সংগ্রাম চ্যাটার্জি
"এই কথা আজ বলে যাব, প্রবলপ্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে..."
রবীন্দ্রনাথ: সভ্যতার সংকট; পয়লা বৈশাখ, ১৩৪৮ / এপ্রিল, ১৯৪১
সেই ঐতিহাসিক দিনে
বাকিটা তার আগেই ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে গেছে, কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি ছিল শুধু। এবার মিত্রশক্তির চার প্রতিনিধির সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলেন জার্মান সেনার সর্বোচ্চ নেতৃত্ব! অবশেষে পরাজিত হল একদা অপরাজেয় নাৎসি বাহিনী, আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে অভিঘাতময় পর্ব— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর প্রায় ৫ কোটি জীবনের বিনিময়ে (যার সিংহভাগই সোভিয়েত ইউনিয়নের) বিশ্ব মানবতা তার সবচেয়ে বড় বিপদকে মোকাবিলা করে ইতিহাসের ভয়ংকরতম অধ্যায় পেরিয়ে পা রাখল নতুন এক পর্বে।
তখন বার্লিনে ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেরিয়েছে, ফলে ক্যালেন্ডারে ৯ মে। সালটা ১৯৪৫।
বার্লিনের সংসদ ভবন রাইখস্ট্যাগের মাথায় তখন লালঝান্ডা হিল্লোলিত হচ্ছে। সেই রাইখস্ট্যাগ— যেখান থেকে একদা শুরু হয়েছিল তৃতীয় রাইখের নামে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর জয়যাত্রা! সেই রাইখস্ট্যাগ— যা পুড়িয়ে দেওয়ার মিথ্যে মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সাধারণ সম্পাদক কমরেড দিমিত্রভের ঘাড়ে! সেই রাইখস্ট্যাগ— যা ক্রমেই চিহ্নিত হয়েছিল ফ্যাসিবাদের জয়ের প্রতীক হিসেবে! সেই রাইখস্ট্যাগের চুড়োয় তখন লালঝান্ডা! আজ থেকে ৮০ বছর আগে...
"যুদ্ধ আর আশার মধ্যে এ-এক দৌড় চলছে বটে! একরকম মৃত্যুর সাথে আরেকরকম মৃত্যুর প্রতিযোগিতা। কে আগে? — ফ্যাসিজমের মৃত্যু? না আমার?.........ধনতন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণুতা আজ পৃথিবীকে বিভীষিকায় আচ্ছন্ন করেছে। হাজার হাজার মানুষ মরবে! তারপর যারা বেঁচে থাকবে তারা বলবে— ফ্যাসিজমের অধ্যায় আমি পার হয়ে এলাম!"
জুলিয়াস ফুচিক: ফাঁসির মঞ্চ থেকে

আগের কিছু কথা
সালটা ১৯১৭, নভেম্বর মাস। মানব সভ্যতার অন্যতম যুগান্তকারী অধ্যায়ের সাক্ষী থাকল গোটা বিশ্ব— কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি বা রুশ কমিউনিস্ট পার্টির হাত ধরে নেমে আসা অকাল বসন্তের ছোঁয়ায় সমাজ বিকাশ এক অন্য ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করল! রুশ বিপ্লব জন্ম দিল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার, এই প্রথমবার শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রব্যবস্থা পথ চলা শুরু করেই পাল্লা দিল তাবড় তাবড় পুঁজিবাদী দেশগুলোর সাথে। গোটা মানবসভ্যতার সামনে হাজির করল প্রকৃত বিকল্প, প্রকৃত স্বাধীনতা এবং তখনও পর্যন্ত সবথেকে প্রসারিত এবং আক্ষরিক অর্থেই সবচেয়ে গভীরে প্রোথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে। শুরুতেই এই বিকল্পকে সমূলে উৎখাত করার লক্ষ্যে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইউরোপের এক সে এক পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি! বিপ্লবকে রক্ষা করার মরণপন জেদে, এই আক্রমণ আর ঘরের মধ্যেকার বিদ্রোহকে একযোগে সামাল দিতে আরও একবার যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করল রুশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন লালফৌজ। পরাজিত পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ এবার পথ বদলে যে পথে চলা শুরু করল, তারই এক পর্যায়ে সামনে এল বিশ্ব মানবতার ঘৃণ্যতম শত্রু— মানবসভ্যতার সামনে আসা সবচেয়ে বড় বিপদ: ফ্যাসিবাদ!
ফ্যাসিবাদ কী?
ব্রিটিশ কমিউনিস্ট নেতা রজনী পাম দত্তের মতে ফ্যাসিবাদ হচ্ছে চরম অবক্ষয়ের এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে আধুনিক পুঁজিবাদের পূর্ণাঙ্গ ও সবচেয়ে 'স্বাভাবিক' রূপ! তাঁর মতে, ফ্যাসিবাদের বিকাশের জন্য একদিকে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপট, প্রচলিত সংসদীয় ব্যবস্থার সম্পর্কে ব্যাপক মোহভঙ্গ, সমাজের বড় অংশের ওপরে পুঁজিপতি শ্রেণির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের পাশাপাশি শ্রমিকশ্রেণির দুর্বলতাও দায়ী।
এই ক্ষেত্রে আবার কমরেড স্তালিনের কথায়: শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণির না, বরং পুঁজিপতি শ্রেণির দুর্বলতার অন্যতম লক্ষণ ফ্যাসিবাদ, যখন আর পুঁজিপতি শ্রেণি একদিকে নিজ নিজ দেশের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং অন্যদিকে অন্যান্য দেশের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলা করতে পারে না, তখনই উদ্ভব হয় ফ্যাসিবাদের!
তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কমরেড দিমিত্রভের ফর্মুলেশন (যা ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ৭ম কংগ্রেস অনুমোদন করে) অনুযায়ী "ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদ হচ্ছে লগ্নিপুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী অংশের সর্বোচ্চ প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব"।
এককথায় বললে, ফ্যাসিবাদ হল বিকৃত পুঁজিবাদ!
ইউরোপে ফ্যাসিবাদের সূচনা পর্ব: ইতালি
আধুনিক পুঁজিবাদের উত্থানভূমি খোদ ইউরোপেই ক্ল্যাসিক্যাল ফ্যাসিবাদের জন্ম! একদা যে দেশ ইউরোপিয় রেনেসাঁর অন্যতম কেন্দ্র— সেই ইতালিতেই প্রথম থাবা বসাল এই মতবাদ, মুসোলিনি আর তার রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট পার্টির হাত ধরে!
১ম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত, আর্থিকভাবে জর্জরিত এবং ভার্সেই চুক্তির ফলে চরম অপমানিত একটা দেশে যখন এই অবস্থার বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়ছে, যখন প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হচ্ছে সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি— ১৯২২'র নির্বাচনে ২৭৩ টি আসনের মধ্যে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা পেল ১২২, টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি ১১৬ টি! এই প্রেক্ষাপটে রুশ বিপ্লবের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় ইতালি আরেকটা রাশিয়া যাতে না হয়ে যায়— সেই লক্ষ্যে হাত মেলালো কমিউনিস্ট বিরোধী সবকটা শক্তি, সামনে ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টি ও তার নেতা বেনিটো মুসোলিনী!
ঐ ১৯২২ সালেরই শেষদিকে তার কুখ্যাত 'ব্ল্যাকশার্ট বাহিনী' নিয়ে মুসোলিনির রোম অভিযান এবং ক্ষমতা দখলেই এই পর্ব শেষ হল না, বরং এইবারে শুরু হল আসল 'খেলা'! প্রাচিন রোমের আধা কাল্পনিক কীর্তিকলাপকে আধুনিক মোড়কে সামনে এনে সেই মত দেশ গড়ার স্লোগানে গোটা দেশ জুড়ে সৃষ্টি করা উগ্র দেশপ্রেমের গণ হিস্টিরিয়ার কুয়াশার পিছনে শুরু হল নির্মমভাবে কমিউনিস্ট নিধন যজ্ঞ, সঙ্গী হল সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা, এবং বাকি সব কমিউনিস্ট বিরোধী শক্তি!
১৯২৬ সালে ইতালির একনায়ক (ডুস্যে) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন মুসোলিনি, আর পথ চলা শুরু করল পুঁজিবাদের বিকৃততম রূপ ফ্যাসিবাদ!
এরপর জার্মানি: হিটলার ও নাৎসিবাদ
কিছু পার্থক্য থাকলেও মোটামুটি ইতালির মুসোলিনির মডেলের 'অনুপ্রেরণা'য় জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ কায়েম হল হিটলারের নেতৃত্বে, তার নাৎসিবাহিনীর চরম আগ্রাসনের মাধ্যমে। ইতালির মত এখানেও যেমন ছিল ১ম বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে পাওয়া বঞ্চনা, সাথে জার্মানির আধা কাল্পনিক অতীত-গৌরবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্লোগান, তেমনি ছিল উগ্র, অন্ধ কমিউনিস্ট বিরোধিতা। এতে সামিল হল চার্চ, শিল্পপতি / বড় পুঁজিপতি, মিলিটারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
সাথে যুক্ত হল একদিকে জার্মানির পুরাতন রাজতন্ত্রের পছন্দের স্লোগান— পূর্ব সীমান্তের রাশিয়ার জমি কেড়ে জার্মানদের বাঁচার মত জায়গা চাই (লিবেনস্রম), বৃহত্তর জার্মানি পুনঃদখলের আওয়াজ।
সর্বোপরি চরম উগ্র ইহুদি বিরোধিতা— যে ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের একটা সামগ্রিক পরিমণ্ডল আগে থেকেই জার্মানিতে ছিল। আর, হিটলারের বর্ণিত "খাঁটি আর্য" জার্মান রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষায় 'বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্ব'-র স্লোগান ছিল সেই বিদ্বেষের বাতাবরণকে চাগিয়ে তোলা এবং ধরে রাখার অন্যতম তাত্ত্বিক ভিত্তি!
এই "নিকৃষ্ট রক্তের জাত"(!), "কসাই"(!) ইহুদিদের এবং এদের একমাত্র মদতদাতা এবং জার্মানির উন্নতির পথে একমাত্র শত্রু "দেশদ্রোহী"(!) কমিউনিস্টদের একেবারে চেঁছেপুঁছে সাফ না করলে "জার্মান শ্রেষ্ঠত্ব" অর্জন করা সম্ভব না— এই ছিল হিটলারের প্রচার! যার মাধ্যমে সংসদীয় নির্বাচনে বড় অংশের মানুষের সমর্থনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন হিটলার!
এই সবকটা প্রবণতার এখনকার আমাদের দেশের পরিস্থিতির কিছুটা হলেও মিল খুঁজে পাচ্ছেন না?
এই সব কিছুর সাথে হিটলারের প্রচার প্রোপাগাণ্ডার কথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার। নাৎসি পার্টির প্রচার সচিব গোয়েবলসের নেতৃত্বে অর্ধসত্য ভাষণ তো বটেই, এমনকি রাতকে দিন করে দেওয়া মিথ্যা কথা চুড়ান্ত নৈপুণ্যের (!) সাথে বারেবারে প্রচার করে সেটাকেই জনমানসে সত্যি কথা হিসেবে গেঁথে দেওয়ার এই অভূতপূর্ব প্রক্রিয়াটিকে বাদ দিয়ে হিটলার আর তার রাজনীতিকে বোঝা সম্ভব না (আপনি যদি এর সাথে ‘গোদি মিডিয়া’র মিল খুঁজে পান, কারোর কিছুই বলার নেই!)!
মুসোলিনির কুখ্যাত ‘ব্ল্যাকশার্ট বাহিনী’র মত এখানেও সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সমান্তরালে তৈরি হল ততোধিক ভয়ংকর 'ব্রাউন শার্ট' বাহিনী। (এই ব্ল্যাক শার্ট, ব্রাউন শার্ট ইত্যাদির সাথে কোথাও গিয়ে সাদা জামা আর খাঁকি প্যান্ট পরা চেনা লোকজনের মিল পান না?!)
আরও যে দুটো শব্দ বাদ দিয়ে হিটলার অসম্পূর্ণ, তা হল ‘SA’ (‘ঝটিকা বাহিনী’), এবং অবশ্যই গেস্টাপো (নাজিদের গোপন পুলিশ)!
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্রের সবকটি স্তম্ভ একে একে করায়ত্ব করে তারপর একদিকে তৎকালীন জার্মান পুঁজিপতিদের থেকে পাওয়া অফুরন্ত ফান্ড, আরেকদিকে গোয়েবলসীয় প্রচার এবং সর্বোপরি ‘SA’, ব্রাউন শার্ট বাহিনী আর গেস্টাপোর নিপুণ (!) ব্যবহারের মাধ্যমে বিরোধীদের— বিশেষ করে কমিউনিস্ট ও ইহুদিদের উপর ভয়াবহ মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার চালিয়ে, কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে ঢুকিয়ে সীমাহীন অত্যাচার চালিয়ে, খুন করে, আইনস্টাইন সহ হাজারো প্রথিতযশা মানুষকে স্রেফ ইহুদি হবার কারণে দেশছাড়া করে, বার্লিনের রাস্তায় প্রকাশ্যে লাখো লাখো বই জ্বালিয়ে (১০ মে, ১৯৩৩) গোটা দেশজুড়ে লাগাতার খুন- সন্ত্রাসের নারকীয় পরিবেশ তৈরি করে এবং সাথে সাথে উগ্র জাতীয়তাবাদী গণ হিস্টিরিয়া সৃষ্টি করে দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে ১৯৩৪ সালে ডিক্টেটরশিপ চালু হয় হিটলার আর তার নাৎসি বাহিনীর নেতৃত্বে! এখন থেকে তিনি জার্মানির সর্বময় কর্তা, ফ্যুয়েরার!

‘Final Solution’!
যার পুরো বাক্যটা হবে: "The "Final Solution to the Jewish question" ! অর্থাৎ??? অর্থাৎ আর কিছুই না, ১৯৩৫ সালে জার্মান পার্লামেন্ট (রাইখস্ট্যাগ) গৃহীত হিটলারি আইন— জার্মান নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের চুড়ান্ত সমাধান। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে এক ধর্মের মানুষকে ২য় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে তারপর তাদের নিয়ে কী করা যায়? এরই সমাধানের কোড নেম হচ্ছে ঐ ‘Final Solution’!
প্রথমে বসতির মধ্যে চিহ্নিত করা, তারপর তাদের একটা ছোট্ট অংশে ঘিরে ফেলা (ঘেটো), তারপর একদিন সবাইকে তুলে নিয়ে রেলগাড়ি চাপিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া নতুন ঠিকানায়— যে ঠিকানার নাম (মোদী জমানায় ডিটেনশন ক্যাম্প) ঐ হিটলারের জমানায় ছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। যার সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী ক্যাম্প বা ক্যাম্পগুচ্ছের নাম ছিল আউৎসউইচ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প— ১৯৪২-র মে মাস থেকে চালু হওয়া পৃথিবীর নিকৃষ্টতম কারাগার!
এবার স্পেন: রণাঙ্গণে মুখোমুখি দুই শিবির
৩০'র দশকের গোড়াতে স্পেনে ধারাবাহিকভাবে গণআন্দোলন-গণসংগ্রামের তীব্রতা বাড়ার প্রেক্ষাপটে একে মোকাবিলায় ফ্যাসিস্টদের বাড়াবাড়িও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পপুলার ফ্রন্ট ১৯৩৬-র নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এই সরকার, এবং সামগ্রিকভাবে বাম- গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ফ্যাসিস্ট ফ্যাঙ্কোর উদ্যোগে হাত মেলায় সবরকম প্রতিক্রিয়ার শক্তিরা। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ!
সশস্ত্র রণাঙ্গণে মুখোমুখি দুই শিবির! ফ্যাসিস্ট ফ্যাঙ্কোর পক্ষে সরাসরি নেমে পড়ে ইতালি ও জার্মানি। উল্টোদিকে পপুলার ফ্রন্টের সরকারকে সমর্থন করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত, এবং ফ্যাসিবিরোধী এই সংগ্রামে সরাসরি যুক্ত হন সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কমিউনিস্টরা এমনকি লেখক-শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মীরাও! এই লড়াইকে সংহতি জানায় আমার দেশের বুদ্ধিজীবি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোও। স্পেনে গড়ে ওঠে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড! মুখোমুখি লড়াইয়ে শহীদ হন ক্রিস্টোফার কডওয়েল, র্যালফ্ ফক্সের মত বুদ্ধিজীবিরা!
এই মুখোমুখি লড়াইয়ের ময়দানেই সোচ্চারিত হয় স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী কমরেড ইবারুরির সেই স্লোগান: "নো পাসারন"!
এই লড়াইয়ে ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোর জয় স্পেনের মাটিতে বেশ কিছু বছরের জন্য ফ্যাসিবাদকে স্থায়িত্ব দিলেও ফ্যাসিবিরোধী শক্তির অসামান্য লড়াই প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উৎসাহিত করে চলেছে...
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: কারণ ও প্রেক্ষাপট
আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধের সূচনার অন্ততঃ দশটা বছর আগে থেকেই এর প্রস্তুতি চলেছে — বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দায় জর্জরিত পুঁজিবাদী দেশগুলি এই ভয়াবহ সংকট থেকে বেরনোর লক্ষ্যে যেমন বিশ্ব বাজারকে ভাগবাঁটোয়ারা করার প্রয়াস নিল— যার আবশ্যিক পরিণতি আরও একটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, এবং চুড়ান্ত পরিণতি অবশ্যই ফ্যাসিবাদের উদ্ভব। এবং সেটাই তো হল!
কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অন্ততঃ গোটা চারেক যুদ্ধ বা আগ্রাসনের ফল— ইতালির আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) আক্রমণ, জাপানের চিন ও মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ, স্পেনের গৃহযুদ্ধ, এবং জার্মানির অস্ট্রিয়া ও পরে চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ! সর্বোপরি ১৯৩৯-র ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের পোলাণ্ড আক্রমণের দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার দিন হিসেবে চিহ্নিত হল। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে
ইউরোপে ইতালি, জার্মানি এবং স্পেন; পূর্ব এশিয়ার জাপানকে নিয়ে গঠিত ব্লকের (অক্ষশক্তি) বিরুদ্ধ শক্তি একযোগে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তি। এককথায় পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সর্বোত্তম বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল এই ২য় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে।
শুধু এই দ্বন্দ্বটাই না, আমরা কমিউনিস্টরা যে চারটি মৌলিক সামাজিক দ্বন্দ্বের কথা বলে থাকি তার সবকটাই প্রকটভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এই ২য় বিশ্বযুদ্ধে। একটির কথা তো এক্ষুনিই লিখলাম, এর ঠিক আগের পরিচ্ছেদে উল্লিখিত আছে আরও দুটির কথা— স্পেনের গৃহযুদ্ধ ছিল শ্রমিক বনাম পুঁজিপতিদের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন, এবং জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ ও ইতালির আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) আক্রমণ ছিল তৃতীয় দুনিয়ার দেশের সাথে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশের দ্বন্দ্ব।
এখন পর্যন্ত চতুর্থ বা বর্তমান সময়ের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বের কথাটা এল না! সেটা সামনে এল আরও প্রায় পৌনে ২ বছর পরে— ১৯৪১-র ২২ জুন 'অপারেশন বারবারোসা'র হাত ধরে, অর্থাৎ অনাক্রমতা চুক্তি ভেঙে নাজি জার্মানির সোভিয়েত আক্রমণের দিন থেকে।যুদ্ধের চরিত্র পাল্টে গেল এক লহমায়, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রূপ নিল সাম্রাজ্যবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্বে। যে দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি ঠিক করে দেবে বিশ্ব মানবতার ভবিষ্যৎ— হয় সমাজতন্ত্র অথবা চরম বর্বরতা!
অপারেশন বারবারোসা থেকে শেষ যুদ্ধ
বাঁধভাঙা বন্যার জলের মত তীব্রতার সাথে সোভিয়েত সীমানায় আছড়ে পড়া নাজি বাহিনী একযোগে চালালো ত্রিমুখী আক্রমণ— একদম উত্তরে লেলিনগ্রাদ, মাঝে রাজধানী মস্কো এবং দক্ষিণে স্তালিনগ্রাদের দখল নেবার চরম আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে একদিকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে গুছিয়ে নেওয়া, অবিশ্বাস্য তৎপরতার সাথে কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী কারখানাগুলিকে যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনকারী কারখানায় রূপান্তরিত করা, পাল্টা আঘাতের প্রস্তুতি নেওয়া, এবং সর্বোপরি গোটা সোভিয়েতের জনগণকে বিশ্ব মানবতার স্বার্থে নিজ পিতৃভূমি রক্ষার এই ভয়ংকরতম যুদ্ধে সামিল করার কাজটিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিলেন কমরেড স্তালিন।
নাৎসি জার্মান ফোর্স সেই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী, ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের একের পর এক দেশের সেনা যার সামনে কার্যত ফুৎকারে উড়ে গেছে, তার মোকাবিলায় প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে লালফৌজ, একের পর এক গ্রাম, শহর নিশ্চিহ্ন হচ্ছে প্রতিদিন; তারই মধ্যে কার্যত এক অসম লড়াই চালিয়ে সর্বোচ্চ প্রতিরোধ গড়ে তুলছে লাল ফৌজ আর সোভিয়েতের জনগণ।
এই প্রতিরোধ পর্বে ১৯৪২এ তেহরানে এবং আবারও ১৯৪৩এ মস্কো শীর্ষ বৈঠকে স্তালিন মিত্রশক্তির অন্য শরিকদের কাছে সরাসরি দাবি করেছেন ইউরোপের অন্য কোথাও একটা অন্ততঃ দ্বিতীয় ওয়ার ফ্রন্ট খোলার কথা, নইলে গোটা বাহিনীর সবটাই সোভিয়েতে মোতায়েন করার সুযোগ পাচ্ছে নাৎসিরা। ওদিকে যতই একসাথে থাকুক না কেন, মিত্রশক্তির অন্য শরিকদের কাছে হিটলারের জার্মানির মত স্তালিনের রাশিয়াও তো শত্রু! আসল লড়াইটা হচ্ছে সোভিয়েত-জার্মানির বর্ডার জুড়ে, আর ব্রিটেন-ফ্রান্স- মার্কিনিরা নিরাপদ দূরত্বে বসে অপেক্ষা করেছে যুদ্ধে উভয়েই দুর্বল হবে কখন, সেই সময়ের জন্য।
যখন ওঁরা বুঝতে পারলেন পুরো লড়াইটা সোভিয়েত লালফৌজ জিতে বেরিয়ে যাবে, তখন কার্যত বাধ্য হয়েই দ্বিতীয় ওয়ার ফ্রন্ট খোলা হল, কিন্তু সে তো অনেক পরে— ১৯৪৪-র ৬ জুন ফ্রান্সের নর্ম্যাণ্ডিতে অবশেষে নামে ব্রিটিশ-মার্কিন সেনা! ততক্ষণে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিয়েছে সোভিয়েতের লালফৌজের অসামান্য বীরত্বের সাথে লড়াই, সাথে অবশ্যই রুশ জনতার অভূতপূর্ব দেশপ্রেমিক ভূমিকা! পরপর মস্কো, লেলিনগ্রাদ এবং সর্বোপরি স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ জিতে মার্শাল ঝুকভের নেতৃত্বে এবার লালফৌজ এগোচ্ছে বার্লিনের দিকে। লক্ষ্য: একদা ফ্যাসিবাদের জয়ের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত রাইখস্টাগ!
রোমের রাস্তায় মুসোলিনি ততক্ষণে প্রকাশ্য ফাঁসিকাঠে ঝুলছে, আর ওদিকে বাঙ্কারের মধ্যে সদলবলে আত্মহত্যা করেছে অ্যাডলফ হিটলার!
বাকিটা তো শুরুর দিকেই লেখা আছে...

Vistula-Oddr Offensive
তদ্দিনে লেনিনগ্রাদ, মস্কো এবং সর্বোপরি স্তালিনগ্রাদের শেষ যুদ্ধে নাৎসী বাহিনীকে পরাস্ত করে পশ্চিম দিকে ধাওয়া করেছে লাল ফৌজ। আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই জার্মান রাইখস্ট্যাগের চুড়োয় উড়বে লাল পতাকা, ঠিক সেই সময়ে সোভিয়েত লাল ফৌজের সর্বাধিনায়ক কমরেড স্তালিন গঠন করলেন 'অপারেশন ভিস্তুলা ওডার', নেতৃত্বে মার্শাল ঝুকভ।
দিনটা ১২ জানুয়ারি, ১৯৪৫!
মাত্র ২ সপ্তাহের মধ্যে লাল ফৌজ পৌঁছে গেল আউৎসউইচ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের দৌড়গোড়ায়, আর ২৭ জানুয়ারি আউৎসউইচ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প মুক্ত করে মানবতার কলঙ্কতম এক অধ্যায় শেষ করল লাল ফৌজ!
২৭ জানুয়ারি মানবতার ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম দিন, দিনটা পালিত হয় 'Holocaust Remembrance Day' হিসেবে— এই দিনে লাল ফৌজ মুক্ত করেছিল আউৎসউইচ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পকে।
২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে এবং বিশেষ করে শেষ হবার পরে পূর্ব ইউরোপ জুড়ে এইরকম অসংখ্য কারাগার বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের হদিস পাওয়া যায়। মানবসভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে জঘন্যতম, সবচেয়ে ঘৃণ্য, সবচেয়ে বিকৃততম অপরাধসমূহ মঞ্চস্থ হয়েছিল এখানে বা এই ক্যাম্প গুচ্ছতে!
কয়েকটা সামান্য নিদর্শন মনে করিয়ে দিই শুধু:
এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে এনে মেরে ফেলার আগে গায়ের সোনাদানা তো নিয়েই নিত, মানুষের চুল কামিয়ে তা দিয়ে কুশন বানাত ফ্যাসিস্টরা!
গ্যাস চেম্বারে Zyklon B দিয়ে মেরে ফেলা মানুষের চামড়া দিয়ে নানান শৌখিন জিনিসপত্রে ঘর উপচে পড়ত হিটলারের নিচু থেকে উঁচু সব অফিসারদের!
এর চেয়েও নৃশংস অপরাধ ছিল— জীবন্ত মানুষকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হত এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলিতে!
মহাযুদ্ধ শেষের পরে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লালফৌজের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের বিজয় পরবর্তী বিশ্ব-পরিস্থিতির পরিবর্তনের গতিমুখকে নিয়ন্ত্রণ করে যেদিকে, তার ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন
- পূর্ব ইউরোপের বহু দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয়।
- শক্তিশালী হয় এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকা জুড়ে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, পরিণতিতে উপনিবেশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং স্বাধীনতা অর্জন করে আমার দেশের মত বহু দেশ।
- একইসাথে বিশ্ব পুঁজিবাদ বাধ্য হয়েই আশ্রয় নেয় কল্যাণমূলক অর্থনীতির। গণতন্ত্র, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র, সামাজিক নিরাপত্তা, বেকার ভাতা ইত্যাদি সবই এই ঐতিহাসিক বিজয়ের ফলশ্রুতি।
এক কথায় গোটা দুনিয়ার সামাজিক ভারসাম্য বিপুল পরিমাণে পরিবর্তিত হয়। গোটা দুনিয়ার সামনে অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে উঠে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন, এশিয়া ভূখণ্ডে নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে উঠে আসে চীন, বেশ কিছু পরে ভিয়েতনাম। পরের ২ দশকের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় এক তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে সমাজতান্ত্রিক ব্লক।
এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির জয় না হলে পৃথিবীর ইতিহাসটাই পাল্টে যেত, মানবতার সবটুকু আলোকোজ্জ্বল দিক ঢেকে যেত গভীরতম অন্ধকারে! সেই অর্থে বিশ্বযুদ্ধের শেষটা কার্যত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মানবতা বনাম বর্বরতার মহাযুদ্ধে। এবং এটাও স্বীকার করতেই হবে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐ ঐতিহাসিক বিজয়ের মূল কারিগর সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ এবং অবশ্যই তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব কমরেড স্তালিন। স্তালিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত লাল ফৌজের অসামান্য ভূমিকায় রক্ষা পেয়েছিল বিশ্ব মানবতা।
আজ সেই মহান ঐতিহাসিক বিজয়ের ৮০ বছর পূর্তির সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে কোনও দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে নেই, সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ গোটা পূর্ব ইউরোপ থেকেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবলুপ্ত! গোটা পৃথিবীর ভারসাম্য আবারও পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঢলে পড়েছে! তার নিজস্ব আভ্যন্তরীণ নিয়মেই পুঁজিবাদ বারেবারে সংকটে জর্জরিত হচ্ছে, আবার উন্নত বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এবং সর্বোপরি বিরুদ্ধ শক্তির দূর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে সে নেমে আসা সংকট সাময়িকভাবে হলেও মোকাবিলা করে নিতে পারছে।
যদিও পুঁজিবাদের নিজস্ব আভ্যন্তরীণ সংকট স্থায়ীভাবে সে মোকাবিলা করতে পারে না, এবং এই জায়গা থেকেই বিশ্ব জুড়ে আবারও মাথাচাড়া দেয় অতি দক্ষিণপন্থা, ফ্যাসিস্ট প্রবণতা। এর বর্তমান চেহারা গত শতাব্দীর বিশ দশকের মত হুবহু না মিললেও এটুকু দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে প্রায় দু দশক আগে থেকে চলা বিশ্ব জোড়া আর্থিক মন্দার পর এই প্রবণতা অনেকখানিই বৃদ্ধি পাচ্ছে। গোটা দুনিয়া জুড়ে নানান আইডেন্টিটিকে ভিত্তি করে বেড়ে চলা এই প্রবণতার রাজনৈতিক শক্তিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং সর্বোপরি আমাদের দেশেরও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে।
গত শতাব্দীর বিশের দশকে আমাদের দেশে তৈরি হওয়া RSSকে সরাসরি ইতালির মুসোলিনী এবং তার ফ্যাসিস্ট পার্টির ভারতীয় সংস্করণ বললে অত্যুক্তি হবে না। যার রাজনৈতিক দল বিজেপির মধ্যে নয়া ফ্যাসিবাদের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই দেখা যাচ্ছে।
মতাদর্শগত অবস্থান থেকেই দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ না নেওয়া এই সংগঠন আমার দেশের সংবিধান-ঘোষিত বহুত্ববাদী ধারণা, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে নস্যাৎ করে। অখণ্ড হিন্দু ভারতের লক্ষ্যে কাজ করা এই সংগঠন এবং এর সমস্ত শাখাপ্রশাখার ঘোষিত শত্রু সামাজিকভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ, এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কমিউনিস্টরা— আরও নির্দিষ্ট করে বললে সিপিআইএম।
শ্রমজীবী মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত রেখে আরও মুনাফা অর্জন, এবং সেই কাজে বিভাজিত জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াইকে দূর্বল করার লক্ষ্য নিয়েই দুনিয়ায় অন্যান্য জায়গার মত আমাদের দেশেও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক নয়া ফ্যাসিস্ট এই শক্তির সাথে যুক্ত হয়েছে কর্পোরেটরা, বড় বড় পুঁজিপতিরা!
এই কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক নেক্সাস— যার রাজনৈতিক মুখ বিজেপি, এই এখন আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণের সবচেয়ে বড় শত্রু। এই নয়া ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক লড়াই। এই লড়াইয়ে সামিল করতে হবে বাকি সমস্ত শক্তি, বাকি সমস্ত রাজনৈতিক দল এমনকি ব্যক্তিকেও।
এই লেখার একদম শুরুতে উল্লেখ করা রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো একবার দেখে নিন— আজকের এই সময়ে আমার দেশের মদমত্ত প্রবলপ্রতাপশালী ক্ষমতাবানেরা যখন ক্রমাগতই আত্মম্ভরিতা প্রদর্শনে ব্যস্ত, ঠিক তখন তাদের পূর্বসূরীদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয়ের ৮০ বছর পূর্তিতে এই অঙ্গীকারটুকুই থাক।