সৌভিক ঘোষ
অক্টোবর বিপ্লব ও ভারতীয় বিপ্লবীরা
‘ডিয়ার কমরেড ক্রুপস্কায়া,
লেনিনের জীবনের কয়েকটি বিশেষ অধ্যায় সম্পর্কে জানতে আমি রীতিমত চেষ্টা করে চলেছি। যদিও ইতিমধ্যে তাঁর যতগুলি জীবনী প্রকাশিত হয়েছে কিংবা আপনি যে স্মৃতিকথা লিখেছেন তাতে সেই সম্পর্কে কোনোরকম উল্লেখ নেই। যদি আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছ থেকে পাই তবে বিশেষ কৃতজ্ঞ থাকব।
আমার জিজ্ঞাসাঃ
১) লন্ডনে বসবাস করার সময় লেনিনের সাথে ভারতীয় কারোর পরিচয় বা যোগাযোগ হয়েছিল কি? যদি সেরকম কোনও ঘটনা আপনার মনে পড়ে তবে আমাকে অবশ্যই জানাবেন।
২) ১৯০৭ সালে স্টুটগার্ট কংগ্রেসে দুজন ভারতীয় প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মহিলা, তার নাম রুস্তমজি কামা। তিনি ঐ সম্মেলনে ভারতীয়দের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার প্রসঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহনও করেছিলেন। আমি জানতে চাইছি, ভারত সম্পর্কে লেনিনের সাথে ম্যাডাম কামার কোনও আলোচনা হয়েছিল কি?
৩) অক্টোবর বিপ্লবের পূর্বে, বিশেষ করে ১৯১২-১৭ পর্যায়ে লেনিন নিজে বা অন্য কারোর মাধ্যমে ভারতীয় বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন কি?
অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের পক্ষ থেকেই আমি ‘লেনিন ও ভারতবর্ষ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনার কাজ করছি। এই কাজে উপরোক্ত তথ্যগুলি সংগ্রহ করা আমার বিশেষ প্রয়োজন।
আমি আশা করছি আপনি আমাকে সেই কাজে সহযোগিতা করবেন এবং যত দ্রুত সম্ভব এ সম্পর্কিত তথ্য যদি আপনার কাছে থাকে বা আপনার মনে পড়ে তবে সেগুলি আমাকে জানাবেন।
আপনি হয়ত আমাকে চিনবেন না ধরে নিয়ে আমি অনুরোধ জানাচ্ছি আমার পরিচয় ও কাজ সম্পর্কে কমরেড পিয়াতানস্কি অথবা কমরেড মানৌলস্কি’র কাছে খোঁজ করতে পারেন।
ইতি
ভ্রাতৃবৎ অভিনন্দন সহ
চট্টোপাধ্যায়
২৫শে জানুয়ারি, ১৯৩৪’
এ চিঠির লেখক বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, ‘চট্টো’ নামেই সুপরিচিত ছিলেন। রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লব সফল হওয়ার পরে লেনিনের উদ্দেশ্যে টেলিগ্রাম মারফৎ শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। সর্বহারা বিপ্লবের প্রতি সহমর্মিতা ও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানোর প্রথম কৃতিত্ব তাঁরই। ঐ টেলিগ্রাম লেখার পরে রাশিয়ায় সশরীরে উপস্থিতও হন। মস্কোয় তখন বিদেশ থেকে আগত বিপ্লবীদের পাশাপাশি অনেকের ভিড়, সবাই লেনিনের সাথে দেখা করতে চায়। না, অনেক চেষ্টা করেও বীরেন্দ্রনাথ লেনিনের সামনে উপস্থিত হতে পারেননি। প্রথম ভারতীয় হিসাবে দুজন তরুণ ১৯১৮ সালে লেনিনের সাথে দেখা করেছিলেন, একান্ত গোপনে। চট্টোপাধ্যায়’রা যা খুঁজছিলেন তাতে ভুল কিছু ছিল না, শুধু অমন সাক্ষাৎ বা পরিচয়ের সময়টুকুর সম্ভাবনা তারা সঠিক নির্ধারণ করতে পারেননি। হয়ত তারা ভাবতে পারেননি বার্লিন কমিটির প্রতিনিধিদেরও আগে সরাসরি ভারত থেকে কোনও বিপ্লবী রাশিয়ায় এসে উপস্থিত হতে পারেন। তাই হয়ত চট্টোপাধ্যায়ের চিঠিতে বিপ্লবের আগেকার সন-তারিখ উল্লেখ করা হয়েছিল, স্টুটগার্ট কংগ্রেসের খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বার্লিন কমিটি বা বিদেশে আশ্রিত অন্যন্য বিপ্লবীদেরও আগে ভারত থেকেই বিপ্লবীদের সেই দল মস্কোয় পৌঁছে যায়। তাঁরাই প্রথম ভারতীয় যারা লেনিনের সাথে দেখা করেছিলেন, রাশিয়ায় কমিউনিস্টদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে তারা রীতিমত আলোচনাও করেন।
পথে বাধা ছিল, বিপদের আশঙ্কা ছিল- ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও পুলিশের নজরে এলে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার তো বটেই এমনকি ‘শ্যুট অ্যাট সাইট’-র সম্ভাবনাও যথেষ্টই ছিল। এসব জেনেও তারা এগিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে তারা নকল নাম ব্যবহার করেছিলেন। পাসপোর্ট ইত্যাদিতে যেটুকু উল্লেখ রয়েছে তাতে জানা যায় ঐ দুই ভারতীয় ছিলেন মহম্মদ হাদি এবং আহমত হ্যারিস। এরা উচ্চশিক্ষিত, দুজনই দিল্লীর স্থায়ী বাসিন্দা।
রাশিয়ার সীমানায় প্রবেশ করার পরে তারা প্রাদেশিক পিপলস কমিশার অফ ফরেন অ্যাফেয়ার্স’র দফতরে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন। সেখানেই তারা লেনিনের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্য জানান। কমিশার তাদের মস্কোয় থাকার বন্দোবস্ত করে দেয় এবং জানায় কিছুদিনের মধ্যেই তারা লেনিনের সাথে দেখার করার, কথা বলার সুযোগ পেতে পারেন।
২৩শে নভেম্বর, সন্ধ্যায় ক্রেমলিনে তারা দুজনেই লেনিনের সাথে আলোচনায় বসেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের তৎকালীন অবস্থা, ভারতীয় জনগণের লড়াই-সংগ্রাম ও মুক্তিআন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেই সাক্ষাৎকারের বিবরণ লিখিত দলিল আকারে সংরক্ষণেরও সিদ্ধান্ত হয়। সেই দলিলটিই ৪০ বছর পরে কোলচাকের প্রাদেশিক সরকারের মহাফেজখানা থেকে উদ্ধার হয়।
দলিলের এক জায়াগায় উল্লেখ রয়েছে- ‘ঐ দুই ভারতীয় বিপ্লবী ইতিমধ্যেই পিপলস কমিশার অফ ফরেন অ্যাফেয়ার্সের দফতরে একটি লিখিত বিবৃতি জমা দিয়েছিলেন। সেই বিবৃতির শিরোনাম ছিল ‘মেসেজ ফ্রম দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া’। দিল্লীর বাসিন্দা ঐ দুই সুশিক্ষিত যুবক ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসাবে মস্কোয় এসেছিলেন। ভারত সহ ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত প্রাচ্যদেশসমূহের মুক্তি সংগ্রামের সমস্যা প্রসঙ্গে তারা লেনিনের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন।’
২৫শে অক্টোবর ঐ দুজন ‘নিখিল রাশিয়া কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি’র সাথে আলোচনায় বসেন। অক্টোবর বিপ্লব সংক্রান্ত দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষিত ছিল মস্কোর কেন্দ্রীয় লেখ্যাগারে, সেখানেই ঐদিনের সভার কার্যবিবরণী মেলে। সভায় ভারতীয় বিপ্লবীদের তরফে বক্তব্য রাখার সময়ই হলঘর কাঁপিয়ে উচ্চারিত হয়- ‘কমরেডস অ্যান্ড ব্রাদার্স!’।
সাইবেরিয়ার প্রাদেশিক সরকারের অধীনস্থ মহাফেজখানায় সেই আলোচনার লিখিত দলিল খুঁজে পাওয়া যায়, ১৯৫৮ সালে। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে ভারতে অবস্থিত রাশিয়ান দূতাবাসের তথ্য দফতর থেকে প্রকাশিত একটি প্রেস রিলিজে সেই দলিল সম্পর্কে সকলকে জানানো হয়।

প্রবাসে ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রচেষ্টা
ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার পথে একাধিক পরস্পর বিরোধী বিপ্লবপন্থাকে একজায়গায় নিয়ে আসে। নিজস্ব বৈশিষ্ট অনুযায়ী সেই সকল গোষ্ঠীর প্রত্যেকটি অংশই নিজেদের উপলব্ধিকে মুক্তিসংগ্রামের প্রধান উপায় মনে করত। মোটের উপরে এদের তিনটি দল হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এক পক্ষ দেশের মাটিতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকদের বহুবিধ লড়াই আন্দোলনের সাথে যুক্ত থেকে নেতৃত্বের ভূমিকায় নিজেদের উন্নীত করেছিলেন। এদের মধ্যেকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের রাজনীতিতে উৎসাহ হারিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় পক্ষে ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে যারা বিদেশ থেকে উপযুক্ত সাহায্যের প্রত্যাশায় দেশান্তরী ছিলেন, এদেরই একটি অংশ তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেছিলেন। এই দুই পক্ষ ছাড়াও আরেক দল ছিলেন যারা সশস্ত্র বিপ্লবের পথে এগিয়ে অশেষ যন্ত্রণা, নিপীড়ন সহ্য করে ব্রিটিশ জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায় উপলব্ধি করেছিলেন কমিউনিজম প্রতিষ্ঠাই মুক্তির একমাত্র পথ।
প্রথম পর্বে এ প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিদেশের মাটিকে ব্যবহার করে যারা দেশমুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হন।
১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তাদেরই একটি অংশ তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বিদেশের মাটিতে ভারতীয় বিপ্লবীদের সংঘবদ্ধ চেহারা মূলত তিনটি। একদিকে ‘গদর পার্টি’ আরেকদিকে ‘বার্লিন কমিটি অফ রেভলিউশনারিজ’। ভারত থেকে এক ঝাঁক তরুণ ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার আশায় আফগানিস্তানে এসে হাজির হন, তৎকালীন পরিস্থিতিতে এরাই তৃতীয় পক্ষ।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সম্মুখ সমরে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত গদর পার্টি জাহাজে করে অস্ত্র ও সেনাবাহিনী পাঠানোর পরিকল্পনা নেয়। কোমাগাতামারু’র ঘটনার পরে তাদের ছোট-বড় যাবতীয় উদ্যোগেই ব্যপক বাধা আসতে থাকে। দলের নেতৃত্ব উপলব্ধি করেন ইউরোপ তাদের সহায়তা করছে না, আগামিদিনেও তেমন কোনও সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার বিপ্লবীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়, তারা বলশেভিকদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিষয়ে অবহিত হন। পরবর্তীকালে ভারতের মাটিতে শ্রেণী আন্দোলন ও গণআন্দোলন পরিচালনায় তাদের অনেকেই কমিউনিস্ট নেতৃত্ব হিসাবে ভূমিকা পালন করেছেন।
বার্লিন কমিটি ছিল কার্যত একটি গোষ্ঠী, কিন্তু পরিচিতি, যোগাযোগ ও কর্তব্যের প্রতি একনিষ্ঠতায় এরা ছিলেন অনন্য। এই দলেরই মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, মহম্মদ বরকতুল্লাহ, নলিনী গুপ্তরা। এরা মূলত জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ‘শত্রুর শত্রু আমাদের মিত্র’ নীতির প্রভাবেই তারা জার্মানিতে উপস্থিত হন। তাঁরাই গড়ে তোলেন বার্লিন কমিটি। জার্মানির অবস্থা সন্তোষজনক নয় উপলব্ধি করে তারাই পরবর্তীকালে স্টকহোমে নতুন করে বিপ্লবী সমিতির কেন্দ্র স্থাপন করেন। ততদিনে ইউরোপের একাধিক সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটরা সেখানে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। এদের প্রায় সকলেই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সদস্য ছিলেন। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সদস্যদের মধ্যে সংশোধনবাদীরাও ছিলেন (তখনও লেনিন বার্নস্টাইনদের মতবাদকে চুরমার করেননি)। এইসব দক্ষিণপন্থী সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটরা ভারতীয়দের কথাবার্তায় বিশেষ গুরুত্ব দেননি। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, ‘জাতিসমূহের মুক্তি আন্দোলনকে সোশ্যালিস্টরা আদৌ গুরুত্ব দিতে চান না, একথা আমরা ক্রমেই বুঝতে পারি’। প্রথমে জার্মানরা, পরে সোশ্যালিস্টরাও তাঁদের হতাশ করলেন। ঐ পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের সামনে নতুন বন্ধুর সন্ধান করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। তারা দেখলেন একমাত্র রাশিয়ার বলশেভিকরাই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত ও জরুরি বিবেচনা করছেন। উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন লেনিন। এম এন রায়ের সঙ্গে ভারতে বিপ্লবের পথ নির্ধারণ সংক্রান্ত বিতর্কে লেনিনের ঐ মতামত আরও স্পষ্ট হয়।
এবার এম এন রায়, হ্যাঁ কোনও পক্ষ না, একজন মানুষ। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীনই অনুশীলন সমিতির সদস্য হন। সে দল নিষিদ্ধ হলে যতীন মুখার্জির (বাঘা যতীন) নেতৃত্বে যুগান্তর সমিতিতে যুক্ত হলেন। তারই নির্দেশে জার্মানি থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করতে ১৯১৫ সালে জাভায় চলে যান। সেখানে ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারী এড়াতে একের পর এক দেশ ঘুরেছেন, নকল পাসপোর্টের বন্দোবস্ত করেছেন। মালয়, ইন্দোচিন, ফিলিপিন্স, জাপান, কোরিয়া হয়ে চীন হয়ে ১১৯১৬ সালে জাহাজে চেপে আমেরিকার সানফ্রান্সিস্কো’তে উপস্থিত হন। পরিচয় গোপন রাখতে মানবেন্দ্রনাথ রায় হিসাবে চিহ্নিত হন ইতিমধ্যে ভারতে ব্রিটিশ পুলিশ যুগান্তর দলের উপরে ব্যাপক নিপীড়ন নামিয়ে আনে, যতীন মুখার্জির শহীদ হওয়ার খবরও তার কাছে পৌঁছে যায়। এর পরে রায়ের বিপ্লবী জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। আমেরিকায় তার সাথে পরিচয় হয় এভেলিন ট্রেন্টের, তারা একে অন্যকে ভালোবেসে বিবাহ করেন। ইতিমধ্যে রায়ের সাথে বলশেভিক বিপ্লবী মাইকেল বরোদিনের পরিচয় হয়েছে। বরোদিনের সহায়তায় তিনি মার্কসবাদ, বলশেভিজম, কমিউনিজম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন ও গভীরতর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। মেক্সিকোর সমাজতান্ত্রিক দল ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ মেক্সিকো’ হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে এম এন রায় তার সম্পাদক হলেন। সেই সুবাদেই রায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে এশিয়াটিক ব্যুরোর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
রায় দেশের মাটিতে সক্রিয় বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির সাথে যোগাযোগ করতে সচেষ্ট ছিলেন, এর সঙ্গে এশিয়াটিক ব্যুরোর কাজও তাকে করতে হচ্ছিল। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ধার কমে এলে ভারতের যুবসম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে দেশের মুক্তির জন্য কার্যকরী ও নতুন রাজনৈতিক পন্থার জন্য একধরনের খোঁজ শুরু হয়। এদেরই একটি অংশ মুহাজির (দেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় দেশান্তরী) পরিচিতি নিয়ে বাইরে থেকে সাহায্যের প্রত্যাশায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। নানা ঘাত প্রতিঘাতের শেষে তারা তুরস্কে পৌঁছলেন, ততদিনে রাশিয়াতে বিপ্লবের খবর এসেছে। জার্মানি যে তাদের সাহায্য করবে না একথাও তারা কম-বেশি বুঝেছেন।
মানবেন্দ্রনাথ রায় এদের তুরস্কে পৌঁছানোর খবর পেলেন। এভেলিন ট্রেন্ট ছাড়াও তখন রায়ের সাথে রয়েছেন অবনী মুখার্জী ও তার স্ত্রী রোজা ফিটিংগোফ। রোজা শুধু অবনীর স্ত্রীই ছিলেন না, রুশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও ছিলেন। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রাথমিক ইচ্ছা ছিল ঐ সকল মুহাজির যুবকদের সংগঠিত করে তিনি ভারতীয় মুক্তিফৌজ (Liberation Army) গড়ে তুলবেন। তাসখন্দে রায়’রা একটি মিলিটারি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আফগান সরকারের সমীপে চিঠি লিখে তারা আবেদন জানালেন যাতে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র সমেত ঐ মুক্তিফৌজ আফগানিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারে। আফগানিস্তানের সরকার তাদের ঐ প্রস্তাবে রাজী না হলে রায় নিজের পরিকল্পনা বদল করলেন। লেনিন অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন এমন পরিকল্পনা কার্যকর হবে না, ‘they (British) would bombard Amanullah’s citadel with silver and gold bullets’ বলে তিনি আগেই সতর্ক করেছিলেন।
সামরিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও বেশ কয়েজকজন যুবক সামরিক শিক্ষায় সুদক্ষ হয়ে ওঠেন, অনেকে রাশিয়ার কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়েছিলেন। এদের মধ্যে থেকে দুজন- মহম্মদ শফিক সিদ্দিকি ও মহম্মদ আলী (আহমদ হাসান) এবং এভেলিন ট্রেন্ট রায়, অবনী মুখার্জি, রোজা ফিটিংগোফ এবং এম পি আচার্যকে সঙ্গে নিয়ে রায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করলেন। মহম্মদ শফিক সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। পরে আরও দুবার এদের সভা হয়েছিল, ১৯২০ সালের ১৫ই ডিসেম্বরের সভার কার্যবিবরণী (মিনিট্স) থেকে জানা যায় আরও তিনজনকে পার্টির তরফে ক্যান্ডিডেট মেম্বরশিপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই তিনজন ছিলেন আব্দুল আদির শেহরাই, মাসুদ আলী শাহ এবং আকবর শাহ (সেলিম)। তখনকার নিয়মে ক্যান্ডিডেট মেম্বরশিপের সময়সীমা ছিল তিন মাস।
প্রবাসে গঠিত পার্টির সাফল্য
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নিয়মানুসারে যে কোনও কমিউনিস্ট পার্টিকে আন্তর্জাতিকে নিজেদের কর্মসূচি নথিভুক্ত করতে হত। পার্টির প্রতিষ্ঠা করলেও এম এন রায়’রা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে নিজেদের কর্মসূচি জমা করতে পারেননি। ১৯২১ সালে বার্লিন কমিটি মস্কোয় পৌঁছায়, তারাও রায়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পার্টিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চাননি। তাদের যুক্তি ছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করুক। এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এম এন রায় প্রতিষ্ঠিত পার্টিকে ‘ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট গ্রুপ’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। তখনকার পরিস্থিতিতে প্রবাসে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের খবর ভারতে এসে পৌঁছায়নি। অনেক পরে কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেবেন্দ্র কৌশিকের মাধ্যমে মুজফফর আহমদ পার্টি প্রতিষ্ঠার খবর পান।
তাসখন্দে প্রতিষ্ঠিত পার্টি খুব একটা কাজ এগোতে না পারলেও এম এন রায় নানাভাবে দেশের বুকে সক্রিয় একাধিক কমিউনিস্ট গ্রুপগুলির সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে কিছুদূর সফল হয়েছিলেন। কলকাতায় মুজফফর আহমদ, বোম্বাইতে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে এবং মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার সহ অনেকেকে তিনি একাধিক চিঠি লিখতে শুরু করেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে সেই সমস্ত চিঠিপত্র যে সময়মত এসে পৌঁছেছিল এমন না, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পেরেছিল স্রেফ খবর চেপে রাখার কৌশলে বলশেভিকবাদের বিপদ’কে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
১৯২১ সালে গুজরাটের আমেদাবাদ শহরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রিশতম অধিবেশনের আয়োজন হয়েছিল। রায় এই আয়োজনে নিজে উপস্থিত হতে না পারলেও অধিবেশনে কমিউনিস্টদের বক্তব্য তুলে ধরতে চাইলেন। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি ও অবনী মুখার্জী একটি ইশতেহার লেখেন। লেখা শেষ হলে খসড়াটি নিয়ে তারা হাজির হন লেনিন ও স্তালিনের সামনে। সাধারণভাবে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তরফে বিবৃতিটি অনুমোদিত হলেও একটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ আজও জরুরী। স্বাধীন ভারত কেমন হবে সে প্রসঙ্গে কমিউনিস্টদের বক্তব্য জানতে ঐ দলিল এখনও প্রাসঙ্গিক। দলিলের শুরু থেকে শেষ অবধি দুটি বক্তব্য বারে বারে উঠে আসে। এক, স্বাধীন ভারত সম্পর্কে তখনও অবধি যে সকল মতামত রাজনীতির আবহে ভেসে চলছিল তার কোথাও গরীব, মেহনতী ভারতীয়দের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য ভাবনাচিন্তা ছিল না। দুই, দেশের স্বাধীনতা আসবে অথচ দেশের এক বিরাট অংশের মানুষের উপরে যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষন, নিপীড়নের বন্দোবস্তটির কোনরকম বদল ঘটবে না এমন স্বাধীনতায় কার লাভ হবে, কাদের লাভ হবে?
রায়ের লেখায় এক জায়গায় বিকল্প কর্মসূচি হিসাবে সমস্ত দেশীয় সুদখোরদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। এই প্রস্তাবটি শুনতে ভালো লাগলেও, স্তালিন এই সম্পর্কে নিজের মতামত জানিয়ে উল্লেখ করলেন, এমনটা হলে ছোট ও মাঝারি কৃষকরা চাষের কাজে জরুরী অর্থের সংস্থান কোথা থেকে করবে? কে তাদের টাকা ধার দেবে? তখনকার বাস্তবতায় স্তালিনের প্রস্তাব ছিল উচিত হবে সুদের হার যেন কোনোভাবেই ৬শতাংশের বেশি না হয়।
এম এন রায় নিজের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন সেদিন স্তালিনের প্রস্তাবে তার ভুল ভেঙে যায়। তিনি উপলব্ধি করেন বিপ্লবী কর্মসূচি আকাশ থেকে নামিয়ে আনা যায় না, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই তাকে নির্মাণ করতে হয়, কার্যকরী করতে হয়।
জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ঐ ইশতেহার সহজে প্রচার করা যায়নি, গোপনে বিলি করতে হয়েছিল। ইশতেহারের কোথাও একে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিবৃতি বলেও উল্লেখ করা হয়নি, রায় ও মুখার্জির নামেই প্রচার হয়েছিল। ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও পুলিশের চাপ, কংগ্রেসের দোলাচলে থাকা নেতৃত্ব এমনকি স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীর অনুমোদন না থাকা সত্বেও সেদিন এ কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দুজন। প্রথমজন মৌলানা হসরৎ মোহানি, দ্বিতীয়জন স্বামী কুমারানন্দ। এই ইশেতাহারের এক বিশেষ দিক, এতে বারে বারে দেশের জনসাধারণকে সহযাত্রী বলে সম্বোধন করা হয়। তখনকার পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের এক বিরাট অংশের মধ্যেই কমিউনিজম ও কমিউনিস্টদের সম্পর্কে কার্যত কোনও ধারানাই ছিল না। এ স্বত্বেও নিজেদের দেশের মানুষ যে তাদের বক্তব্যের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে একমত হবেন এমন অনুভব থেকেই কমিউনিস্টরা সমগ্র দেশবাসীকে ‘সহযাত্রী’ হিসাবে অভিনন্দিত করেছিলেন। এটি নিছক সৌজন্যের বিষয় না, এটাই বিপ্লবী হিম্মৎ।
মুজফ্ফর আহ্মদের স্মৃতিকথা থেকে ইশতেহারটি এ প্রবন্ধের জন্য সংগৃহীত হয়েছে। কাকাবাবুর লেখা থেকেই জানা যাচ্ছে ঐ ইশতেহারের বাংলা ভাষান্তর করেছিলেন শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়। মূল লেখার বানান অবিকৃত রেখেই ইশতেহারের একেবারে শেষ কিন্তু আজও প্রাসঙ্গিক অংশটিকে এখানে যুক্ত করা হল-
‘সহযাত্রী দেশবাসীগণ,
কংগ্রেসের কার্যসূচীতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সমস্যাটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, সে সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। ভারতের মানুষ অগণিত জাতি, ধর্ম মত ও সম্প্রদায়ে বিভুক্ত। এই ব্যবধানকে দূর করতে কতকগুলি কৃত্রিম ও আবেগভরা প্রচারে কোনো কাজ হবে না। সৌভাগ্যক্রমে এই অসংখ্য দল ও সম্প্রদায় একটি প্রবল শক্তির চাপে দুটি সুস্পষ্ট শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সেই শক্তি হল অর্থনীতি। এই অর্থনীতির অমোঘ বিধানে বিত্তশালী শ্রেণী সম্পদহীন নিঃস্ব মানুষকে শোষণ করে চলেছে। এই শ্রেণীবিভাগে কিছু কিছু 'উগ্র দেশপ্রেমিক' বড় অস্বস্তি বোধ করেন। কারণ তাঁরা প্রচার করে বেড়ান যে এই ভারতবর্ষ ঈশ্বরের এক বিশেষ সৃষ্টি। কিন্তু একথা অস্বীকার করা চলে না যে অর্থনীতির অমোঘ বিধানে ভারতবর্ষেও সক্রিয়-তারই প্রভাবে সহস্র সামাজিক ব্যবধানকে দূর করে ভারতবর্ষ দুটি বিরাট শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই অমোঘ বিধানেই হিন্দু শ্রমিক তার মুসলমান সহকর্মীর ঘনিষ্ঠ হয়ে আসছে। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের এই একমাত্র পথ। যারা স্পষ্টভাবে এই সমাজ-অর্থনীতির অভ্রান্ত নীতি অনুধাবন করবে, তারা আর উদভ্রান্তের মতো সন্ধান করতে যাবে না যে কীভাবে মুসলমানের মনে গোজাতি সম্বন্ধে শ্রদ্ধা জাগানো যায় বা হিন্দু কৃষককে বোঝাতে হবে না যে তাঁর আত্মার মুক্তি ও ইহকালের সকল যন্ত্রণা মোচনের একমাত্র উপায় হলো খিলাফৎ উদ্ধার বা তুর্কীদের হাতে আর্মেনিয়াদের বশ্যতা স্বীকার। ফাঁকা ভাবালুতার পথে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য আসবে না। অর্থনৈতিক শক্তির বাস্তব পথেই তা সম্ভব হবে। আমাদের কর্তব্য সে বাস্তব যুক্তির উপর জোর দেওয়া এবং সেই পথে আস্থা রাখা।
সহযাত্রী দেশবাসীগণ,
আপনারা একটি ক্ষুদ্র শ্রেণীর উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে সমগ্র জাতির অভাব-অভিযোগের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। রাজনৈতিক জুয়াখেলা ছেড়ে সমাজশক্তির সমর্থনে কংগ্রেস উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠুক। আপনারা কাজের দ্বারা প্রমাণ করুন যে কংগ্রেস দেশীয় ধনিকশ্রেণীর একচেটিয়া অধিকার অর্জনের জন্য নয়, সমগ্র ভারতীয় জনগণকে-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সর্বপ্রকার শোষণ থেকে মুক্তি দেবার জন্য বিদেশী শোষণের অবসান চায়। আপনারা প্রমাণ করুন যে কংগ্রেস সত্যই জনগণের যথার্থ প্রতিনিধি এবং জনগণের সংগ্রামে প্রতিস্তরে নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা কংগ্রেসের আছে। তবেই কংগ্রেস যথার্থ জাতীয় নেতৃত্ব অর্জন করবে। এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষের খামখেয়ালে নির্ধারিত কোনো নির্দিষ্ট তারিখে স্বরাজ আসবে না, স্বরাজ অর্জিত হবে সর্বস্তরের মানুষের সচেতন ও সম্মিলিত চেষ্টায়।’
প্রবাসে গঠিত পার্টির আরেকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য মুখপত্র প্রকাশ।
১৯২২ থেকে ১৯২৩ অবধি প্রকাশিত হয় ভ্যানগার্ড অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স। ইংরেজিতে প্রকাশিত ঐ কাগজই ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুখপত্র। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অনুমোদনক্রমেই যে কাগজ প্রকাশিত হচ্ছে তারও উল্লেখ ছিল। বলাই বাহুল্য এ কাগজ বিদেশে ছাপা হত, ভারতের ব্রিটিশ সরকার একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। রায়’দের যেমন অনেক কষ্ট করে এ কাগজ ভারতে পাঠাতে হত, এদেশের কমিউনিস্টদেরও তেমনই ঝুঁকি নিয়ে তা যোগাড় করতে হত, ছড়িয়ে দিতে হত।
ইতিমধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১৯২০ সালে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এআইটিইউসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই এ সংগঠনে কমিউনিস্টদের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
দেশের মাটিতে কমিউনিস্টদের অগ্রগতি
ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও পুলিশি নির্যাতনের বাধা পেরিয়েই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির সাথে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের যোগাযোগ বাড়তে থাকে। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ সাল অবধি ভারতে কমিউনিস্টদের কাজে উল্লেখযোগ্য গতি আসে, দেশের মূল অঞ্চলগুলিতে (প্রেসিডেন্সী এলাকা) সংগঠনের প্রসার ঘটে।
ভারতে কমিউনিস্টদের অগ্রগতি আটকাতে ব্রিটিশ সরকার তৎপর হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দেশে ফেরত আসা কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার করে পেশোয়ার জেলে আটক রাখা হয়। এদের বিচার শেষ হয় ১৯২৩ সালে, দশ বছর অবধি সশ্রম কারাদন্ডের শাস্তি হয়। পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে পরিচিত হলেও এটিই ছিল ভারতে কমিউনিস্টদের দমন করতে ব্রিটিশ সরকারের তরফে দায়ের হওয়া প্রথম মামলা। বলশেভিকদের আটকাতে ব্রিটিশ সরকারের স্বরাষ্ট্রদপ্তরের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল- ‘Wherever communism manifests itself, it should be met and stamped out like the plague. The spread of communism in India is not one of those problems which may be looked at from a particular ‘angle of vision’; it must be looked straight in the face and it must be fought with the most unrelenting opposition.’
কমিউনিস্টরাও উপলব্ধি করেন কেবলমাত্র বাইরে থেকে পাঠানো সহায়তার জোরে এগোনো যাবে না। কমিউনিজম সম্পর্কে, তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে দেশের জনসাধারণকে ধারণা দিতে পত্রিকা প্রকাশ হতে শুরু করে। কাজী নজরুল ইসলাম’কে সঙ্গে নিয়ে মুজফফর আহমদ বাংলায় সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশ করেন। তারা দুজনে ‘ধূমকেতু’ এবং ‘গনবানী’ নামেও পত্রিকা চালিয়েছিলেন। ১৯২১ সালেই শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে’র লেখা ‘গান্ধী ভার্সেস লেনিন’ বইটি সাড়া ফেলে দেয়, পরবর্তীকালে তারই সম্পাদনায় ‘সোশ্যালিস্ট’ পত্রিকার প্রকাশ ঘটে। পেশোয়ার সরকারী কলেজের অধ্যাপক গুলাম হুসেনের সাথে মস্কো ফেরত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পরিচয় হয়। তিনি নিজের চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে লাহোরে সংগঠনের প্রসারে মনোযোগী হন। তারই উদ্যোগে উর্দু ভাষার মাসিক পত্রিকা ‘ইনকিলাব’ প্রকাশ পায়, পাঞ্জাবে বেরোতে শুরু করে নতুন কাগজ ‘কীর্তি’। মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার ইংরেজিতে ‘লেবর কিষাণ গেজেট’ ও তামিল ভাষায় ‘থোজিলালান’ নামের পত্রিকা প্রকাশ করেন। অন্যান্য বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলিও নিজেদের পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করে।
ব্রিটিশ সরকার রীতিমত ভয় পেয়ে যায়। ১৯২৩ সালে শওকত উসমানী’কে কানপুর থেকে এবং মুজফফর আহমদ’কে কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার করা হল। কিছুদিনের মধ্যেই লাহোর থেকে গুলাম হুসেন’কে গ্রেপ্তার করা হল। পরে নলিনী গুপ্তকেও মামলায় দোষী হিসাবে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কানপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে চার্জশিট পেশ করার সময় অভিযুক্তের তালিকায় মোট আট জনের নাম যুক্ত হয়। বাকি তিনজন ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়, সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার এবং রামচরন লাল শর্মা। এর আগে তারা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে মামলার নথিতে বলশেভিক শব্দটি যুক্ত করেনি, ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে উল্লেখ করেছিল। এবার তারা সরাসরি ‘কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা’ নামেই নথি দায়ের করল।
এ মামলার আবহেই দেশের বুকে সক্রিয় সমস্ত কমিউনিস্ট গোষ্ঠীকে একজায়গায় এনে কমিউনিস্ট সম্মেলন আয়োজনের আহ্বান জানানো হয়। কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময়েই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সুবাদে কমিউনিস্টদের সম্পর্কে ক্রমশ দেশজুড়ে আগ্রহ তৈরি হয়। সেই সমস্ত খবর লেখকদের অনেকেই কমিউনিস্টদের প্রতি সমর্থনের দৃষ্টিভঙ্গি নেন। এমন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েই সম্মেলনের আহ্বান জানানো হয়। দেশের বুকে কমিউনিস্টদের প্রথম সম্মেলন এটিই।
ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে এ মামলা এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
কেন?
একটি সহজ তথ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
ব্রিটিশ সরকার এ মামালার নামে বলশেভিক শব্দটি যুক্ত করেছিল এই আশায় যে বলশেভিকদের ভারতীয়রা ঘৃণা করে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু ঘটল না, ব্রিটিশ প্রশাসন স্বীকার করে নিল ভারতে কমিউনিজমের মেয়াদ স্থায়ী হতে চলেছে (communism had come to stay)। কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি দৈনিকে এ মামলার ফলাফল আলোচনার সময় খবরে লেখা হল ‘the fear of the law against communism has been removed’; এদেশে কমিউনিজম বিরোধী আইনের যাবতীয় ভয়-ভীতি মুছে গেছে।।
তথ্যসুত্রঃ
১) Documents of The Communist Movement in India,National Book Agency, Volume I- XXVII
২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি, মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি
৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement
Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977
৪) Reminiscences of Lenin: Nadezhda Krupskaya