পারমিতা ঘোষ চৌধুরী, কৃষ্ণায়ন ঘোষ
ষোড়শ পার্টি কংগ্রেস
১৯৯৮ সালের ৫-১১ অক্টেবর (কলকাতা)
অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন জ্যোতি বসু।
দেশে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৬৮০ জন প্রতিনিধি কংগ্রেসে যোগ দেন।
অন্তির্জাতিক পরিস্থিতি
পঞ্চদশ কংগ্রেসের পরবর্তী সাড়ে তিন বছরের ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পরে শুরু করা সাম্রাজ্যবাদীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত আক্রমণ বিশ্ব জুড়ে প্রগতিশীল শক্তিগুলির ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। অবশ্য, আগেও যেমন বলা হয়েছিল, সমাজতন্ত্রের সেই বিপর্যয়গুলি পুঁজিবাদের সামনে সম্প্রসারণের নতুন সুযোগ খুলে দিয়েছে এবং সাময়িকভাবে হলেও, ভারসাম্যের কাঁটা সাম্রাজ্যবাদের অনিকুলেই গেছে।
সি পি আই (এম) সমাজতন্ত্রের সমর্থনে তার অঙ্গীকারে অবিচল থাকছে এবং বৈরী সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের মুখোমুখি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির প্রতি তার সুদৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করছে।
অসম ব্যবস্থা চাপিয়ে দেবার এবং শোষণকে তীব্রতর করার সাম্রাজ্যবাদী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধে ক্রমবর্ধমান গতি সঞ্চারিত হচ্ছে। আলোচ্য সময়কাল কমিউনিস্ট, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির পুনরুজ্জীবন ও পুনঃসংগঠিত হওয়ার এবং শ্রমিকশ্রেণীর পালটা আক্রমণ হানার সাক্ষী। ১৯৯৭সালের আগস্ট মাসে বিশ্বায়ন ও নয়া উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে হাভানায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলন ছিল সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের মোকাবিলায় ক্রমবর্ধমান আগ্রহের প্রতিফলন। একই প্রতিফলন ঘটেছে পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট ইস্তেহার পুস্তিকার ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারগুলিতেও। সি পি আই (এম) নিজেকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বিরুদ্ধে এই আন্তর্জাতিক সংগ্রাম ও সৌভ্রাতৃত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করে। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি দল হিসেবে সি পি আই (এম) সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে ভারতীয় জনগণকে তাদের ন্যায্য ভূমিকা পালনের জন্য নিরলসভাবে সংগঠিত করে যাবে।
জাতীয় পরিস্থিতি
১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় জনতা পার্টি পরিচালিত সরকার ক্ষমতাসীন হবার ফলে দেশে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এই প্রথম কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল করেছে একটি আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক দল যারা ফ্যাসিবাদী মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং-সেবক সঙ্ঘের নির্দেশে পরিচালিত। এর ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির দিক থেকে ভারতীয় রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভিত ও জাতীয় ঐক্যের বিপদ দারুণভাবে বেড়ে গেছে। পরন্তু, বি জে পি-আর এস এস জোটের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল মদীর শ্রমজীবী মানুষ ও বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির পক্ষে বৃহত্তর আক্রমণের বিপদ সূচিত করেছে।
কী করে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হল সেই আলোচনায় যাবার আগে গত ১৯৯৫ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত পঞ্চদশ পার্টি কংগ্রেসে আমরা পরিস্থিতির কী বিশ্লেষণ করেছিলাম সেটা স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক।
পঞ্চদশ কংগ্রেস নিম্নলিখিত মূল সিদ্ধান্তগুলিতে উপনীত হয়েছিল: (ক) সামনের দিনগুলিতে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে, (খ) কংগ্রেস (আই) সরকার অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতিগুলি দেশকে আরও বেশি করে ঋণজালে আবদ্ধ করে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করবে এবং শ্রমজীবী মানুষের ওপর আরও বেশি বোঝা চাপাবে; (গ) ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক চ্যালেঞ্জ স্বাধীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভিত, তার ঐক্য ও সংহতিকে গুরুতরভাবে বিপন্ন করছে এবং শ্রমিকশ্রেণী ও মেহনতী মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরাচ্ছে।
এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পঞ্চদশ কংগ্রেস যে রণকৌশল গ্রহণ করেছিল তা হল: (ক) সর্বনাশা অর্থনৈতিক নীতিগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আরও তীব্র করা (খ) রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত উভয় দিক থেকেই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে তীব্রতর করা (গ) বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির ঐক্যকে আরও শক্তিশালী করা। এই লক্ষ্যগুলি অর্জনের জন্য এইসব চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পার্টি কংগ্রেস জনগণের সকল অংশকে সংগঠিত করার প্রয়োজনের ওপর জোর দিয়েছিল। পার্টি কংগ্রেস থেকে "কংগ্রেস ও বিজে পি-কে পরাস্ত করার” এবং তৃতীয় বিকল্পের সাফল্যের লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল।
তারপর দুটি সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। প্রথমটি ১৯৯৬ সালের মে মাসে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। দুটি নির্বাচনেই পঞ্চদশ কংগ্রেসের অনুমান সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে এবং দুটি নির্বাচনের একটিতেও কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নির্বাচনী ফলাফল দেখিয়েছে (ক) কংগ্রেস একচেটিয়া ক্ষমতা হারাবার পর একদলীয় শাসনের যুগ শেষ হয়েছে। কংগ্রেস ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ১৯৯৮-এর নির্বাচনেও তারা পুরনো অবস্থান ফিরে পায়নি; (খ) কংগ্রেসের পতনের পাশাপাশি ঘটেছে বিজেপি-র উত্থান। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি লোকসভায় একক বৃহত্তম দলে পরিণত হয়। পরবর্তী নির্বাচনেও সেই অবস্থান বজায় থাকে (গ) বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির দুর্বলতার কারণে বি জে পি কংগ্রেসের অপশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়েছে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হয়েছে। বাম দলগুলি সংসদে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়নি। ২.৫ পঞ্চদশ পার্টি কংগ্রেসের পরবর্তী বছরগুলি জনতা দলের পতনের সাক্ষী।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই দল অনেকগুলি আসন হারায় এবং ১৯৯৮ সালে ভাগ হয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। কয়েকটি রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি শক্তিশালী এবং জাতীয় স্তরে তাদের ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, এই দলগুলি প্রধানত রাজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কোনো কোনো দল সবিধাবাদী অবস্থান নেয়, যেমন সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর তেলুগু দেশম বাজপেয়ী সরকারকে সমর্থন দান করেছে।
বিগত দুটি সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল থেকে পরিষ্কার যে, বাম শক্তি বৃদ্ধি না পেলে এবং বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির হস্তক্ষেপ ক্ষমতা না বাড়লে কোনোরকম প্রগতিশীল পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িক ও দক্ষিণপন্থী দলগুলি বর্জোয়া-জমিদার শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষের সুযোগ নেবার কাজ চালিয়ে যাবে, যদিও এই শক্তিগুলিও সেই উদারনৈতিক নীতির সমর্থক যার ফলশ্রুতি জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ। বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির দুর্বলতাই এর কারণ। বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপের দ্বারাই কেবল জনগণকে ভুলপথে পরিচালনকারী সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী শক্তিগুলিকে প্রতিহত করা সম্ভব।
পঞ্চদশ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবের সূত্র ধরে:
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং অর্থনৈতিক নীতিগুলির বিরোধিতা উভয় ক্ষেত্রেই আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ বুর্জোয়া বিরোধী দলগুলিকে সঙ্গে নেবার। কিন্তু এটা করতে গিয়ে মনে রাখতে হবে অর্থনৈতিক নীতিগুলি সম্পর্কে ওদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সঙ্গে মেলে না। অনুরূপভাবে, নির্বাচনী সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এটা দেখলে ঐ দলগুলি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামেও সুবিধাবাদী অবস্থান নিতে পারে। এই উপলব্ধির ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন কৌশল রচনা করে এবং তৃতীয় বিকল্পের জন্য প্রয়াস চালায়।
১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পরে বি জে পি যাতে সরকার গঠন করতে না পারে সেই জন্য আমাদের পার্টি উদ্যোগ নেয় এবং যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এই ব্যাপক ঐক্যের ফলেই ১৩ দিনের বাজপেয়ী সরকার যা প্রতিনিধিত্বমূলক ছিল না, তার হঠাৎ অবসান হয়। বামদলগুলি ছাড়াও যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলির মধ্যে ছিল জনতা দল, সমাজবাদী পার্টি এবং তেলুগু দেশম, ডি এম কে, তামিল মানিলা কংগ্রেস এবং অগপ-সহ আঞ্চলিক দলগুলি। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে একার শক্তিতে সরকার গঠন করা সম্ভব ছিল না। বাইরে থেকে কংগ্রেসের সমর্থনের সাহায্যেই কেবল একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠন সম্ভব হয়।
এই পরিস্থিতিতেই কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, পার্টি সরকারে যোগ দেবে না, কিন্তু বাইরে থেকে সরকারকে সমর্থন করবে। এই ভিত্তিতেই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় এবং একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয় যাতে আমাদের পার্টিও যোগ দেয়।
প্রত্যেকটি ধর্মনিরপেক্ষ বর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলই যে উদারনীতিবাদের অর্থনাশা অর্থনৈতিক নীতিগুলির সমর্থক এই সত্য সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থাকা সরও আমাদের পার্টি মূলত সাম্প্রদায়িক দলগুলি যাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে না করে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই একটি ন্যূনতম যৌথ কর্মসূচি রচনার প্রয়াসে অংশীদার
এই ন্যূনতম যৌথ কর্মসূচি ছিল আপসের দলিল। এই দলিলে অর্থনৈতিক মতির দিশা-নির্দেশ সম্পর্কে যুক্তফ্রন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ শরিক দলগুলির মতের প্রতিফলন ঘটে। এই মত ছিল আগেকার কংগ্রেস আমলের অর্থনৈতিক প্রতিগুলিকেই চালিয়ে যাওয়া। তা হলেও একই দলিলে এমন কতকগুলি বৈশিষ্ট্যও ছল যেগুলি অবশ্যই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। এগুলি ছিল যক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায় প্রভৃতি সাক্রান্ত। তাছাড়া দলিলে কিছু অর্থনৈতিক প্রশ্নে শ্রমজীবী মানুষকে কিছু রিলিফ দেবার অঙ্গীকারও ছিল।
যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দেবার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটি এই সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে যে, পার্টিকে তার স্বাধীন কার্যকলাপ বাড়াতে হবে, যুক্তফ্রন্ট সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলি থেকে নিজেদের আলাদা করতে হবে এবং পার্টির নিজস্ব অবস্থান ও প্রভাবকে সংহত করতে হবে। অর্থনৈতিক নীতিগুলি জনগণের ওপর বোঝা চাপানো অব্যাহত রাখার কারণে উদ্ভূত গণ অসন্তোষের ফয়দা লুটে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করবে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি। পার্টিকে তাই এই গণ অসন্তোষকে গণতান্ত্রিক খাতে সমবেত করার লক্ষ্যে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
শীর্ষ নেতাদের দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত চলতে থাকায় কংগ্রেস ক্রমেই দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা দেবেগৌড়া সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করে এবং সমর্থন প্রত্যাহার করে। তারা শর্ত দেয় সমর্থন অব্যাহত রাখতে হলে দেবেগৌড়া সরকার হঠাতে হবে। যুক্তফ্রন্টের মধ্যে সি পি আই (এম) সহ বামদলগুলির দৃঢ় অবস্থান সত্ত্বেও শরিক দলগুলির অধিকাংশই চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করে। গুজরাল সরকার আসার পর কংগ্রেস দল ক্রমশ নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করতে চেষ্টা করে। যুক্তফ্রন্ট সরকারের সামগ্রিক কাজকর্মের খতিয়ান থেকে দেখা যায় বিদেশ নীতি ও কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ সত্ত্বেও এই সরকার উৎসাহের সঙ্গে সেই সব নীতিই অনুসরণ করে যেগুলি উদারনীতিকরণ ও বেসরকারিকরণকে সাহায্য করবে। ন্যূনতম যৌথ কর্মসূচিতে জনমুখী মূল ধারাগুলি রূপায়ণে এই সরকার ব্যর্থ হয়। আইন সভায় মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ, খেতমজুরদের জন্য কেন্দ্রীয় আইন, লোকপাল বিল, গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি, গরীবদের জন্য অর্ধেক দামে রেশন সরবরাহ ব্যবস্থা সহ গণবণ্টন ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করা প্রভৃতি পদক্ষেপগুলির কোনোটিকেই গুজরাল সরকার গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ ও রূপায়ণের কোনো চেষ্টাই করেনি। ২.১৪ জৈন কমিশনের অন্তর্বর্তী রিপোর্টকে অজুহাত করে কংগ্রেস অন্যায়ভাবে সমর্থন তুলে নিলে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে। ১৯৯৮-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচন থেকে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যেখানে বিজেপি আগের চেয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে এবং নতুন করে কিছু আঞ্চলিক দলের সঙ্গে সমঝোতা করে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠনে সক্ষম হয়। কংগ্রেস দলের নেতৃত্বে সোনিয়া গান্ধীর আগমন সত্ত্বেও ঐ দলের নিন্দিত নীতিগুলির কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। যুক্তফ্রন্টের বিপর্যয় ঘটে এবং ফ্রন্ট প্রায় অর্ধেক আসন হারায়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের কাজকর্ম সাধারণ মানুষের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর কারণ, ন্যূনতম যৌথ কর্মসূচির জনমুখী ধারাগুলি রূপায়ণে ব্যর্থতা, যুক্তফ্রন্টের শরিক অ-বাম দলগুলির রাজ্যে নিজেদের সরকারের অনুসৃত নীতিগুলির নেতিবাচক প্রভাব, এবং ১৯৯৮-এর নির্বাচনের মুখে যুক্তফ্রন্টের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির অভাব।
গত একদশক ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে যে দক্ষিণপন্থী ঝোঁক দেখা দিয়েছে বাজপেয়ী সরকার গঠন সেই অব্যাহত ধারার অংশ। আসন ও ভোটের শতাংশ হার বৃদ্ধি পেয়ে বি জে পি আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী হয়েছে। মিত্র দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে বি জে পি আগের তুলনায় আরও ৬০টি আসন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। বি জে পি-র উত্থানের পাশাপাশি চলেছে কংগ্রেসের পতন। কংগ্রেসের এই অবক্ষয়ের ফলে শ্রেণী হিসাবে বুর্জোয়া-জমিদার শ্রেণীগুলির উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন বি জে পি-র দিকে সরে গেছে। সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল একটি দলের অনুকূলে সমর্থনের এই সরণটাই ভারতীয় পরিস্থিতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত করেছে।
সাম্প্রদায়িকতার বিপদ
অযোধ্যার বিষয়কে কেন্দ্র করে বি জে পি-আর এস এস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ জোটের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ যেভাবে দানা বাঁধে এখন কেন্দ্রে বি জে পি পরিচালিত সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে তা এক নতুন মাত্রা পেয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে এবং তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে যা অর্জন করার চেষ্টা এরা এতকাল চালিয়ে এসেছে এখন তাই পরিপুরক হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করা হবে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র আর এন এস বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটবে। বি জে পি-আর এস এস জোটের কর্মসূচিকে এখন প্রকাশ্য ও গোপন এই উভয় পথেই এগিয়ে নিয়ে যাবে সরকার। বি জে পি ও তার মিত্রদের তথাকথিত "জাতীয় কর্মসূচি”তে হিন্দুত্ববাদী শক্তিসমূহের কয়েকটি মূল লক্ষ্য স্থান পায়নি। অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ, সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষাকারী ৩০নং ধারা বাতিল, অভিন্ন সিভিল কোড প্রভৃতির মতো কয়েকটি বিষয়কে ঘোষিত কর্মসূচির বাইরে রাখা হয়েছে, কিন্তু অন্য কায়দায় এইসব লক্ষ্যপূরণের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
পারমাণবিক উগ্র দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে
বাজপেয়ী সরকার সংগোপনে এবং অবৈধভাবে দেশের বহুদিনের স্বীকৃত পরমাণু নীতি একেবারে পাল্টে দিয়েছে। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ভারতের পরমাণু নীতির ধারাবাহিকতা তিনটি প্রধান স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। প্রথমত, ভারত বৈষম্যমূলক পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার বিরোধী চুক্তি (NPT) এবং সামগ্রিক অস্ত্র-পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তিকে (CTBT) কখনই মেনে নেয়নি, কারণ এইসব চুক্তিতে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে ও পারমাণবিক অস্ত্রের উপর এইসব দেশের একচেটিয়া অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারত তার পারমাণবিক ক্ষেত্রে নিজস্ব ইচ্ছা বা বিচারকে কখনোই কারো কাছে বন্ধক রাখেনি এবং মূলত শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য পারমাণবিক প্রযুক্তিকে সর্বাধুনিক অবস্থায় রেখেছে। তৃতীয়ত, পারমাণবিক অস্ত্রের বিশ্বজনীন নিরস্ত্রীকরণ এবং সেই উদ্দেশ্যে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলির সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি ভারত বহুকাল ধরেই নিরবচ্ছিন্নভাবে জানিয়ে এসেছে। এই নীতির সুবাদেই ভারত তার সার্বভৌম অধিকার বজায় রেখে, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের মাধ্যমে বিশ্বশান্তির সপক্ষে দাঁড়িয়ে বিশ্বে মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল।

পার্টিকে শক্তিশালী কর:
বাম ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচির জন্য লড়াইয়ের উপর ভিত্তি করে শ্রমজীী। মানুষের সমস্ত অংশকে সমবেত করার ক্ষেত্রে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির অগ্রগতির প্রকল্যের জন্য প্রয়োজন পার্টির উল্লেখযোগ্য এবং দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি। সি পি আই (এম) একই অগ্রণী অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যারা শ্রমিকশ্রেণীর মতাদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। এমনকি, সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরবর্তীকালেও পার্টি দৃঢ়ভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌল নীতিগুলিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। মার্কসবাদ এবং সর্বহারার অন্তর্জাতিকতাবাদের উপর ভিত্তি করে পার্টির মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্নবীকরণ ও কুরধার করা প্রয়োজন, যাতে পার্টি বাম ও গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে। ১৯৯২-এর মতাদর্শগত প্রস্তাবে যে মতাদর্শগত আলোচনা শুরু করা হয়েছিল তা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে পার্টিকে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও আই এম এফ-বিশ্বব্যাঙ্ক অনুমোদিত উদার নীতি এই দুই বিপদের বিরুদ্ধে প্রধান যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের চৌহদ্দির বাইরে জনগণের যে বিশাল অংশ আছে, তাদের সমবেত করে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেই এই লড়াই চালাতে হবে।
পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং সাংগঠনিক কাজ সুচারুভাবে করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নজর দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বলীয়ান হতে হলে পার্টিকে সংগঠনের ক্ষেত্রে এবং কাজকর্মের ধারার ক্ষেত্রে যে ত্রুটি এবং ঘাটতি আছে তা অবশ্যই কাটিয়ে উঠতে হবে। সমগ্র পার্টিকে সতর্ক থেকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে বিরোধী শ্রেণী-প্রভাব ও ক্ষতিকর ঝোঁক যেমন সংসদ-সর্বস্বতা, অন্তর্দলীয় কোন্দল ও কমিউনিস্ট মূল্যবোধের অবক্ষয় যা সামনে এসেছে তা যেন শিকড় গজাবার সুযোগ না পায়। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার উপর ভিত্তি করে পার্টির যে বিপ্লবী চরিত্র, তাকে রক্ষা করে শক্তিশালী করতে হবে। পার্টিকে সমস্ত অস্বাস্থ্যকর ঝোঁক থেকে মুক্ত করতে বিগত সময়ে যে ত্রুটি সংশোধনী অভিযান চালানো হয়েছে, সর্বস্তরে তা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
গণসংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে পার্টির একটি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই নেওয়া উচিত। স্বাধীন ও ব্যাপক বিভিন্ন গণসংগঠন যারা লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠনে টেনে আনে এবং তাদের জীবন ও সমস্যার সাথে জীবন্ত যোগাযোগ রাখে, তাদের উপর ভিত্তি করেই পার্টি দ্রুত অগ্রসর হতে পারে। গণসংগঠনসমূহের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ থেকে যে ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার মাধ্যমে যাতে শ্রেণী ঐক্য এবং জনগণের ঐক্য গড়ে ওঠে, সেটা দেখা পার্টির বিশেষ দায়িত্ব।
এই ধরনের হস্তক্ষেপ এবং কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে পার্টি জনগণের যে বিশাল অংশ বর্তমানে বুর্জোয়া দলগুলির পিছনে সমবেত হয়ে আছে, তাদের কাছে আবেদন জানাবে। উপরে বর্ণিত অবস্থাসমূহ ভারতীয় জনগণের বিশাল অংশের দৈনন্দিন জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এর ফলস্বরূপ, জনগণের অবশ্যম্ভাবী অসন্তোষকে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির পিছনে সংগঠিতভাবে সমবেত করতে হবে। এ কাজে পার্টি সেই বাজনৈতিক মিত্রদের খুঁজে নেবে যারা আমাদের উদ্বেগের অংশীদার।
স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বার্ষিকীর বৎসরব্যাপী অনুষ্ঠান ১৯৯৮-এর ১৫ই আগস্ট শেষ হয়েছে। সময়টাকে পার্টি কাজে লাগিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শের পরিপন্থী সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও জাতপাতভিত্তিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে। সাথে সাথে দেশপ্রেম ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যা একমাত্র জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে পারে, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসও জারি থেকেছে। যে জনগণ জাতীয় স্বাধীনতার জন্য বিরাট ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার ক্ষেত্রে বুর্জোয়া জমিদার শ্রেণীর ব্যর্থতা সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে এই বার্ষিকী সি পি আই (এম) এবং বাম শক্তির কাছে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। বিগত পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা হল, অর্থনৈতিক সংগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ হলেও, কেবল তাই যথেষ্ট নয়। সমান গুরুত্ব দিয়ে বুর্জোয়া-জমিদার শ্রেণীগুলির বিরুদ্ধে আমাদের মতাদর্শগত অভিযান পরিচালনা করা দরকার। আগামী দিনগুলিতে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত। সাম্রাজ্যবাদ এবং বুর্জোয়া-জমিদার শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনার মাধ্যমে এই সময়ে জাতির জীবনে পার্টি এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এই উপলক্ষে আমাদের শপথ-এমন এক গণবিপ্লবী পার্টি আমরা গড়ে তুলবো যা জনগণের পূর্ণ আর্থ-সামাজিক মুক্তির মাধ্যমে দারিদ্র্য ও শোষহীন এক ভারতবর্ষ গড়ে তোলার জন্য জনগণকে নেতৃত্ব দিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে।
১৭ জন সদস্য নিয়ে পলিট ব্যুরোর তৈরী হয়। সাধারণ সম্পাদক হন : হরকিষান সিং সুরজিৎ। পলিট ব্যুরোর সদস্য হলেন : হরকিষান সিং সুরজিৎ, জ্যোতি বসু, বালা নন্দন, ভি এস অচ্যুতানন্দন, ই. কে. নায়ার, সীতারাম ইয়েচুরি, পি রামচন্দন, উমানাথ, মানিক সরকার, অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু, প্রকাশ কারাত, পি রাম চন্দন, শৈলেন দাশগুপ্ত, এম কে পান্ধে, পিনারাই বিজয়ন।

সি পি আই (এম) ১৭ তম পার্টি কংগ্রেস ১৯-২৪ মার্চ, ২০০২, হায়দরাবাদ
প্রেক্ষাপট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান আক্রমণের পরবর্তী সময়ে ১৭তম পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ সালে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে 'গ্লোবাল ওয়ার' এর অংশ হিসেবে বিজেপি সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উৎসাহের সাথে সহযোগিতা করে।
এর পূর্ববর্তী বছরগুলোতে সংখ্যালঘুদের ওপর নজিরবিহীন আক্রমণ হয়, যার মধ্যে গুজরাট দাঙ্গা উল্লেখযোগ্য। এতে রাষ্ট্রশক্তির প্রত্যক্ষ মদত ছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) অনুপ্রবেশ করেছিল, বিজেপি সরকারের সহায়তায়। বিজেপি সরকার দেশকে নির্বিচারে বিদেশি পুঁজির জন্য উন্মুক্ত করে দেয়, যা শ্রমজীবী শ্রেণির ওপর তীব্র আঘাত হানে। দলিত ও আদিবাসীদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার আধিপত্য আরও জোরদার করতে সচেষ্ট হয়। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শোষণ তীব্রতর হয় এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে বেকারত্ব বাড়ে, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সংকুচিত হয়। আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজির আধিপত্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে, যার ফলে ২০০০ সালের পর থেকে একাধিক দেশের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়। আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক পতন, এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ, যেখানে সাম্রাজ্যবাদী নীতির কারণে দেশটি দেউলিয়া হয়ে যায়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামরিক আধিপত্যও বিস্তারের চেষ্টা চালায় ক্রমাগত। প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে ইজরায়েলি আগ্রাসনকে সমর্থন, ইরাকের উপর অবরোধ ও সামরিক হস্তক্ষেপ, ন্যাটোর মাধ্যমে যুগোশ্লাভিয়ায় হামলা—এসবই মার্কিন নীতির অংশ ছিল। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের ব্যালিস্টিক মিসাইল-বিরোধী চুক্তি থেকে সরে এসে অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে আরও উসকে দেয়।
মার্কিন আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধ বাড়তে থাকে। চীন ও রাশিয়া যৌথভাবে মার্কিন সামরিক নীতির বিরোধিতা করে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একঘরে হয়ে যায়। কিয়োটো জলবায়ু চুক্তি, ডারবান বর্ণবিদ্বেষবিরোধী সম্মেলন এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে মার্কিন অবস্থান ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে।
বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলনও ধীরে ধীরে জোরদার হতে থাকে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন সম্মেলনে যেমন সিয়াটল (১৯৯৯), জেনোয়া (২০০১), এবং দোহা (২০০১)-তে বিক্ষোভ লক্ষ্য করা যায়। ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গণসংগঠন বৈশ্বিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমনকি উন্নত দেশগুলিতেও কর্মসংকোচন ও সামাজিক সুরক্ষা সংকোচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন বাড়তে থাকে।
সমসাময়িক দিনে এই প্রতিরোধ আরও প্রসারিত হবে বলে ধারণা করা হয়। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে যে-কোনো লড়াই সফল করতে কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল শক্তি নেতৃত্ব দিতে বদ্ধপরিকর হয়।
জাতীয় পরিস্থিতি
১৯৯৮ সালে বিজেপি প্রথমবার কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন হয় এবং তাদের শাসনকাল ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ওপর গুরুতর হুমকি তৈরি করে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর আদর্শে পরিচালিত এই সরকার সাম্প্রদায়িক বিভাজন, শ্রমজীবী মানুষের ওপর আক্রমণ এবং বৈদেশিক নীতিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলে। বিজেপির চার বছরের শাসনে দেখা যায়, (ক) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হয়েছে, (খ) বেসরকারিকরণ ও উদারীকরণের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির ওপর শোষণ বেড়েছে, (গ) ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি দুর্বল করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, (ঘ) শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব পড়েছে, এবং (ঙ) স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিজেপি প্রথম ১৯৯৬ সালে ১৩ দিনের জন্য ক্ষমতায় আসে, পরে ১৯৯৮ সালে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে, যা ১৯৯৯ সালে পুনরায় নির্বাচিত হয়। যদিও বিজেপির ভোট মাত্র ২৩.৭% ছিল, তারা এনডিএ জোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তবে, এনডিএ কেবল বিজেপির প্রকৃত এজেন্ডাকে আড়াল করার জন্য একটি ছদ্মাবরণ ছিল। বিজেপি ও আরএসএসের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠন, যা বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং রাষ্ট্রযন্ত্রে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সশস্ত্র বাহিনীতেও আরএসএসের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
বিজেপি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র পরিবর্তন করতে সচেষ্ট হয়, সংখ্যালঘুদের অধিকার সংকুচিত করতে এবং রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার চালু করতে উদ্যোগ নেয়। শিক্ষাক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়া হতে থাকে, ইতিহাসের সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে জ্যোতিষশাস্ত্র ও বৈদিক শিক্ষা চালু করা হয়।
২০০১ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ঘোষণা করে যে তারা বাবরি মসজিদের স্থানে মন্দির নির্মাণ শুরু করবে, যা গুজরাটের দাঙ্গার মাধ্যমে চরম রূপ নেয়। বিজেপি সরকার এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমানোর কোনো পদক্ষেপ তো নেয়ইনি, বরং আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে পরোক্ষ সমর্থন দিতে থাকে।
বিজেপির শাসনকালে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ বেড়েছে ক্রমাগত। ১৯৯৮ সাল থেকে খ্রিস্টান সংখ্যালঘুরা বিশেষভাবে আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে ১৯৯৯ সালে ওড়িশার গ্রাহাম স্টেইনস এবং তার সন্তানদের হত্যা উল্লেখযোগ্য। বজরং দলের মতো সংগঠন অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে, যা ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে।
১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার পর বিজেপি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচার বাড়িয়ে দেয়, তাদের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করতে শুরু করে। প্রশাসনের সাম্প্রদায়িকীকরণ হওয়ায় সংখ্যালঘুরা রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস হারাতে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বাড়তে থাকে, যা মৌলবাদী শক্তিদের উৎসাহিত করে।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) জোর দিয়ে উল্লেখ করে যে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করা অপরিহার্য, তবে একইসঙ্গে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধেও লড়াই করাও প্রয়োজন।
জাতীয় ঐক্যের উপর বিজেপির শাসন বিরূপ প্রভাব ফেলতে থাকে, বিশেষ করে জম্মু ও কাশ্মীরে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল ও সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে। জাতীয় সম্মেলন এনডিএ জোটে যুক্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষ বিচ্ছিন্নতা অনুভব করতে থাকে, মৌলবাদী শক্তি সক্রিয় হয় এবং সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি পায়। বিজেপি সরকারের নীতি কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বদলে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ত্বরান্বিত করতে থাকে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়ে যায়। নাগাল্যান্ড ও মণিপুরের সংঘর্ষ এবং বিভিন্ন উগ্রপন্থী সংগঠনের তৎপরতা জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকিতে পর্যবসিত হয়। আরএসএস খ্রিস্টান ও মুসলিম-বিরোধী প্রচার চালিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
পার্টি সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে এবং কাশ্মীরসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানায়। উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের ওপর জোর দেওয়া হয়। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষা করাই জাতীয় ঐক্য রক্ষার একমাত্র পথ বলে পার্টি মনে করে।
জাতীয় অর্থনীতি
উদারনীতির এক দশক (১৯৯১-২০০১) ভারতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। নরসিমা রাও সরকার নয়া অর্থনৈতিক নীতি চালু করলেও, বাজপেয়ী সরকার সবচেয়ে আগ্রাসীভাবে আই এম এফ, বিশ্বব্যাংক ও ডব্লিউ টি ও-র শর্ত মেনে নেয়। তাদের নীতির ফলে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির প্রভাব বাড়ে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ ত্বরান্বিত হতে থাকে এবং বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলির স্বার্থ রক্ষা করা শুরু হয়। এই নীতি জনসাধারণের দারিদ্র্য ও দুর্দশাকে বাড়িয়ে তুলতে থাকে।
পার্টি ধারাবাহিকভাবে উদারনীতির বিরোধিতা করে। উদারীকরণের এক দশকে শিল্পোৎপাদনে অধোগতি দেখা দেয়, খাদ্যশস্য উৎপাদন জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় কমে যায়, এবং চাহিদার অভাবে অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসে। বীমা খাতকে বিদেশি লগ্নির জন্য উন্মুক্ত করে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে দুর্বল করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শেয়ার কমিয়ে দিয়ে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণের পথে নেয় সরকার, যা অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শিল্পক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করায় দেশীয় শিল্প সংকটে পড়ে যায়। দাভোলে এনরন প্রকল্পের ব্যর্থতা সরকারের বিদ্যুৎ নীতির দুর্বলতা প্রকাশ করে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের উপর লাগামহীন আক্রমণ চলতে থাকে—এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রির প্রচেষ্টা এবং ১৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিলগ্নীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকেও বেসরকারি খাতের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্ত মেনে আমদানি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাজপেয়ী সরকারের বাজেট নীতিতে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের ব্যাপক কর ছাড় দেওয়া হয়, কিন্তু সাধারণ মানুষের উপর পরোক্ষ করের বোঝা চাপানো চলতে থাকে। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের অনাদায়ী ঋণ বাড়লেও সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ভারতে কর-জিডিপি অনুপাত বিশ্বে সবচেয়ে কমে যায়, যা ধনীদের স্বার্থরক্ষা করে। অর্থনীতির মন্দা ত্বরান্বিত হয়, সরকারি বিনিয়োগ হ্রাস পায় এবং বৈদেশিক ঋণ বাড়তে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলোর উপর কোষাগারীয় সংকটের বোঝা চাপিয়ে দেয়, যার ফলে বিশ্বব্যাংকের কঠোর শর্ত মেনে চলতে রাজ্য সরকারগুলি বাধ্য হয়।
কৃষিক্ষেত্রে উদারনীতির প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করায় কৃষিপণ্যের দাম কমে কৃষকরা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। কৃষিক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ কমে, ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির হার হ্রাস পায়। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা অসহায় হয়ে পড়ে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করে কৃষকদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ভূমি সংস্কার নীতি সংকটে পড়ে, কৃষিজমি বহুজাতিক সংস্থা ও বড় ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া শুরু হয়।
মজুত খাদ্যশস্যের অপ্রয়োজনীয় সংরক্ষণ এবং গণবণ্টন ব্যবস্থার ব্যর্থতার ফলে গরীব জনগণ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়। সরকারি পরিষেবার উপর ব্যবহারিক মূল্য চাপিয়ে দেওয়া হয়, ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, পরিবহন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোতে লক্ষাধিক কর্মী ছাঁটাই করা হয়। শিল্প ও ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যাপক সংকট দেখা দেয়।
পার্টি মনে করে ভবিষ্যতে ভারতীয় অর্থনীতি আরও গভীর সংকটে পড়তে চলেছে যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পার্টির দূরদর্শিতা প্রমাণ করে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব ভারতের উপর পড়বে মনে করা হয়। ততকালীন সরকার বৃহৎ ব্যবসায়ী ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর স্বার্থ রক্ষা করায় জনগণের দুর্দশা আরও বাড়ে।
সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার সংগ্রাম
নারীর অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়, বিশেষত পঞ্চায়েত ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। তবে সংসদ ও রাজ্যের আইনসভায় নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বুর্জোয়া দল বাধা সৃষ্টি করে, বিশেষ করে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার, যেখানে তাদের চাকরি ও মজুরির ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা সাধারণ ব্যাপার হয়ে যায়। উদারনৈতিক বাজার ব্যবস্থার কারণে নারীর পণ্যীভবন বাড়ে এবং নতুন ধরনের লিঙ্গ বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। নারী নির্যাতন, পণপ্রথা, যৌন হয়রানি ও লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষার মতো সমস্যাগুলি বাড়তে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠী নারীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। সিপিআই (এম) নারীদের অধিকারের পক্ষে দ্বিধাহীন অবস্থান গ্রহণ করে এবং নারীবিরোধী সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নেয়।
জাতপাত প্রথার কারণে সমাজ বিভাজিত হয়ে পড়ে, যা গণতন্ত্র ও শ্রেণী ঐক্যের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে জাতপাতের বিভাজনের প্রভাব পড়তে থাকে। দলিত ও নারীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত বৈষম্যমূলক সামাজিক প্রথাগুলি গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করে। পার্টি জাতপাতের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার চালানোর কথা বলে এবং সমস্ত ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেয়।
আমেরিকার 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ'কে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে বিজেপি সরকার বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক আইন প্রণয়ন করে, যার মধ্যে 'পোটা' অন্যতম। এ ধরনের আইন গণতন্ত্রকে সংকুচিত করতে থাকে এবং রাজ্যগুলির বিরোধিতা সত্ত্বেও কেন্দ্র সরকার দমনমূলক নীতির দিকে এগিয়ে যায়।
বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপও গণতান্ত্রিক অধিকারে বাধা সৃষ্টি করে। কেরালা হাইকোর্ট বন্ধ ও হরতালের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা জনগণের প্রতিবাদ ও মিছিল করার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করে। রাষ্ট্রের উদারনৈতিক নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগের রায় দেওয়া হতে থাকে, যা গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দুর্বল করে তোলে। বিহারে উচ্চবর্ণের জমিদার বাহিনীর মতো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলি দরিদ্র জনগণের বিরুদ্ধে হিংসা ও সন্ত্রাস চালাতে থাকে, যেখানে নারী ও শিশুরাও নির্যাতনের শিকার হয়। একইভাবে, কিছু নকশালপন্থী গোষ্ঠীর হিংসাত্মক কার্যকলাপ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা শাসকশ্রেণীর প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
বামপন্থী শক্তি ও তৃতীয় বিকল্পের গুরুত্ব
সি পি আই (এম) পুঁজিবাদী-জমিদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে এবং বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধী শক্তি হিসেবে ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হয়। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরায় বামপন্থী কর্মীদের হত্যা ও নিপীড়নের চেষ্টা চালানো হয়, কিন্তু পার্টি তা সফলভাবে প্রতিরোধ করে।
২০০১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের বিজয় বামপন্থী বিকল্পের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করে। কেরালায় পরাজয়ের মূল কারণ ছিল জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক শক্তির একত্রিত হওয়া এবং কিছু সাংগঠনিক দুর্বলতা। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট সরকার ভূমিসংস্কার, বিকেন্দ্রীকৃত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং জনকল্যাণমূলক নীতি প্রশংসিত হয়।
পার্টি মনে করে জাতীয় রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। বি জে পি এবং কংগ্রেস—এই দুই প্রধান শক্তির বাইরে এক বিকল্প গঠনের লক্ষ্যে সি পি আই (এম) নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নেয়। এর অংশ হিসেবে বাম দল, সমাজবাদী দল ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোর একত্রিত হওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়।
বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট: বিকল্প পথ
গণসংগ্রামের মাধ্যমে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, মধ্যবিত্ত শ্রেণী, বুদ্ধিজীবী, যুবক ও মহিলাদের সমবেত করে বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠণের আহ্বান জানানো হয়।
সি পি আই (এম) রাজনৈতিক, মতাদর্শগত ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী না হলে বাম আন্দোলন এগোবে না। তাই জনগণের মধ্যে পার্টির প্রভাব বাড়ানো, গণসংগ্রামকে বিস্তৃত করা এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর অগ্রাধিকারের কথা বলা হয়। গণসংগঠনগুলোর প্রভাব বাড়াতে যৌথ মঞ্চের নীতি গ্রহণ করা হয়।
সম্মেলনের শেষে
পার্টি কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে একত্রিত করে বিজেপি-আরএসএস জোটের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিজেপি ও কংগ্রেস ব্যতীত অন্যান্য শক্তিগুলোর সমন্বয়ে গণফ্রন্ট গঠনের আহ্বান রাখা হয়।
পার্টি কংগ্রেস তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল – বিজেপি নেতৃত্বাধীন সাম্প্রদায়িক জোটকে পরাস্ত করা, কেন্দ্রে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং লোকসভায় বামপন্থী শক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো।
কংগ্রেস ৭৯ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করে। নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি, কমরেড হরকিষাণ সিং সুরজিতকে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করে।
১৭ সদস্যবিশিষ্ট পলিট ব্যুরো গঠন করে।
তথ্যসুত্রঃ
১) Documents of The Communist Movement in India,
National Book Agency, Volume I- XXVII
২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,
মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি
৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement
Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977