সাম্প্রতিক গবেষণার নিরিখে মানব বিবর্তন – ভবানী শঙ্কর জোয়ারদার প্রথম পর্ব

চার্লস রবার্ট ডারউইন ১৮০৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের স্রুশবেরিতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা খ্যাতনামা চিকিৎসক ও অর্থশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পিতামহ চিকিৎসক ও লেখক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এ হেন সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তান রূপে প্রথমে ডাক্তারি পড়ার জন্য তাঁকে এডিনবার্গ পাঠানো হয়। ফিরে আসেন, তখন কেম্ব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি করা হয়, এই ভেবে যে সাধারণ ডিগ্রি নেওয়ার পর যাজকবৃত্তির প্রশিক্ষণে নিযুক্ত হতে পারবেন। প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়ানো ও নমুনা (specimen) সংগ্রহই তার নেশা ছিল।

এমন সময়ে অভিযাত্রী জাহাজ ‘The Beagle’- এ প্রকৃতি অন্বেষক হিসাবে সুযোগ পেয়ে যান। ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথ বন্দর থেকে ১৮৩১ সালের ২৭ ডিসেম্বর জাহাজের যাত্রা শুরু হয়। মূলত দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলে জরিপ ও সমীক্ষা করেন জাহাজের পর্যবেক্ষকগণ । এই অবসরে চার্লস প্রবাল প্রাচীর বীক্ষণ এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ (জীবাশ্ম সহ) করতে থাকেন ও নিজের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করন। অভিযাত্রী জাহাজ ১৮৩৬ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে আসে।

The Journey of The Beagle, Image Source : Google

এই পাঁচ বছরের সংগৃহীত নমুনা ও নিরীক্ষণ নোট থেকে তথ্য বিশ্লেষণ করে কতকগুলি সিদ্ধান্তে আসেন। কিন্তু এই কাজ করতে ও বিভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ১৮৫৮ সাল হয়ে যায়। ঠিক এই সময়ে সুদূর মালয় থেকে বিশিষ্ট প্রকৃতি বিজ্ঞানী আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের একটি চিঠি ও গবেষণাপত্র চার্লসের কাছে পৌঁছয়। চার্লস গবেষণাপত্রটি পড়ে বিস্ময়াভূত হয়ে যান। এতদিন তিনি যা ভেবে এসেছেন তার অনুরূপ ধারণা ওয়ালেসের পত্রে পরিস্ফুট। তখন লন্ডনের রয়াল সোসাইটি একটি সভা ডেকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে জৈব বিবর্তনের তত্ত্বটি ঘোষণা করেন এবং এর উদ্ভাবক হিসাবে সমকৃতিত্ব দিয়ে ডারউইন ও ওয়ালেসের নাম উল্লেখ করেন।

Alfred Wallace and Charles Darwin , Source:Google

প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ (The Theory of Natural Selection)

জীবের (উদ্ভিদ ও প্রাণী) জনগোষ্ঠীর (Population) মধ্যে সর্বদা পার্থক্য বর্তমান। তা দেহগত, অভ্যাসগত এবং প্রজননগত তো বটেই, অন্যান্য বিষয়েও রয়েছে। কোন একটি সময়কালে এই পার্থক্যসমূহ (এক বা একাধিক) জনগোষ্ঠীর কাউকে কাউকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে, অন্যান্যদের করবে না। যারা টিঁকে থাকল তারা যেন নির্বাচিত হল এবং সময়ের ব্যবধানে নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হবে। এটা যেহেতু প্রকৃতিতে ঘটতে থাকে তাই এই তত্ত্বকে প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ বলা হয়। ডারউইন ও ওয়ালেসের অনুসন্ধানে এই তত্ত্বই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মানবের ক্ষেত্রে জৈব বিবর্তন

এই যে জৈব বিবর্তনের তত্ত্ব, তা কি মানবের উদ্ভবের ইতিহাসে প্রযোজ্য ? ডারউইন ১৮৭১ সালে The Descent of Man প্রকাশ করেন এবং দাবি করেছিলেন, মানুষ প্রাক্-মানব জীব থেকেই উদ্ভূত। তিনি আরো মনে করেছিলেন, মানুষদের পূর্বপুরুষদের আবির্ভাব ঘটে আফ্রিকাতে। তিনি যুক্তি হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন, আমাদের নিকট আত্মীয় শিম্পাঞ্জি ও গোরিলারা আফ্রিকাতেই বাস করে। সম্প্রতি দক্ষিণ ও পূর্ব আফ্রিকায় এবং ইথিওপিয়ায় প্রাক্-মানবের বিভিন্ন স্তরের একাধিক জীবাশ্ম পাওয়া গেছে।

মানবের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মডেল

বর্তমান মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo sapiens) । তার বিবর্তন ব্যাখ্যা করার জন্য ইতিহাসগত ভাবে দু’টি মডেল দেওয়া হয়েছে। একটি হল ‘বহু অঞ্চল’ (Multi Regional) মডেল। এই মডেলের অনুগামীরা দাবি করেন, হোমো স্যাপিয়েন্সের বিবর্তন অনেকদিন ধরে একাধিক জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়। এইভাবে উদ্ভূত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণের ফলে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যটি ‘Out of Africa’ মডেল। শেষোক্ত মডেলটি বেশির ভাগ মানুষ অনুসরণ করেন। হোমো স্যাপিয়েন্স আফ্রিকাতে উদ্ভব হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পরিযায়ী হয়। আরও প্রমাণ পাওয়া যায় ‘Out of Africa’মডেলের সপক্ষে মানুষের করোটির আয়তনের থেকে। সারা বিশ্বের ৪৩টা মানব গোষ্ঠীর জিন বিন্যাস ও করোটির পরিমাপ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আফ্রিকা থেকে যতদূরে চলে যাওয়া যাবে, ততই মানবগোষ্ঠীগুলির জিনগত পার্থক্য কমে যায়। এটার কারণ সম্ভবত এই – আফ্রিকার আদি বসতি যত ছড়িয়ে পরছিল, ততই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। ফলে ওদের জিনগত পার্থক্যও হ্রাস পাচ্ছিল।

Out of Africa, Google

সান্তে পাবো (Svante Pääbo)

মানুষের আদিভূমি আফ্রিকা ও প্রাক্-মানবের বিভিন্ন পর্যায়গুলি সম্বন্ধে তথ্য এবং হোমো স্যাপিয়েন্সের মানব আত্মীয় প্রভৃতি সম্পর্কে আরো গভীরভাবে জানার সুযোগ হয়েছে এবারের Physiology/Medicine বিভাগে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সান্তে পাবোর অসামান্য গবেষণার থেকে। পাবো সুইডেনের উপসালা (Uppsala) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল কেমন করে এ্যাডিনো ভাইরাসের E19 প্রোটিন দেহের প্রতিরোধশক্তি ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। ১৯৮৬-৮৭ সালে গবেষক হিসাবে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। ১৯৮৭ সালেই ক্যালিফোর্নিয়ার University of California, Berkeley তে লুপ্ত স্তন্যপায়ীর জিনোম নিয়ে এ্যালান উইলসনের কাছে গবেষণা করতে জান। ১৯৯০ সালে তিনি ইয়রোপে ফিরে আসেন ও মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালের থেকে জার্মানির লিপজিগ-এ Max Planck Institute of Evolutionary Anthropology-এর প্রতিষ্ঠাতা অধিকর্তা।

Paabo

হোমো স্যাপিয়েন্স ও নিয়ান্ডারথাল

গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে , দেহগতভাবে আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স প্রথম আবির্ভূত হয় আফ্রিকাতে তিন লক্ষ বছর আগে। আমাদের নিকটতম আত্মীয় নিয়ান্ডারথালরা (Neanderthal, জার্মানির নিয়ান্ডারথাল উপত্যকায় গুহায় প্রাপ্ত মানুষজন) আফ্রিকার বাইরে উদ্ভূত হয়। তারা ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে ছড়িয়ে পরে আনুমানিক চার থেকে তিন লক্ষ বছরের মধ্যে। পরে তারা লুপ্ত হয়। প্রায় ৭০হাজার বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্সের গোষ্ঠীগুলি মধ্যপ্রাচ্যে পরিযায়ী হয়। সেখান থেকে তারা বিশ্বের অন্যান্য অংশে পরিব্যাপ্ত হয়। এইভাবে হাজার হাজার বছর ধরে হোমো স্যাপিয়েন্স ও নিয়ান্ডারথালরা সহবাস করেছিল ইউরোপের বৃহৎ অংশসমূহে। আমাদের সঙ্গে নিয়ান্ডারথালদের কী ধরণের সম্পর্ক ছিল? এই দলগুলির জিনোম (Genome: মানুষের দেহে অবস্থিত সমস্ত জিনগুলি) বিশ্লেষণ করে তার হদিশ পাওয়া যেতে পারে। নব্বই দশকের শেষে মানব জিনোমের বিন্যাস(sequence) প্রকাশিত হয়। এর ফলে বিভিন্ন প্রকার মানবের জিনগত সম্পর্ক জানতে সুবিধা হয়। তবে বর্তমান মানুষ ও লুপ্ত নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে সম্পর্ক জানতে হলে প্রাচীন মানব জীবাশ্মদের জিনোমের ডিএনএ বিন্যাস নির্ধারণ করা আবশ্যক।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন