অর্ণব রায়, বাবিন ঘোষ
পশ্চাৎপট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিতকাল পরেই ভারতের মানুষ ঔপনিবেশিক সরকারের স্বরূপ সম্বন্ধে নিঃসন্দিহান হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যেই 'হোম রুল' সম্বদ্ধে যুদ্ধের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে যখন মন্টেগু- চেমসফোর্ড কমিশনের নেতৃত্বে স্রেফ লোক-দেখানো সংস্কারের অবতারণা করা হয়, স্বাভাবিক পরিণতিতেই ক্ষুব্ধ হয় দেশের মানুষ। ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে যুদ্ধে প্রায় ১০ লক্ষ ভারতবাসীর প্রাণদান, ২১ কোটি টাকার আর্থিক মদত দেওয়া সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক শাসক এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতা বা নিদেন 'হোম রুল' দিতেও অস্বীকৃত হয়। উদ্বেলিত জনগণকে স্রেফ রাষ্ট্রের সশস্ত্র শক্তি দিয়ে নিরস্ত করার উদ্দেশ্যে প্রণীত হয় কুখ্যাত রাওলাট আইন, যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গেলে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ঘটে জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা। এই সকল ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে দেশ জুড়ে কৃষক-শ্রমিক, ছাত্রসমাজ এবং দেশীয় বুর্জোয়ার একটি বৃহত্তর অংশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রায় দেড় শতকের বেশি সময় ধরে ঔপনিবেশিক শাসনে ক্লিষ্ট কৃষক, প্রায় দাস অবস্থায় শোষিত হয়ে চলা শ্রমিকশ্রেণী, অকল্পনীয় মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্বের শিকার তদানিন্তন স্কুল- কলেজ পাশ করা তরুণ, মধ্যবিত্ত, অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন উদীয়মান দেশীয় শিল্পমালিক সকলের জন্যই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে শরিক হওয়ার বস্তুগত পরিস্থিতি নির্মাণ হয়।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের জন্ম কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, যেমন আকস্মিক ছিল না চৌরিচৌরায় ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯২২ সালে ঘটে যাওয়া কৃষক অসন্তোষজাত পুলিশ থানা আক্রমণ। ১৮৫৭ পরবর্তী সময়ে ভারতের পূর্বতন সামন্ত প্রভু, নবাব, রাজা-মহারাজদের সাথে ব্রিটিশ শাসকদের সমঝোতা ঘটে। প্রথম পক্ষ বুঝতে পারে যে স্রেফ সামরিক শক্তিতে তাদের পক্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে হারানো দুষ্কর এবং অপর পক্ষ বুঝে যায় যে দেশীয় নবাব আর রাজা-রাজড়াদের ব্যক্তিগত বিলাস বৈভব অক্ষুন্ন রাখার গ্যারান্টির বিনিময়ে তাদের সমর্থনে ভারতে শাসন সহজতর হবে। অতএব, এই সামন্ত প্রভুরা ১৮৫৮ সালের মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণার পরে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের তাঁবেদারে পরিণত হয়। এদের সাথেই তাল মেলায় ব্রিটিশ শাসনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জন্ম নেওয়া জমিদার শ্রেণী, যাদের শ্রেণীগত আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য ঔপনিবেশিক শাসন জিইয়ে রাখার প্রয়োজন ছিল। উনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে উন্মেষ ঘটে ভারতীয় মালিকানাধীন কিছু আধুনিক শিল্পের। এই সকল শিল্পের শ্রমিক আসে মূলত ঔপনিবেশিক শাসন সঞ্জাত হতদরিদ্র কৃষক / হস্তশিল্পীদের পরিবারগুলি থেকে। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হওয়ার সময় থেকেই ধীরে ধীরে ভুস্বামী সম্প্রদায় এবং উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের সংশ্লিষ্ট শ্রেণীস্বার্থের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে থাকে ভারতের রাজনীতির নতুন এই যুগে। উল্লিখিত এই দুই শ্রেণীর কিছু ক্ষেত্রে সংঘাত এবং বহু ক্ষেত্রে সমঝোতাও প্রকাশ হতে থাকে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে। রুটি- -রুজির দাবিতে শিল্পশ্রমিক/ কৃষি শ্রমিকদের যে কোনো আন্দোলনের বিরোধিতায় এই দুই শ্রেণীর মধ্যে সাদৃশ্য ছিল।
ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ভারতের সামাজিক আন্দোলন প্রতীচ্যের বিভিন্ন। দর্শনের অভিঘাতে পুষ্ট হতে থাকে। হিন্দু ধর্মের সংস্কারপন্থী আন্দোলন এই অভিঘাতে তার আগের ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী ভক্তিবাদী অবস্থানের সাথে মিশেল ঘটায় ইউরোপীয় রেনেসাঁর এবং ফরাসী বিপ্লবের বিবিধ দর্শনের। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, নাগরিক অধিকারের মৌলিক দর্শনগুলি ধীরে ধীরে নিয়তিবাদকে অতিক্রম করে জায়গা করে নিতে থাকে সামাজিক রাজনৈতিক মননে। এই পটভূমিতেই জন্ম নেয় হিন্দু পুনরুত্থানবান। সামন্ততান্ত্রিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে উদ্ভুত জমিদারশ্রেণী এবং সামন্তবাদের মদতেই বাড়ে হিন্দু পুনরুত্থানের মতাদর্শ। প্রাক-মধ্যযুগ ভারতবর্ষের 'হিন্দু যুগের' 'গৌরবোজ্জ্বল অতীত' এর নির্মাণে প্রত্যক্ষ বা প্রথমভাবে হলেও, বর্ণাশ্রম প্রথার প্রতি, পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতি সমর্থন এই পুনরুত্থানবাদের বৈশিষ্ট্য। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার এক দশক আগেই জন্ম হয় হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আর্য সমাজের। পরবর্তীকালে মহারাষ্ট্রে বাল গঙ্গাধর তিলকের শিবাজী উৎসব, গণেশ উৎসব, এই 'গৌরবোজ্জ্বল অতীতের' নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে গান্ধী ও তাঁর চিন্তার শরিক, বিশাদংশে সোশালিস্টরা সামনে আসায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের একটা স্রোত কংগ্রেসে বহমান থাকলেও হিন্দু পুনরুত্থানের সোচ্চার উচ্চারণগুলি কিছুটা হ্রাস পায়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গণসংগ্রাম গড়ে তোলার বিকল্পহীনতায় এবং আন্দোলন সংগঠিত করার বাস্তবতায়, গান্ধী 'সর্বধর্ম সমভাব' এর ডাক দেন। অসহযোগ আন্দোলনে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের বিপুল পরিমাণে যোগদান এবং সেই আন্দোলনের ক্ষমতা প্রমাণ করে দেয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মঞ্চের অপরিহার্যতা। সাথে সাথে জাতীয় কংগ্রেসের অন্দরে এবং বাইরে বাড়তে থাকে কমিউনিস্ট/ সোশালিস্টদের কর্মকান্ড। রক্ষণশীল হিন্দু উচ্চবিত্ত জমিদার এবং রাজা-রাজড়া শ্রেণীর একটা বড় অংশে সোশালিস্ট/কমিউনিস্টদের ভারতের রাজনীতিতে প্রভাব বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম দেখে কিছুটা শঙ্কিত হয়। জাতীয় কংগ্রেসের থেকে স্বতন্ত্র একটি রক্ষণশীল হিন্দু সামাজিক/রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তাদের জন্য। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আড়াই দশক পরেই প্রতিষ্ঠিত হয়। পাঞ্জাব হিন্দু সভা যাদের ঘোষিত অবস্থান ছিল ভারতে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের বিরোধী। পাশাপাশি স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের নেতৃত্বে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ভাবনার প্রসার ঘটানো হতে থাকে যে মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু সমাজের নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেসের থেকেই মুসলমান সমাজের বিপদ। এই সকল ঐতিহাসিক পটভূমিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের জন্ম।
জন্ম ও বৃদ্ধি- ১৯৪৭ অবধি
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের ঠিক পরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। এই দাঙ্গার ঘটনাগুলির পেছনে আর্য সমাজের 'শুদ্ধি' অভিযান এবং তার প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান সমাজের মধ্যে 'তবলিঘ' এবং 'তাঞ্জিম' আন্দোলনের অনেকখানি ভূমিকা ছিল। ঐতিহাসিক কারণে মহারাষ্ট্রে (তদানীম্বন বোধাই প্রদেশে) মুঘল শাসনের অভিঘাত উত্তর এবং পূর্ব ভারতের চেয়ে অনেক কম ঘটেছিল। এই প্রদেশে প্রাক-ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ্যবাদের সাথে রাজতন্ত্রের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ছিলা। ব্রিটিশ ভারতে অন্তর্ভুক্তির পর থেকে শাসন ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ্যবাদের এই আধিপত্য শিথিল হয় মহারাষ্ট্রে। ১৮১৮ খ্রীষ্ঠানে ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে পেশোয়া রাজতন্ত্রের সামরিক পরাজয়ের গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল দলিত মাহার জাতির ব্রিটিশ পক্ষে যোগদান, যা কিনা আদতে ছিল পেশোয়া ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের বর্ণবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধের একটি রূপ। এ সকল কারণে মহারাষ্ট্রে একটি অভিজাত হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের জন্মের ভিত্তি রচিত হয়। ১৯২৫ সালে মারাঠা চিৎপাবন ব্রাহ্মণ কেশব বলিয়াম হেডগেওয়ারের নেতৃত্বে স্থাপিত হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। উচ্চ বর্ণ হিন্দু যুবকদের সামরিকীকরণ, 'দেশের' ভাবনার নির্মাণে ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং জাতীয়তাবাদের একীকরণ, গোড়া থেকেই সংঘের মতাদর্শগত বুনিয়াদ। এই বুনিয়াদের ওপর পরবর্তী নির্মাণ ঘটে দ্বিতীয় সরসংঘ চালক (সংঘের সর্বময় নেতা) মাধব সদাশিব গোলওয়ালকারের দ্বারা। গোলওয়ালাকার রচিত We or Our Nationhood Defined গ্রন্থে 'দেশ' এর যে সারাংশ ব্যখ্যা রয়েছে, তার বুনিয়াদ হল এক ধর্ম (হিন্দুধর্ম), এক জাতি (হিন্দু), এক ভাষা (সংস্কৃত)। সেমিটিক সম্প্রদায়সমূহ, অর্থাৎ ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জাতীয়তাবাদের এই নির্মাণের বাইরে রাখা হয়। হেডগেওয়ার থেকে গোলওয়ালকার হয়ে তাবৎ সঙ্ঘচালকদের মতাদর্শগত গুরু ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের জার্মান দার্শনিক ফ্রীডরিখ উইলহেল্ম নীটশে। নীটশের “উরোশ" বা "সুপারম্যানের" দর্শন ঠিক যেমন জার্মানির নাৎসিদের মতাদর্শগত পুষ্টি যুগিয়েছিল, তেমনই তা হিন্দুত্ববাদের ও অন্যতম মতাদর্শগত ভিত্তি। ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত “The Antichrist গ্রন্থে নীটশে বাইবেল অপেক্ষা মনুসংহিতার দার্শনিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেন। তাঁর 'সুপারম্যান' দর্শনের প্রতিফলন তিনি খুঁজে পান মনুসংহিতায়, যেখানে ছত্রে ছত্রে ব্রাহ্মণের অক্ষয়, অজেয় 'শ্রেষ্ঠত্বের' ভিত্তিতে সমাজ এবং শাসনব্যবস্থায় তাদের একাধিপত্যকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। অতএব, ভারতের সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে এবং আর্থ-সামাজিক সাম্যের প্রবল বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিংশ শতকের হিন্দুত্ববাদ লুফে নেয় নীটশেকে। উনবিংশ শতকে হিন্দু পুনরুত্থানবাদের দর্শন বহুলাংশে গড়ে ওঠে এই দু'জনের মতবাদের ভিত্তিতেই। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের একাধিপত্য, চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক অবস্থান, একনায়কের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুমোদন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুনরুত্থানবান সমর্থন পায় ঊনবিংশ শতকের ইউরোপীয় রক্ষণশীলতার। ঊনবিংশ শতকের শেষের দশক থেকে মুসলমান সমাজে বাড়তে থাকা রক্ষণশীল রাজনীতি, খিলাফৎ আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে মুসলমান সমাজের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু রক্ষণশীলতার স্বতন্ত্র প্রবেশ ঘটল রাজনীতিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের জন্মের মধ্য দিয়ে।
ভূমিসংস্কারে বিরোধীতা, শ্রেণী সম্পৃক্ত যে কোনো প্রশ্নে মৌনতা, দ্বিজাতিতত্ত্বে সমর্থন, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রতি অনীহা, উগ্র পুরুষতান্ত্রিকতা, কংগ্রেস বিরোধীতা, সঙ্ঘ এবং মুসলিম লীগ উভয় পক্ষেরই সমান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সংঘ এবং লীগের রাজনৈতিক শক্তির উৎস হল অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি তীব্র ঘৃনা । সংঘ এবং লীগ উভয়েরই মূল শ্রেণীভিত্তি ছিল হিন্দু মুসলমান জমিদার / সামন্ত প্রভু বা এবং মুৎসুদ্দি মালিকগোষ্ঠী । We or Our Nationhood Defined-এ ভারতীয় পরিচিতি নিয়ে গোলওয়ালকার বিশদে নিজেদের ভাবনার কথা লেখেন। তিনি লেখেন যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ-বিরোধী আন্দোলন যথার্থ জাতীয় আন্দোলন নয়, কারণ তা স্রেফ ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের (territonal nationalism) মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাঁর মতে ব্রিটিশ-বিরোধীতা জাতীয় আন্দোলনের অভিমুখ হতে পারে না।
'সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ' যা কিনা প্রকারান্তরে হিন্দু রক্ষনশীল আধিপত্যবাদ, তাকেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আখ্যা দেন গোলওয়ালকার। উপরোক্ত প্রশ্নে জার্মান ফ্যাসিবাদের ভূয়সী প্রশংসা করে গোলওয়ালকার এই সিদ্ধান্তে আসেন যে হিন্দু এবং মুসলমান, এই দুই সম্প্রদায়ের একত্রে এক দেশে, সমানাধিকারের ভিত্তিতে সহাবস্থান অসম্ভব এবং অ-হিন্দু সকল জাতিকে হিন্দু রাষ্ট্রের অধীনতায় নিঃশর্তে, কোনরকম অধিকারের দাবি ছাড়াই বসবাস করতে হবে। সংঘের যাবতীয় দলিল থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধীতা নয়, বরং মুসলিম বিরোধীতাই তাদের রাজনীতির অভিমুখ। এই রাজনীতির ফলশ্রুতি হিসেবে সংঘ জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি বরং উলটোদিকে সেই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৩৪ সালে জাতীয় কংগ্রেস থেকে সংঘ সদস্যদের বহিষ্কার করা হয়। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হল সংঘকে কখনো ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়নের মুখোমুখি হতে হয়নি। আন্দামানে বন্দি থাকাকালীন মুচলেকা দিয়ে মুক্ত বিনায়ক দামোদর সাভারকার এবং হেডগেওয়ার এ বিষয়ে লিখিত ফরমান জারি করেছিলেন যে সংঘ বা হিন্দু মহাসভার কোনো সদস্য যেন সরকার বিরোধী কোন রাজনৈতিক অবস্থান না নেয়। দমন পীড়ন এড়াতে ১৯৪০-এর আইন অমান্য আন্দোলন, ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন, আজাদ-হিন্দ ফৌজ, রশিদ আলি দিবস, নৌ-বিদ্রোহ, প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রামে সংঘ সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। সংঘের ট্রেডমার্ক যে পোশাক এবং কুচকাওয়াজ, তাও বন্ধ রাখা হয়। ঐ সময় ব্রিটিশ সরকারের আদেশ মেনেই এসব ঘটেছিল। সংঘের কিছু কর্মী বেশ কিছু মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষী দিয়ে সরকারের সুবিধাও করে দেয়। এ প্রসঙ্গে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর উদাহরণ দেওয়া যায়। আগ্রা জেলার বটেশ্বর গ্রামে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় গণবিক্ষোভে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকারি কিছু সম্পত্তি। সেই সংক্রান্ত মামলায় অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং তার দাদাকেও অভিযুক্ত করা হয়। অটল বিহারী পুলিশের কাছে এবং আদালতে জবানবন্দি দেন যে তিনি বা তার দাদা এই ঘটনায় জড়িত ছিলেন না, স্রেফ প্রতাক্ষ সাক্ষী ছিলেন বরং বাকি সকল অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিশদে সাক্ষীও তিনি দেন। মূলত তার এই জবানবন্দির সাহায্যেই সরকারপক্ষ নিজেদের মামলা সাজাতে পারে। রাজসাক্ষী হওয়ার ফলে বাজপেয়ীর শাস্তি মকুব হয়ে যায়। জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় সংঘ উষ্কানি দিতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের বিভেদনীতির সক্রিয় এজেন্ট হিসেবেই তারা সেকাজ করেছিল।
মার্কসবাদী পথ পত্রিকার ফেব্রুয়ারি-মার্চ,২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ