পারমিতা ঘোষ চৌধুরী
অষ্টম পার্টি কংগ্রেস
২৩ - ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৮ (কোচি)

রাজনৈতিক প্রস্তাব
ভারত সেই সময় চলছে দারুন অর্থনৈতিক সংকট সাথে রাজনৈতিক সংকট। সামন্ত ও আধাসামন্ত জমিদারতন্ত্রের সাথে সন্ধি করে দেশের শিল্পায়নের যে পথ শাসকবর্গ শ্রেণী অনুসরণ করে, তাতে অর্থনৈতিক পথের চরম দেউলিয়াপনা সম্পূর্ণ প্রকাশ হয়ে পরেছে।
‘কল্যাণকর রাষ্ট্র’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ’ গড়ার প্রতারনা ভরা বাক্যজাল ছড়ানোর দিন শাসকদলের নেতাদের আর ছিল না। সাধারণ মানুষের উপর বুর্জোয়া- জমিদার শ্রেণীগুলির নগ্ন আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে। বিদেশী সাম্রাজ্য বাদের প্রতি নির্ভরশীলতা বারার কারণে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর সাম্রাজ্যবাদী চাপ বেড়েছে। উপস্থিত হয় নয়া-উপনিবেশবাদী মার্কিন আধিপত্যের ভয়ানক আশঙ্কা। নিদারুণ খাদ্যাভাব ও বুভুক্ষা, ক্রমবর্ধমান বেকারি ও দুঃখকষ্ট, মুদ্রাস্ফীতির অবিরাম বৃদ্ধি ও দেনার বোঝা, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্বিসহ করভার, শিল্পক্ষেত্রে লকআউট, লে-অফ ও ছাঁটাই, ক্ষুদ্রশিল্প ও হস্তচালিত তাঁত শিল্পের ধ্বংসসাধন, দিনের পর দিন মেহনতী কৃষকদের নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এবং কার্যত কংগ্রেসী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ভুল প্রমান করে। আমাদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীনতা কে সুরক্ষিত করার জন্য সেই বিপদের মুখে লড়াই করে তাকে পরাজিত করাই কর্তব্য।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালের মূলগত শ্রেণীবিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন মন্তব্য করেছে যে, "আমাদের কাল, মহান অক্টোবরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দ্বারা প্রবর্তিত ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ হল যার মর্মবস্তু-তা হল দুই বিরোধী সমাজব্যবস্থার মধ্যে এক সংগ্রামের কাল, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও জাতীয় মুক্তি-বিপ্লবের কাল, সাম্রাজ্যবাদ ভেঙে পড়বার ফলে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা অবসানের কাল, আরও বেশি সংখ্যায় জাতিগুলির সমাজতান্ত্রিক পথে উত্তরণের কাল, বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের বিজয়ের কাল।" আরো বলা হয় "আমাদের যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এই যে, বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি সমাজ বিকাশের চূড়ান্ত নির্ধারক উপাদান হয়ে উঠছে।"
জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে যে, "জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের আঘাতে ঔপনিবেশিক দাসত্বের ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়ার ঘটনাটি ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক থেকে, কেবল বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গঠনের পরবর্তী দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী।"
আমাদের পার্টি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির এই বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন পুরোপুরি সমর্থন করে। এই পর্যায়ে, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ভূমিকাটিকে যা ছোট করে দেখায়, সেই দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী এবং সংশোধনবাদী বিকৃতিকে বাতিল করে পার্টি জোরের সাথে বলে চলেছে যে, একদিকে জাতীয় মুক্তির জন্য সংগ্রামরত শক্তিগুলি এবং অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে দ্বন্দ্বটিই এখন সামনের সারিতে এসে পড়েছে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর বিকাশের বর্তমান স্তরে আমাদের যুগের সমস্ত মৌলিক দ্বন্দ্বগুলি এক কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে কাজ করছে।
মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র এই সময় তার সবচেয়ে বর্বর রূপটি সামনে আনে ভিয়েতনামের জনগণ কে নৃশংস আগ্রাসী যুদ্ধের চরম বিপর্যয়।
বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সশস্ত্র প্রতিরক্ষাবাহিনীর প্রতিরোধ ও গেরিলা যুদ্ধ গড়ে উঠছে। লাতিন আমেরিকাতে কলম্বিয়া, পেরু, ভেনিজুয়েলা ইত্যাদির দৃষ্টান্ত, এশিয়ায় থ্যাইল্যান্ড, ব্রহ্মদেশ, লাওস, কম্বোডিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার অভিজ্ঞতাসমূহ সংগ্রামের পুরোভাগে ভিয়েতনামের অবস্থান, এবং সমস্ত আরব দুনিয়াতে সাম্রাজ্যবাদ অনুপ্রাণিত ইজরাইলের আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ প্রস্তুতি ছাড়াও, পর্তুগীজ অধিকৃত গিনি, অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিকে, জিম্বোবোয়ে ও ব্রাজাভিল কঙ্গোর সশস্ত্র সংগ্রামগুলি সম্পূর্ণরূপে এই ঘটনার সত্যতাই সমর্থন করছে। ১৯ ৫৫ - ৬৬ এইসময় কালে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির কাছে পিছিয়ে পরা দেশ গুলির বৈদেশিক ঋণ বিপুলভাবে বেড়ে যায়। ১৯৫৫ সালে এই ঋণ শোধের কিস্তি বছরে ৩৭৫ কোটি টাকা আর ১৯৬৬ সালের মধ্যে তা আটগুণ বেড়ে ৩,০০০ কোটি টাকায় পৌছায়।
ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যান্য অসংখ্য জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের এবং শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের প্রবাহসমূহের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এতই গভীর ও সুদূরপ্রসারী যে এই যুগের অন্যান্য মৌলিক দ্বন্দ্বগুলি সমাজতান্ত্রিক শিবির আর সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং শ্রমিকশ্রেণী ও বুর্জোয়াশ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, এসবই আরও তীক্ষ্ণ ও তীব্র হয়ে উঠছে।
সমাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সংঘাত ও তীক্ষ্ণতা
সমগ্র বর্তমান যুগের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বটি-বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সাথে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব, আরও গভীর ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে।
যুদ্ধের অব্যবহিত পরে এক দশক বা তার কিছু বেশি কাল পর্যন্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তার প্রধান আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করেছিল, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে রাখা, ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে মুক্ত করা, বাণিজ্য বয়কট, ইত্যাদি জিগির তুলে সামরিক জোট ও ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। ইউরোপে সমঝোতা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মতৈক্যে'র কথা বলার সাথে সাথে চীনকে ঘিরে রাখা'র আওয়াজ তুলে জাতিসংঘে চীনকে তার প্রাপ্য আসন থেকে বঞ্চিত করে এবং চীনের সাথে নিজেদের মিত্রদের বাণিজ্য বন্ধ করতে বাধ্য করে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা গণচীনের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করছে।
পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলিতে সবরকমের ধ্বংসমূলক কাজকর্ম চালাবার জন্য দাবার বড়ে হিসাবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ইউরোপে অতিশয় ব্যস্তভাবে পশ্চিম জার্মান সমরবাদী ও ফ্যাসিস্টদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে তুলছে, এবং এইভাবে ইউরোপে ও পৃথিবীতে নিরাপত্তা ও শান্তিকে বিপন্ন করছে। যুদ্ধ-পরবর্তীকালের চুক্তিগুলির দ্বারা নির্দিষ্ট বিভিন্ন রাষ্ট্রের সীমানাগুলি বন সরকার মানতে অস্বীকার করছে, এবং সমাজতন্ত্রী জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্বের পক্ষে তা এক সরাসরি বিপদ হয়ে উঠেছে। এইভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শক্তিবর্গের সামরিক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের যে লাভগুলি ঘটেছিল সাম্রাজ্যবাদীরা মরিয়া হয়ে তা বিনষ্ট করার চেষ্টা করছে।
শেষ মুহূর্তে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ওয়ারশ চুক্তির পাঁচটি সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপের দ্বারা তা ব্যর্থ হলেও, সমাজতন্ত্রী চেকোশ্লোভাকিয়ায় প্রতিবিপ্লবের জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত প্রায় সাফল্যের স্তরে পৌঁছেছিল। অবস্থা আজ যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আত্মসন্তুষ্টির কোন স্থান নেই, কারণ,
প্রতিবিপ্লবের শক্তিগুলি এখনও সক্রিয়। সমাজতন্ত্রী শিবিরের দেশগুলির বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নতুন নতুন আঁকাবাঁকা উপায়গুলিকে চেক সংকট উদ্ঘাটিত করে দিয়েছে। আধুনিক সংশোধনবাদের পরিণাম কিরকম বিপর্যয়কর এবং কিভাবে তা সমাজতন্ত্রকে দুর্বল করে চেক সংকট তাও প্রকাশ করে দিচ্ছে।
সমাজতন্ত্রী উত্তর ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে চলেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ আক্রমণ, তা ছাড়া সমাজতন্ত্রী কোরীয় গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রও সর্বদা মার্কিন আগ্রাসনের বিপদের মুখে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় তার তাঁবেদার সরকার কায়েম রেখে এবং সেখানে একলক্ষ মার্কিন সশস্ত্রবাহিনী মোতায়েন করে কোরিয়ার জনসাধারণের মাতৃভূমির একীকরণে বলপূর্বক বাধা দিচ্ছে এবং কোরিয়ার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে চূর্ণবিচূর্ণ ও কোরিয়ার গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী জাপানের সাথে যড়যন্ত্র করছে।
সুদূর আমেরিকা মহাদেশে সমাজতন্ত্রের নিঃসঙ্গ ঘাঁটি কিউবার সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সর্বদাই মার্কিন হুমকির মধ্যে রয়েছে ও লাতিন আমেরিকার কয়েকটি মার্কিন তাঁবেদার রাষ্ট্র কিউবাতে সামরিক অভিযানের প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ কথাবার্তা বলছে।
চীনের জনগণের প্রজাতন্ত্র অসংখ্য মার্কিন সামরিক, নৌ এবং বিমানঘাঁটি দ্বারা পরিবেষ্টিত। চীনের ভূখণ্ডের একটি অংশ তাইওয়ানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখল করে রেখেছে। চীন আজ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তগুলির এক বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কথা সংক্ষেপে বলতে গেলে, এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার জনগণের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সাথে সাম্রাজ্যবাদ, প্রধানত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বটি, বিশ্বদ্বন্দ্বগুলির পুরোভাগে থেকে যাচ্ছে, আর তা আমাদের যুগের আর সকল মৌলিক দ্বন্দ্বগুলিকে তীক্ষ্ণতর ও তীব্রতর করে তুলছে, বিশেষ করে সমাজতন্ত্রবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের শিবিরের মধ্যে কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বটিকে।
সাম্রাজ্যবাদীরা, প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ঘনায়মান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক সংকটের কবলে নিমজ্জিত, সোভিয়েত কমিউনিজম ও চীনা কমিউনিজমকে আটকে রাখার জন্য তারা তাদের জিগির তুললেও ও বিশ্বব্যাপী রণনীতির যাবতীয় কথাবার্তা বললেও এবং সে উদ্দেশ্যে তাদের বেপরোয়া সামরিক প্রস্তুতি করলেও,
তারা সর্বপ্রথমে ও সর্বাগ্রে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক, পশ্চাৎপদ ও পরনির্ভর দেশগুলিকেই তাদের সম্প্রসারণবাদী লক্ষ্যের এবং লুণ্ঠনের সহজ শিকারে পরিণত করে।
সমাজতন্ত্রী দেশগুলির অগ্রগতি
এই সকল চক্রান্ত এবং বিশ্ব সমাজতন্ত্রী শিবিরকে নিশ্চিহ্ন করা ও এক 'মার্কিন যুগ'-এর প্রবর্তনের জন্য বিশ্বব্যাপী রণনীতি সম্পর্কে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সদন্ত বোলচাল সত্ত্বেও, সমাজতন্ত্রী দেশগুলি শিল্পক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতি লাভ করছে এবং বিজ্ঞান ও প্রয়োগবিদ্যার পরমাশ্চর্য বিজয় অর্জন করে চলেছে।
বৈষয়িক সম্পদ ও শিল্পে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দৃঢ় অগ্রগতির সাথে সংকট জর্জরিত বিশ্বধনতান্ত্রিক শিবিরের তুলনা করলে এক বিরাট পার্থক্যই দেখা যাবে।
বুভুক্ষা, দারিদ্র্য, কর্মহীনতা, এবং শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে বারংবার মন্দা ও সংকটের বিকট নিশাস্বপ্ন থেকে মুক্ত হয়ে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দেশগুলি এখন পৃথিবীর মোট শিল্পজাত দ্রব্যসামগ্রীর প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ উৎপাদন করছে। সমাজতন্ত্রী দেশগুলির মিলিত সামরিক শক্তি প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে, এবং তার প্রতিরক্ষা ক্ষমতা দ্রুত বেড়ে উঠছে। তাছাড়া, এই দেশগুলি চিরকালের জন্য, পশ্চাৎপদ জাতি ও রাষ্ট্রগুলিকে শিল্পের সাজসরঞ্জাম, কারিগরি কৌশল এবং ঋণদানের বিষয়ে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির একচেটিয়া অধিকার ভেঙে দিয়েছে, আর তাতে রক্তলোলুপ একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ও তাদের বিশ্বব্যাপী লুঠের কম ক্ষতি হয়নি।
শিল্পের প্রধান শাখায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনমাত্রার কাছাকাছি এসে গিয়েছে এবং কোন কোন বিষয়ে এমনকি তাকে ছাড়িয়েও গিয়েছে। পৃথিবীর মোট শিল্প উৎপাদনে তার অংশ ১৯৩৭ সালে শতকরা ১০ ভাগেরও কম থেকে বেড়ে বর্তমানে প্রায় শতকরা ২০ ভাগে পৌঁছেছে। মহাকাশে প্রথম স্পুৎনিক পাঠিয়ে ১৯৫৭ সালে পারমাণবিক ও মহাকাশ গবেষণার এক বিরাট সাফল্য দিয়ে শুরু করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন এই ক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, চাঁদের চারিদিকে ঘুরিয়ে জণ্ড ৫-কে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনায় তার সর্বশেষ সাফল্যটি এই বিজয়েরই এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
সমপরিমাণে বিস্ময়কর চীন গণপ্রজাতন্ত্রের অগ্রগতিও-এবং এটা আরও দর্শনীয়-কারণ, এই অগ্রগতি অস্বাভাবিক অসুবিধা ও কঠিন অবস্থার মধ্যে ঘটছে। প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের ভারতবর্ষের অপেক্ষাও অনেক বেশি পশ্চাৎপদ এক অর্থনীতির উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের খাদ্য, বস্তু এবং বাসস্থানের যোগাড় করার দায়িত্ব মাথায় নিয়েও সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ থেকে বাণিজ্য বয়কটের মধ্যে এবং প্রতিশ্রুত ভ্রাতৃসুলভ সাহায্যদানে সোভিয়েত সংশোধনবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও, গণচীন এগিয়ে চলেছে, তার সমাজতান্ত্রিক শিল্প, কৃষি এবং বিজ্ঞান এক অতি বিস্ময়জনক অল্প সময়ের মধ্যে সে গড়ে তুলেছে। এমনকি তার পরম শত্রুরাও স্বীকার করছে যে চীনের ইস্পাত উৎপাদন ২ কোটি টন, কয়লার উৎপাদন ৫০ কোটি টন, তৈলের উৎপাদন ১ কোটি ৫০ লক্ষ টন এবং খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১৯ কোটি টন ছাড়িয়ে গিয়েছে। হাল্কা শিল্প, বস্ত্র, কাগজ এবং চিনির উৎপাদন ১৯৫৭ সালের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে।
বিজ্ঞান ও শিল্পে চীনের অগ্রগতি সকলকে বিস্ময়ে অভিভূত করেছে। ওষুধ, শল্যবিদ্যা, জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় চীন অনেকগুলি চমৎকার বিজয় অর্জন করেছে। ১৯৬৪ সালের শেষ তিনমাসে পারমাণবিক বিজ্ঞানে তার প্রধান সাফল্য ঘটেছিল, এবং আজ আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ('আই. আর. বি. এম.') নিয়ে চীন পরীক্ষা করতে যাচ্ছে; তার এই সর্বাঙ্গীন সাফল্যগুলি সারা বিশ্বে চীনের শত্রুদের শিরদাঁড়াতে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।
মার্কিনী বিধ্বংসী যুদ্ধের মাঝে উত্তর ভিয়েতনামের জনসাধারণ বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে প্রতি বছর শিল্প উৎপাদন শতকরা ২২ ভাগ ও কৃষি উৎপাদন শতকরা ৪.৫ ভাগ বেড়েছে; জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প ও হস্তশিল্পের অংশ শতকরা ১৭ ভাগ থেকে বেড়ে শতকরা ৫৩ ভাগ হয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে সর্বদা বিপদের মুখে থেকেও এবং তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সর্বনিকৃষ্ট ধরনের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, সমাজতন্ত্রী কিউবাও বিপুল অগ্রগতি লাভ করেছে। কতকগুলি কারণে তাদের মধ্যে গতি ও বেগের তারতম্য থাকা সত্ত্বেও এবং তাদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে এরকম কিছু সমস্যা থাকলেও অন্যান্য সকল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে।
ভারতের অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণসমূহ
ভারতের জনসাধারণের সুবিপুল পশ্চাৎপদ অবস্থা এবং দারিদ্র্য হল দু'শ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের শাসনে বিদেশি পুঁজি এবং তার দুষ্কর্মের সামন্ততান্ত্রিক সহযোগীদের লুঠেরা শোষণের পরিত্যক্ত বিষময় ফল। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পর গত দু-দশক ধরে কংগ্রেসী শাসকরা শোষণকারী বিদেশি পুঁজির অবসান ঘটাতে যেমন রাজী নয়, তেমনি তারা সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক জমিদারী ব্যবস্থা এবং কৃষকসমাজের উপর তার উৎপীড়নকারী লুণ্ঠনের অবসান ঘটাতেও আগ্রহী নয়। বরং উল্টে তারা এক আত্মঘাতী পথে চলেছে। সে পথটি হল, জঘন্য ধরনের কৃষি-সংস্কারের কিছু কিছু ব্যবস্থা করে, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথে অব্যাহত সহযোগিতা এবং জমিদারতন্ত্রের সাথে সক্রিয় মিতালির পথ। তাছাড়া, তারা উৎসাহভরে ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের শ্রীবৃদ্ধি লাভে এবং বিদেশি পুঁজিপতিদের সাথে তাদের জোট গঠনের কাজকর্মে সাহায্যই করেছে।
এইভাবে, কংগ্রেস দলের 'সদাশয়' শাসনে, মেহনতি জনসাধারণের সর্বনাশ করে যারা শোষণ ও লুণ্ঠন করে ও সম্পদের পাহাড় জমিয়ে তোলে সেই ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিপতি, বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী এবং সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক জমিদারদের হাতে দেশকে তুলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটটি এই তিন প্রকার শোষণের পুঞ্জীভূত ফল ছাড়া আর কিছু নয়, এবং দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে এই তিন শত্রুর বিলোপ ও ধ্বংস ঘটানো ছাড়া, এই সংকট সমাধানের আর কোন স্থায়ী সমাধানের পথও নেই। এই সংকটের প্রকাশ নানারকমভাবে হতে পারে, কিন্তু তার মূল কারণ কেবল এই তিন শত্রুই।
ভারতীয় জনসাধারণকে এই তিন রকম লুঠের ব্যবস্থা সম্প্রতিকালে একদিকে জনসাধারণ ও অন্যদিকে বুর্জোয়া জমিদারদের যে সরকার সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথে সহযোগিতা ও আপস করছে সেই সরকারের মধ্যেকার দ্বন্দ্বটিকে তীব্র এবং তীক্ষ্ণ করে তুলেছে।
১৯৬৮-৬৯ সালের বাজেট থেকে দেখা যায়, সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতিগুলির দৌলতে দেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৬,২২৫ কোটি টাকায় পরিণত হয়েছে। কেবল ১৯৬৮ সালেই বাৎসরিক ঋণ পরিশোধের কিস্তি ছিল ২৪২ কোটি টাকা। টাকার বিনিময় হার কমাবার ফলে বিদেশি ঋণের পরিমাণ শতকরা ৫৭.৫ ভাগ বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল।
১৯৬৮-৬৯ সালের বাজেট থেকে দেখা যায়, সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতিগুলির দৌলতে দেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৬,২২৫ কোটি টাকায় পরিণত হয়েছে। কেবল ১৯৬৮ সালেই বাৎসরিক ঋণ পরিশোধের কিস্তি ছিল ২৪২ কোটি টাকা। টাকার বিনিময় হার কমাবার ফলে বিদেশি ঋণের পরিমাণ শতকরা ৫৭.৫ ভাগ বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল।
অর্থনীতির উপর সামন্ততন্ত্র ও আধা-সামন্ততন্ত্রের ভূমিকা
সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন অংশকে কিনে নিতে এবং আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করতে সি. আই. এ.-র মতো তাদের সংস্থাগুলির কাজকর্ম তীব্রভাবে বাড়িয়ে তুলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা এই পরিস্থিতির পরিপূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে। এই সমস্তই আমাদের ভবিষ্যতের পক্ষে এক মহাবিপদ স্বরূপ।
কৃষকদের ক্রমবর্ধমান উত্তাল বিক্ষোভের চাপে ও বৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণীর জরুরি অর্থনৈতিক প্রয়োজনে এবং তাদের রাজনৈতিক আপাত সুবিধার খাতিরে সরকার যে জঘন্য রকমের কৃষি-সংস্কার প্রবর্তন করেছে, তা মূলগত ভূমিসম্পর্কগুলির কোন পরিবর্তনও ঘটায়নি, অথবা অর্থনীতির উপর সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক শিকলগুলি চূর্ণবিচূর্ণ করা দূরে থাকুক, সেগুলি শিথিল পর্যন্ত করেনি। মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে জমির মালিকানার কেন্দ্রীকরণ ঘটেই চলেছে, সামান্য পরিবর্তিত ও সংশোধিত আকারে হলেও সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক শোষণ অক্ষুণ্ণই রয়েছে, এবং নিচের স্তরের কৃষকদের নিঃস্বকরণ দ্রুতগতিতেই চলেছে, আর একই সঙ্গে, তার বাজার ব্যবস্থার নিয়মকানুন নিয়ে পুঁজিবাদ কৃষি অর্থনীতির অভ্যন্তরে প্রবলভাবে প্রবেশ করে চলেছে এবং ফলে, ভারত বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির সহযোগিতায় লিপ্ত বুর্জোয়া-জমিদার শ্রেণীগুলির শাসনে রুদ্ধগতি বিকৃত এবং সঙ্কটজর্জর পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের বৈশিষ্ট্যসূচক যাবতীয় বিধ্বংসী লুণ্ঠন ঘটে চলেছে।
ভারতীয় একচেটিয়া কারবারগুলির বৃদ্ধি
স্বাধীনতালাভের পরবর্তীকালে ভারতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল ভারতীয় একচেটিয়া কারবারগুলির দানবীয় বৃদ্ধি।
পরিশেষে বলা যায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলির মধ্যে বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের আশু কারণগুলি লক্ষ্য করা যেতে পারে:
(১) ভারতীয় অর্থনীতি বিশ্ব ধনতান্ত্রিক বাজারের সঙ্গে বাঁধা, তাই ভারতের অর্থনীতি বিশ্ব ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্কটের অধীন।
(২) বড় বড় ধনতান্ত্রিক দেশগুলির দুর্বল বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে অসমান বাণিজ্যের শর্তাবলীর দরুন ভারত ক্রমাগতই ক্ষতি স্বীকার করছে।
(৩) বিকাশমান দেশগুলির উপর সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের সঙ্কটের বোঝা চাপিয়ে দেবার নীতিটি ভারতের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে তীব্রতর করে তুলছে।
(৪) বৈদেশিক ঋণ ও বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের গলাকাটা দামের দরুন ঋণ পরিশোধের যে অসহনীয় বোঝা অর্থনীতির উপর চেপে বসেছে, তা মজুরিকে অনাহারের স্তরে নামিয়ে এনেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে সীমাবদ্ধ করেছে এবং সঙ্কটকে তীব্র করে তুলেছে। এই ঋণগুলি এবং যে সব শর্তে সেগুলি সংগৃহীত হয় তা (আমদানি দ্রব্যের বদলি দ্রব্য তৈরি করে) দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারটি পুরোপুরি দখল করতে ভারতীয় পুঁজিপতিদের বাধা দিচ্ছে এবং তাদেরকে বিদেশি পুঁজিপতিদের সাথে ভাগাভাগি করে সে বাজারটি ভোগ করতে বাধ্য করছে।
(৫) সামন্ততান্ত্রিক ভূমিসম্পর্কের বিলোপ সাধন করতে ব্যর্থতা কৃষি উৎপাদনকে ক্ষুণ্ণ করছে, অনটন সৃষ্টি করছে, খাদ্যের চড়া দর চাপিয়ে দিচ্ছে, শিল্পজাত দ্রব্যের বাজারটি সীমাবদ্ধ করছে এবং ক্ষুদ্রাকার উৎপাদনের সঙ্কট সৃষ্টি করছে। মরসুমের সামান্যতম প্রতিকূল পরিবর্তনেই এই ক্ষুদ্রাকার উৎপাদনের উপর সহজেই আঘাত এসে পড়ে এবং তার অযোগ্যতা প্রতিপন্ন হয়।
(৬) মুষ্টিমেয়র হাতে ক্রমবর্ধমান পরিমাণে উৎপাদনের উপায়গুলি কেন্দ্রীভূত হওয়া, এরাই সমাজের উপর চড়া দাম চাপিয়ে দেয়।
(৭) মুদ্রাস্ফীতির সরকারি নীতি, মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে মেহনতি মানুষের কাছ থেকে পুঁজিপতিদের কাছে জোর করে সম্পদ হস্তান্তর করারই পদ্ধতি।
(৮) বৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণীর পক্ষে সুবিধাজনক সরকারের মূল্যনীতি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র পরিচালনায় অদক্ষতার দরুন বিপুল অপচয়- যার ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র যাতে বিরাট আকারে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা থেকে অতি সামান্যই পুঁজি গঠনে সাহায্য করেছে। এর ফলে বুর্জোয়া জমিদার শাসন ব্যাবস্থার সাথে ভারতের জনসাধারণের দ্বন্দ্ব টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে এবং সরকারের বর্তমান নীতি গুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামে উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে।
কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ
কয়েকটি রাজ্য সরকারের উপর থেকে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ায়, কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ এবং তার ফলে ভারত ইউনিয়নের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কাজকর্মে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে তা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। আমাদের পার্টির কর্মসূচিতে সঠিকভাবেই বলা হয়েছিল যে, এই সংঘর্ষের পেছনে রয়েছে একদিকে বৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণী ও অন্যদিকে অঙ্গরাজ্যগুলির বুর্জোয়াশ্রেণী সমেত জনসাধারণের গভীরতর দ্বন্দ্ব। অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং বিভিন্ন অঞ্চলের অসমান অর্থনৈতিক বিকাশের দরুন এই গভীরতর বিরোধটি প্রতিনিয়তই তীব্র হচ্ছে।
গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং পুলিশি রাষ্ট্র স্থাপনের উদ্যোগ
অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সঙ্কটের কবলে পড়ে এবং গণতান্ত্রিক সমাধানগুলি খুঁজে বের করতে অনিচ্ছুক ও অক্ষম হয়ে, কংগ্রেসী সরকার নিপীড়নমূলক উপায়গুলি অবলম্বন করছে।
ইতিমধ্যেই জঘন্য নিবারক আটক আইনটি সংবিধানে লিখিত হওয়া সত্ত্বেও, ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পুরো পাঁচটি বছর ধরে তারা ভয়ঙ্কর ভারতরক্ষা আইনটিকে দেশের উপর চাপিয়ে রেখেছিল, এবং তারা ঘৃণিত ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা প্রবর্তিত বহু পুরনো ফৌজদারী দণ্ডবিধিটিও জিইয়ে রেখেছে। এসবেও সন্তুষ্ট না হয়ে এক তথাকথিত 'বেআইনী কার্যকলাপ (নিরোধক) আইন' তারা বিধিবদ্ধ করেছে ও তাতে তাদের ইচ্ছামত যে কোন সংগঠনকে দমন ও বেআইনী ঘোষণা করার শয়তানীসুলভ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, এবং এই আইনটিকে দেশের বিচার বিভাগের এক্তিয়ার বহির্ভূত রাখা হয়েছে। পরবর্তীকালে পার্লামেন্টে 'ব্যাঙ্কিং কোম্পানি আইন', 'কেন্দ্রীয় শিল্প নিরাপত্তা বাহিনী আইন', 'ভারতীয় রেলওয়ে আইন', এবং 'অত্যাবশ্যকীয় কাজকর্মাবলী আইন' প্রভৃতি বেশ কয়েকটি শ্রমিকশ্রেণী বিরোধী আইন পাস করেছে। দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে পুলিসী নিপীড়নের অন্তহীন কাহিনী এক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং জনসাধারণের উপর লাঠি চালনা, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ ও রাইফেলের গুলিবর্ষণ তো এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার সংগ্রাম এবং তা নষ্ট করার জন্য কংগ্রেসী চক্রান্তসমূহ
চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের পর গত আঠারো মাসে আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সারকথা বলতে গেলে তা একদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ ও অন্যদিকে পুরোভাগে দাঁড়ানো কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) সমেত গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের মধ্যে এক দেশব্যাপী শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রথম পক্ষ প্রাণপণ চেষ্টা করছে জনসাধারণের স্বার্থের বিরুদ্ধে ও তার নিজের স্বার্থের অনুকূলে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সঙ্কটটি সমাধান করার আর দ্বিতীয় পক্ষ শাসকশ্রেণীগুলির সঙ্কটের পটভূমিতে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
কেন্দ্র তার হাতে অবস্থিত রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে, অন্যান্য দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল বিরোধীপক্ষের মধ্যে তার নিজের শ্রেণীর রিজার্ভ বাহিনীর উপর নির্ভর করে, এবং কিছু গণতান্ত্রিক পার্টির মধ্যে রাজনৈতিক দোদুল্যমানতার ও কমিউনিস্টবিরোধী কুসংস্কারের সুচতুর ব্যবহার করে কংগ্রেস দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র উপরই তার আক্রমণের প্রধান অগ্নি বর্ষণ করছে। কারণ এই পার্টিই পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালার যুক্তফ্রন্ট ও রাজ্য সরকারগুলিতে চূড়ান্ত নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

গণসংগ্রামের ক্রমবর্ধমান উত্তাল তরঙ্গ এবং আমাদের পার্টির সম্মুখে কর্তব্যসমূহ
ঘনায়মান অর্থনৈতিক সংকট এবং সংকটের বোঝাগুলি সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপাবার জন্য বুর্জোয়া-জমিদার শ্রেণীগুলির পক্ষ থেকে ক্রমবর্ধমান আক্রমণ প্রতিরোধ ডেকে আনছে এবং দেশব্যাপী গণসংগ্রামেরই সূচনা করছে। এই প্রক্রিয়াটি চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ও শাসক কংগ্রেস দলের উপর পরাজয়ের আঘাতের পর তা অতিরিক্ত উদ্দীপনা লাভকরল।
কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গে দুটি বামঘেঁষা যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের ঘটনা, তাঁদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে জনসাধারণকে বাড়তি সুযোগ এনে দিল।
পার্টির সপ্তম কংগ্রেসের পর থেকে, গত চার বছরের সংগ্রামের ঘটনাবলী এটা যথেষ্ট পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, পার্টির কর্মসূচির ভিত্তিতে রচিত পার্টির রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মধারাটি ('লাইন') একটি ত্রুটিহীন ও সঠিক শ্রেণীচিন্তা ও কর্মধারা, সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে ও পরে 'বাম' হঠকারিতার বিরুদ্ধে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সপক্ষে পরিচালিত মতাদর্শগত-রাজনৈতিক সংগ্রাম জয়লাভ করেছে, এবং এইসব প্রাপ্ত শিক্ষা এবং তাদের দ্বারা উদ্দীপ্ত আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান পার্টিকে অনমনীয় দৃঢ়তা, উদ্যম এবং নিষ্ঠা সহকারে তার সঠিক রাজনৈতিক লাইনকে সম্পূর্ণরূপে কাজে রূপান্তরিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে- আজকের দিনে পার্টির কাছে এই হল আহ্বান।
যে সব প্রধান কর্তব্য ও স্লোগানগুলিকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ কাজকর্ম এবং সংগ্রামগুলি পরিচালনা করতে হবে :
(১) বড় বড় জমির মালিকদের কাছ থেকে তাদের উদ্বৃত্ত শস্য কিনে নেবার একচেটিয়া অধিকার, খাদ্যশস্যের পাইকারী ব্যবসায়ের রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া কারবার, মজুত উদ্ধার, এবং গণ-কমিটির মারফত খাদ্যশস্যের ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের ব্যবস্থা-সমন্বিত, আমাদের পার্টির দ্বারা রচিত, একটি জাতীয় খাদ্যনীতি। একমাত্র এই ধরনের নীতিই পি এল- ৪৮০-র অধীন অবমাননাকর খাদ্য আমদানির অবসান ঘটাতে পারে।
(২) কৃষকদের সকলপ্রকার উচ্ছেদ বন্ধ করে, জমির মালিকানার কেন্দ্রীকরণ ভেঙে দেওয়া, আবাদযোগ্য সমস্ত পতিত জমি এবং সরকারি ও বেসরকারি বনাঞ্চলের পতিত জমি এবং জমিদারদের সমস্ত উদ্বৃত্ত জমি ও বেনামী এবং দুরভিসন্ধি প্রণোদিত হস্তান্তরের দ্বারা জমিদারদের বেআইনী ভোগ দখলাধীন জমি বিনামূল্যে ভূমিহীন ক্ষেতমজুর ও গরীব চাষীদের মধ্যে বণ্টন, ক্ষেতমজুরদের উপযুক্ত মজুরি এবং তাদের ও গরীব চাষীদের ঋণ থেকে ত্রাণ, খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষকদের সুবিধা প্রদান।
(৩) পূর্ণ কর্মসংস্থান, ছাঁটাই বন্ধ, অটোমেশন বন্ধ, প্রয়োজন-ভিত্তিক মজুরি এবং শ্রমিকশ্রেণী ও কর্মচারিবৃন্দের জন্য জীবনধারণের খরচ বৃদ্ধির পূর্ণ ক্ষতিপূরণ, সংকটাপন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি হাতে নেওয়া ও তা পরিচালনা করার জন্য এবং বেকার শ্রমিকদের ত্রাণমূলক সুবিধা প্রদানের জন্য রাজ্যগুলিকে কেন্দ্র থেকে আর্থিক সাহায্যদান, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সংগঠিত করার পূর্ণ স্বাধীনতা, ধর্মঘটের অধিকার, ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি, ধর্মঘটবিরোধী সমস্ত আইন প্রত্যাহার।
(৪) কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের দাবিগুলি, এসেন্সিয়াল সার্ভিসেস আইন ও অন্যান্য ধর্মঘটবিরোধী আইন এবং ধর্মঘটের জন্য রেল শ্রমিকদের শাস্তিদানের আইনগুলির বাতিলকরণ।
(৫) সংগ্রামী জনসাধারণের বিরুদ্ধে পুলিসী সন্ত্রাসের অবসান, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতাগুলির সম্প্রসারণ, এবং যাবতীয় নিপীড়নমূলক ও গণতন্ত্রবিরোধী আইন বাতিলকরণ।
(৬) জাতীয় এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, হরিজন এবং উপজাতীয় জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলির পূর্ণ গ্যারান্টি।
(৭) ছাত্রদের দাবিগুলি, ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব সম্বলিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা, শিক্ষায়তনে পুলিশের প্রবেশের বিরুদ্ধে আইনগত নিষেধাজ্ঞা, শিক্ষাব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন, গরীব ছাত্রদের অর্থনৈতিক সাহায্য, চাকুরির নিশ্চয়তা, শিক্ষকদের জন্য ন্যায্য ব্যবস্থা।
(৮) ঘাটতি অর্থসংস্থান ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করে এবং আয় ও লিমিটেড কোম্পানিগুলির মুনাফার সর্বোচ্চ সীমা ধার্য করে ক্রমবর্ধমান চড়া দামের বিরুদ্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
(৯) প্রতিরক্ষা ব্যয় ও জনসাধারণের বিপুল করভার কঠোরভাবে কমানো।
(১০) ভারত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য ব্যাপকতম স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, সেজন্য (ক) কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আদায় করা যাবতীয় কর-রাজস্বের শতকরা ৭৫ ভাগ রাজ্যগুলির মধ্যে বণ্টন, (খ) সংবিধানের ৭ম তফশিলভুক্ত যুগ্ম তালিকার অধিকাংশ বিষয়ই রাজ্যগুলির নিকট হস্তান্তর করা, এবং (গ) আই এ এস, আই পি এস ইত্যাদির মতো সর্বভারতীয় চাকুরিতে নিযুক্ত সমস্ত সরকারি কর্মচারিরা যে যে রাজ্যে নিযুক্ত থাকবে সেখানে তাদের সম্পূর্ণভাবে সেই রাজ্য সরকারগুলির শৃঙ্খলাগত কর্তৃত্বের অধীন হতে হবে।
(১১) সীমান্তের জাতীয় জনসমাজসমূহ এবং উপজাতীয় জনসাধারণের সমস্যাসমূহের একটি ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক সমাধান।
(১২) বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির জাতীয়করণ, ব্যাঙ্কগুলির এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের এবং একচেটিয়া শিল্পগুলির জাতীয়করণ।
(১৩) যাবতীয় বিদেশি ঋণ ও সার্ভিস চার্জ এবং বিদেশি পুঁজির নিজ দেশে পুনঃপ্রেরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা।
(১৪) আমাদের অর্থনীতি, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ক্রমবর্ধমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে লড়াই, আমাদের দেশের পক্ষে মার্কিন নয়া-উপনিবেশবাদী বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ও তাকে পরাস্ত করা।
(১৫) আমাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতির উপর ক্রমবর্ধমান মার্কিন চাপ প্রতিরোধ করা, সরকার তার চীনবিরোধী নীতি পরিত্যাগ করুক এবং চীনের সাথে মীমাংসার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা অবলম্বন করুক এই দাবি করা; সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সূদৃঢ় করার জন্য এবং ভিয়েতনাম ও যাবতীয় জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে পরিপূর্ণ সমর্থন জানাবার জন্য দাবি করা।
(১৬) পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ও শান্তিপূর্ণভাবে তার সাথে বিরোধগুলির মীমাংসা।
(১৭) অবিলম্বে ভূতপূর্ব দেশীয় রাজাদের ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাগুলির অবসান।
কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ২৮ জন সদস্য নিয়ে।
পলিট ব্যুরোর গঠিত হয় ৯ জন সদস্য নিয়ে, পি সুন্দরাইয়া, এম বাসবপুন্নাইয়া, পি রামমূর্তি, হরকিষাণ সিং সুরজিৎ, জ্যোতি বসু, এ কে গোপালন, ই এম এস নাম্বুদীরিপাদ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, বি টি রণদিভে।
সম্পাদক পুনঃনির্বাচিত হন পি সুন্দরাইয়া।
আগের পর্বতথ্যসুত্রঃ
১) Documents of The Communist Movement in India,
National Book Agency, Volume I- XXVII
২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,
মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি
৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement
Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977