Party Congress History Part VIII Cover

পার্টি কংগ্রেস – ইতিহাস থেকে আগামী (৮ম পর্ব)

পারমিতা ঘোষ চৌধুরী

নবম পার্টি কংগ্রেস

২৭ জুন - ২ জুলাই ১৯৭২ (মাদুরাই)

রাজনৈতিক প্রস্তাব

আমাদের পার্টির বিগত কংগ্রেসের পরবর্তীকালীন সময়ের আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী বর্তমান যুগের সমস্ত দ্বন্দ্বগুলির ক্রমবর্ধমান তীব্রতা প্রকাশ করছে। সেগুলি এটাও প্রকাশ করছে যে, সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলির মধ্যেকার দ্বন্দ্বটি এখনও পর্যন্ত সমস্ত দ্বন্দ্বগুলির কেন্দ্রবিন্দুরূপে কাজ করছে।

পুঁজিবাদী জগতে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে যে মুদ্রা সংক্রান্ত তোলপাড় দেখা দিয়েছিল, তাতে করে বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির অতি গভীর সংকটই প্রকাশ পেয়েছে। এখন থেকে গত পর পর তিনটি বছর, সকল পুঁজিবাদী দেশগুলিতে উৎপাদনে বৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে।

পুঁজিবাদী দুনিয়ার নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এমন এক অর্থনৈতিক সংকটের খপ্পরে পড়েছে, যা থেকে নিজেকে মুক্ত করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিকূল বৈদেশিক দেনা-পাওনার ব্যালেন্স নতুনভাবে বেড়ে গেছে। মুদ্রাস্ফীতি ক্রমবর্ধমান। এটা ঘটেছে অর্থনীতির সমারিকীকরণ, ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রচণ্ড ব্যয়, দুনিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য রাখার উদ্দেশ্যে যুদ্ধাস্ত্রের জন্য ব্যয়, সর্বোপরি সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিরুদ্ধে লড়াই চালাবার এবং অগ্রসর ও অনগ্রসর উভয় দেশগুলিতে বিপুল পরিমাণে পুঁজি রপ্তানির জন্য।

সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি

গত তিন বছরে সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের তীব্রতা আরও বেড়েছে, উত্তেজনা প্রশমন ও নিরস্ত্রীকরণের আলাপ-আলোচনার আবরণে সমাজতন্ত্রী দেশগুলিকে ভিতর থেকে ভাঙবার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের চেষ্টা তীব্রতর হয়ে উঠেছে।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির তুলনায় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হয়েছে। জনগণের জন্য ক্রমবর্ধমান ও সমৃদ্ধ জীবনযাত্রার মান সুনিশ্চিত করেছে।

এ কথা মনে রাখতে হবে যে, যে সময়ে পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ সমাজতন্ত্রী হয়ে গেছে এবং সমস্ত দিক দিয়ে দ্রুত উন্নতি লাভ করে চলেছে, যে সময়ে আগেকার উপনিবেশগুলির অধিকাংশই আরও অনুকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করতে পেরেছে এবং যে সময়ে শক্তিশালী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ও বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনগুলির ঝড় সমস্ত মহাদেশে বয়ে চলেছে, সে সময়ে বিশ্ব পুঁজিবাদী সংকটটিও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সমাজতন্ত্রী দেশগুলির অধিকাংশই অতি পশ্চাৎপদ অর্থনীতির উত্তরাধিকারী হলেও শিল্প, কৃষি, বিজ্ঞান, কারিগরি বিদ্যা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি লাভ করেছে। সমাজতন্ত্রী শিবিরের দেশগুলি কেবল যে পুঁজিবাদী অতি উৎপাদনের পুনঃপৌনিক সংকট, বেকার সমস্যা, অভাব ও দারিদ্র্য থেকে মুক্ত এক সমৃদ্ধশালী সমাজতন্ত্রী অর্থনীতি গড়ে তোলার কাজে সফল হয়েছে তাই নয়, তারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির বিরাট স্তম্ভরূপেও দাঁড়িয়েছে।

সমাজতন্ত্রী শিবিরের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি, বিশেষ করে দুটি বড় সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণচীনের অগ্রগতি সাম্রাজ্যবাদী শিবিরকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থায় ফেলছে এবং ছোট ও দুর্বল জাতিগুলিকে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায় এবং সাম্রাজ্যবাদীদের চাপ প্রতিরোধ ও অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদ অবস্থা দূর করার জন্য বৈজ্ঞানিক কারিগরি ও শিল্প সংক্রান্ত সাহায্য সংগ্রহ করতে সক্ষম করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পুতুল সশস্ত্র বাহিনীগুলির উপর বিপর্যয়কারী আঘাত হানতে বিশ্ব সমাজতন্ত্রী শিবিরের সামরিক সাহায্য ভিয়েতনাম ও ইন্দোচীনের দেশগুলির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রভূত সাহায্য করেছে। সারসাই এই সমস্তই সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব তীব্রতর করছে। উত্তেজনা প্রশমন ও নিরস্ত্রীকরণের আলাপ-আলোচনার আবরণে সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থা ভেতর থেকে দুর্বল করার সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টা তীব্র হচ্ছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড পরাজয় সত্ত্বেও, সে লাওস ও কাম্বোডিয়ায় যুদ্ধ বিস্তার করেছে। ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের উপর প্রচণ্ড বোমাবর্ষণের আক্রমণ তীব্র করেছে, কোরিয়ার জনগণের মিলন বন্ধ করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় দখলদারী সৈন্যবাহিনী রেখে চলেছে, চীনের বিরুদ্ধে তাইওয়ানকে সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে, কিউবার অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান জাতীয় পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য

ভারতের অর্থনৈতিক সংকট থামিয়ে দেওয়া গেছে ও তা পার হওয়া গেছে বলে সরকারি মুখপাত্রদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ দাবি সত্ত্বেও এই সংকট তার প্রধান প্রধান লক্ষণগুলির দিক হতে মোটেই হ্রাস পায়নি। বিশ্বপুঁজিবাদী সংকট এবং প্রধান প্রধান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যে মুদ্রা ও বাণিজ্য যুদ্ধ চলেছে, তা আমাদের পরনির্ভর ও সংকট-জর্জরিত অর্থনীতিকে কঠিন আঘাত করতে বাধ্য। এক কোটি শরণার্থীর ভরণ-পোষণের বিরাট সমস্যা ও দেশের উপর প্রতিরক্ষার যে অতিরিক্ত বোঝা চেপেছে, তা পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে।

This image has an empty alt attribute; its file name is UR-2.jpg
Jyoti Basu while movement

নব-কংগ্রেসী শাসকরা জনসাধারণের মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছে যে, দেশের খাদ্য সমস্যার কার্যত সমাধান হয়ে গেছে। ১৯৬৭ সাল থেকে পর পর চার বছর সুবৃষ্টি ও ফসলের ভাল ফলন, ১৯৭১ সালে ১০ কোটি ৮০ লক্ষ টন খাদ্যশস্যের রেকর্ড উৎপাদন, এবং 'সবুজ বিপ্লবের' ফল, এইসব কারণে সরকার খাদ্য আমদানি বন্ধ করতে পেরেছে এবং শহরাঞ্চলে খাদ্যশস্যের যোগান বাড়াতে পেরেছে, যদিও দামস্তর শহরের গরিবদের আয়ত্তের বাইরে রয়েছে। কিন্তু এটা খুবই স্পষ্ট, গত পনেরো বছর ধরে দৈনিক মাথাপিছু খাদ্যের প্রাপ্ত পরিমাণ পনেরো থেকে যোলো আউন্সের মধ্যেই স্থির হয়ে রয়েছে। খাদ্যের দাম বেড়েই চলেছে, যদিও ব্যবসায়ীরা কৃষকসমাজকে লুঠ করার জন্য, ফসল ওঠার সময় বাজারের কলকাঠি নেড়ে শস্যের দাম সাময়িকভাবে নামিয়ে দেয়।

শহরাঞ্চলগুলির প্রয়োজন মেটাবার জন্য গ্রামের ধনীদের কাছ থেকে বিক্রয়লব্ধ উদ্বৃত্ত শস্য সংগ্রহ করতে "সবুজ বিপ্লবে”র যে কৌশল বুর্জোয়া-জমিদার সরকারকে অবশ্যই সাহায্য করেছে, তা গ্রামাঞ্চলে মুষ্টিমেয় ধনীদের ও বিপুল সংখ্যক গরিবদের মধ্যে ব্যবধানটি বাড়িয়ে তোলা ছাড়াও খাদ্যাভাবের সমস্যাটি কেবল শহর থেকে গ্রামে চালান দিচ্ছে মাত্র। কৃষিকার্যে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় ট্রাক্টর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির ব্যবহার খেতমজুরদের মধ্যে বেকারি বাড়াতে ও তাদের মজুরি কমাতে জমিদারদের সাহায্য করছে। বাস্তবিকপক্ষে, সবুজ বিপ্লবের এই কৌশল হল বুর্জোয়া ভূমিসংস্কারের বিশেষ নীতি এবং এটা কৃষকসমাজের স্বার্থে প্রকৃত ভূমিসংস্কারের বিরোধী। খাদ্য সমস্যার সমাধান এর দ্বারা সম্ভব নয়। এ গ্রামীণ জনসাধারণের সুবিপুল অংশের ক্রয়ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেয় এবং কেবল গ্রামীণ ক্ষেত্রে সামাজিক দ্বন্দ্বগুলিকে তীব্র করে তোলে।

লম্বা তিন বছরের তথাকথিত "পরিকল্পনা ছুটি”র পর যে, চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু করা হয়েছিল, তা শোচনীয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, যা মধ্যবর্তীকালীন পরিকল্পনা মূল্যায়নের রিপোর্টেই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু তাদের নীীতিকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করার বদলে ভারত সরকার ও পরিকল্পনা কমিশন তাদের একই পুরানো নিন্দিত পলিসি নিয়ে চলেছে, যেটা দেখা যাচ্ছে ‘পঞ্চম পরিকল্পনার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি’ নামক তাদের দলিলে।

দারিদ্র্যরেখার নিচে অবস্থিত অর্থাৎ মাসিক গড়ে ২০ টাকারও কম আয়ের মানুষের সংখ্যা স্বাধীনতার পর বেড়ে গত ২৫ বছরে শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ হয়েছে এবং বস্ত্র ও অন্যান্য একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মাথাপিছু ব্যবহারের পরিমাণ স্থিতাবস্থায় রয়েছে; এই সকল ঘটনা সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য কিভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে সংকুচিত করে তুলেছে, এবং এই হল শিল্পের অচলাবস্থা, বস্ত্র ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের দরজা বন্ধ এবং সরকারি ও বেসরকারি শিল্পক্ষেত্রের কলকারখানার উৎপাদন ক্ষমতার সাংঘাতিক অল্প ব্যবহারের প্রধান কারণ। অতএব, শিল্প ও কৃষির সামগ্রিক চিত্রটি একটি গভীর ঘনায়মান সংকটের হতাশাময় চিত্র, দেউলিয়া পুঁজিবাদী পথের কাঠামোর মধ্যে যার কোন সমাধান নেই।

সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলী

এই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর দ্রুত বিকাশ, আমাদের পার্টির নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীমণ্ডলীর আবির্ভাব ও ক্ষমতাচ্যুতি, শাসক পার্টিতে ভাঙন, বামপন্থী ঐক্যে বিভেদ, লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা কংগ্রেসের বিজয়, বাংলাদেশ সংগ্রাম উপলক্ষে ভারত-পাক যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জনগণের জয়, ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে শাসক পার্টির বিজয়, সন্ত্রাস ও কারচুপির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন প্রহসনে পরিণত করা, -এই ঘটনাগুলি দেশ যে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তারই পটভূমিতে ঘটেছে। জনগণের জীবনে সংকটের ফল আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। পুঁজিপতি-জমিদার সরকার তার যাবতীয় কলাকৌশল সত্ত্বেও অর্থনীতিকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারেনি। গ্রামাঞ্চলের মতো শহরগুলিও শ্রমের বাজারে ভিড় করা বিপুল সংখ্যক বেকার নিয়ে বিস্ফোরণ কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। ৫০ লাখের উপর রেজিষ্ট্রীকৃত বেকার, তিন হাজারের উপর বন্ধ কলকারখানা, ২০ লাখের উপর শিক্ষিত বেকার, গ্রামাঞ্চলে তীব্রতর অনাহার নিয়ে সরকার এক সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন। সরকার এটা বুঝতে পারছে এবং সম্ভাব্য বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া লাঘবের জন্য বেকার সমস্যার উপর অনেকটা মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে ও একটা কিছু করা হচ্ছে বলে হাজার হাজার মানুষের মনে আশা জাগাচ্ছে। এই পরিস্থিতির ফলে স্বভাবতই জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের সংগ্রাম, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ ফেটে পড়ছে।

পশ্চিমবঙ্গে আধা-ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস

ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে, গণতান্ত্রিক সমর্থনের দাবি করে শাসক কংগ্রেস বিরাট জয় যদি লাভ করে থাকে, তবে পশ্চিমবঙ্গে ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী শক্তি, যা থেকে কেবলমাত্র বিশ্বাসঘাতক সংশোধনবাদীরা পালিয়ে গেছে, তার মুখোমুখি হয়ে শাসক কংগ্রেসকে, ক্ষমতায় আসার উদ্দেশে নির্বাচনে কারচুপি করার জন্য গুণ্ডাদের,

খুনীদের ও পুলিস অক্রমণের এবং সমস্ত রকম জাল-জুয়াচুরির উপায়ের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। এমন কোন দুষ্কর্ম নেই যা এখানে শাসক পার্টি না করে ছেড়েছে। পোলিং বুথে প্রকাশ্য আক্রমণ, খুন করা, ভোটদাতাদের ভোটদানে বিরত করার জন্য আক্রমণ, ব্যালট বাক্সে কংগ্রেসের পক্ষে ছাপ দিয়ে ভর্তি করা, ভোটের ফল জাল করা, কংগ্রেসী ও তাদের বশংবদ দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্টদের নির্বাচিত করার জন্য এই সমস্ত রকম উপায়ই নেওয়া হয়েছিল। "দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র” নির্বাচন পরিচালনায় সবচেয়ে বড় জালিয়াতি প্রকাশ করেছে-সাধারণ মানুষ তার ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত।

সন্ত্রাস, আধা-ফ্যাসিস্ট আক্রমণ, পরিকল্পিত হত্যা, এবং গুণ্ডাদের দ্বারা খুন প্রভৃতি চলতে থাকার অবস্থার মধ্যে নির্বাচন এসেছিল। কংগ্রেস এই পদ্ধতিগুলি নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। নির্বাচনে জেতবার জন্য কংগ্রেস উপরে বর্ণিত ঘৃণ্য অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে নির্বাচনী অফিসার ও পুলিস অফিসারদের যোগসাজসে সমস্তরকম দুষ্কর্মের আশ্রয় গ্রহণ করেছে।

অনেকগুলি নির্বাচনী কেন্দ্রে, নির্বাচন কার্যত হয়েছিল ভোটদাতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এটা ছিল শ্রেণী-সংগ্রামের তীব্র বহিঃপ্রকাশ।

এ সত্ত্বেও, সন্ত্রাসের মধ্যে আমাদের পার্টির পক্ষে ৩,৭০০,০০০ এবং আমাদের মিত্রদের পক্ষে ৮০০,০০০ ভোট পড়ে। কংগ্রেস গুণ্ডাশাহীর পক্ষে এটা মস্ত বড় পরাজয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা আমাদের ভোট দিয়েছেন ও যারা বন্দুকের মুখে ভোটদানে বঞ্চিত হয়েছেন, তারা পার্টি ও গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন।

পার্টির রণকৌশল

এই কারণে আমাদের প্রাক্তন মিত্রদের পক্ষ থেকে সমস্ত রকমের প্ররোচনা সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্টকে এবং বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির ঐক্যকে রক্ষা করার কাজে আমাদের পার্টি আগাগোড়া সমপরিমাণে অটল ছিল। শ্রেণীগত শক্তিগুলির পারস্পরিক সম্বন্ধ এবং শ্রেণীগুলির অভ্যন্তরে বিভিন্ন পার্টির পারস্পরিক বিন্যাস ও বিকাশমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন আমাদের উপর এই ঐতিহাসিক কর্তব্য আরোপ করেছিল। এই কারণেই জনগণের (পপুলার) সংগ্রাম ও আন্দোলনের সংগঠকরূপে যুক্তফ্রন্ট সরকারগুলির ভূমিকা পরিত্যাগ না করে আমাদের পার্টি সে সরকারগুলিকে রক্ষা ও তাদেরকে চালু রাখতে চেষ্টা করেছিল। এই কারণেই জনগণের কাছে সংবিধানের এবং তার ধারাগুলির সীমাবদ্ধতা তুলে ধরার সাথে সাথে আমাদের পার্টি জনগণকে আশু সুযোগ-সুবিধা দেবার জন্য গুরুতররূপে চেষ্টা করেছিল। সেই কারণেই মন্ত্রিসভায় থাকার সময়ে আমরা খোলাখুলিভাবে গণসংগ্রামকে উৎসাহ দিয়েছিলাম এবং তাদের সম্পূর্ণ রক্ষার ব্যবস্থা করেছিলাম।

সংশোধনবাদী বিশ্বাসঘাতকতা দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের অনুসৃত

বিশ্বাস-ঘাতকতামূলক লাইনটি শাসক কংগ্রেস পার্টিকে সমর্থন এবং আমাদের নেতৃত্বে চালিত বামপন্থী শক্তিগুলির উপর আক্রমণ করার জন্য সকল চেষ্টা কেন্দ্রীভূত করছে। এই লাইনকে যে আদর্শগত তত্ত্বের সাজপোশাকেই সাজানো হোক না কেন, এর সারমর্ম হল কংগ্রেসের লেজুড় হিসেবে কাজ করা এবং শাসকশ্রেণীগুলিকে নতুন তত্ত্বগত হাতিয়ার সরবরাহ করে তাদের হয়ে আমাদের পার্টিকে আক্রমণ করা। জনগণের এবং আমাদের পার্টির বিরুদ্ধে কংগ্রেসী হিংসাত্মক আক্রমণকে আড়াল করার জন্য, পশ্চিমবাংলায় আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসকে আড়াল করার জন্য এবং তাদের নিজেদের অনুগামীদের কংগ্রেসী শিবিরে নিয়ে গিয়ে ঢোকাবার জন্য- আমাদের বিরুদ্ধে সংকীর্ণতাবাদ, বামপন্থী হঠকারিতাবাদ এবং ‘সন্ত্রাসের রাজনীতি’ ইত্যাদি যাবতীয় অভিযোগগুলি করা হচ্ছে। তারা যখন বুর্জোয়া ও সর্বহারার যৌথ নেতৃত্বের কথা বলে, তখন তাদের প্রচারিত শ্রেণীসহযোগিতার সে লাইনের যুক্তিসম্মত পরিণতি দাঁড়ায় এই। গত তিন বছর ধরে, দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট নেতারা ভিতর থেকে যুক্তফ্রন্টকে ভাঙার জন্য তাদের যথাসাধ্য করেছে, যাবতীয় বিশ্বাসঘাতকদের হাতে তত্ত্বগত অজুহাত জুগিয়েছে এবং বামপন্থী ঐক্য ধ্বংস করার জন্য কংগ্রেসের পঞ্চম বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। কেরালা ও পশ্চিমবাংলার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার আমলে তাদের ভূমিকা সুপরিচিত। কেরালাতে তারা আমাদের পার্টির বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবে কংগ্রেসের সাথে হাত মিলিয়েছে।

পশ্চিমবাংলায়, দলত্যাগী দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট নেতারা ১৯৭১-এর নির্বাচনে কিছু আসনে কংগ্রেসের সাথে চুক্তি করেছিল। তখন কংগ্রেসের সাথে পুরোপুরি বোঝাপড়া ও চুক্তি করা সম্ভব হয়নি, কারণ অন্যান্য যারা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল তারা তাতে রাজি হয়নি।

১৯৭১-৭২-এ দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট নেতারা প্রতিটি যুক্ত আন্দোলনকে ভিতর থেকে বানচাল করার চেষ্টা করেছিল এবং কয়েকটি বামপন্থী পার্টিকে কংগ্রেস ও তার গণসংগঠনগুলির সাথে জড়িত করার চেষ্টা করেছিল। তাদের সংগঠিত গুণ্ডাবাহিনী পুলিসের সাহায্য নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণে ক্রমবর্ধমানভাবে অংশগ্রহণ করতে আরম্ভ করেছিল। অনেক স্থানেই তারা আমাদের কর্মীদের আক্রমণ ও হত্যা করার জন্য কংগ্রেসী গুণ্ডাদের সাথে হাত মিলিয়েছিল।

১৯৭২-এ, দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট নেতারা তাদের মুখোশ একদম ছুঁড়ে ফেলে দেয়, সমস্ত বামপন্থী পার্টির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং নির্বাচনে প্রকাশ্যেই কংগ্রেসের সাথে এক মোর্চা গঠন করে।

নবম পার্টি কংগ্রেসের আহ্বান

সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে লড়াই করুন।

আত্মবিশ্বাসের সাথে এই পার্টি কংগ্রেসে আলোচিত কর্তব্যের মুখোমুখি হয়ে, আমাদের পার্টিকে তার বর্তমান দুর্বলতাগুলি চিনতে-জানতে হবে, যাতে সেগুলি দ্রুত দূর করা যায়। পরিস্থিতি অনুসারে প্রয়োজনের তুলনায়, আমাদের সংগঠিত শক্তি উপযুক্ত নয়, পার্টি সদস্যদের গুণগত মান, মতাদর্শগত প্রস্তুতি- এইসবগুলিই যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। বাস্তবিকপক্ষে, আমাদের অনেক কাজকর্মে ও চালচলনে অতীতের বোঝা এখনও ঘাড় থেকে নামেনি। প্রত্যেকটি পার্টি সদস্য ও সমগ্র পার্টিকে এই ত্রুটি দূর করার জন্য সচেতনভাবে চেষ্টা করতেই হবে এবং নিজেকে মতাদর্শগতভাবে আরও উন্নত করতে হবে। গণআন্দোলনগুলিতে যাতে যথাযথভাবে  নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হয় এবং পার্টি গঠনের জন্য কর্মীদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা যাতে সুনিশ্চিত করা যায়, সেজন্য মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থাকে আশু কর্তব্যরূপে পার্টি নেতৃত্বকে অবশ্যই হাতে নিতে হবে। আমাদের পার্টিকে এই দুর্বলতাগুলি বিলক্ষণরূপে লক্ষ্য করতে হবে এবং এ কথা উপলব্ধি করতে হবে যে, এই দুর্বলতাগুলি দূর না করলে দেশে কোনও বিপ্লবী আন্দোলনই গড়ে তোলা যাবে না। পার্টি কর্মীদের এ কথা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, বিপ্লবী তত্ত্বের সচেতন উপলব্ধি ছাড়া কোনও বিপ্লবী কর্ম হতে পারে না। আমরা এইসব দুর্বলতাগুলি দূর করবোই এবং এগিয়ে যাবোই।

আমাদের পার্টি আমাদের দেশে সঠিক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী লাইন গ্রহণ করতে পেরেছে এবং বিপুল বাধার বিরুদ্ধে তা অনুসরণ করেছে। বাম ও দক্ষিণ দিক থেকে আক্রান্ত হয়েও, আমাদের জনসাধারণের ও আমাদের শ্রেণীর প্রতি অনুগত থেকে, আমাদের দেশের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রয়োগ করে, আমরা আমাদের নিজস্ব অবস্থান বজায় রেখেছি। ফলাফল কী হয়েছে, তা সকলেই দেখতে পাচ্ছেন। সর্বদা আক্রান্ত হয়েও, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকা নামিয়ে নিতে অস্বীকার করে, একমাত্র আমাদের পার্টিই শাসকশ্রেণীর আক্রমণের সামনে দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

নবম কংগ্রেসের সময়ে পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল ১০৭১৩৪ জন।

কেন্দ্রীয় কমিটি ৩১ জনকে নিয়ে গঠিত হয়।

পলিটব্যুরোর গঠিত হয় ৯ জন কে নিয়ে।

সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন - পি সুন্দরাইয়া।

নির্বাচিত পলিটব্যুরোর সদস্য হলেন- পি সুন্দরাইয়া, এম বাসবপুন্নাইয়া, পি রামমূর্তি, হরকিষান সিং সুরজিৎ, জ্যোতি বসু, এ কে গোপালন, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, বি টি রণদিভে।

আগের পর্ব

তথ্যসুত্রঃ

১) Documents of The Communist Movement in India,

National Book Agency, Volume I- XXVII

২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,

মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি

৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement

Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977


শেয়ার করুন

উত্তর দিন