বাম পথে হন্ডুরাস - শান্তনু দে....

২ ডিসেম্বর ২০২১

বলিভিয়ার পর এবার হন্ডুরাস!

হন্ডুরাস মুক্ত! ফিরলো বামপন্থায়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়েছেন বামপন্থী প্রার্থী জিয়োমারা কাস্ত্রো। সেইসঙ্গেই বারো-বছরের রক্ষণশীল, উগ্র দক্ষিণপন্থী মাদক-স্বৈরাচারী জমানার অবসান। লাতিন আমেরিকায় মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠান এক জোরালো আঘাত। হন্ডুরাসে এক নতুন যুগের সূচনা।

জিয়ামারা কাস্ত্রো

৫৩.২৬ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন লিবার্টি অ্যান্ড রিফাউন্ডেশন পার্টি (লিবরে)-র নেত্রী জিয়োমারা কাস্ত্রো। শাসকদল ন্যাশনাল পার্টির প্রার্থী, রাজধানী তেগুচিগালপার মেয়র নাসরি আসফুরা পেয়েছেন সাকুল্যে ৩৪.১৮ শতাংশ ভোট। শুধু তাই নয়, আড়াইদশক পর এই প্রথম রাজধানী শহরের মেয়র-পদও শাসকদলের হাতছাড়া হয়েছে। তেগুচিগালপার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন একজন বামপন্থী প্রার্থী।

জিয়ামারা কাস্ত্রো

‘লেডি কাস্ত্রো’ হতে চলেছেন হন্ডুরাসের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি। ৬২-বছরের কাস্ত্রোর স্বামী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ম্যানুয়েল জেলায়া। বারো-বছর আগে মার্কিন মদতে সামরিক অভ্যুত্থানে যাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। সমর্থন করেছিল ওবামা প্রশাসন। পোরফিরিও লোবো’কে দিয়ে শুরু। পরে ২০১৪ থেকে হুয়ান ওরলান্দো হার্নান্ডেজের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত মাদক-স্বৈরাচারী জমানা।

জিয়োমারা কাস্ত্রোর সঙ্গে ম্যানুয়েল জেলায়া

হার্নান্ডেজের বেপরোয়া দুর্নীতির সঙ্গে তীব্র শ্রমিক-বিরোধী নীতি, যা ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে দারিদ্র, তার বিরুদ্ধে তুমুল প্রচারাভিযানই বিপুল জয় এনে দিয়েছে কাস্ত্রোকে। তিনি নিজের কর্মসূচীকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী বলে ঘোষণা করেছেন।

গতবছরই দুনিয়া দেখেছে বলিভিয়াকে। সেনা অভ্যুত্থান থেকে গণ অভ্যুত্থান। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় চোয়ালচাপা লড়াই। শেষে এক দুর্দান্ত জয়। বলিভিয়া ফিরেছে বামপন্থায়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হন্ডুরাস।

এবারে কাস্ত্রোর প্রচারাভিযানের লক্ষ্য ছিল দেশের শ্রমিকশ্রেণি, মেহনতি মানুষ। যদিও, ২০০৫ সালে জেলায়া নির্বাচিত হয়েছিলেন তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থী অবস্থান থেকে। অবশ্য দ্রুতই তিনি বামপন্থার দিকে ঝোঁকেন। দারিদ্র দূরীকরণে নেন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জোরদার করেন হন্ডুরাসের সার্বভৌমত্বকে। উন্নত করেন পরিকাঠামোকে। দেশকে যুক্ত করেন আলবা’র সঙ্গে, যে সংগঠন তৈরি করেছিল কিউবা আর ভেলেজুয়েলা, যার লক্ষ্য লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয় দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা। পেট্রোক্যারিবের কর্মসূচীর সুফল পায় হন্ডুরাস, ভেনেজুয়েলার মতো তেল-সমৃদ্ধ দেশগুলির থেকে পায় জ্বালানির সুযোগ। একইসঙ্গে জেলায়া তোলেন সোতো কানো থেকে মার্কিন সেনাঘাঁটির ঝাঁপ বন্ধ করার দাবি।

ফেব্রুয়ারি, ২০০৯। কারাকাসে আলবা’র বৈঠক উপলক্ষে ম্যানুয়েল জেলায়া। সঙ্গে কিউবার প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হোসে রামন মাচাদো, দানিয়েল ওর্তেগা, উগো সাভেজ এবং ইভো মোরালেস

জেলায়ার সময় প্রায় দ্বিগুণ করা হয় ন্যূনতম মজুরি। শিশুদের জন্য সুনিশ্চিত করা হয় সর্বজনীন বিনামূল্যে শিক্ষা। ১৬ লক্ষের বেশি শিশুর জন্য নিশ্চিত করা হয় স্কুল-মিল। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে করা হয় ভূমি সংস্কার। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত করতে ডাক্তার নিয়ে আসা হয় কিউবা থেকে। হতদরিদ্র মানুষদের অধিকাংশের ঘরে পৌছে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ। হন্ডুরাসে দারিদ্র সীমায় থাকা মানুষের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০ শতাংশ।

ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে ম্যানুয়েল জেলায়া। রয়েছেন রাউল কাস্ত্রো

আর সেকারণে ওয়াশিংটনের রোষের মুখে পড়ে হন্ডুরাস! সেনা অভ্যুত্থানে অপসারিত হন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জেলায়া। আর অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ থেকেই জন্ম নেয় লিবরে পার্টি। অভ্যুত্থান-উত্তর দিনগুলিতে প্রতিরোধের মুখ হিসেবে উঠে আসনে জিয়োমারা কাস্ত্রো। নির্বাচনী প্রচারে তিনি বলেছেন শ্রমিকশ্রেণি ও গরির মানুষের স্বার্থরক্ষার কথা। তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার সঙ্গেই বলেছেন চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বানিজ্যিক সম্পর্ক পুনর্স্থাপনের কথা। যখন তাইওয়ান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু। ওয়াশিংটন হন্ডুরাসের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখাবে বলে আশাপ্রকাশ করেছে বেজিঙ। মধ্য আমেরিকায় ওয়াশিংটনের ‘আধিপত্যবাদী আচরণ’ নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন চীনের বিদেশমন্ত্রী।

জয়ের পর কাস্ত্রো বলেছেন, স্বৈরাচারকে আমরা হারিয়ে দিয়েছি। ‘বারো বছর মানুষ ছিলেন প্রতিরোধ সংগ্রামে। তাঁদের বারো বছরের এই আত্মত্যাগ কখনও ব্যর্থ হবে না। এই বারো বছর আবারও প্রমান করেছে মানুষই পারে মানুষকে রক্ষা করতে।’ আমরা শান্তি ও ন্যায়ের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত প্রশ্নে নেওয়া হবে গণভোট। ‘এই দেশে আর ক্ষমতার অপব্যবহার হবে না।’

জিয়োমারা কাস্ত্রো

লিবরে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হুয়ান বারাহোনা ২০১৭ সালেই হন্ডুরাসের সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি হন্ডুরাসের ইউনিফাইড ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের প্রধান। বছরতিনেক আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের পরিবর্তনের লক্ষ্যে ক্ষমতায় যাওয়াই আমার স্বপ্ন, যাতে শুরু করা যায় একটি পৃথক ব্যবস্থা, একটি সমতাবাদী ব্যবস্থা, একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা।’


শেয়ার করুন

উত্তর দিন