পারমিতা ঘোষ চৌধুরী
দশম পার্টি কংগ্রেস
রাজনৈতিক প্রস্তাব
আমাদের পার্টির গত কংগ্রেসের পরবর্তী সময় দেখা গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালীন পুঁজিবাদের সবচেয়ে গভীর সংকট একালের সমস্ত দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করে তুলেছে।
এ কালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক সাফল্য হল ভিয়েতনাম, লাওস ও কাম্পুচিয়ার জনগণের বিজয় এবং প্রবল মার্কিন সামরিক শক্তির যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয়। মহান অক্টোবর বিপ্লবের পর এটাই হল সাম্রাজ্যবাদের চতুর্থ বৃহত্তম পরাজয়, সমাজতান্ত্রিক শিবির, বিশ্বশ্রমিকশ্রেণী ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের একটা সাধারণ বিজয়। তিনটি দেশের বিজয়ী জনগণ পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব থেকে বের হয়ে এলেন, স্মরণ করিয়ে দিল শ্রমিকশ্রেণীকে যে আমাদের এ যুগ হল পুঁজিবাদ থেকে সমাজবাদে উত্তরণের যুগ।
কেপ ভারদে, গিনি বিসাউ, মোজাম্বিক ও আঙ্গোলার মুক্তিলাভ সাম্রাজ্যবাদ পৃষ্ঠপোষিত পর্তুগীজ জলদস্যু সাম্রাজ্যের পতন ঘটাল।
সাম্রাজ্যবাদীদের মিষ্টি-মধুর কূটনীতিক ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতিগুলিকে উপেক্ষা করে, জিম্বাবয়ের জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চলছে। বেদখলকারী আয়ান স্মিথের সঙ্গে মুক্তিসংগ্রামীদের অন্তহীন আলোচনায় প্ররোচিত করার চেষ্টা ব্যর্থ। নামিবিয়ার জনগণ দক্ষিণ আফ্রিকার বেআইনীভাবে তাঁদের ভূখন্ড দখল করে রাখার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
জাতি বিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকায় এক অভূতপূর্ব বিপ্লবী অভ্যুত্থান দেখা যাচ্ছে। যাতে শতগত নরনারীকে হত্যা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার। এই নগ্ন অমানুষিক দমনপীড়নের ফলে উদ্ভূত বিক্ষোভ তরঙ্গ সাম্রাজ্যবাদীদেরও প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য করেছে। এমনকি রাষ্ট্রসংঘে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে প্রস্তাব কখনও কখনও তাদের সমর্থন করতে হয়েছে। কিন্তু তাদের কৌশল ধরা পড়ে গেছে এবং সংগ্রামী জনগণকে আরও বোকা বানানোর ক্ষমতা তাদের ফুরিয়ে গেছে।
বানানোর ক্ষমতা তাদের ফুরিয়ে গেছে।
চোখের সামনেই পুরনো ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ধসে পড়ছে দেখে, সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের হৃত প্রভাব ও কর্তৃত্ব ফিরে পেতে চাইছে তাঁবেদার, দালাল আর হঠকারীদের মাধ্যমে। চিলিতে তাদের দালালরা আলেন্দে সরকারের পতন ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ইন্দোনেশিয়ায় তারা সুহার্তোর পুরাদস্তুর ফ্যাসিস্ত শাসনকে টাকা ও মদত জোগাচ্ছে বাংলাদেশে মুজিবুর রহমানের হত্যা ঘটিয়েছে থাইল্যান্ডে তাদের দালালরা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা সামরিক অভ্যুত্থানকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, বহু দেশেই সাফল্যের পর পরই তাদের জনগণের বিরোধিতা ও সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। চলছে তীব্র লড়াই। সাম্রাজ্যবাদীরা পিছু হঠছে।
বিশ্ব পুঁজিবাদী সংকট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই সময় দেখা গেল পুঁজিবাদের সবচেয়ে বেশি সংকট। এটা ছিল প্রথম যুদ্ধোত্তর সংকট, যা একই সঙ্গে সমস্ত পুঁজিবাদী দেশে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। এর গভীরতার চেহারাটা পুরোমাত্রায়ই নজরে পড়ে এই ঘটনা থেকে যে এতে শুধু উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রই নয়, মুদ্রা ও ঋণসংক্রান্ত ক্ষেত্রগুলিও এই আবর্তে পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্বেকার পর্যায় সংকটে একমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধির হার হ্রাস পেত। আর এখন পরপর দু'বছর ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে সমগ্র উৎপাদনই তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বেকার সংখ্যার প্রচণ্ড বৃদ্ধির মধ্যেও এটা প্রতিফলিত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা যে ২৩টি দেশের সমীক্ষা করেছে, তার হিসাবে সেখানে বেকার সংখ্যা পৌঁছেছে ১ কোটি ৬০ লক্ষে। ঐ একই সূত্র থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭০ লক্ষ এবং ইউরোপীয় অর্থনীতিক কমিউনিটি অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে ৫৫ লক্ষ বেকার রয়েছে। অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশগুলির বেকার সংখ্যা সমপরিমাণে উদ্বেগজনক।
এ সংকট দেখা দেয় অভূতপূর্ব মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে এবং তা শ্রমিকশ্রেণীর দুর্দশাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। তখন থেকে একদিকে অচলাবস্থা অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির ভয় চেপে বসেছে বুর্জোয়া প্রশাসকদের মনে।
এই ঘটনা থেকেই পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের তীব্রতা সুস্পষ্ট এই কারণে যে, উৎপাদন পুনরুদ্ধারের সামান্য পাঁচ শতাংশ হারেও সংশ্লিষ্ট দেশগুলির পুঁজিবাদীরা আতঙ্কিত। তাদের আশঙ্কা উন্নতির বেশি হারবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাবে, বেকার সংখ্যা বাড়াবে এবং এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
এইভাবে সাধারণ সংকট এমন একটা স্তরে পৌঁছেছে যেখানে পুঁজিবাদ উৎপাদন, দাম ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সংকটের আগেকার ভারসাম্য পর্যন্ত ফিরিয়ে আনতে পারছে না। যে প্রযুক্তিগত বিপ্লব যা উৎপাদনকে চরমে তুলতে সক্ষম এবং দূর করতে পারে অভাব ও দুঃখদুর্দশা, একচেটিয়া পুঁজি শাসনে, তার ফল হচ্ছে উল্টো। পুঁজিবাদের মৌল নিয়মগুলিই আরও জোরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পুঁজিবাদের চেয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে অনেক উন্নত, জনসাধারণের কাছে সেটা দিনদিনই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
এই ঘটনাবলী আমাদের যুগের সমস্ত দ্বন্দ্বকে প্রচণ্ডভাবে বাড়িয়ে তুলেছে, আর সেটা আবার তীব্র করছে পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটকে।

শ্রমিকশ্রেণী এবং পুঁজিপতিশ্রেণীর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব
এই দ্বন্দ্ব আত্মপ্রকাশ করেছে ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে লাগাতার ধর্মঘটের সংখ্যাবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। সংকটের বোঝা শ্রমিকশ্রেণীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার জন্য পুঁজিবাদী শাসক-শ্রেণীগুলির নানা চেষ্টার প্রতিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি ও ইতালিতে বারবার ধর্মঘটের ঢেউ উঠেছে অনেক সময় ধর্মঘট সংস্কারবাদী নেতৃত্বের বাধা ডিঙিয়েই ঘটেছে।
তাছাড়া ইউরোপীয় মহাদেশে এ সংকটে দেখা গেল স্পেন ও পুর্তগালে ফ্যাসিস্ত শাসনের অবসান, আর গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। ঐ একই সময়ে উৎখাত হয়েছে গ্রিসের সামরিক চক্র।
ফ্রান্স ও ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি আরও শক্তিশালী দল হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রথমোক্তটি তার নির্বাচনী ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব
কতকগুলি অর্থনৈতিক প্রশ্ন ও নীতির উপর সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বগুলির তীব্রতা লক্ষ্য করা গেছে যেমন, মুদ্রাসংক্রান্ত সংস্কার, অন্য দেশ থেকে আমদানির বিরুদ্ধে শুল্ক ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থায় সোনার ভূমিকা, স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস্ (টাকা তুলবার বিশেষ অধিকার), তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির প্রতি মনোভাব এবং সামরিক জোট সম্পর্কিত আশু প্রশ্নগুলি।
সংকটের ফলে বিশ্বের বাজার সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এত তীব্র হয়ে উঠেছে, যা পূর্বে কখনও হয়নি। জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাতের দরুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থার ভয় দেখানো হচ্ছে। পশ্চিম জার্মানিরও বিশেষ করে জাপানি পণ্যের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এই উভয় দেশের উপর জোর চাপ আসছে তাদের বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত কমিয়ে আনতে, মার্কিন পণ্য প্রবেশের জন্য তাদের দেশের দরজা খুলে দিতে এবং তাদের মুদ্রার মূল্য বাড়িয়ে দেবার জন্য যাতে মার্কিন পণ্য আমদানি সহজ হয়।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এই উভয় নীতির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার অন্য অংশীদারদের মধ্যে সংঘাত প্রায়ই তীব্র মতপার্থক্যের রূপ নেয়।
সাম্রাজ্যবাদ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে
উপনিবেশ ব্যবস্থার পতন সত্ত্বেও পুঁজিবাদের বিষম সংকটের সঙ্গে সঙ্গে, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের তাদের শাসকশ্রেণীগুলিসহ দ্বন্দ্বও তীব্রতর হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদ বনাম সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া
গত পার্টি কংগ্রেসের পরবর্তীকালে ভিয়েতনাম, লাওস ও কাম্পুচিয়ার জনগণের বিপুল জয়ের ফলে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া প্রভূত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
পুঁজিবাদী দুনিয়া যখন গভীর থেকে গভীরতর সংকটে জর্জরিত, সেই তুলনায় সোভিয়েত রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ তখন দৃঢ় পদক্ষেপে ও অবাধে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে আরও এগিয়ে গেছে।
এই উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলি ছাড়াও, এসময়ে সাম্রাজ্যবাদীদের উপর সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় ঘটেছে।
জাতিসংঘ থেকে তাইওয়ান বিতাড়িত এবং চীন জনগণের সাধারণতন্ত্র তার ন্যায়সঙ্গত আসনে সেখানে বসেছে এবং নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যও হয়েছে।
পূর্বেই বলা হয়েছে, দক্ষিণ আমেরিকান রাজ্যগুলিকে মার্কিন-প্ররোচিত সমাজতান্ত্রিক কিউবার অবরোধ তুলে নিতে হয়েছে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, সাম্রাজ্যবাদীদের দাঁতাত-এর প্রস্তাব গ্রহণ এবং ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতার উপর হেলসিংকি সম্মেলনের সফল সমাপ্তি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রও অংশ নিয়েছিল। সম্মেলনের চূড়ান্ত বিধান, সম্মেলন শেষে গৃহীত ঘোষণা এই নামে পরিচিত, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা, রাষ্ট্রগুলির সীমান্ত অলঙ্ঘনীয় ও আঞ্চলিক সংহতি বজায় রাখার মতো অনেকগুলি মৌলিক নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিলাভ করেছে এবং বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র জি ডি আর-এর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তুলেছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে পোল্যান্ডের ওডার-নীসে পশ্চিম সীমান্ত, জি ডি আর ও চেকোস্লোভাকিয়া সীমান্ত। এইভাবে আইনের ভাষায়, মিউনিখ ফরমান চিরতরে বাতিল হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপসংহার
আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী দেখিয়ে দিচ্ছে-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যখন পশ্চাদপসরণ করছে এবং সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার শক্তি, জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন এবং শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্য আন্দোলন যেমন প্রসারিত হচ্ছে তখন সাম্রাজ্যবাদ তার শক্তি পুনর্গঠিত করতে এবং প্রগতি, স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের শক্তিগুলির বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণের জন্য চেষ্টা করে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়তে সদা সতর্ক নজর রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ ও চিলির অভিজ্ঞতা থেকেই যা আর একবার প্রমাণিত।
সমাজতান্ত্রিক শিবির বিভক্ত না হলে এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে দক্ষিণ ও বাম বিচ্যুতি না ঘটলে, শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের শক্তিসমূহের আরও চমকপ্রদ অগ্রগতি সম্ভব হতে পারত।
সংশোধনবাদ ও সংকীর্ণতাবাদ, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী শক্তিগুলিকে সংগঠিত করার জন্য এর ঐক্যের, সম্মিলিত ইচ্ছা ও সংহতিকে তছনছ করে দিয়ে, ধারণাতীত ক্ষতি করেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন জনগণের সাধারণতন্ত্রের মধ্যে তীক্ষ্ণ মতভেদকে সাম্রাজ্যবাদীরা কাজে লাগিয়েছে এবং এখনও লাগাচ্ছে। এ দুটির মিলিত সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হতে পারত সাম্রাজ্যবাদীদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক এবং বিশ্ব পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সাধনের সহায়ক।
এই দুটি শাসক পার্টি অনুন্নত দেশগুলিতে বিপ্লবী শক্তির বিকাশ তাদের সরকারের বৈদেশিক নীতির সুবিধাবাদী প্রয়োজনগুলির অধীন করার যে নীতি অনুসরণ করে আসছে, তাতে সদ্যমুক্ত দেশগুলিতে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই নীতির ফলে কয়েকটা দেশে বিপর্যয় ঘটা সত্ত্বেও, তারা শিক্ষা গ্রহণ করেনি, সেই সুবিধাবাদী পথেই চলছে।
তা সত্ত্বেও, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অর্থনৈতিক অগ্রগতি, বেকারি ও অন্যান্য পুঁজিবাদী ব্যাধিমুক্ত একটা নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাদের বিরাট পদক্ষেপ কোটি কোটি মানুষকে আকর্ষণ করছে সমাজতন্ত্রের পতাকাতলে আসতে। বহু ভুলভ্রান্তি ও বিচ্যুতি সত্ত্বেও, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নতুন মর্যাদা অর্জন করছে।
এই অবস্থায়, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে নীতিসম্মত ঐক্যের জন্য সংগ্রাম-যে ঐক্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অবিনশ্বর নীতি ভিত্তিক-মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রতি অনুগত প্রত্যেকেরই অবশ্য কর্তব্য।
শান্তিপূর্ণভাবেই সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটবে, এমন আত্মসন্তুষ্টি ও রঙীন কল্পনা যেমন পরিহার করতে হবে, তেমনই একথাও ভুললে চলবে না যে তামাম প্রগতিশীল শক্তি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রায় লিখে দিয়েছে, জাতিসমূহ ও জনসাধারণ সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক দুঃখ-দুর্দশার যুগ অবসানকল্পে প্রবলভাবে কসচেষ্ট হয়েছেন।
বিগত পাঁচ বছরের ঘটনাবলী দেখিয়ে দিচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্ররা যত চেষ্টাই করুক না কেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তারা যে উদ্যোগ হারিয়ে ফেলেছে, তা আর পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। যাত
জাতীয় পরিস্থিতি
জরুরি অবস্থা সমগ্র দেশে যে একদলীয় স্বৈরাচারী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তার নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মাদুরাই-এ অনুষ্ঠিত আমাদের পার্টির নবম কংগ্রেস থেকে যে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল, তা এখানে স্মরণে আসে: "শাসক পার্টির পক্ষে যথোপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা দ্বারা জনগণের ব্যাপক অংশকে শান্ত করার অক্ষমতা, তাদের উপর আরও বোঝা চাপিয়ে দেবার একান্ত প্রয়োজনীয়তা, দমনযন্ত্রের ব্যবহার, এবং সেই সঙ্গে বামপন্থীবিরোধী দলের দুর্বলতা, অপরাপর বুর্জোয়া দলগুলির দুর্বল হওয়া, সমস্ত রকম বিরোধীদের প্রতি শাসক পার্টির ধৈর্যের অভাব ও অসহিষ্ণুতা, এইসব কিছু হতে এক পার্টি একনায়কত্বের সম্ভাব্য ঝোঁক ফুটে এরে উঠছে। বর্তমানে শাসকশ্রেণীগুলির সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করছে শাসক পার্টি, এই শাসক পার্টি যে সুবিধাজনক অবস্থান অর্জন করেছে, তা সম্ভবত সহজে তারা না ছেড়ে দেবে না।
বুর্জোয়া-জমিদার দলগুলির মধ্যে বর্ধিত সংঘাত
শাসক ও বিরোধী, বুর্জোয়া-জমিদার দলগুলির মধ্যে পূর্বেকার চেয়ে সংঘাত তীব্রতর শাসক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে সংকট নিজেকে আরও আত্মপ্রকাশ করল।
সন্দেহ নেই, গভীরতম অর্থনৈতিক সংকট এবং শাসকশ্রেণীগুলি ও ব্যাপক জনসাধারণের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব জরুরি অবস্থা জারির ভিত্তি। কিন্তু জরুরি অবস্থার উপর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবে যেমন বলা হয়েছে, জরুরি অবস্থা ঘোষণার আশু কারণ বুর্জোয়া-জমিদার জোটের রাজনৈতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিপ্লবের, জনসাধারণের প্রত্যক্ষ চ্যালেঞ্জ নয়, এসেছিল প্রতিদ্বন্দ্বী বুর্জোয়া-জমিদার দলগুলির পক্ষ থেকে, যারা অর্থনৈতিক সংকটের ফলে উদ্ভূত গণঅসন্তোষের সুযোগ নিয়ে সরকার দখল করতে চেয়েছিল।
বুর্জোয়া-জমিদার দলগুলির মধ্যে বিরোধ বহুদিন থেকেই তীব্র হয়ে উঠছিল কিন্তু ইতিপূর্বে এত গভীর হয়ে ওঠেনি। প্রাক্-জরুরি অবস্থাকালে এ বিরোধ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যেকোনো সম্ভাব্য উপায়ে সরকারি যন্ত্র দখলের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী জোটগুলির দৃঢ় সংকল্পের মধ্যে এটা প্রতিফলিত হয়েছিল। উভয় গোষ্ঠীই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাগিদে ব্যবস্থাটাই সংকটে ফেলে, তাদের এতদিনের সযত্নে পোষণ করা সংসদীয় রীতিনীতি ও বদ্ধমূল ধারণাগুলি এখন লংঘন করতে প্রস্তুত হয়।

ব্যাপক মঞ্চ
একনায়কত্বের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রামের জন্য প্রয়োজন একটা ব্যাপক মঞ্চ, লড়াই করার জন্য। বুর্জোয়া-জমিদার দলগুলির নিজেদেরই মধ্যে তীব্র বিরোধের ফলে এই মঞ্চ গড়ে তোলার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এই ব্যাপক মঞ্চের আশু লক্ষ্য হবে, স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের সৃষ্ট কাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়া, গণতন্ত্র সম্প্রসারিত করা, এবং ভবিষ্যতে কোন শাসক দল বা সরকার যাতে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলির ক্ষতিসাধন না করতে পারে, সেজন্য সংবিধানে নতুন ধারা সংযোজন।
এই ব্যাপক জমায়েতের কর্মসূচীতে থাকা দরকার
(১) মিসা প্রত্যাহার; নিবর্তনমূলক আটকের জন্য যে ধারাটি সংবিধানে রয়েছে তা বাতিল করা, একনায়কত্বের প্রধান হাতিয়ার রিসার্চ ও অ্যানালিসিস উইং ভেঙে দেওয়া; পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা,
(২) ৪২ তম সংবিধান সংশোধন আইন রদ করা,
(৩) সংবিধানের যে ৩৫২ নং ধারায় রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার অধিকার দেওয়া হয়েছে তা এমনভাবে সংশোধন করা যাতে একমাত্র প্রকৃত যুদ্ধ বাধলেই তবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যাবে,
(৪) রাজ্যের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির শাসন সংক্রান্ত ৩৫৬ থেকে ৩৬০ ধারাগুলি বাতিল করা,
(৫) প্রতিনিধি ফিরিয়ে আনার অধিকার সংবিধানের অন্তর্ভুক্তি,
(৬) তেমনি আবার আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব,
(৭) ভোটদানের বয়স আঠারো বছরে কমিয়ে আনা।
বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির কর্মসূচী
(১) স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া, জরুরি অবস্থাকালে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলা, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির প্রতিরোধ ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ব্যাপকতর মঞ্চ থেকে প্রস্তাবিত নতুন গণতান্ত্রিক সংস্কার ও সংবিধান সংশোধন।
(২) রাজ্যগুলির ক্ষমতা সম্প্রসারণের ও তাদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য নতুন সাংবিধানিক ধারা সংযোজন।
(৩) রাষ্ট্রের উপর বুর্জোয়া-জমিদার শ্রেণীগুলির কব্জা এবং আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য সংবিধানের মৌল পরিবর্তন, জনগণের মৌলিক অধিকারগুলিকে সরকার বা শাসক দলের ক্ষতি করার বাইরে রাখার জন্য ধারা সংযোজন।
(৪) সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসাবে কাজের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা।
(৫) বিদেশি প্রভাবমুক্ত জাতীয় অর্থনীতির পরিকল্পিত ও স্বাধীন বিকাশ। রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার বর্ধিত ভূমিকা।
(৬) বিশ্বব্যাঙ্কের সঙ্গে আপসের বিরুদ্ধে, বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে আমন্ত্রণের বিরুদ্ধে এবং অন্যান্য যেসব নীতি দেশের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা আনে, সে সবের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালানো।
(৭) ভারতীয় একচেটিয়া কারবারগুলির জাতীয়করণ।
(৮) জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনভিত্তিক মজুরির ন্যায় ন্যূনতম শর্তের ব্যবস্থা রাখার ভিত্তিতে একটি ন্যায্য ও সমদর্শী আয় ও মজুরি নীতি নির্ধারণ
(৯) মুদ্রাস্ফীতি, ঘাটতি ব্যয়, ভারী করের বোঝা এবং উচ্চ মূল্যের বিরোধিতা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জোরালোভাবে মূল্য হ্রাস ও তার সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করা।
(১০) জমিদারী বিলোপ, আমূল ভূমিসংস্কার আইন যাতে ক্ষেতমজুর ও গরীব কৃষকরা বিনামূল্যে জমি পায় তার ব্যবস্থা করা, উচ্ছেদবিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ; কৃষকদের উৎপন্ন ফসলের ন্যায্য দর সুনিশ্চিত করা; কৃষক সাধারণকে সহজে অল্পসুদে ঋণ ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরকারি ভর্তুকি দিয়ে সরবরাহ।
(১১) ক্ষেতমজুরদের ন্যায্য মজুরির গ্যারান্টি, ক্ষেতমজুর ও গ্রামীণ গরীবদের বিনামূল্যে বাস্তুজমি বণ্টন, ক্ষেতমজুর, গরীব কৃষক ও আধা প্রলেতারিয়েতদের ঋণ মকুব এবং অল্প সুদে ঋণ ও খরচের জন্য ধার দেবার উদার ব্যবস্থা; তাদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষার সুযোগ।
(১২) গ্রামীণ বেকারদের পূর্ণ কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং যতদিন তা না হয় ততদিন বেকারভাতা প্রদান।
(১৩) শ্রমিকশ্রেণীর জন্য প্রয়োজনভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি প্রদান, মজুরি বৃদ্ধি স্থগিত, লক-আউট, লে-অফ ও মিল-ক্লোজারের বিরুদ্ধে, বন্ধ মিল ও সংস্থাগুলির অধিগ্রহণ, পূর্ণ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের জন্য পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার, পুলিশী অনুসন্ধান ব্যবস্থার অবসান, শ্রমিকশ্রেণী-বিরোধী সমস্ত আইনকানুনের বিরুদ্ধে, পূর্ণ কর্মসংস্থানের জন্য এবং কর্মসংস্থান সাপেক্ষে বেকারদের রিলিফ প্রদান, অটোমেশন ও বেকারি বাড়ায় এমন সমস্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
(১৪) সমস্ত রাজ্যে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অবিলম্বে অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন।
(১৫) শিক্ষার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধন, যাতে তা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক হয়ে ওঠে।
(১৬) তফশিলী জাতি ও উপজাতিদের বিরুদ্ধে যারা অত্যাচার উৎপীড়ন চালায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
(১৭) হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী-দের সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
(১৮) নারীদের জন্য সমান মজুরি, সমমর্যাদা ও সমসুযোগ।
(১৯) যে সব অঞ্চলে উপজাতিরা সংখ্যায় অধিক, সে অঞ্চলগুলিকে তফসিলভুক্ত বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিয়ে আসার জন্য জনসংযোগ স্থাপন করতে ও অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি ৪৪ জনকে নিয়ে গঠিত হয়।
পার্টি কংগ্রেসে ৫৭২ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন - ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ
নির্বাচিত পলিটব্যুরো সদস্যরা হলেন- ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, পি সুন্দরাইয়া, এম বাসবপুন্নাইয়া, পি রামমূর্তি, হরকিষান সিং সুরজিৎ, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাসগুপ্ত, বি টি রণদিভে, সমর মুখার্জী, এ বালাসুব্রহ্মণ্যম, ই বালানন্দন।
আগের পর্বতথ্যসুত্রঃ
১) Documents of The Communist Movement in India,
National Book Agency, Volume I- XXVII
২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,
মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি
৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement
Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977