১. ২০২০ সালের শিক্ষানীতি বস্তুত একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিসম্মত শিক্ষা নীতি, কোন বাস্তব নীতি সম্মত দলিল নয়। হালকা ভাবে বিচার করলে একে যতই আকর্ষণীয় মনে হোক না কেন এর ভিতর নীতির কার্যকারিতা ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে কোন বিস্তারিত প্রকল্প পাওয়া যায় না। এই শিক্ষানীতিতে রয়েছে এমন অনেকগুলি নির্দিষ্ট প্রস্তাব যা বাস্তবসম্মত নয় এবং যেগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যেকার প্রয়োজনীয় ঐক্যের একান্ত ক্ষতিসাধন করবে। ওই সমস্ত প্রস্তাবনা বাস্তবে কার্যকরী হতে গেলে শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি খরচও অনেক বেশি প্রয়োজন হবে যা এখনও দিবাস্বপ্ন। এই শিক্ষানীতিতে ধীরে ধীরে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপে জনস্বার্থবাহী ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে জিডিপির ৬ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু এ ধরনের ব্যয় বরাদ্দের কথা ১৯৬৬ সালের কোঠারি কমিশনের সময় থেকেই বলা হয়ে আসছে। বর্তমান সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একথা বলা চলে সরকারকে বার্ষিক শিক্ষাখাতে খরচও বাড়াতে হবে। এই এই শিক্ষানীতিতে লেখা বিভিন্ন প্রস্তাবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করলে বোঝা যায় এর মধ্যে যথেষ্ট ফাঁক রয়েছে এবং উচ্চারিত ও অনুচ্চারিত কথার ইঙ্গিত থেকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভূত করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বোঝা যায়। এই নীতির প্রয়োগে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে নাকচ করে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির স্বশাসন নষ্ট করে দিয়ে, শিক্ষা পদ্ধতির বাণিজ্যিকীকরণকে আরো ত্বরান্বিত করে, শিক্ষায় অসাম্যকে আরও বাড়তে দিয়ে, স্কুলস্তর থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের মনে আরএসএসের আদর্শ অনুযায়ী দেশ গড়ার কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হবে যার ফলে আমাদের দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি গোড়াতেই বিনষ্ট হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় এভাবে একটি অমূলদ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রয়োগের ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের চেতনা ও কাজে যুক্তিবাদের জায়গায় বিচারশক্তিহীনতা তৈরি হবে; রহস্যবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার ফলে বিজ্ঞান মনস্কতার বদলে ছোটদের মনে বিজ্ঞানবিরোধী চিন্তা ভাবনার জন্ম হবে। এই প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যতের তরুণ প্রজন্ম এক ধরনের ক্রীতদাসতুল্য অনুবর্তিতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
১.১ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা কি চেহারা নেবে সেই নিয়ে অবশ্যই এই নতুন শিক্ষানীতি প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিচে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে কিভাবে এই নতুন শিক্ষানীতির প্রয়োগে সার্বিক ভাবে শিক্ষার সব স্তরে গুণগতমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে, শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেকেই বঞ্চিত হবে, বিশেষ করে দেশের গ্রামীণ, দরিদ্র এবং পিছিয়ে থাকা অংশের পরিবারের থেকে আশা ছাত্রছাত্রীরা। এই নীতিতে কোথাও শিক্ষায় সংরক্ষণের কথা বলা নেই যার ফলে শিক্ষাব্যবস্থার বেড়ে চলা খরচের ধাক্কা সামলাতে না পেরে আমাদের দেশের অনেক ছেলেমেয়ে ই নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না এবং ভবিষ্যতে কার্যকরী কর্মসংস্থান প্রকল্পের সাথে যুক্ত হতে ব্যর্থ হবে। সারা পৃথিবীতে জ্ঞান এবং দক্ষতা নির্ভর অর্থনীতির কারণে ভবিষ্যতে কাজ পাওয়ার জন্য আধুনিক শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। এই শিক্ষানীতিতে মানব সম্পদের যোগানের দিকেই বাড়তি নজর দেওয়া হয়েছে যা কার্যকরী হতে গেলে এরই সাথে সরকারের পক্ষ থেকে আধুনিক অর্থনীতি সম্মত নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি করার প্রয়োজন রয়েছে। এই শিক্ষা নীতি প্রসঙ্গে দেশের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে কর্মপ্রার্থী র বদলে কর্মদাত্রির কথা বলেছেন তা যথেষ্টই দুর্বোধ্যতার অলংকার দোষে দুষ্ট। আজকের পরিবর্তনশীল পৃথিবীর চাহিদা অনুযায়ী যেভাবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে তাকে আজকের দিনে বেরোজগারি র ভয়াবহ চিত্রের সাথে তুলনা করা হলে বোঝাই যায় এর ফলে স্কুল এবং উচ্চশিক্ষা দুই থেকেই অনেকে সরে আসতে বাধ্য হবে।
খ) বুনিয়াদি শিশুশিক্ষা ব্যবস্থা, উন্নয়ন সমূহ
২. তিন থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের জন্য এই শিক্ষানীতিতে একটি তিন বছরের শিক্ষাক্রম করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এই বয়সের শিশুদের খেলাধুলা এবং বিভিন্ন শারীরিক কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে যথাযথ পুষ্টি ও পরিচর্যার দ্বারা এক নিরাপদ ও পরিচর্যার পরিবেশে তাদের জ্ঞান এবং শিক্ষার দক্ষতা বাড়ানোর কাজ করা হয়। এই লক্ষ্যে সফল হতে নির্দিষ্ট কর্ম কুশলতায় দক্ষ এবং সুনির্দিষ্ট পেশাদার দিয়েই শিশুদের শিক্ষাদানের কাজ করতে হয়।
২.১ নতুন শিক্ষানীতিতে এই কাজ করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে চালু অঙ্গনওয়াড়ি ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় প্রাইমারি বিদ্যায়তন গুলিকে ব্যবহার করতে। এই কাজ যথাযথভাবে করতে ভালো হয় যদি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র গুলিকেই প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করবার সিদ্ধান্ত হয় কারণ এই সমস্ত কেন্দ্রে পরিবারের মানুষজন তাদের শিশুদের খুব সহজেই এখানে পৌঁছে দিতে পারেন, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা শিশু পরিচর্যার জন্য বাড়িতে বাড়িতে অভিভাবকদের কাউন্সিলিং করার কাজেও দক্ষতার পরিচয় রাখবেন। নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে এই কাজে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের জন্য স্থানীয় নিকটবর্তী বিদ্যালয়গুলির সাহায্যে ভার্চুয়াল লার্নিং প্লাটফর্ম ব্যবহার করে তাদের ট্রেনিং দেওয়া হবে যদিও নতুন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির কথা বলা হয়নি কিংবা নতুন কাজের ক্ষেত্রে প্রাপ্য সুযোগ সুবিধারও কোনো উল্লেখ করা হয়নি।
২.২ নতুন শিক্ষানীতির ইসিসি ই পদ্ধতি অনুযায়ী স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের কেই নতুন শিক্ষাক্রমে প্রয়োজনীয় শিক্ষাসহায়ক জিনিসপত্রের নিশ্চয়তা নির্ধারিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে বিভিন্ন পরিবারের কাছে পরিচ্ছন্নতার স্বাস্থ্যবিধি এবং খাদ্য সুরক্ষা ও পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থাপনা করতে হবে তাদেরই।
গ) স্কুল শিক্ষা
৩. এদেশে শিক্ষা সংবিধানের কেন্দ্র রাজ্যের যৌথ তালিকার অন্তর্ভুক্ত বিষয়, এই শিক্ষা নীতির ফলে শিক্ষাব্যবস্থার গোটাটাই দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর বদলে কেন্দ্রমুখী হয়ে পড়বে। এতে রাজ্যগুলির অধিকারই যে কেবল খর্ব হবে তাই নয়, এক্ষেত্রে রাজ্যগুলি কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অনুসারী সংস্থায় পরিণত হবে। এতে বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির বিভিন্নতার বৈশিষ্ট্য নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে শিক্ষার যথার্থ উপযোগী ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি আমাদের দেশে শিক্ষার বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মেলেনা। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে যেমন তামিলনাড়ু এই শিক্ষানীতির ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবনা কে সামনে রেখে বিরোধিতা জানিয়েছে।
৩.১ আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এতদিনকার পদ্ধতি ছিল স্কুল স্তরে পাঠ্যবই গুলি রাজ্য সরকার গুলির নির্দেশ অনুযায়ী লেখা হতো। এর পরিবর্তে অতি আধুনিক দেশগুলির পদ্ধতি অনুসরণ করে জাতীয় শিক্ষানীতিতে সারা দেশের জন্য একই পাঠ্যবইয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যাতে স্থানিক (রাজ্যের) বৈশিষ্ট্য যুক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে (শিক্ষানীতির ৪.৩১ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। এ ধরনের কেন্দ্রীকরনের ফলে সারাদেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততার হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে যার ফলাফল কেমন হতে পরে বুঝতে সাম্প্রতিককালে কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে পরীক্ষার সিলেবাস কমানোর সময় ধর্মনিরপেক্ষতা, ক্রান্তিদর্শন চিন্তাভাবনা এবং নির্দিষ্ট কিছু ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিষয় সম্বলিত অংশগুলিকেই বাদ দেওয়ার ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায়।
৪. বর্তমানে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক হারে ব্যক্তিমালিকানাধীন স্কুলের প্রচলন শুরু হয়েছে, সেই সময় সরকারি স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করার বদলে নতুন শিক্ষানীতিতে বেসরকারিকরণকেই উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন লোক হিতৈশী প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে স্কুল চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে (শিক্ষানীতির ৮.৪ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। ৩.৬ নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিকল্প মডেল অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। এভাবেই সংঘ পরিবার ও তাদের মত সংস্থাগুলিকে শিক্ষাক্ষেত্রে অনুপ্রবেশের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ৮.৫ অনুচ্ছেদে যে কোন বেসরকারি শিক্ষা সংস্থাকেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সরকারি বিধি-নিষেধের আওতার বাইরে রাখার কথা বলা হয়েছে। এসব কিছুর দ্বারাই বস্তুত শিক্ষা ব্যবস্থাকে নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে। নরম কিন্তু শক্ত বাঁধনের কথা উল্লেখ করে বস্তুত নতুন শিক্ষানীতিতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে যেভাবে শিক্ষার ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ করা হয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে লাগামহীন দুর্নীতি হয় তাকে কার্যত এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
৫. ২০০৯ এর রাইট টু এডুকেশন আইন অনুযায়ী ৬ থেকে ১৩ বছর বয়সী প্রত্যেককে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে রাজ্য গুলির উপর যে দায়িত্ব ছিল তা নতুন শিক্ষানীতিতে খর্বিত হবে। শিক্ষানীতির ৩.১ নম্বর অনুচ্ছেদে '৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ' তৈরি করে দেওয়ার যে ফাঁপা ঘোষণা আছে তা বস্তুত কোন কাজের হয়ে উঠবে না। সিভিল সোসাইটি র সাহায্যে স্কুলছুট দের জন্য যেভাবে বিকল্প শিক্ষা কেন্দ্রের কথা বলা হয়েছে তাতে পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারগুলির সন্তানেরা মূল শিক্ষাক্রম থেকে বঞ্চিত হবে, তাদের জন্য একমাত্র উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা হতো সরকারি জনশিক্ষা।
৫.১ জাতীয় শিক্ষা নীতির ৩.৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সামাজিক অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষদের জন্য এবং নানা বিধ প্রতিবন্ধকতার শিকার হওয়া শিশুদের জন্য সরকারের উদ্যোগে জাতীয় ও রাজ্য মুক্ত বিদ্যালয় গুলির দ্বারা শিক্ষা দেওয়ার কাজ করা হবে, এতে তাদেরকে আরো বেশি করে ডিজিটাল ডিভাইড এর শিকার হতে হবে। প্রয়োজন ছিল এই সমস্ত অংশের শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার দ্বারা তাদেরকে মূল শিক্ষাক্রম এর সাথে যুক্ত করা।
৫.২ অনুচ্ছেদ নম্বর ৭ এ বলা হয়েছে ছোট কিংবা বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে যে সমস্ত সরকারি বিদ্যায়তনে রয়েছে সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হবে, বন্ধ করে দেওয়ার অজুহাত দেওয়া হয়েছে দক্ষতা, কার্যকরীতা এবং সম্পদের উপযোগিতা। অর্থাৎ এই সমস্ত ক্ষেত্রে বহু শিক্ষক শিক্ষিকা তাদের কাজ হারাবেন এবং একইভাবে বহু শিশু অনেক দূরবর্তী স্থানে বিদ্যায়তনে যুক্ত হবার সুযোগ হারিয়ে কার্যত শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ হারাবে।
৫.৩ ইতিপূর্বে শিক্ষা সম্পর্কিত সমস্ত কমিশন গুলির প্রস্তাব ছিল আরো বেশি বেশি জনশিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে জনসাধারণের জন্য স্থানীয় স্তরে বিদ্যায়তন গড়ে তোলার। এই বুনিয়াদি পরিকল্পনাকেই ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পূর্ণ নাকচ করেছে, অথচ স্থানীয় স্তরে জনশিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে সরকারি স্কুল তৈরি করার নীতি সমস্ত আধুনিক উন্নত দেশে মেনে চলা হয়।
৬. ঘোষিত শিক্ষানীতির ৪.৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রচলিত দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষার ব্যবস্থা বদলে সারাদেশে অভিন্ন তিনটি পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে যা তৃতীয় পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীতে নেওয়া হবে। ৪.৪১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা "পরখ" প্রকল্প অনুযায়ী সারাদেশে অতিরিক্ত একটি অল ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে যাতে সবকটি পাঠ্য বিষয়কেই অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই ব্যবস্থার দ্বারাই অ্যাসেসমেন্ট, রিভিউ এবং শিখান্তে জ্ঞানের পরিমাপ ও সার্বিক উন্নতির পরীক্ষা করা হবে। স্কুলে পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে স্কুল নিজে কোন পরীক্ষা গ্রহণ করবে না, সারা দেশের জন্যই স্কুল শিক্ষাকে কোর্স ভিত্তিক এবং সেমিস্টার ভিত্তিক করা হয়েছে। এর ফলে সর্বভারতীয় এবং রাজ্য শিক্ষা বোর্ড গুলির অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এ ধরনের "এক্সাম রাজ" বস্তুত মূলগতভাবে জাতীয় শিক্ষানীতিকেই একটি এলোমেলো, স্ববিরোধী এবং এই নীতি সম্পর্কে সরকারের বড় বড় দাবি গুলিকে অসার প্রমাণ করছে।
১. অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে জাতীয় শিক্ষানীতি ভারতের সমাজ ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সংঘ পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রয়োগ করছে। প্রস্তাবিত গোটা নীতিতে কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি একবারও আসেনি, যদিও এই নীতি ঘোষণা করছে এতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতা, বস্তুনিষ্ঠ চিন্তাভাবনা এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধের সংশ্লেষ ঘটবে। ৪.৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ভারতীয় শিক্ষাদান ব্যবস্থার কথা বলে এমন কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে যা ভয়ানক অস্পষ্ট। দেশীয় পদ্ধতির সাহায্যে আলগোছে উপজাতি গোষ্ঠী সমূহের ভাষা এবং সংস্কৃতির চর্চার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষাক্রম এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই শিক্ষানীতি জোর দিয়েছে বিভিন্ন প্রধান ভারতীয় ভাষাগুলির উৎস ও ঐক্যের ক্ষেত্রে যা মূলত সংস্কৃত ভাষার ধারণা থেকে গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে দ্রাবিড়ীয় আদিবাসী এবং উত্তর পূর্ব ভারতের অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠী গুলিকে কার্যত অগ্রাহ্য করা হয়েছে যেমনটা এক জাতি - এক ভাষা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংঘ পরিবারের তরফ থেকে বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার সমৃদ্ধশালী সাহিত্যকীর্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই নীতিতে পালি, প্রাকৃত ও পারসিক ভাষার উল্লেখ থাকলেও অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় উর্দু ভাষার উল্লেখ অনুপস্থিত!
ঘ) শিক্ষক - শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ
৭. ভারতের জনশিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে উপজাতি ও বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলিতে সরকারি শিক্ষায়তনে উপযুক্ত এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষক শিক্ষিকার যে বিপুল ঘাটতি রয়েছে তাকে জাতীয় শিক্ষানীতিতে স্বীকার করে নেয়া হলেও সেই সমস্যাকে এই নীতিতে কোথাও সমাধানের লক্ষ্য হিসেবে নেওয়া হয়নি। রাইট টু এডুকেশন আইন অনুসারে বহু রাজ্যে উপযুক্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক শিক্ষিকার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এই সমস্যার সমাধানে কিছুই বলা হয়নি বরং 'স্কুল কমপ্লেক্স' গড়ে তুলে কিংবা স্কুলগুলির মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকা আদান-প্রদান করার যে ব্যবস্থার কথা জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত হয়েছে তা যথেষ্ট অবাস্তব (প্রস্তাবিত নীতির ৫.৫ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। যদিও যথেচ্ছ "ট্রান্সফার ইন্ডাস্ট্রি" এর উল্লেখ করে স্কুল শিক্ষক শিক্ষিকাদের যত্রতত্র ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা কে বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে অথচ এই কাজ সফলভাবে করতে গেলে রাজ্যগুলির সাথে কেন্দ্রকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে চলতেই হবে যাকে এই শিক্ষানীতিতে বহুলাংশে ছোট করে দেখানো হয়েছে।
৮. নতুন শিক্ষানীতির ৫.৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত "এক্সাম রাজ" ভবিষ্যতে সারাদেশের বুনিয়াদি স্তর থেকে শুরু করে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই টিচার্স এবিলিটি টেস্ট বা টেটকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
৯. সবচেয়ে সমস্যা হল নতুন শিক্ষানীতিতে নার্সারি থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পঠন-পাঠনের কাজে যুক্ত সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটি বিষয়ের উপর স্পেশালাইজেশন সহ চার বছরের ইন্টিগ্রেটেড বিএড ডিগ্রী থাকতে হবে। আগেকার ব্যবস্থায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর কাজে যুক্ত শিক্ষক শিক্ষিকাদের ব্যাচেলর অফ এলিমেন্টারি এডুকেশন কোর্স পাস করতে হতো, নবম থেকে দশম শ্রেণীর পঠন-পাঠনের কাজে যুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দুবছরের বিএড ডিগ্রি থাকতে হতো এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ানোর জন্য পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি প্রয়োজন ছিল। এতে প্রতিটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী চার বছরের ডিগ্রিপ্রাপ্ত গ্রাজুয়েটদের এক বছরের কোর্স পাশ করতে হবে, তিন বছরের ডিগ্রিপ্রাপ্ত গ্রাজুয়েটদের দু বছরের কোর্স করতে হবে যাতে অপ্রয়োজনীয়ভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাডেমিক যোগ্যতা উপরে বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে অথচ শিক্ষণের প্রয়োজনে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দায়সারা মনোভাব নেওয়া হচ্ছে। এতে শেষ পর্যন্ত 28 বার তিন মাসের একটি শর্ট টার্ম কোর্স করে যে কেউ নির্দিষ্ট যোগ্যতা মান ছাড়াই ভলেন্টিয়ার কিংবা পার্টটাইম অথবা অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার হিসেবে কাজে যুক্ত হতে পারবে যাতে প্রকৃত গুনাবলী সম্বলিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে অন্যায় হবে এবং শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার কাজ আরো মজবুত হবে।
১০. জাতীয় শিক্ষানীতিতে ১৫.১০ অনুচ্ছেদে স্বয়ম/দীক্ষা প্রকল্পের দ্বারা শিক্ষক - শিক্ষিকাদের অনলাইনে প্রশিক্ষিত করার কথা বলা হয়েছে অথচ গ্রামীণ এবং দুর্গম এলাকা সমূহ যেখানে ইন্টারনেটের পরিষেবা নেই সেইসব এলাকায় শিক্ষনের কাজে যুক্ত এবং ছাত্র - ছাত্রীদের সমস্যাকে ভাবনার মধ্যে রাখা হয় নি।
১১. এস ই ডি জি এর অন্তর্গত কিংবা অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা যুক্ত ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কিভাবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষিত করা হবে সেই নিয়ে এই শিক্ষা নীতিতে কিছুই বলা হয় নি, এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই উল্লিখিত অংশের ছাত্র ছাত্রীদের বঞ্চনার শিকার হতে হবে। বস্তুত এই শিক্ষানীতিতে স্পেশাল এডুকেশনের শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইনই নেই।
ঙ) বৃত্তিমূলক শিক্ষা
১২.বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা কী শিখবে, শিখে কী কাজ করবে এসব কিছু নিয়ে আমাদের দেশের ধ্যানধারণা এখনো পুরনো দিনেই আটকে রয়েছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং এবং পরিষেবা শিল্পের ক্ষেত্রে যে আমুল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এসেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ভোকেশনাল শিক্ষা আরো বেশী গুরুত্ব রাখে। এদিকে ভারতের সমাজব্যবস্থা হাজার হাজার বছর ধরে যে জাতপাতের বদ্ধজলায় আটকে রয়েছে, তার ছাপ এসে পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও । একদিকে উচ্চবর্ণ, মধ্যবিত্ত বাড়ীর ছেলেমেয়েরা মূলতঃ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করে এসেছে, অন্যদিকে নিম্নবর্ণের ক্ষেত্রে পারিবারিক পেশাগত স্কিল উত্তরাধিকার সূত্রে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে চলে এসেছে। ভারতের বর্তমান শ্রমশক্তির মাত্র ২% এর নিজের কাজের ক্ষেত্রে প্রথাগত ট্রেনিং রয়েছে, যেখানে চীন, ইউরোপ আর জাপানের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা যথাক্রমে ৫৫%, ৮০-৮৫% ও ৯০% । সে শিল্পোন্নত দেশই হোক বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোই হোক, স্কুলশিক্ষার বিভিন্ন স্তরে এবং তার পরে বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থাকে তারা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দেখে আসছে। ভারতে এখনো ভোকেশনাল শিক্ষাদান শুরুই হয় মাধ্যমিক পাশ করার পরে, বিভিন্ন ITI এর মাধ্যমে। এই ব্যবস্থা এতটাই অপ্রতুল যে তা দিয়ে মাধ্যমিক পরবর্তী ড্রপ আউটকেও আটকানো সম্ভব হয়না।
১৩. যদিও খসড়া এনইপি ২০১৯ কিছুটা ভালোর দিকে এগিয়েছিল, সেখানেও প্রচুর সমস্যা ছিল তবুও বলা হয়েছিল যে বিভিন্ন স্তরের এবং মেয়াদী শিক্ষার (VocEd) কোর্স উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (এইচইআই) দেওয়া হবে, যা আইটিআইয়ের সাথে জোটবদ্ধ হবে, শিল্প এবং অন্যান্য ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকেও সেখানে যুক্ত করা হবে। কিন্তু এনইপি তে এর বিপরীতে হাঁটা হয়েছে এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে বিশদে কিছু উল্লেখও করা হয়নি। এনইপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে VocEd পুরোপুরি "পর্যায়ক্রমে সমস্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাগত প্রস্তাবের সাথে সংহত হবে” (১৬.৫) এবং এই লক্ষ্যে," মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি আইটিআই, পলিটেকনিক্স, স্থানীয় শিল্প ইত্যাদির সাথে সহযোগিতা করবে।" এটি একাধিক বিবেচনার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত প্রত্যাবর্তিত পদক্ষেপ।
১৩.১ এনইপি তে নীরবে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে যে ১০ ক্লাসের পরে ড্রপ আউট হয়, এটি শিশুদের একটি পূর্ণ ও সুদৃঢ় শিক্ষাগ্রহণ থেকে বিরত রাখে। মাধ্যমিক শিক্ষাকে বেশিরভাগ আধুনিক দেশগুলো কেবল একটি উপযুক্ত কর্ম শক্তির জন্যই নয়, ক্ষমতায়িত নাগরিকদের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচনা করে।
১৩.২ নবম শ্রেণীও এর পরের শিক্ষার্থীদের অবশ্যই বিভিন্ন আধুনিক বাণিজ্য, কারুশিল্প এবং শিল্প ক্ষেত্রগুলিতে পরিচয় প্রয়োজন এবং ভিত্তি-স্তরের দক্ষতা অর্জন করা উচিত, তবে এগুলি কেবলমাত্র পরিচয়সূচক, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিকল্প অন্বেষণ করতে সক্ষম করে। তবে, পেশাগত চাকরিমুখী দক্ষতা এবং পরবর্তী শিক্ষা কেবল বিদ্যালয়ের পরেই পাওয়া যায়। ১৩.৩ এই পরিকল্পনায় ইতিমধ্যেই ভারাক্রান্ত স্কুল শিক্ষায় বাড়তি বাঝা চাপায় যেখানে পর্যাপ্ত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা সম্পন্ন নতুন শিক্ষকের প্রয়োজন এবং সর্বোপরি, বিভিন্ন ব্যবসা/ পেশার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম/যন্ত্রপাতির বিশাল ব্যয়বহুল কাঠামোর দরকার। দক্ষতা এবং জ্ঞানের পরিপূরণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যগুলি অর্জন করতে ব্যবহারিক অদক্ষতার কারণে এটা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
চ) উচ্চ শিক্ষা (উ.শি)
১৪. ভারতীয় উচ্চশিক্ষা ইতিমধ্যেই বেসরকারিকরণের পথে অনেক দূর চলে গেছে। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে কলেজ স্তরে ভর্তির ৪৫% হয়েছিল সম্পূর্ণ বেসরকারি কলেজগুলোতে ও ২১% হয়েছিল বেসরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজগুলোতে। পেশাদার পাঠ্যক্রমগুলিতে স্নাতকস্তরে ৭২.৫% এবং স্নাতকোত্তরে প্রায় ৬০% ভর্তি হয় পুরোপুরি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।এমনকি অনেকগুলি সরকারি প্রতিষ্ঠানে, বিশেষত পেশাদার কোর্সে, ফি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঁচ ভাগের চার ভাগ শিক্ষার্থীনথিভুক্ত করে আধিপত্য বজায় রেখেছে, কিন্তু এখানেও বিষয়গুলো খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। ২০১৪-১৫ এবং ২০১৮-১৯ এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়স্তরে নাম নথিভুক্তি বৃদ্ধির ৫৫% ই হয়েছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্য ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গিয়েছিল সরকারি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (নিয়মিত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় , যেখানে নাম নথিভুক্তি বৃদ্ধি স্থগিত বা হ্রাস পেয়েছে )। ব্যাঙের ছাতার মত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলোর অনেকগুলোরই অনুপযুক্ত পরিকাঠামো ও শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়ে পরিচালিত হয়। এই প্রবনতা বিশেষ করে কারিগরি ও পেশাদার কোর্সের ক্ষেত্রে অনেকটা বেশি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ ফি এবং বিভিন্ন বেআইনি ফি ও চার্জ আদায় করেছে, তবে এখনও উপযুক্তভাবে দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত স্নাতক নিশ্চিত করতে সেগুলো অক্ষম।অন্যদিকে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার জন্য তহবিলের আকাল, গবেষণা তো দূরের বিষয়, তাদের বাধ্য করা হচ্ছে - হয় ফি বাড়াতে নয় বাণিজ্যিকীকরণে।এনইপি ২০২০ তে কেবল এই সমস্যার কোনও সমাধান নেই তা নয়, বিভিন্ন সুন্দর বুলি এবং সুললিত ভাষায় আবদ্ধ করে এমন একটি মডেল প্রস্তাব করা হয়েছে যা বেসরকারীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, অসাম্য এবং শিক্ষার উপযুক্ত মানের বিশাল সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
১৫. এনইপির সর্বাধিক লক্ষণীয় দিক হ'ল এটি উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় দরিদ্র, দলিত, আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, কন্যা সন্তান এবং অন্যথায় প্রান্তিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে গভীর বৈষম্য এবং প্রবেশাধিকারের সমস্যাকে স্বীকৃতি দেয় না।
১৫.১ এমনকি "সংরক্ষণ" শব্দটি পুরো নথিতে একবারও উল্লেখ হয় না! উ.শি (৯.২) এর প্রধান সমস্যাগুলি বিশ্লেষণ করার সময়, এনইপি কেবল “সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে স্থানীয়-ভাষায় শিক্ষাদানকারী নামমাত্র উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সীমিত প্রবেশাধিকার” এর কথা উল্লেখ করেছে। তবে ভারতে উ.শি যে উদ্বেগজনক কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার সেই কথা উল্লেখ করা হয়নি,।এরফলে কর্মসংস্থানে আরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
১৫.২.উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সির নতুন প্রবেশিকা পরীক্ষার ভিত্তিতে, কিন্তু প্রতিটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অন্যান্য মানদণ্ডের সাথে এই স্কোরগুলি তাদের পছন্দমত ব্যবহার করতে পারে। আজ অবধি সমস্ত তথাকথিত "মেধা-ভিত্তিক ব্যবস্থা" তে এটা সুবিদিত যে এটি তফশিলি জাতি /উপজাতি এবং অন্যান্য বঞ্চিত অংশগুলির সম্ভাবনাগুলোকে আরও আঘাত করবে এবং তাদের বর্জনের পদ্ধতিগুলোকে শক্তিশালী করবে।
১৫.৩ মুক্ত শিক্ষাকে প্রকৃতপক্ষে প্রধান না হলেও একটি জরুরি পন্থা হিসাবে অগ্রণী করা হয়েছে, ন্যায়সঙ্গত অধিকারের সমস্যার উত্তর এবং গ্রস এনরোলমেন্ট অনুপাত (জিইআর) (১২.৫-১২.৬) বৃদ্ধির মূল উপকরণ হিসাবে, কারণ স্পষ্টতই মূলধারার বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণের সামর্থের বাইরে চলে যেত এমনকি সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ফি বৃদ্ধি এমন হারে করত যা বেশীরভাগ ভারতীয়র সাধ্যের বাইরে।দরিদ্ররা ধীরে ধীরে উ.শি এর বাইরে চলে যাবে এবং ওপেন লার্নিং ডিগ্রির সাথে লড়াই করবে, এবং অন্যান্য মধ্যম আয়ের দেশের তুলনায় উ.শি-এর জিইআর-এ ইতিমধ্যে করুণ অবস্থায় থাকা ভারতীয়দের জিইআর আরও খারাপ করবে।
১৫.৪ আর্থ সামাজিক বঞ্চনা বা অন্য ধরণের প্রতিবন্ধকতার শিকারদের ক্ষেত্রে নতুন সর্ববোধক শব্দচয়ন SEDGs (Socio-Economically Disadvantaged Groups) করে তাদেরকে ক্ষতিপূরণের জন্য ফ্রিশিপ/স্কলারশিপ দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা স্পষ্ট করা হয়নি। এনইপি আরও বলেছে যে "বেসরকারী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৃহত্তর সংখ্যক ফ্রিশিপ এবং স্কলারশিপ প্রদানের জন্য উত্সাহিত করা হবে," তবে এক্ষেত্রেও কোন নির্দিষ্ট নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি।
১৬. উ.শি সম্পর্কিত এনইপি-র একটি বড় প্রস্তাব হোল অনুমোদিত কলেজসমূহকে সরিয়ে দিয়ে বৃহত্তর, বহুবিষয় সম্বলিত বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তার পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত কিছু কলেজের দিকে অগ্রসর হওয়া যেগুলো বিভিন্ন বিষয়ে ও বিভাগে ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা রাখবে।
১৬.১ এই প্রস্তুতির বাস্তবতা ও বিরাট পরিমাপ নিয়ে বহু প্রশ্নের অবকাশ কাছে, এরফলে বহু নথিবদ্ধ কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। বিপুলাকায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যাবে গ্রামীন ও প্রান্তিক এলাকার শিক্ষার্থীদের আয়ত্তের বাইরে যা শিক্ষার্থীদের আরও ব্যয় বাড়িয়ে তুলবে এবং তাদের উচ্চশিক্ষায় প্রবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এনইপি এছাড়াও বিচিত্র পরামর্শ দেয় যে বিশেষজ্ঞ প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠান যেমন আইআইটি এবং সম্ভবত মেডিকেল কলেজগুলিকেও নিজেদেরএকইভাবে রূপান্তর করতে হবে!এই প্রস্তাবটি নিয়ে বেশ কয়েকটি অন্যান্য মূলগত সমস্যা রয়েছে।
১৬.২ এই বহুবিষয় সম্বলিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমা এবং ডিগ্রি সহ প্রতিবছরের পরে প্রবেশ ও প্রস্থানের সুযোগ সহ ৪ বছরের স্নাতক কোর্স প্রদান করবে। প্রবেশের সুযোগকে জীবনব্যাপী শেখার এবং শিল্পক্ষেত্রে কাজের পরে পার্শ্বীয় প্রবেশের সুবিধার জন্য একটি ব্যবস্থা হিসাবে বোঝা যেতে পারে।যাইহোক, প্রতি বছরের পরে শংসাপত্র এবং ডিপ্লোমা প্রদান অনর্থক। স্নাতক কোর্সের পাঠ্যক্রমটি এ জাতীয় বিচ্ছিন্ন মডিউলে নকশা করা যায় না।অনেক দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প-মেয়াদী শংসাপত্র / ডিপ্লোমা কোর্স দিয়ে থাকে, বিশেষত বৃত্তিমূলক শিক্ষার সাথে যুক্ত, তবে এগুলি বিভিন্ন স্তরে নির্দিষ্ট NSQF (National Skills Qualifications Framework ) মান পূরণ করার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে।স্নাতক কোর্স সম্পূর্ণ আলাদা এবং এইভাবে কাজ করতে পারে না।এই জাতীয় কাঠামোটি প্যাডাগজিক বিষয়বস্তু এবং ডিগ্রির মানকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করবে।
১৬.৩ এনইপি আরও প্রস্তাব করে যে, বিস্তৃত জাতীয়-কাঠামোর পরিধির মধ্যে, প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বিষয়ে তাদের নিজস্ব পাঠক্রম তৈরি করবে এবং উ.শি হবে একটি অবাধনীতি(laissez-faire) বিষয়। উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরে দেশের শিক্ষা সংক্রাম্ত চাহিদাকে চিহ্নিত করা বা অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ গঠনের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাবে কোন ধরণের রাষ্ট্রীয় দিক নির্দেশের লক্ষণ নেই। এগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বোধের ওপরে,সম্ভবত বাজারের সংকেত দ্বারা পরিচালিত হবে বিষয়গুলো।
১৬.৪ পেশাদার এবং কারিগরি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিস্তৃতভাবে একই ধাঁচা অনুসরণ করা হয়, তার সাথে যুক্ত হওয়া দুর্বলতা হল কোর্স, পাঠ্যক্রম ইত্যাদি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় বৈজ্ঞানিক বা শিল্প অগ্রাধিকারের সাথে কোনও যোগসূত্রের চিহ্ন নেই।
১৬.৫ ক্রমশ স্বায়ত্তশাসন প্রাপ্ত কলেজগুলোর ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতা অর্জন হওয়ার অভিজ্ঞতা এখন পর্যন্ত দেখিয়েছে যে কলেজগুলোর স্বায়ত্তশাসনটির অর্থ কেবলমাত্র আরও বেশি বেসরকারীকরণ, উচ্চতর ফি এবং প্রয়োজনভিত্তিক স্বল্প-মেয়াদী কোর্স দেওয়ার স্বাধীনতার সাথে উচ্চ শিক্ষায় আরও বাণিজ্যিকীকরণ।
১৭.উপরোক্ত প্রস্তাবগুলো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রস্তাবিত নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সাথে যুক্ত।এনইপিতে বিস্তৃত কাঠামোটি একটি তথাকথিত "হালকা এবং টাইট" কাঠামোর জন্য।ধারণা করা যায় এর অর্থ ফলাফলের জন্য কেবল বিস্তৃত একাডেমিক কাঠামো এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থা স্থাপন করা, উভয়েরই অনুশীলন করা হবে "দৃঢ় ভাবে"কিন্তু পাঠ্যক্রম, ফি, কোর্স কাঠামো, শিক্ষকদের বেতন ও কাজের শর্ত ইত্যাদির মতো প্রায় সমস্ত কিছু রাখা হবে "হালকা" নিয়ন্ত্রনে , আসলে বিনা নিয়ন্ত্রনে এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্জিমাফিক।এটি উচ্চ শিক্ষার কর্পোরেটকরণ, বেসরকারীকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণের একটি উন্মুক্ত আমন্ত্রণ।
১৭.১ কর্পোরেট কাঠামোর সাথে সাদৃশ্যটি এনইপি প্রস্তাবনার দ্বারা স্পষ্ট করা হয় যে প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বতন্ত্রভাবে তার নিজস্ব বোর্ড অব গভর্নর গঠন করবে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত বিষয়গুলির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেবে।
১৭.২ পৃথক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের “মানসেবামূলক”(পড়ুন কর্পোরেট)উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে হবে এবং তাদের নিজস্ৱ ফি-কাঠামো ঠিক করার স্বাধীনতা থাকবে, সম্ভবত বিস্তৃত সরকারি নির্দেশিকাগুলোর অভ্যন্তরে থেকে তারা এই কাজ করতে পারবে যেখানে “ফি নির্ধারণের পদ্ধতিটি ব্যয় পুনরুদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করবে।"অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতে যেমন বিদ্যুত বিতরণ সংস্থা, বিমান সংস্থা ইত্যাদিতেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় যেখানে সরকার কর্পোরেটের জন্য ভাল আয় নিশ্চিত করার সুবিধার্থী হিসাবে "নিয়ন্ত্রণ" এর খোলশে কাজ করে।
১৭.৩ এই নিয়ন্ত্রণকারী কাঠামোটি বোঝায় যে সরকার কেবলমাত্র "হালকা" মান নিয়ন্ত্রণের কাজ করবে, তবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের এই জাতীয় মানগুলো পূরণ করতে সক্ষম করার জন্য তহবিল সরবরাহের কোনও দায় নেবে না।এনইপি তে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল গঠনের বিষয়ে কোন প্রস্তাব নেই,সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি তহবিল ব্যবহারের বিশেষ সুযোগ থাকবে নাকি সকলের জন্য সমান ব্যবস্থা এই পদ্ধতি তহবিলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে স্পষ্ট নয়। পর্যাপ্ত সরকারি সাহায্যের অভাবে সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মত পন্থা নিতে বাধ্য হবে যার ফলে বানিজ্যিকীকরণ বাড়বে ও উচ্চশিক্ষায় ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার কমবে।
১৮. এনইপিতে প্রস্তাবিত সকল ব্যবস্থায় অতিমাত্রায় কেন্দ্রিককরণ রয়েছে, নিতান্ত বাস্তবায়ন ব্যতীত উচ্চ শিক্ষায় রাজ্যগুলির খুব কম বা কোনও ভূমিকা নেই।
১৮.১ নিয়ন্ত্রনের জন্য National Higher Education Regulatory Council (NHERC),অনুমোদনের জন্য National Accreditation Council (NAC),অনুদানের জন্য Higher Education Grants Council (HEGC) এবং শিক্ষার ফলাফলের মূল্যায়নের জন্যGeneral Education Council (GEC) এর মত একাধিক কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে Higher Education Commission of India (HECI) নামক একটি শীর্ষ সংস্থা তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলাফলের মূল্যায়নও কেন্দ্রীয়ভাবে করা হবে যার ভিত্তিতে ক্রমতালিকায় অবস্থান , অনুমোদন ও প্রাপ্য তহবিল নির্ধারিত হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য শিক্ষাবিদ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়া নিয়ে অনেক কথা হলেও, সরকারের হস্তক্ষেপ স্পষ্ট।
১৮.২ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির জন্য একটি কেন্দ্রীয় সংস্থার তত্ত্বাবধানে জাতীয় স্তরে প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়া হবে যদিও এই পরীক্ষার মূল্য কতটা থাকবে তা প্রশ্নাতীত নয় কারণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই পরীক্ষার ফলকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য নিজেদের ইচ্ছানুসারে ব্যবহার করতে পারবে। রাজ্য বোর্ডগুলোর প্রাসঙ্গিকতা, তাদের দ্বারা পরিচালিত পরীক্ষাগুলো এখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে। রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য রাজ্য-স্তরের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে কীভাবে কাজ করার প্রত্যাশা করা হয় তা এনইপির দ্বারা চিহ্নিত হয়নি, স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে দেশের সকল উচ্চশিক্ষআ প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত এই কেন্দ্রীয় সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হবে।
১৯.বেসরকারিকরণ ও কর্পোরেটকরণের এই নয়া উদারবাদী প্রেক্ষাপটে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভারতে ডাকার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। যদিও এটা উচ্চশিক্ষায় "চিকিত্সা পর্যটন" এর সমতুল্য একটা প্রক্রিয়া হিসাবে দেখানোর ব্যর্থ প্রয়াস হতে পারে তবে এটা কাজের ক্ষেত্রে কিছু ভিন্ন আঙ্গিকও তুলে ধরে।এটা ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আদপে একটা আদর্শ তৈরি করে দেবে যার মধ্যে কর্পোরেট পরিচালনার কায়দা, বাজারকেন্দ্রীক পাঠ্যক্রম তৈরি,শিক্ষকদের চুক্তিভিত্তিক বা আংশিক সময়ের জন্য নিয়োগ ও উচ্চ হারে ফি এই সবই অনুসরণ করতে হবে। এটা বেশ ‘কঠিন’ ; “বিদেশী” বিশ্ববিদ্যালয়কে “স্বদেশী” ভারতে ডাকা হচ্ছে।
২০. একটা কেন্দ্রীয় ‘জাতীয় গবেষণা তহবিল’ (NRF-National Research Fund ) স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে যা সরকারি এবং বেসরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণার জন্য অনুদান দেবে। আবারও, যেমনটা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, এই NRF ,দেশের বৈজ্ঞানিক বা শিল্প ভিত্তিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তার থেকেও বেশি, গবেষণা প্রস্তাব এসেছে তাই..., সেই প্রবনতায় বেশি নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত, গবেষণা অগ্রাধিকার এবং এ্যাজেন্ডাগুলো রাজ্যগুলোর দিকে সরানো নিয়ে আবারও কোনও লক্ষণ নেই, কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধানটা আরও বাড়িয়ে তোলা হবে।
২১. শিক্ষকরা এনইপি এর সম্ভাব্য প্রধান শিকার হতে চলেছে। পড়ুয়ারা এই ব্যবস্থায় গিনিপিগ হবে, বিশেষ করে দুর্বল অংশের পড়ুয়ারা, এই কর্পোরেট ধাঁচার উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য (১৩.৪-১৩.৭) তারা প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে।শিক্ষকদের বেতন,কাজের প্রকার ও চাকরির মেয়াদ, পদোন্নতি ইত্যাদির বিষয়ে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কোন অভিন্ন মান বা নীতি না থাকায় সংশ্লিষ্ট উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের BoG কর্তৃক অভ্যন্তরীণভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কাজের মূল্যায়ণ হবে বিষয়গত এবং কোনও তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত।
২২. এনইপি তে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাগত বা প্রশাসনিক গণতন্ত্রীকরণের কোন অবকাশ নেই। শিক্ষক, অন্যান্য কর্মচারীদের জন্য কোন ভূমিকার কথা এতে ভাবা হয়নি এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাকেন্দ্রীক বা প্রশাসনিক সংস্থায় শিক্ষার্থীদের জন্য কোন ভূমিকারও উল্লেখ নেই।
শেয়ার করুন