ অবধি হয় শোষণ ও শাসকের পক্ষে দাঁড়ায় নাহলে শোষিত-বঞ্চিতের পক্ষ নেয়।

socialism

আমরা স্পষ্ট ভাষায় সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে। মনে রাখতে হবে সর্বহারা ও শ্রমিক শব্দদুটি সমার্থক নয়। সামগ্রিক অর্থে শ্রমজীবী বলতে কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত সবাইকে একসাথে বোঝায়। এই বিরাট অংশের মানুষ যারা শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত হচ্ছেন তাদের মুক্তির দর্শন ও শাসকের দর্শন এক হতে পারে না। এটা উপলব্ধি করতে হয়।

আমাদের মতাদর্শকে আমরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বলি।  ১৮৪৪-৪৫ নাগাদ মার্কস-এঙ্গেলস একসাথে যে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক সংগ্রাম করেছিলেন তখনই মার্কসবাদের নির্মাণ হয়েছিল বলে ধরা হয়। পরবর্তীকালে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময় মার্কস-এঙ্গেলসের সময় থেকে পুঁজিবাদ যেভাবে সাম্রাজ্যবাদের স্তরে পৌঁছেছিল তার ব্যখ্যা করলেন লেনিন। তিনি চিহ্নিত করলেন সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর। এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি তাতে সাম্রাজ্যবাদের ঐ ব্যখ্যায় উল্লিখিত দুয়েকটি বিষয়ের কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। তখনকার পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরে কোন কোন দ্বন্দ্ব কাজ করছে সেগুলিকে লেনিন সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর ব্যখ্যায় ছিল সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরস্থ কোন কোন দ্বন্দ্ব ক্রমাগত তীব্র থেকে তীব্রতর হবে এবং তারই পরিণতিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। এহেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা করতে হবে এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই ঐ যুদ্ধ পরিস্থিতিকে ব্যবহার করতে হবে। এই কাজ করতে হবে শ্রমিক, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষের রাজ কায়েম করতে, বিপ্লবের স্বার্থে। এ কারণেই মার্কসবাদের সাথে লেনিনবাদ কথাটি যুক্ত হয়। আমরা এদুটি শব্দকে আলাদা করে বিবেচনা করি না, তাই মতাদর্শ বলতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ একসঙ্গে উচ্চারিত হয়।

এই মতাদর্শের লক্ষ্য কী সমাজ বিপ্লব সম্পন্ন করা। সে বিপ্লবের লক্ষ্য হবে প্রথমে সমাজতন্ত্র ও পরে শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজ বা কমিউনিস্ট সমাজ প্রতিষ্ঠা। সমাজতন্ত্র বলতে বোঝায় যে ব্যবস্থায় প্রত্যেকে নিজের কাজ অনুযায়ী যথাযথ মজুরী পাবে। সাম্যবাদেও সকলে কাজ করবে, কিন্তু মজুরি হিসাবে পাবে যতটা তাদের প্রয়োজন। এমন সমাজ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে সেই প্রশ্নে এখনই কোনও ধারণা দেওয়া সম্ভব না, তবে বলা যায় এ এক দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসাবে গড়ে উঠবে।

মনে রাখতে হবে আমাদের মতাদর্শ কোনও আপ্তবাক্য নয়। একে মুখস্ত করে বললেই চলে না, আমাদের মতাদর্শ হল এগোনোর রাস্তায় পথনির্দেশিকা। এই মতাদর্শ শেখায় বস্তুজগত সতত গতিশীল, সেই গতির ভিত্তিতেই সমস্ত কিছুকে বিবেচনা করে নির্ধারণ করতে হয় সামাজিক শক্তি হিসাবে কোনটি বিকাশমান আর কোনটি ক্ষয়িষ্ণু। অনড়, অটল, স্থির সত্য গোছের কোনকিছুতে এই কারণেই আমরা আস্থা রাখি না।

এই মতাদর্শের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের ধারণা মার্কস, এঙ্গেলস বা লেনিনের আবিষ্কার নয়। তাদের জন্মের আগে থেকেই শব্দগুলি প্রচলিত ছিল, যদিও তখনকার অবস্থায় সমাজতন্ত্র ছিল কাল্পনিক মতবাদ। মার্কসবাদী দর্শন হল বৈজ্ঞানিক অর্থাৎ বিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সঙ্গতি রেখেই এই মতাদর্শ এগিয়েছে। বিজ্ঞানের বিকাশ কখনো এক জায়গায় স্থির থাকে না, তাই মতাদর্শও সময়োপযোগী পথনির্দেশিকা হিসাবে সামনের দিকে এগোয়। এই কারণেই একসময় যা ছিল মার্কসবাদ তাকেই পরবর্তীকালে মার্কসবাদ - লেনিনবাদ বলা হল। আজকের দিনে লেনিনের যুগের মতো করে সাম্রাজ্যবাদী পরিস্থিতির ব্যখ্যা, বিশ্লেষণ করলে চলে না। আজকের পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব স্তিমিত অবস্থায় রয়েছে, অবশ্য এর অর্থ যে ঐ দ্বন্দ্ব একেবারে শেষ হয়ে গেছে এমনটা নয়। ভবিষ্যতে ঐ দ্বন্দ্ব আবার মাথাচাড়া দিতে পারে, তেমন পরিস্থিতিতে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লব সম্পন্ন করতে লেনিনের শিক্ষাকেই পুনরায় প্রয়োগ করা হবে। এ কারণেই আমরা বলি মতবাদ, মতাদর্শ নিজেই একটি বিকাশমান বিষয়।

এ সম্পর্কে একটি জরুরি উদাহরণ মনে রাখা যায়। মার্কস এঙ্গেলসের যুগে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে দর্শনের জগতে বস্তুবাদ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল। ফয়েরবাখ যেমন ছিলেন তেমনই অন্যান্য বস্তুবাদী দার্শনিকরাও ছিলেন।  ঐ যুগের দাবী অনুসারেই মার্কস এঙ্গেলস নিজেদের কাজে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে তুলে ধরেন। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কারের সুবাদে বস্তুবাদী দর্শন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। মনে রাখতে হয় ঐ সময় নিউটনীয় বলবিদ্যার পরিসর অতিক্রম করে পদার্থবিদ্যার নতুন শাখা হিসাবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবিষ্কৃত হচ্ছে। সমসাময়িক গণিত চর্চার প্রভাবও তার উপর পড়েছিল। এই সমস্ত আবিষ্কার বিজ্ঞানে বস্তুর অস্তিত্ব এবং দর্শনের প্রশ্নে বস্তুবাদকে আক্রমণ করেছিল। অনেকেই অবস্থাকে পদার্থবিদ্যার সংকট বলে চিহ্নিত করেছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে মাখের দর্শনচিন্তার বিরোধিতা করে লেনিনকে 'বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ বিচারবাদ' লিখতে হয়েছিল। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ইতিহাসে লেনিনের লেখা এ বইটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। লেনিন সিদ্ধান্ত টানলেন এই বলে যে ঐ পরিস্থিতি বিজ্ঞানের সংকট না আসলে বিজ্ঞানের জগতে বিপ্লবকেই নির্দেশ করছে। ঐ পরিস্থিতির অনুসারী হয়েই বিংশ শতাব্দীতে 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব' লেখা হয়েছিল।

লেনিন অবশ্য দ্বন্দ্বতত্ত্ব ও বস্তুবাদকে আলাদা আলাদা করে বিচার বিবেচনা করেননি। হেগেল ও ফয়েরবাখ নিজেদের দর্শনচিন্তার নিরিখে একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এদুটিকে মেলানো যাচ্ছিল না। মার্কস এঙ্গেলস সেই কাজ সম্পন্ন করেন। লেনিন বললেন দ্বন্দ্বতত্ত্বই হল বস্তুবাদ - ডায়ালেক্টিক্স ইজ মেটিরিয়ালিজম। আমরা যখন পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে সত্যের সন্ধান করি তখন এই উপলব্ধিকে মাথায় রেখেই এগোতে হয়। আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্যালেস্তাইন, লেবানন, সিরিয়াকে ঘিরে যা চলছে, আরব দেশসমূহের পাশাপাশি সারা পৃথিবীতে তার প্রভাব পড়ছে। আফ্রিকায় প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা লুঠ রুখে দিয়ে ফরাসী সেনাবাহিনীকে ফিরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমাদের চারপাশে শ্রীলঙ্কার উদাহরন যেমন রয়েছে, তেমনই বাংলাদেশের উদাহরণও রয়েছে। এসমস্ত ঘটনার মধ্যে থেকেই সত্যকে টেনে বের করে আনতে হয়। টেনে আনার পরে কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে সেটিই সত্য? এই হল সত্য অন্বেষণের পরবর্তী ধাপ। আমাদের মনে রাখতে হয় একমাত্র প্রয়োগের অভিজ্ঞতাতেই সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়, প্র্যাকটিস ইজ দ্য ক্রাইটিরিয়ান অফ দ্য ট্রুথ।

আজকের অবস্থাটি কেমন? দুনিয়াজোড়া উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইতালি, জার্মানিতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তাকে সাধারণভাবে ফ্যাসিবাদ বলা হত। সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের বৈঠকে বিস্তৃত আলোচনা, বিতর্ক চলেছিল। ঐ পরিস্থিতির মোকাবিলায় কমিউনিস্টদের রণনীতি কি হবে, রণকৌশল কী হবে এসবই ছিল আলোচনার বিষয়, বিতর্কের প্রসঙ্গ। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে এ বিতর্কের নিষ্পত্তি হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তিকে একযোগে লড়াই করতে হবে। ঐ পরিস্থিতির সাথে আজকের অবস্থার একটি মিল হল এই যে আরেকবার ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ঘটছে, যদিও এখনকার অবস্থায় বিপদকে নয়া-ফ্যাসিবাদ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় তার অন্যতম উদাহরণ। আজকের পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট কী? তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে পরস্পর বিরোধী অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। আজ সে অবস্থা নেই, ঐ পরস্পর বিরোধী অন্তর্দ্বন্দ্ব স্তিমিত হয়ে রয়েছে। এর কারণ পুঁজি নিজের দেশীয় চরিত্র, জাতীয় পরিচিতি ইত্যাদি ঝেড়ে ফেলে আন্তর্জাতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। একে কেন্দ্র করেই নয়া উদারবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই আজকের বিপদ আজকের বৈশিষ্ট অনুযায়ী আগেকার ফ্যাসিবাদ নয়, নয়া ফ্যাসিবাদ। একে মোকাবিলা করতে আজকের পরিস্থিতিতে মতাদর্শের লড়াই আজকের দাবী অনুযায়ী হবে।

আগেকার অবস্থার সাথে আজকের পরিস্থিতির কিছু সাধারণ চরিত্র রয়েছে। এগুলিকেও আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। অন্যতম সাধারণ বৈশিষ্ট হল যা কিছু সত্য তাকে চাপা দিতে বারংবার মিথ্যা বলে যাওয়া। এই কৌশলে মিথ্যাকেই সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া। আগেকার পরিস্থিতির সাথে আজকের তফাৎ হল এই যে তখন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের দেশগুলি দুটি পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, আজ তার সকলে একপক্ষে রয়েছে। মনে রাখা উচিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে ন্যাটো গর্বাচেভকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা পূর্ব গোলার্ধে আর এক ইঞ্চিও এগোবে না। সে চুক্তি ভেঙেই তারা ইউক্রেনে যুদ্ধ চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেই বারংবার মনে রাখতে হয় নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ। তাই ইতিহাস আঁকড়ে ধরে একই কথা বলে যাওয়া না, পরিস্থিতি কখনো এক জায়গায় দাঁড়ায় থাকে না। পরিস্থিতি সবসময় জটিল থেকে জটিলতর হওয়ার দিকে এগোয়।তাই তার বিচার, বিশ্লেষণ ও মোকাবিলার পথও আগের অবস্থার পুনঃপ্রয়োগ হবে না, আজকের মত করেই তা সম্পাদিত হতে হবে।

মোকাবিলার পথে বাধা কী? ধর্ম, জাতি, বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ  ইত্যাদিকে ভিত্তি করে মানুষের ঐক্যকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। হিটলার, মুসলিনিরাও এমন চেষ্টা করেছিল। আমরা এসবের বিরুদ্ধে। আমরা জাতির পরিচিতির বদলে আন্তর্জাতিক পরিচিতিকে ভিত্তি করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই। মুক্তি সংগ্রামের প্রশ্নে আমাদের অবস্থান সারা দুনিয়ার সাধারণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সকলের সংগ্রামী ঐক্যের পক্ষে। একদিকে মানুষকে বিভাজনের জন্য চক্রান্ত, আরেকদিকে তাদের ঐক্য বজায় রাখার লড়াই। তাই ঐ নিপীড়ন, অত্যাচার, বঞ্চনার বিরুদ্ধে দুনিয়াজুড়ে সমস্ত শক্তিকে এক করতে হবে। এই ঐতিহাসিক শিক্ষার কোনও পরিবর্তন হয়নি। তখন হিটলার, মুসোলিনির বিরুদ্ধে স্টালিন, রুজভেল্ট ও চার্চিল একজায়গায় এসেছিলেন। আজকের পরিস্থিতি পুনরায় তেমন কিছুর দাবী তুললে আবার তেমন বন্দোবস্ত করেই সামনে এগোনো হবে।

ধর্ম সম্পর্কে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা আমাদের জন্য এক বিষয় না। ব্যক্তির ধর্মাচরণের অধিকারকে আমরা স্বীকার করি।  ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে ভারতীয় অভিজ্ঞতা হল রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মের কোনও হস্তক্ষেপ থাকবে না। সাম্প্রদায়িকতা আসলে মানুষকে একে অন্যে থেকে আলাদা করে রেখে শাসন করার রাজনীতি। আর তাই মতাদর্শগত সংগ্রামে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় লড়াই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। এই প্রশ্নে আমরা রবীন্দ্রনাথ ও ইকবালের লেখা কয়েকটি লাইন মনে রাখতে পারি।

আমরা কি ভুলতে পারি ইকবালের কলম থেকেই বেরিয়েছিল 'সারে জাহানসে আচ্ছা, হিন্দুস্তান হামারা'?

রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন

ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে...

এই কবিতাটির শেষে তিনি আমাদের জন্য যে প্রশ্ন রেখেছেন সেটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-

আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে

হেনেছে নিঃসহায়ে,

আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে

বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে

কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।

কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,

অমাবস্যার কারা

লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে,

তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে--

যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।

এর উত্তরও তিনি দিয়ে গেছেন।

আমরা সেই উত্তর থেকে আজকের পরিস্থিতির মোকাবিলায় ভরসা পাই, পথনির্দেশও খুঁজে পাই।

ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির

মূক সবে-ম্লানমুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর

বেদনার করুণ কাহিনী; স্কন্ধে যত চাপে ভার-

বহি চলে মন্দগতি, যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার,—

তার পরে সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি’;

নাহি ভর্তসে অদৃষ্টেরে, নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি,

মানবেরে নাহি দেয় দোষ, নাহি জানে অভিমান,

শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোন মতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ

রেখে দেয় বাঁচাইয়া! সে অন্ন যখন, কেহ কাড়ে,

সে প্রাণে আঘাত দেয় গর্ব্বাদ্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে,

নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে,

দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে,

মরে সে নীরবে! এই সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে

দিতে হবে ভাষা, এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে

ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে-

মুহূর্ত্ত তুলিয়া শির একত্র দাড়াও দেখি সবে!

যার ভয়ে তুমি ভীত, সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,

যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে;

যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার,—তখনি সে

পথ-কুকুরের মত সঙ্কোচে সত্রাসে যাবে মিশে;

গণশক্তি পত্রিকার ৫৯তম প্রতিষ্ঠা দিবসে বক্তৃতা


শেয়ার করুন

উত্তর দিন