Party Congress History Part X Cover

পার্টি কংগ্রেস – ইতিহাস থেকে আগামী (১০ম পর্ব)

পারমিতা ঘোষ চৌধুরী

একাদশ পার্টি কংগ্রেস

২৬ - ৩১ জানুয়ারি, ১৯৮২ (বিজয়ওয়াদা)

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

পার্টির জলন্ধর কংগ্রেসের অভিমত ছিল: ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ থেকে পুঁজিবাদের সর্বাপেক্ষা গভীর সংকট এই সময়ে দেখা দেয়। এইটিই ছিল যুদ্ধোত্তরকালের প্রথম সংকট যা একই সঙ্গে সমস্ত পুঁজিবাদী দেশে সংক্রমিত হয়। এই সংকটের গভীরতা পুরোপুরি ধরা পড়ে এই তথ্য থেকে যে, এই সংকট শুধু উৎপাদন ও ভোগ-ব্যয়ের ক্ষেত্রকেই নয়, আর্থিক ও ঋণের ক্ষেত্রকেও গ্রাস করেছে।’

আজ পুঁজিবাদ আবার আর একটা সংকটে নিমজ্জিত, ১৯৩২-এর সংকটের পর এটা কঠিনতম সংকট হিসেবে বিবেচিত।

১৯৮০ সালে বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশে উৎপাদন হ্রাসের পর ১৯৮১ সালে পুঁজিবাদী দুনিয়া আরও পড়তির সম্মুখীন।

চলতি মন্দা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী। পুঁজিবাদী দেশগুলির নেতাদের আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎবাণী সত্ত্বেও এই মন্দা সাত বছর ধরে চলছে। এ বছরেও এর গতি হ্রাস পায়নি, উৎপাদনে কিছু হেরফের মাত্র দেখা যাচ্ছে। ১৯৭৪ সালের পূর্বেকার তুলনায় পশ্চিমী দেশগুলিতে বার্ষিক গড়পড়তা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার দু-গুণেরও বেশি হ্রাস পেয়েছে। ১৯৮০ সালে অর্থনীতিতে দেখা গেল কার্যত এক অচলাবস্থা। সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহে একমাত্র যে ক্ষেত্রটিকে বেশ রমরমা ভাব তা হচ্ছে যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবসা।

পুয়ের্তোরিকোতে অনুষ্ঠিত ১৯৭৬ সালের বৃহৎ সাতটি দেশের দ্বিতীয় সম্মেলনে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল যে মুদ্রাস্ফীতিই পয়লা নম্বর দুশমন। তারপর থেকে প্রতিটি সভায় শীর্ষ নেতারা প্রতিজ্ঞা নিচ্ছেন যে, মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবেন, কিন্তু তবু তাঁরা একে নিয়ন্ত্রণে আনতে অক্ষম।

মজুরি ও আয়

১৯৭৩ থেকে ১৯৮০-র মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকের প্রকৃত আয় ১০.৫ শতাংশ কমে গেছে, যদিও সংবাদপত্রে বলা হয়েছে হ্রাসের পরিমাণ ১৫ শতাংশ। ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পরে এটাই হল মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার সবচেয়ে তীব্র অধোগতি।

এই সংকট দেখিয়ে দিচ্ছে যে (একচেটিয়া কারবারীদের স্বার্থে) অর্থনীতির রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংকট কাটাতে ব্যর্থ। যে সামরিক শিল্পজোট এই পুঁজিবাদী দেশটাকে শাসন করছে তারা যে শুধু অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে অক্ষম তা-ই নয়, তারা তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

এই চক্রের কাছে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার অন্যতম উপায় হল সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি। অধুনা বাজেট বরাদ্দের একটা বড়ো অংশ খেয়ে নিচ্ছে এই সামরিক ব্যয়, এতে অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে।

তীব্র গতিতে মার্কিনী প্রতিরক্ষা ব্যয় যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা থেকে বোঝা যাবে কী বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে এই বিধ্বংসী কাজে।

সাম্রাজ্যবাদীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব

সত্তর দশকের শেষ দিকে পুঁজিবাদী দুনিয়ার শিল্পোৎপাদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ ছিল ৩০.৯ শতাংশ, আর পশ্চিম ইউরোপের অংশ ছিল ৩৪.৪ শতাংশ। এখন পুঁজিবাদী দেশগুলোর মোট ব্যবসা-বাণিজ্যের অর্ধেকের কাছাকাছি এসেছে পশ্চিম ইউরোপের আয়ত্তে। ১৯৭৯ সালে পশ্চিম ইউরোপ মোট ২২২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করত, পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ছিল ১৮২ বিলিয়ন ডলার। ১৯৮০ সালে জাপান ১৯৭৯-র তুলনায় ১৯ শতাংশ বেশি গাড়ি ই ই সি (ইউরোপীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠ) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে রপ্তানি করেছে। সেখানে জাপানের মোট গাড়ি বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার কোটি ডলার। জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি বাজারের এক-চতুর্থাংশ করায়ত্ত করেছে, আজ সে মিনি-কম্পিউটার তৈরির মতো উন্নত জটিল যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও মার্কিন প্রাধান্য চ্যালেঞ্জ করছে।

পুঁজিবাদী দেশগুলির অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব

কী মূল পুঁজিবাদী দেশগুলি, কী তাদের চারপাশের এলাকা-উভয় ক্ষেত্রেই গোটা ব্যবস্থার ভিত্তি পর্যন্ত কেঁপে উঠছে।

মুদ্রাস্ফীতি, মজুরি হ্রাস, ছাঁটাই ও বেকারির মারফত জীবনযাত্রার মানের ওপর যে সব আক্রমণ আসছে তার বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী দেশগুলির শ্রমিকশ্রেণী অবিরত সংগ্রাম করছে। শ্রমকে আরও নিংড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে, শিল্প প্রতিষ্ঠানে আরও নিরাপত্তার জন্য, উন্নত চিকিৎসা ও পেনশন-নিরাপত্তার দাবিতেও শ্রমিকশ্রেণী লড়াই করছে। মুদ্রাস্ফীতি রোখার অজুহাতে মজুরি-বৃদ্ধি রোধের ব্যবস্থাকে শ্রমিকশ্রেণী মেনে নিতে রাজি হয়নি।

সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সঙ্গে তীব্র দ্বন্দ্ব

বর্তমান সংকট সাম্রাজ্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে তীব্র করে তুলেছে। এর নিদর্শন হল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক দেঁতাও (উত্তেজনা প্রশমনের সমঝোতা) পরিত্যাগ ও মারাত্মক যুদ্ধ প্রস্তুতি। রেগান প্রশাসন উগ্র প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে অস্ত্রসজ্জায় মার্কিন প্রাধান্য দাবি করে এবং ইউরোপে পেরসিং ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন রেখে। তারা বৃহৎ আয়তনে শুরু করেছে মানববিধ্বংসী নিউট্রন সমরাস্ত্রের উৎপাদন।

একই সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার ও অন্তর্ঘাতের উদ্দেশ্যে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। পোল্যান্ডে প্রতিবিপ্লবের প্রতি তাদের সমর্থন খুবই স্পষ্ট এবং প্রকাশ্য। সম্প্রতি তারা এতদূর গেছে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করেছে।

সাম্রাজ্যবাদ ও তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে তীব্রতর দ্বন্দ্ব

পুঁজিবাদের সংকট এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি কর্তৃক অনুসৃত পুঁজিবাদী পথ গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে এইসব দেশের ওপর সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিণামে তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়েছে; ঋণের বোঝা বেড়েছে। প্রতিকূল বাণিজ্য শর্তের দরুন এ সব দেশের লুটের বোঝা আরও ভারী হয়েছে, এদের উৎপন্ন পণ্যের দামের নিশ্চয়তা না থাকায় এরা পশ্চিমী পুঁজিবাদী দেশগুলির ওপর অসহায়ভাবে নির্ভরশীল। বহুজাতিক কারবারগুলির অনুপ্রবেশের ফলে শোষণ আরও প্রচণ্ড এবং দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হচ্ছে, ফলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিস্ফোরণ দেখা দিচ্ছে।

জাতীয় পরিস্থিতি

ভারতবর্ষের অর্থনীতি প্রধানত পুঁজিবাদী দুনিয়া ও তার বাজারের সঙ্গে যুক্ত। তৃতীয় -বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো তাকেও পুঁজিবাদী সংকটের প্রভাবে পুরোপুরি ভুগতে হয়েছে। এতে অর্থনীতির দীর্ঘস্থায়ী সংকটের অবস্থা আরও তীব্র হয়েছে, পরিণামে দেখা গেছে ব্যাপক গণ-অসন্তোষ আর জনগণের অভ্যুত্থান এবং দেশের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। জরুরি অবস্থাকালের একনায়কী শাসনও জনগণের অসন্তোষ দমাতে পারে নি এবং দেশে স্থায়িত্ব আনতে পারেনি। জনগণ তাকে বাতিল করল, জনতা সরকার ক্ষমতায় এলো, কিন্তু তাতেও অবস্থা স্থিতিশীল হল না। সংবিধানসম্মত মেয়াদের অর্ধেকটা পূরণ হতে না হতেই তাকে বিদায় নিতে হল। জলন্ধর সংগ্রেস সমাধান করে দিয়েছিল, "একনায়কতন্ত্রের বিপদ দূর করায় যাদের স্বার্থ এমন সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে জনতা দলের অর্থনৈতিক নীতির মোকাবিলা করতে হবে, দেখতে হবে যেন শাসকশ্রেণীদের স্বার্থে শ্রমিকরা বঞ্চিত না হয়।”

অর্থনীতির সংকট

অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা ছাড়াও, পুঁজিবাদী পথের সংকট প্রকাশ হয়ে পড়ছে আরও কয়েকটি ব্যাপারে।

শুরু থেকেই ষষ্ঠ যোজনা এই সংকটের পরিণতি দ্বারা আক্রান্ত। তার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণার অব্যবহিত পরেই পরিপূরণের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির ফলে যোজনার প্রকৃত আয়তন ইতিমধ্যেই ছাঁটাই হয়ে গেছে।

আর যোজনাকালে সরকার যে ক্রমবর্ধমান ঘাটতি ব্যয়ের আশ্রয় নেবেই এ-কথা স্মরণে রাখলে যোজনা ক্রমাগত ছোট হতে বাধ্য। বস্তুতপক্ষে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের ঋণ যে সব শর্ত চাপিয়েছে তার ফলে ষষ্ঠ যোজনা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে এবং এক সময় ঐ যোজনা আনুষ্ঠানিক ভাবেই পরিত্যাগ করতে হবে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতি

চার বছর আগে যখন আমাদের দশম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় তখন স্বৈরতন্ত্রী দলটি ছিল খোলাখুলি নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত, পরাজিত ও জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত।

১৯৭৫ সালে যে দল জরুরি অবস্থা জারি করে সারা দেশের ওপর একদলীয় একানায়কত্বের শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল সে-ই আজ আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। এখন শাসক দল ও জনগণের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে।

সাম্রাজ্যবাদ ও জনগণের মধ্যে দ্বন্দ্বের তীব্রতা দেশের অভ্যন্তরে শক্তিসমূহের আক্রমণ, শাসকদল ও বিরোধী বুর্জোয়া-জমিদার দলগুলির মধ্যে তীব্রতর বিরোধ, বুর্জোয়া শ্রেণী ও জমিদারদের মধ্যে টানাপোড়েন এবং বামপন্থী ঐক্যের বর্ধিত শক্তি- এগুলি এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত।

গণচীনের প্রতি মনোভাব

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধমূলক চক্রান্তের বিরুদ্ধে দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করার যে সংগ্রাম গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের নীতির ফলে জটিল হয়ে উঠেছে। চীনের নীতি মার্কিন চক্রান্তের সহায়ক।

গণচীনের সরকার তাঁদের সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বের শিকার,তাঁদের ধারণা সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বিপজ্জনক। এই কারণে গণচীনের সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন করার নীতি অনুসরণ করে চলেছে, তারা ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তিকে দুর্বল করতে চায়।

অপরপক্ষে, সি পি আই (এম)-এর মতে, যদি মার্কিন চক্রান্তকে প্রতিরোধ করতে হয় তাহলে এই চুক্তিকে বজায় রাখা ও শক্তিশালী করা অবশ্য কর্তব্য।

আমাদের পার্টি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের হাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যদানকে নিন্দা করে, কেননা এটা হল এশিয়াবাসীদের বিরুদ্ধে এশিয়াবাসীদের লড়িয়ে দেওয়া মার্কিন চালেরই অঙ্গ, আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেরই অঙ্গ। গণচীনের সরকার একটা সম্পূর্ণ বিপরীত কৌশল গ্রহণ করেছে, তারা পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারটা সমর্থন করে। দুটো দেশের মধ্যে তিন তিনটে যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর সি পি আই (এম) এ-ব্যাপারে আর আত্মসন্তুষ্টির মনোভাব দেখাতে পারে না। চীনা নীতির বর্তমান এইসব বিচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াই চালালেও পার্টি কিন্তু ভুলছে না যে, চীন একটা সমাজতান্ত্রিক দেশ। পার্টি আন্তরিকভাবে আশা করে যে, চীনে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণচীন অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সহযোগিতায় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সারির সংগ্রামী হিসাবে স্থান করে নিতে সক্ষম হবে।

ভারত ও চীন উভয় দেশের পক্ষ থেকেই দুদেশের মধ্যেকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলেছে, এটা আশার কথা। সি পি আই (এম) বরাবরই 'ভারত-চীন মৈত্রী' সম্পর্ক চেয়ে এসেছে; এই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে কোনও পদপেক্ষকে সে স্বাগত জানায়।

সুবিধাবাদ ও সোভিয়েত-বিরোধিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম

সাম্রাজ্যবাদ পরিচালনা করতে গিয়ে সি পি আই (এম) এবং বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে অবশ্যই কোন কোন বুর্জোয়া-জমিদার দলের সুবিধাবাদী নীতির মোকাবিলা করতে (বি জে পি) অতিশয় দৃঢ়মূল সোভিয়েতবিরোধী ও কমিউনিস্টবিরোধী নীতিরও মোকাবিলা করা প্রয়োজন। জনতা ও অন্যান্য কিছু বুর্জোয়া দল আফগানিস্তান, কাম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি প্রশ্নে একটা সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ করেছিল এবং সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব পোষণ করেছিল।

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ভিত্তিতে রচিত বৈদেশিক নীতির পক্ষে আপসহীন সংগ্রাম

বি জে পি আফগান ও কাম্পুচিয়ার ঘটনাবলীকে ব্যবহার করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আচ্ছা রকম শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। সত্যিকার জোটনিরপেক্ষতার নীতির নাম করে বি জে পি ধারাবাহিকভাবে সোভিয়েতবিরোধী নাতি সমর্থন করে চলেছে। বিজেপি-র জোটনিরপেক্ষতা বিরোধী আক্রমণ ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত- এটাই তো মার্কিন বৈদেশিক নীতি রচয়িতাদেরও উদ্দেশ্য।

বাম নেতৃত্ব পরিচালিত মন্ত্রিসভাগুলির বিরুদ্ধে আক্রমণ

কংগ্রেস সরকার বাম নেতৃত্বে পরিচালিত মন্ত্রিসভাগুলির ওপর বারংবার আক্রমণ চালাচ্ছে। এই আক্রমণ স্বৈরতন্ত্রী ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামেরই অভিব্যক্তি।

কংগ্রেস সরকার নির্লজ্জভাবে কুৎসা আর মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এবং এইসব রাজ্যে আইন ও শৃঙ্খলার সমস্যা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সমাজবিরোধী দলবলের সহায়তায় হিংসাত্মক কাজকর্ম সংগঠিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য কংগ্রেস সংগঠনেরও মন্ত্রিসভাবিরোধী অভিযানে হাত ছিল।  ত্রিপুরাতেও বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে কেন্দ্র এবং কংগ্রেস-র তরফ থেকে একটানা চাপ সৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

কেন্দ্র তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে খাদ্য সমেত বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের সরবরাহ থেকে এই দুটি রাজ্যকে বঞ্চিত করে রেখেছে।

বাম নেতৃত্বে পরিচালিত মন্ত্রিসভাগুলির সাফল্য

বাম নেতৃত্বে পরিচালিত তিনটি মন্ত্রিসভার বড় বড় সাফল্য স্বৈরতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামকে প্রভূত পরিমাণে সাহায্য করেছে। এইসব সাফল্য বামপন্থী শক্তিগুলিকে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে এনে দিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের গৌরবোজ্জ্বল রেকর্ড এই, তাঁরা জনগণের কাছে প্রদত্ত ৩৬ দফা প্রতিশ্রুতির অধিকাংশই পূরণ করেছেন। শিল্পের সমস্ত শাখায় উল্লেখযোগ্য মজুরি বৃদ্ধিতে এবং বোনাস আদায়ে শ্রমিকদের সাহায্য করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারিদের নতুন বেতনক্রম দেওয়া হয়েছে, তাঁদের পুরো ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারও স্বীকার করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ক্ষেতমজুরদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার একর জমি গ্রামের গরীবদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে "অপারেশন বর্গা" এবং ভূমিসংস্কার আইনের সংশোধনীর সাহায্যে সুনির্দিষ্ট এই ব্যবস্থা করা হয়েছে যে কোনও বর্গাদারকে আইনত 'জমি থেকে অথবা উৎপাদনের অংশ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, তাঁদের সস্তায় ঋণের সুযোগও দেওয়া হয়েছে। ভূমিকরের পুনর্বিন্যাস করে তার ঔপনিবেশিক চরিত্র দূর করা হয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকার শিক্ষার উপযোগী বাতাবরণ ফিরিয়ে এনেছেন। পূর্ববর্তী আমলে আবহাওয়াটা বিষিয়ে গিয়েছিল। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে।  সরকার বেকারভাতা দিচ্ছেন, আর বৃদ্ধ গরীব চাষীদের পেনশন দিচ্ছেন।

কেরালার বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের (এল ডি এফ) সরকার দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বণ্টন ব্যবস্থা চালু রেখে প্রশংসনীয় রেকর্ড স্থাপন করেছেন।

উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ

হিন্দু জাতিসত্তার কাছে আর এস এস-এর আবেদনের পিছনে কোনও সত্যিকার 'অভিযোগ নেই জনগণকে বিভক্ত করার উদ্দেশ্যে এ একটি নগ্ন সাম্প্রদায়িক আবেদন। আর এস এস মার্কা এই হিন্দুয়ানি দুটি সম্প্রদায়ের সাবেকি বিচ্ছেদকে কাজে লাগিয়ে হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে লাগাচ্ছে এবং মুসলমানদের পীড়ন করছে। মুসলমানদের বিদেশি ও বিধর্মী হিসেবে প্রচার করা হয়, তাদের অখণ্ডতা এবং তাদের প্রতি সাধারণ ও সমান আচরণের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালিত হয়। তুচ্ছ ধর্মীয় প্রশ্নে যে-সব বিরোধ দেখা দেয় RSS প্রায়শ তার জন্যে দায়ী তারা দাঙ্গায় অংশ নেয় এবং হিন্দুদের ক্রোধকে মুসলমান সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চালিত করে। এরা গণতন্ত্রবিরোধী, প্রগতিশীল চিন্তার বিরোধী এবং সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত এরা অসাম্যদৃষ্ট বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে হিন্দুধর্মের প্রধান স্বত্ত বলে প্রকাশ্যে যুক্তি দেখিয়ে এসেছে। কেরালায় সাম্প্রদায়িকতা প্রসারের জন্যে আর এস এস যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, বেশ কয়েকজন সি পি আই (এম) কর্মীকে খুনের জন্যে তারা দায়ী, আর যুক্ত মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে তারা কুৎসা ছড়িয়েছে। জামশেদপুর দাঙ্গায় তাদের ভূমিকা সরকারি তদন্ত কমিটির সাম্প্রতিক রিপোর্টে ফাঁস হয়ে গেছে।

বামপন্থী শক্তিসমূহের ঐক্য

একটি শক্তিশালী বাম ও গণতান্ত্রিক মোর্চা গঠনের জন্যে পার্টি বেশ কয়েক বছর ধরে 'চেষ্টা করে আসছে।

বাম শক্তিসমূহের ঐক্য আনতে হলে তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বোঝাপড়া দরকার। বাম ঐক্যকে জোরদার করার কাজে এবং এই ব্যাপারে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে গিয়ে বিগত চার বছরে যথেষ্ট সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

অনেক পরীক্ষা ও মোকাবিলা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট টিকে আছে এবং শক্তিশালী হয়েছে। সি পি আই সহ কয়েকটি দলের বামফ্রন্টে অন্তর্ভুক্তি বাম ঐক্যের শক্তি বৃদ্ধি করেছে।

পার্টির লক্ষ্য

স্বৈরতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জই হল প্রধান বিপদ এই আশু পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে লড়াই করতে গিয়ে পার্টি তার বৈপ্লবিক লক্ষ্যকে মোটেই ভুলে যাচ্ছে না। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করে সমাজতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করার ব্যাপারে পার্টি দৃঢ়ভাবে দায়বদ্ধ।

বর্তমানে সংগ্রামে পার্টি নির্দিষ্টভাবে সেই শ্রেণীসমন্বয় ও শ্রেণীশক্তিসমূহের সেই পারস্পরিক সম্বন্ধ করার প্রস্তুতি চালাচ্ছে। যা তাকে তার লক্ষে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।

পার্টি সদস্য ছিল ২৭১৫০০ জন, প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ৫৮৪ জন।

৪২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়, ৯ জন পলিট ব্যুরো সদস্য হন ।

ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পলিট ব্যুরো সদস্য:  ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, এম বাসব পুন্নাইয়া, পি রামমূর্তি, হরকিষান সিং সুরজিৎ, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাসগুপ্ত, বি টি রণদিভে, সমর মুখার্জী, ই বালা নন্দন।

EMS Namboodiripad

দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেস

২৪-২৯ ডিসেম্বর, ১৯৮৫ (কলকাতা)

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

পার্টির বিজয়ওয়াড়া কংগ্রেসেই এটা লক্ষ্য করা গিয়েছিল যে বিশ্ব পুঁজিবাদ বর্তমানে সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে, ১৯৩০ সালের সংকটের পর এমন সংকট আর কখনো দেখা দেয়নি।

শিল্পবিপ্লব, প্রযুক্তিগত বিপ্লব এসব কোন বুলিই সংকটের হাত থেকে পুঁজিবাদী সমাজকে রক্ষা করতে পারেনি। অথচ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া কোন সংকট ছাড়াই বিকশিত হয়ে চলেছে। এ থেকেই এই দুই ব্যবস্থার গুণগত পার্থক্যটি বোঝা যায়।

১৯৮৩ সাল নাগাদ পুঁজিবাদী দুনিয়া এই বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল যে মন্দা কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে। কিন্তু এই পুনরুন্নতির গতি ছিল মন্থর। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (Gross Domestic Product) বৃদ্ধির হার ছিল আনুমানিক ২.২ শতাংশ মাত্র।

১৯৮৪ সালে অবস্থার পুনরুন্নতি চলতে থাকে এবং দেখা গেল যে ঐ বছরটা নেতৃস্থানীয় পুঁজিবাদী দেশগুলির পক্ষে আশাতীতভাবেই ভালো হয়েছে।

পুঁজিবাদের প্রবক্তাদের কাছে বিরাট স্বস্তির কারণ হলেও ঐ পুনরুন্নতিটা কিন্তু সব দেশে সমান হয়নি। এমনকি চরম আশাবাদী মুখপাত্ররাও এই দাবি করতে পারেনি যে নতুন বছরেও আগের বছরের উন্নতির গতিবেগটি বজায় থাকবে।

উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে তীব্রতর দ্বন্দ্ব

এই সংকট এবং তার ফলাফলগুলি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজিবাদের ব্যর্থতা ঘোষণা করে, কিন্তু সেই সঙ্গে তা এটাও দেখিয়ে দেয় যে, জনসাধারণের ওপর এর বিপর্যয়কারী ফলাফল সত্ত্বেও একচেটিয়া পুঁজিপতিদেরও বহুজাতিক সংস্থাগুলির মুনাফা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। কারণ, রাষ্ট্রের সমগ্র নীতিই পরিচালিত হচ্ছে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই। একচেটিয়া কারবারগুলির ও শিল্প-সামরিক জোটের সঙ্গে রাষ্ট্রের এই একাত্মতা এর সামাজিক ভিত্তিকে চরমভাবে সংকুচিত করছে এবং বিভিন্ন প্রকারের অর্থনৈতিক অবস্থার মানুষকে ব্যাপকভাবে সমবেত করে ব্যাপক গণঅঅন্দোলন সম্ভব করে তুলছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শ্রেণীসংগ্রাম তীব্রতর হবার এটাও একটা কারণ।

সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া

একদিকে পুঁজিবাদী দুনিয়া যখন ১৯৩০-এর দশকের পর আজ গভীরতম সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত, যার ফলে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে দ্বন্দ্বগুলি আরও তীব্র হচ্ছে, অপরদিকে তখন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি সংকটমুক্তি থেকে এবং শান্তির সপক্ষে যাবতীয় প্রয়াস অব্যাহত রেখে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্যে আরও অগ্রগতি সূচিত করেছে এবং কাউন্সিল অব মিউচুয়াল ইকনমিক অ্যাসিস্ট্যান্স (পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য পরিষদ)-এর সমাজতান্ত্রিক সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে করেছে।

আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বসমূহ

সংকটজনিত এই পরিস্থিতিতে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী সংঘাত ও রেষারেষি তীব্রতর হচ্ছে, যদিও তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক যুদ্ধ প্রচেষ্টা বন্ধ করতে সক্ষম হবার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়নি। কিন্তু বিশ্ব বাজারের জন্য অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অসম প্রযুক্তিগত বিকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থপর অর্থনৈতিক নীতি এবং সর্বোপরি সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির জন্য দোসরদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক চাপ এ সব মিলে দোসরদের প্রতিরোধ ডেকে আনছে। রেগানের নক্ষত্র যুদ্ধের পরিকল্পনাকে দেখা হচ্ছে যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে মার্কিনী মাতব্বরি হিসাবে। দোসরদের রক্ষার জন্য নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজেকে রক্ষার পরিকল্পনা হিসাবেই এটা ধরে নেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে বিশেষ করে ফ্রান্স প্রবল আপত্তি জানিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র বসাবার স্থান নির্ধারণ এবং চিরাচরিত অস্ত্রের উৎপাদনে আরও অর্থ ব্যয় করার দাবি-এগুলিও বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সঙ্গে সংঘাত বৃদ্ধি

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা এবং পাশ্চাত্য দুনিয়ার ওপর তাদের অনেকের আর্থিক নির্ভরশীলতার ফলে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে এইসব দেশগুলির সংঘাত তীব্রতর আকার ধারণ করছে। এই দেশগুলির বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১৯৭০ সালে ছিল ৭৫০০ কোটি ডলার। ১৯৮৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার কোটি থেকে ১ লক্ষ কোটি ডলার। এ থেকেই বোঝা যাবে পাশ্চাত্য সাহায্যের ওপর তাদের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কতখানি।

এটা অবশ্য হওয়ার কোন কারণ থাকত না, যদি এইসব দেশের সরকারগুলি প্রাক্-পুঁজিবাদী সম্পর্কগুলির অবসান ঘটাত এবং দেশের উৎপাদনশক্তিকে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের কাজে নিয়োগ করত।

কমিউনিস্ট আন্দোলনের ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ঐক্য

আজ যখন এক কাণ্ডজ্ঞানহীন যুদ্ধপ্রয়াস চলছে, দুই সমাজব্যবস্থার মধ্যে চলছে তীব্রতর দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের জন্যে চাপ সৃষ্টি করছে আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা লড়ছে শান্তির জন্যে, বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষার জন্য, তখন কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ঐক্যের প্রশ্নটা সব থেকে জরুরি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঐক্যের অর্থ বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী অগ্রগামী বাহিনীর ঐক্য, তাদের ধ্বংস করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিজয়ী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবগুলির ঐক্য। মতবিরোধের অর্থ- শান্তি, স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের জন্য বিশ্বকে যে নেতৃত্ব দেবে সেই অগ্রণী শক্তির মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য। দুঃখের বিষয় যে এই ঐক্য এখন নেই।

এই সময় কালে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দুই বড় দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মধ্যে সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি ঘটেছে।

জাতীয় পরিস্থিতি

পার্টির বিজয়ওয়াড়া কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮০ সালে কংগ্রেস দল ক্ষমতায় ফিরে আসার পর। সেই পার্টি কংগ্রেসে বলা হয়, "যে দল ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দেশের উপর একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল আজ সেই দলই ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। শাসক দলের সঙ্গে জনগণের দ্বন্দ্ব এখন  নতুন পরিস্থিতির মধ্যে চলেছে। "এগুলির মধ্যে আছে সাম্রাজ্যবাদ বনাম জনগণের দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি দেশের ভিতরে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলির আক্রমণ শাসক দলের সঙ্গে বিরোধী বুর্জোয়া-জমিদার দলগুলির তীব্রতর বিরোধ বুর্জোয়া ও জমিদার শ্রেণীগুলির মধ্যে টানাপোড়েন এবং বামপন্থী ঐক্যের শক্তি বৃদ্ধি।"

গত চার বছরের ঘটনাবলী দেখিয়ে দিচ্ছে যে ঐসব দ্বন্দ্বগুলি আরও তীব্রতর রূপ ধারণ করেছে, সেগুলি নতুন নতুন ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, এবং কতকগুলি একেবারে নতুন সমস্যা ও দায়িত্বের উদ্ভব ঘটেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতিকে মনে না রেখে পার্টির পক্ষে তার কাজকর্ম পরিচালনার সঠিক নির্দেশক লাইন স্থির করা সম্ভব নয়।

কৃষি সংকট

কৃষি সংস্কারে কংগ্রেসের ব্যর্থতা, দেশের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে মান্ধাতার আমলের কৃষি সম্পর্ক বজায় রাখা এবং মুষ্টিমেয়র হাতে জমি পুঞ্জীভূত করে রাখাটা এই সংকটকে অনিবার্য করে তুলেছে।

আমাদের পার্টির কর্মসূচীতে (১৯৬৪) বলা হয়েছে, “প্রায় দুই দশকের কংগ্রেস শাসন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তার কৃষিনীতির লক্ষ্য এবং গতিটা আমাদের ভূমি সম্পর্কের সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক শৃঙ্খল চূর্ণ করে দিয়ে কৃষকসমাজকে যুগযুগব্যাপী বন্ধন থেকে মুক্ত করার দিকে নয়,বরং সামন্ততান্ত্রিক জমিদারকে ধনতান্ত্রিক জমিদারে রূপান্তরিত করা এবং একটি ধনী কৃষক স্তর গড়ে তোলার দিকে। ধনতান্ত্রিক বিকাশের পক্ষে প্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত কৃষিজাত দ্রব্যাদি উৎপাদনের জন্য তারা ভর করতে চায় এই জমিদার ও ধনী কৃষক স্তরটি ওপর। তারা আরও চায় এই অংশগুলিকে গ্রামাঞ্চলে শাসকশ্রেণীর প্রধান রাজনৈতিক ভিত্তিতে পরিণত করতে।”

সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব

ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা, দেশজুড়ে ব্যাপক গুপ্তচর বৃত্তির জাল, খালিস্তানীদের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের উৎসাহ ও সাহায্য দান, ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দমনে ঐ দুই সরকারের অসম্মতি, পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ, শ্রীলঙ্কার তামিল প্রশ্নটি কাজে লাগিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে উগ্রজাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলা এবং ভারতকে কতকগুলি বৈরী মনোভাবাপন্ন সরকার দিয়ে ঘিরে ফেলার চেষ্টা থেকে এটা পরিষ্কার যে বিজয়ওয়াড়া প্রস্তাবে সাম্রাজ্যবাদ বনাম ভারতীয় জনগণের যে তীব্রতর দ্বন্দ্বের কথা বলা হয়েছিল এখন তা আরও তীব্র হয়ে হস্তক্ষেপের রূপ গ্রহণ করেছে।

বামফ্রন্ট সরকারগুলির বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা

কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধের তীব্রতা বৃদ্ধির প্রতিফলন ঘটছে কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক দলের সঙ্গে সি পি আই (এম)-এর নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবাংলা ও ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকারগুলির সম্পর্কের মধ্যে।

কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার এই সরকারগুলির আর্থিক সমস্যা সৃষ্টি করে, সময়মতো অর্থ মঞ্জুর না করে, রাজ্যগুলির শিল্পায়নে বাধা দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। কৃষকসমাজ ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে প্রণীত আইনগত ব্যবস্থা, কায়েমী স্বার্থের বিনিময়ে জনগণকে আশু রিলিফ দিতে পারে এমন ব্যবস্থাগুলিকে কেন্দ্র অনুমোদন করতে অস্বীকার করছে। কৃষি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলি বছরের পর বছর রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য ফেলে রাখা হচ্ছে। আসল লক্ষ্যটা হল এই মন্ত্রিসভাগুলির গণমুখী কর্মসূচী, সাধারণ মানুষকে রিলিফ দেবার কর্মসূচীগুলির প্রতিবন্ধকতা করা এবং এই মন্ত্রিসভাগুলির দক্ষতা ও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে ক্ষুণ্ণ করা।

এর সঙ্গে আছে এই মন্ত্রিসভাগুলির সামনে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা সৃষ্টির জন্য রাজ্য কংগ্রেস  দলগুলির সর্বতোমুখী প্রয়াস। কয়েকশ পার্টি কর্মী নিহত হয়েছে এমন গুণ্ডাদের আক্রমণে স্থানীয় কংগ্রেস দলগুলির মধ্যে যাদের খুঁজে পাওয়া যাবেত। এছাড়া মন্ত্রিসভাগুলির ভাবমূর্তি হেয় করার জন্য অবিরাম কুৎসা প্রচার করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে যে এই দুটি রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।

পার্টি সংগঠন

গত চার বছরে পার্টি বেড়েছে, কিন্তু তার বৃদ্ধি সর্বত্র সমানভাবে হয়নি। কতকগুলি রাজ্য অন্যান্য রাজ্যের অগ্রগতির অংশীদার হতে না পেরে এখনও পেছিয়ে আছে। পার্টির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ঝোঁকের বিপদ সম্পর্কে সালকিয়া প্লেনামের সতর্কবাণী হাল্কাভাবে নেওয়া হয়। সর্বভারতীয় স্তরে পার্টির বিকাশের ক্ষেত্রে এটাকে একটা বিরাট বাধা হিসাবে গণ্য করে তা অতিক্রম করার সচেতন প্রয়াসেরও অভাব আছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রবণতার অর্থ কেন্দ্রীভূত পার্টির অবসান, অথচ কেন্দ্রীভূত পার্টি ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন এগিয়ে যেতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রবণতা মতাদর্শগত সংহতি ও ঐক্যের অভাবকেই ব্যক্ত করে। অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং গুরুত্ব দিয়ে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে।

সালকিয়া প্লেনাম থেকে কুসংস্কারবাদ, ধর্মান্ধতাবাদ ও সামন্ততান্ত্রিক ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাবার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলদের তরফ থেকে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি আক্রান্ত হলে এই সংগ্রামের ক্ষেত্রে দ্বিধা দেখা দেয়। সাম্প্রদায়িক প্রচারের ফলে ছাড়া পাওয়া বিভেদপন্থী প্রবণতাগুলির মোকাবিলা করার সঙ্গে সঙ্গে বস্তুবাদী ও বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার প্রসার ঘটিয়ে ধর্মান্ধতাবাদ ও কুসংস্কারের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকেও মোকাবিলা করার প্রয়োজন আছে। পার্টির কর্মসূচীতে জাতির সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনে সকল প্রকার ধর্মীয় অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য পার্টির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

মুসলমান সম্প্রদায়ের গোঁড়াপন্থীরা নারীদের অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে, আর হিন্দু ও আর এস এস সাম্প্রদায়িক প্রচার বাড়াচ্ছে। এই অবস্থায় পার্টি যদি এই সব ক্ষতিকারক প্রবণতার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা থেকে বিরত থাকে সেটা হবে নিছক সুবিধাবাদ। পার্টিকে উভয় মতান্ধতার বিরুদ্ধেই নিরলস সংগ্রাম অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে।

মার্কসবাদ - লেনিনবাদের প্রতি বিশ্বস্ততা

আমাদের সময়কার কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব-অর্থাৎ সমাজতন্ত্র বনাম সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের দ্বন্দ্বের আলোকে বিশ্ব পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করার লাইনকে পার্টি নিরন্তর তুলে ধরে।

বিচ্যুতি ও বিকৃতি, সংশোধনবাদ ও সংকীর্ণতাবাদ, যা এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তার বিরুদ্ধে পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। কমিউনিস্ট ঐক্যের পতাকাকে উড্ডীয়মান রেখে পার্টি ঐসব বিচ্যুতি সম্পর্কে কর্মীদের শিক্ষিত করে তোলে।

সি পি আই (এম) সর্বহারার একনায়কত্বের তত্ত্বকে সমর্থন করে। সমর্থন করে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি এবং পার্টির অগ্রণী ভূমিকা। পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সংশোধনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে রক্ষা করাকে সকল কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ কর্তব্য বলে মনে করে।

সকলেই চায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজের রূপান্তর। কিন্তু কীভাবে এই রূপান্তর ঘটানো সম্ভব হবে তা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সেটা ঘটাবার জন্য জনগণের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। এটা নির্ভর করে শাসক শ্রেণীগুলির আচরণের উপর, যারা, ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দেয়, জনগণের ইচ্ছার তোয়াক্কা করে না বরং সন্ত্রাস ও বর্বর হিংসার দ্বারা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে দমন করে। ভারতের জনসাধারণ জরুরি অবস্থা ঘোষণার অভিজ্ঞতা ভুলতে পারে না, যখন রাতারাতি বলপ্রয়োগ করেনি এবং সংশোধনবাদকে ভারতীয় পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের তাদের সকল স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল।

অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পার্টি সংশোধনবাদ ও সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে। পার্টি সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তার সতর্ক প্রহরা শিথিল করে প্রয়োগ হিসাবে হাজির করার চেষ্টাকে সর্বদা উদঘাটিত করে চলেছে।

জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সামাজিক প্রগতির এই মহান উদ্দেশ্যে সি পি আই (এম) নিজেকে সমস্ত জনগণের সেবায় নিয়োজিত করছে। সি পি আই (এম) এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, তার সমস্ত কমিটি, ইউনিট এবং সকল সদস্য জনগণের স্বার্থে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই সময়ে পার্টির সদস্য ছিল ৩৬৭৮২৮ জন, পার্টি কংগ্রেসে প্রতিনিধি ছিলেন ৬৪৬।

৭০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় কমিটি, ১০ জনের পলিট ব্যুরো।

ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পলিটব্যুরো সদস্য :  ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ, এম বাসবপুন্নাইয়া, নৃপেন চক্রবর্তী, জ্যোতি বসু, সরোজ মুখার্জী, হরকিষান সিং সুরজিৎ, বি টি রণদিভে, সমর মুখার্জী, ই বালা নন্দন, ভি এস অচ্যুতানন্দন।

আগের পর্ব

তথ্যসুত্রঃ

১) Documents of The Communist Movement in India,

National Book Agency, Volume I- XXVII

২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,

মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি

৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement

Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977


শেয়ার করুন

উত্তর দিন