সার্বজনীন মানবাধিকার দিবস (১০ ডিসেম্বর ২০২০) প্রসঙ্গে রাজ্য পার্টির নোট

এবারের সার্বজনীন মানবাধিকার দিবস (১০ ডিসেম্বর ২০২০)

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির নোট

স্বাধীনতা, সমতা ও মর্যাদা সহকারে জীবনযাপনের অধিকারই মানবাধিকার। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের আধুনিক ধারণাগুলি সামাজিক অগ্রগতির সূত্রেই বিকশিত হয়েছে। তবে মানবাধিকারের ধারণাগুলি সমসাময়িককালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আলোচ্য হয়ে উঠে রাষ্ট্রসংঘের ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস’ বা ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ’-র সূত্রে।

ফ্যাসিবাদ , নাৎসিবাদের ভয়াবহতা এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা মানবাধিকারের ধারণাগুলিকে নতুন তাৎপর্য দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তরাষ্ট্রীয় সংগঠন রাষ্ট্রসংঘ এগিয়ে আসে। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বরে গৃহীত হয় ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ’। মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার আবিশ্ব প্রযোজ্য নতুন মানদন্ড।

সনদে যথার্থ্ভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে, মানবাধিকার শুধু সার্বজনীন নয়, তা অবিভাজ্যও। একটি ন্যায়সঙ্গত, ধর্মনিরপেক্ষ, সহিষ্ণু সমতাভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে মানবাধিকার সনদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এপর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ভাষায় সনদের অনুবাদ হয়েছে। মানবাধিকার সনদের গ্রহণযোগ্যতা বোঝা যায় এই তথ্য থেকে।

মানবাধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রসংঘ প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর দিনটিকে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

 মানবাধিকার সনদ: তিরিশটি অনুচ্ছেদ

তিরিশটি অনুচ্ছেদে বিন্যস্ত মানবাধিকার সনদ জাতি ধর্ম  দেশ কুল গাত্রবর্ণ ভাষা নির্বিশেষে সব মানুষের মানবাধিকারগুলি চিহ্নিত করা এবং রক্ষা করার লক্ষ্যে এক ঐতিহাসিক দলিল।

মানবাধিকার সনদের বিচারে  সব মানুষই জন্মসূত্রে স্বাধীন এবং সম মর্যাদা সম অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহন করেছে। আইনের চোখে সবাই সমান।

গোত্র (রেস) ধর্ম বর্ণ শিক্ষা ভাষা রাজনৈতিক বা অন্যবিধ মতামত নির্বিশেষে মানবাধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। কারও ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবে না।

মানবাধিকার সনদে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যক্তিরই জাতীয়তার (‘ন্যাশনালিটি’) নাগরিকত্বের অধিকার রয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্র  ইচ্ছামত কোন ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে বা রাষ্ট্রহীন করে দিতে পারে না।

জীবনস্বাধীনতা এবং দৈহিক নিরাপত্তায় প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে। কাউকে অধীনতা বা দাসত্বেআবদ্ধ করা যাবে না। (অনুচ্ছেদ ৪,৫)

সনদ অনুযায়ী, আইনের চোখে সবাই সমান এবং ব্যক্তি নির্বিশেষে সকলেই আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে। কাউকেই খেয়ালখুশিমত গ্রেপ্তার বা আটক কিংবা নির্বাসন দেওয়া যাবে না।

মানবাধিকার সনদে বলা হয়েছে, ধর্ম গোত্র ও জাতি নির্বিশেষে প্রত্যেক পূর্ণ বয়স্ক নারী ও পুরুষের বিবাহের অধিকার রয়েছে। বিয়েতে ইচ্ছুক নরনারীর স্বাধীন এবং পূর্ণ সম্মতিতেই কেবল বিয়ে সম্পন্ন হবে। বস্তুতপক্ষে মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, প্রত্যেক ব্যক্তির ইচ্ছামত ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে; ইচ্ছামত  ধর্মান্তরের অধিকারও রয়েছে (১৮তম অনুচ্ছেদ)।

মানবাধিকার সনদের ১৯তম অনুচ্ছেদ, বাকস্বাধীনতা, তথ্যের অধিকার এবং তথ্যবিনিময়ের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।  অন্য একটি অনুচ্ছেদে সনদ ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।

মানবাধিকার সনদ যেমন সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে তেমনই মানুষের স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ বিকাশের জন্য অর্থনৈতিক সামাজিক ও  সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহের স্বীকৃতিকে অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেছে।

তেইশতম অনুচ্ছেদ তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির কাজের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ন্যায্য বেতন এবং সম কাজে সম বেতনের অধিকার এবং ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত করার অধিকার।

মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী বিশ্রাম এবং অবসর অন্যতম মানবাধিকার। কাজের সময়সীমা হবে যুক্তিসম্মতভাবে সীমিত (চব্বিশতম অনুচ্ছেদ)।

পঁচিশতম অনুচ্ছেদ বলছে: ‘‘প্রত্যেকেরই নিজের ও নিজ পরিবারের জন্য খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সমাজকল্যাণমূলক পরিষেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

শিক্ষার অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে। বলা হয়েছে, অন্ততপক্ষে প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা  হবে অবৈতনিক। প্রাথমিক শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক। কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে লভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সকলের জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে। শিক্ষা সংক্রান্ত পুরো অনুচ্ছেদটাই নীতিগতভাবে শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ এবং পণ্যিকরণের বিরোধী।

একটি বিকাশমান ধারণা

সমাজের মতো অন্য অনেক মূল্যবোধ ও ধারণার মতো মানবাধিকারও একটি বিকাশমান ধারণা। ১৯৪৮ সালে যখন মানবাধিকার সনদ আলোচিত ও গৃহীত হয় তারপর থেকে দুনিয়া অনেক বদলেছে। সনদের তিরিশটি অনুচ্ছেদেই মানবাধিকারের শেষ কথা বলা হয়ে গেছে তা দলিলের প্রণেতারাও বলে যাননি।

পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রসংঘ অনেক কিছুই গুরুত্ব দিয়েছে যেগুলি মানবাধিকার সনদের অনুসারী অথবা সেগুলির মতোই  গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, উদ্বাস্তুদের অধিকার ও  পুনর্বাসনের আন্ত:রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসূচক দলিল ১৯৫১ সালে গৃহীত ‘রিফিউজি কনভেনশন’, ১৯৬৫ সালে গৃহীত সব ধরনের জাতিগত বৈষম্য সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দলিল (কনভেনশন), ১৯৬০ সালে রাষ্ট্রসংঘে গৃহীত ঔপনিবেশিক মুক্তি সংক্রান্ত প্রস্তাব, ১৯৬৬ সালে গৃহীত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত এবং অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত দুটি আন্তর্জাতিক দলিল,  ১৯৭৯ সালে গৃহীত মহিলাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত  দলিল (কনভেনশন), ১৯৮৯ সালে গৃহীত শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত দলিল (কনভেনশন),১৯৯০ সালে গৃহীত মাইগ্রান্ট ওয়ার্কার্স ও তাদের পরিবারবর্গের অধিকারসমূহ সুরক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দলিল (কনভেনশন), ১৯৯২ সালে গৃহীত জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভূক্তদের অধিকার সংক্রান্ত সনদ, ২০০১ সালে গৃহীত সার্বজনীন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংক্রান্ত সনদ, ২০০৭ সালে গৃহীত প্রতিবন্ধীদের অধিকার সংক্রান্ত দলিল (কনভেনশন)।

লিঙ্গ বৈষম্যের প্রশ্নে এল-জি-বি-টি-দের মানবাধিকারের বিষয়টি এখন রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চেও গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হচ্ছে। ১৯৭৯ সালে মহিলাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যেরপ্রতিকার চেয়ে যে দলিল গৃহীত হয়েছিল সেই দলিল এল-জি-বি-টি-দের প্রতি বৈষম্যের মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। ওপরের তালিকা থেকে স্পষ্ট যে সময় অতিক্রমের সঙ্গে সঙ্গে ‘অধিকার’র ধারণারও সময়োপযোগী করা আবশ্যক হয়ে পড়ছে। এটাই স্বাভাবিক।

রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চেই যেমন  উঠে এসেছে এই মত যে দারিদ্রই মানবাধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মানবাধিকার রক্ষা করতে হলে দারিদ্র দূর করতে হবে। সুস্থায়ী উন্নয়ন যে কারনে বৈষম্যহীন অন্তর্ভূক্তিমূলক (‘ইনক্লুসিভ’) উন্নয়নের কথা বলে।

 নয়া উদারবাদ পর্বে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমী দেশগুলি মানবাধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে মুখেসক্রিয় থাকলেও কাজে নিজেদের দেশের নাগরিকদের জন্য সামান্যই বাস্তবায়িত করে। কিন্তু  পরিস্থিতি ভীষণই বদলে যায় নয়াউদারবাদ পর্বে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন খোদ রাষ্ট্রসংঘকেই অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে চায়। পদে পদে মানবাধিকার সনদকে লঙ্ঘন না করে বিশ্বায়ন প্রকল্পের অগ্রগতি সম্ভব নয়।

নয়া উদারবাদ রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক ভূমিকাকেই কাঠামোগতভাবে লঘু করে দিতে চায়। দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচার তার অনিবার্য অভিমুখ। এক অর্থে, নয়া উদারবাদ কাঠামোগতভাবে মানবাধিকার সনদের বিরোধী। করোনা পর্বে অতিদক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তি শাসিত দেশগুলির পরিণতি দেখলে তা স্পষ্ট হবে।

 ভারত ও মানবাধিকার

ঔপনিবেশিকতাবিরোধী সংগ্রামের মহান ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ সদ্যস্বাধীন ভারত ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ’-র প্রথম স্বাক্ষরকারীদের অন্যতম। পরবর্তীকালে ‘রিফিউজি কনভেনশন’ বাদে  মানবাধিকার সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘ-গৃহীত ক’টি দলিলেও ভারত স্বাক্ষরকারী। সেই হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্যসরকারগুলি নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারগুলির পূর্ণ বাস্তবায়নে দায়বদ্ধ।

‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ’ যখন রাষ্ট্রসংঘে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর গৃহীত হয় তখনও স্বাধীন ভারতের সাধারণতান্ত্রিক সংবিধান গৃহীত হয়নি। গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়নের কাজ চলছে। ভারতীয় সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর। বস্তুতপক্ষে স্বাধীন ভারত নিজস্ব সংবিধান চুড়ান্ত করার আগেই রাষ্ট্রসংঘের ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ’-কে গ্রহণ করেছে। ভারতীয় সংবিধানের বয়ানে ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ’-এর সাধারণ স্বীকৃতি স্পষ্ট। বিশেষত মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে।

‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ’-এর প্রতি দায়বদ্ধতার ভিত্তিতেই ভারতে ১৯৯৩ সালে দেশে মানবাধিকার সুরক্ষা আইন গৃহীত হয়। সেই মোতাবেক জাতীয় স্তরে ও রাজ্যস্তরে মানবাধিকার কমিশন গঠনের ব্যবস্থা হয়। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারই দেশের মধ্যে প্রথম রাজ্যস্তরে মানবাধিকার কমিশন গঠন করে।

 মোদী সরকারের মানবাধিকার দলন

ভারতীয় গণতন্ত্র নানা পর্বে জটিল ও কঠিন সময় পার করেছে। সংবিধান ও মানবাধিকার সনদের গণতান্ত্রিক মর্মবস্তুর সঙ্গে শাসক শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্ঘাত বারে বারে মাথাচাড়া দিয়েছে।

কিন্তু বিশেষত ফ্যাসিবাদী সংঘ পরিবার পরিচালিত মোদী সরকারের আমলে কর্পোরেট- সাম্প্রদায়িক শক্তির আঁতাত এবং  সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারগুলির লঙ্ঘন চরমে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মূলগতভাবে মানবাধিকার-বিরোধী। সংঘ পরিবার এবং মোদী সরকার শুধু ভারতীয় সংবিধানকেই  পদে পদে অস্বীকার করছে না, রাষ্ট্রসংঘের ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ’-কেও তারা তুচ্ছ জ্ঞান করছে। মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাই ‘মানবাধিকার’-র  ‘ভারতীয়’ সংজ্ঞা বানানোর ধুয়ো তুলেছেন।

কেন্দ্রে মোদী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে মুক্তচিন্তার মানুষদের পাশাপাশি দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের গায়েও ‘দেশদ্রোহী’ তকমা লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে প্রশাসন এবং হিন্দুত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী। দেশে গণপ্রহারের ঘটনা বেড়ে চলায় উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খোলা চিঠি দেওয়ার ‘অপরাধে’ রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয় দেশের ৪৯ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে। যদিও চাপের মুখ তা শেষপর্যন্ত প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়েছে।

ভিন্নমত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারগুলিকে এরা ধ্বংস করতে চায়।

সাম্প্রতিককালে জম্মুকাশ্মীর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম স্বৈরাচারী পদক্ষেপ, জনমতকে পদদলিত করে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাশ করানোর মতো পদক্ষেপগুলিকে খোদ রাষ্ট্রসংঘ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা  হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এটা দেশের লজ্জা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ভারত রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে কখনও এভাবে ধিকৃত হয়নি। শুধু রাষ্ট্রসংঘ নয়, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার সংগঠনগুলিও মোদী সরকারকে অভিযুক্ত করেছে।

দুই ভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষ পরস্পরকে বিয়ে করতে পারবে না সংঘ পরিবারেরএই হুমকি মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

মোদী সরকারের সময়ে ইউ এ পি এ আইনের সংশোধনী অনুযায়ী যে কোন ব্যক্তিকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দাগিয়েদিতে পারে সরকার। ভারতীয় দন্ডবিধির ১২৪এ ধারার  (১৮৭০ সালে ঔপনিবেশিক প্রশাসন জারি করেছিল) অপব্যবহার যথেষ্ট উদ্বেগের কারন হয়ে উঠেছে। 

ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও শ্রমজীবী জনগণের সুরক্ষাকে লোপাট করে দেবার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী শ্রম আইন সংক্রান্ত দু’টি কোড বিল সংসদে পেশ করেছে মোদী সরকার। সম্প্রতি শ্রম কোড বিকৃত করে দৈনিক কাজের সময়কে আট ঘন্টা থেকে বারো ঘন্টায় পরিণত করেছে মোদী সরকার। কার্যত দাস প্রথা ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) স্বীকৃত শ্রম সংক্রান্ত দীর্ঘদিন মান্য মানদন্ডগুলি ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে মোদী সরকার। মোদী সরকারের কৃষি সংক্রান্ত তিন কালাকানুনও চরম স্বৈরাচারী।

নাগরিকদের ইন্টারনেট ব্যবহারের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আক্রমণ বাড়ছে। বিদেশী বহুজাতিক টেলিকম কোম্পানিগুলির সঙ্গে যোগসাজশে। মোদী সরকার ইতিমধ্যে তথ্যের অধিকার আইনেরও সংশোধন করেছে। ডিজিট্যাল মিডিয়াকে মোদী সরকার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।

মোদী সরকারের আমলেও নির্বাচন কমিশন, তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীন ভূমিকা নজিরবিহীনভাবে আক্রান্ত।

রিপোর্টার্স উইদাউট  বর্ডারস (প্যারিস) সংস্থা প্রকাশিত ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার বিচারে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪০তম। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের স্থান ১৪২তম। ‘ওয়ার্ল্ড ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্স’  প্রতিবেদন অনুযায়ী গণতন্ত্র সূচকে ২০১৯ সালে ভারতের স্থান ৫১তম। ২০১৮ সালের তুলনায় ১০ ধাপ নেমেছে।  নাগরিক অধিকারের ক্ষয়ই এর মুখ্য কারন।

মোদী সরকারের আমলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্নমানবাধিকার সংগঠন  দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

এদেশের মাটিতে আজ সার্বজনীন মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রাম এবং  সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মর্মবস্তু রক্ষার সংগ্রাম অভিন্ন।

 পশ্চিমবঙ্গে

২০১১ সালে পালাবদলের পর তৃণমূল সরকার গণতান্ত্রিক অধিকারগুলির তীব্র আক্রমন নামিয়ে আনে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্য তথ্য কমিশনের মতো রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীন কার্যকলাপও তৃণমূল সরকারের সহ্য হয়নি। তৃণমূল সরকার এমনকি নজিরবিহীনভাবে আইন এবং প্রথা ভেঙে প্রাক্তন বিচারপতির বদলে একজন সরকার-ঘনিষ্ঠ পুলিশ অফিসারকে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করে।

 অতিমারী পর্বে মানবাধিকার

চলতি ২০২০ সালে রাষ্ট্রসংঘ মানবাধিকার দিবস উদযাপন কোবিদ মহামারীজনিত পরিস্থিতির উপর যথার্থভাবেই জোর দিয়েছে। এবারের মানবাধিকার দিবসের বার্তার শিরোনাম- ‘রিকভার বেটার-স্ট্যান্ড আপ ফর হিউম্যান রাইটস’। রাষ্ট্রসংঘ তাৎপর্যপূর্নভাবে বলেছে, কাঠামোগত বৈষম্য এবং বর্ণবাদই কোবিদ ১৯ সংকটের বাড়াবাড়ির কারন। সমতা এবং বৈষম্যহীনতাই কোভিদ-উত্তর পরিস্থিতি মোকাবিলার মূল প্রয়োজনীয় বিষয়।

অতিমারী মোকাবিলায় চারটি বিষয়ের উপর জোর দিতে বলা হয়েছে রাষ্ট্রসংঘের বার্তায়: ‘যেকোন ধরণের বৈষম্যের অবসান করো’; ‘অসাম্যের দিকে নজর দাও’;‘অংশগ্রহণ এবং সংহতির ওপর জোর দাও’ এবং ‘সুস্থায়ী উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাও’।

গণউদ্যোগেই মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে

নাগরিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অর্জিত অধিকারগুলিকে রক্ষা করতে পারে জনগণই। সংগঠিত ও সচেতন জনমতই পারে আজকের কঠিন সময়ে প্রতিরোধের ব্যুহ গড়ে তুলতে। এবারের মানবাধিকার দিবসে সেই লক্ষ্য পূরণই আমাদের শপথ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন